You are currently viewing শূন্য মন্দিরের  সংবেদ্য ঋষি/ রিজোয়ান মাহমুদ

শূন্য মন্দিরের সংবেদ্য ঋষি/ রিজোয়ান মাহমুদ

শূন্য মন্দিরের  সংবেদ্য ঋষি
রিজোয়ান মাহমুদ 

কালের অতল গহব্বর থেকে নিংড়ে তোলা মাটি মানুষ ও সংস্কৃতির ভূগর্ভস্থ পরিচয় যদি হবে কবিতা – তার সহনক্ষম বেদনার্ত  ইতিহাসের নাম কবি শাহিদ আনোয়ার। তিনি বেদনাকে অংকুরিত করে সেখানে নিজে-ই  জল ঢালতেন, এ-ই সূচকের ধারাবাহিকতায় কবি হয়ে ওঠেছেন  চূড়ান্তপর্বের গোঙানি বেদনার্ত ফজর নিয়ে। খুব ধীরে এগিয়ে অথচ অসহিষ্ণু সড়কের পাড়মাতাল শব্দের দুরত্ব মাপতে সক্ষম ছিলেন।  শহিদুল ইসলাম – শাহিদ আনোয়ার হয়ে ওঠতে খুব একটা সময় লাগেনি। যার নিউরনে সর্বদা শব্দের সংগীত, যার ষাষ্টাঙ্গে  অনুভূতির প্রহার, তিনি নিশ্চিত কবি হবেন, এ ধারণা প্রচলিত এবং ভাবনা সঞ্জাত।

আমরা চাক্ষুষ করেছি ধ্যানমগ্ন শব্দের ট্রাযোডান কবিকে – বেদনা জর্জর শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘূর্ণমান অশান্ত অথচ উর্বর ভিন্ন সাঁইজি, যিনি নিজে গাইতেন এবং অপরের মধ্যে সুরের মাতম ছড়িয়ে দিতেন নিভৃতে। দুনিয়াকে অদ্ভুত মায়াবী খোয়াব দেখাবেন শাহিদ এবং বেদান্ত বেদনার সন্ধান দেবেন। এ-ই তো ছিলো তাঁর কাঠ ও ধূপের যজ্ঞ। দেহকে শব্দের পিঞ্জর বানানো যার নিত্যকার অভ্যাস সে শিল্পী কবি-ই  রেললাইন সমান্তরাল হাঁটতে যাবে, কথাটি বদগুণে মিথ্যা যেমন হৃৎগুণে পরমসত্য তেমন।  কবি শাহিদ আনোয়ার মনুষ্য  নির্মিত  সমাজের মধ্যে থেকেও নিজেকে আলাগা করে নিয়েছিলেন, তবে অনুষঙ্গ যাপন একবারের জন্যও ভোলেন নি।  আমরা যারা পাঠক তারা শাহিদ কে খুঁজি একরাশ অন্ধকার বেদনা উজ্জ্বল আলোক রশ্মির ভেতর। প্রকৃতির ফুটোহীন অন্ধকার রক্তাক্ত ধারাপাত কবিতার সাক্ষী হয়ে ওঠে। শাহিদ রাষ্ট্র সমাজের অন্ধিসন্ধি ঘেঁটে  পাঠকের সন্ধান দেন। এক অমোঘ নিয়তি যেন, পড়ো পড়ো গুহার অন্ধকার ভেদ করে একটি আওয়াজ পাঠকের কর্ণমূলে মৃদু আঘাত করে। আমরা দেখি, দীর্ঘদূরে জবুথবু মাথানিচু লাজুক দার্শনিক কবি স্বপ্নদ্রষ্টা শাহিদ দাঁড়িয়ে  কবিতার শিঙ্গা হাতে। সে-ই শিঙ্গা মেঘেও বাজে আবার রৌদ্রেও বাজে।

কবিতা কি?  কবিতা যদি হয় ব্যাক্তি মানসজাত ঈশ্বরের অভিমুখে শব্দের মৃদু কম্পন। কম্পনের ভারে একজন কবি হয়ে ওঠেন অভাবিত পরিমিত ধারণায়। শাহিদ মধ্য আশির এক শক্তিশালী সংরক্ত কবি। স্বভাবে একদম মিতভাষী। চলনে ভীষণ সাদাসিধা নৈতিক মানুষ। অন্তর্গত রোদনের তলদেশে ছিল অলক্ত অনুভূতির গভীরতা। কবিদের মধ্যে মেধাবী এবং এক-ই সাথে সৃজনশীল সত্তা খুব কম-ই থাকেন। কেউ কেউ মেধা প্রয়োগ করে কবিতা লিখতে গিয়ে কিংবা বানাতে গিয়ে কবিতায় শক্ত আবরণ ও  অভঙ্গুর কাঠিন্য তৈরি করেন। যাচনা করেন, রচিত শ্রেষ্ঠ কবিতাটি বুঝি হয়ে গেলো। এ-সব কবিতার  ক্ষণকালীন মেধার বন্ধ্যাত্ব স্বীকার করে নিলেও চিরকালীন আবেগ অনুভূতিতে ম্রিয়মাণ নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। শাহিদ আনোয়ার এর চর্চা ছিল মেধাকে নির্ভরযোগ্য পঙক্তিতে কাজে লাগিয়ে অনুষঙ্গের অনুরণন।  বিশ্বখ্যাত শিল্পী সালভাদর দালি’র মেল্টিং ওয়াচের মতো তাঁর শব্দগুলো গলে গলে নতুন রূপান্তরের দিকে হাঁটে।

৬০ এর দশকের কবি আবুল হাসান এবং শাহিদ আনোয়ার পরিণতির দিক থেকে এক-ই গন্তব্য। দু’জনের মধ্যে ছিল সংরক্ত অনুভূতির গভীরতর প্রতীতী। কবিতাকে শিল্পগুণে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া দু’কবি। দু কবির যেন কোথাও অপ্রাপ্তি অসহিষ্ণুতা ছিল। আবুল হাসান যেমন কবিতায় দেহবাদী রোমান্টিসিজম এনেছেন এবং পাশাপাশি দ্বন্দ্বও দেখেছেন। কবি শাহিদ আনোয়ারও রোমান্টিসিজম এর ভেতরে অদ্ভুত রকমের এক প্রকোপিত কারন্যাল নির্মাণ করেন ;
আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
মা ‘ বকুক, বাবা তার বেদনা দেখুক
,,,,,,, ,,,,,,,,,,,, ,,,,,,,,, ,,,,,,, ,,,,,,, ,,,,,,, ,,,,,,,,,,
একটি জলের খনি,
তার দিকে তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী
“এত যে কাছে আসতে চাও
কতটুকু সংযম আছে তোমার?
এতো যে ভালোবাসতে চাও
তার কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে তুমি”?
( নিঃসঙ্গতা – প্রশ্ন, আবুল হাসান )
অন্যদিকে ;
তোমার দু চোখে সখি
জাদুকরি গুণ
সাড়াতে ময়ুর হই
নিষেধে শকুন।
“রৌদ্রে এমন দহন কী যে আমার ভাষা অন্য
রৌদ্রে তাহার জোড়াঠোঁটর কামড় আছে বন্য”।
“তন্দ্রা কুসুম ফুটছে তোমার চোখে
ঘুম পাড়াচ্ছে হাজার রাতের তারা
বাঁক নিয়েছে তোমার দেহখানি
বুকের মধ্যে তাম্রলিপ্ত ভরা ”
( তোমার দু’চোখে + প্রেম + মনবুনন ; শাহিদ আনোয়ার)

মানব পুরুষ দেহের স্বভাবজাত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা ক্ষমতাপ্রবণ পুরুষজাত। পরাক্রমশালী পুরুষতন্ত্রের মেজাজ মর্জি দেহের সাড়াতে ময়ুর হয়, যদি সেখানে নিষেধ আসে, তখন শকুন! ঝংকৃত ৪ টি লাইনে দেহবাদী রোমান্টিসিজম যেমন আছে তেমনই আছে মোহমুগ্ধ  প্রেমের মোড়ক। এই চিত্রাভাষ চিতাবাঘ এর রূপক। কবি আবুল হাসান এর সাথে ভাবনার আত্মিক নৈকট্য সংলগ্ন থেকে দেহবাদী অনুভাব কিঞ্চিৎ সামনে এলেও শাহিদ অনেক দূরে গিয়ে মানব ধর্মের যাবতীয় বিষয়ানুসঙ্গ অদ্ভুত একটি জায়গায় বিভাসিত করেন।

শাহিদের আরও একটি কবিতায় ;
“কবিতা সুন্দর হাতে গোলাপ নোঙর কর
নারী সুন্দর হাতে চুম্বন নোঙর কর
দ্রোহের ওষ্ট জুড়ে কবিতা — অন্তর
আলস্যের গীতভাষ্যে কবিতা পিঞ্জর
কবিতা পৃথগায়ন কাব্য উবে যাবে
নদীগৃহে মানুষেরা বেদনা জাগাবে ”

শাহিদ নিজস্ব একটা কাব্যভাষা নির্মাণ করতে পেরেছেন। প্রচলিত ধরনের কৌশলে কবিতা রচনা করে ভিন্ন একক বা মাত্রা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।  প্রত্যেক কবিতার মধ্যে অন্তর্গত একটি লিরিক আছে যা কাব্য – অস্থি’র গান। বুননকৌশল একদম মৌলিক।

মধ্য আশিতে অস্থির এক সামরিক শাসনের  দোর্দণ্ডপ্রতাপে যখন সমাজ রাষ্ট্র ইতিহাস কাঁপছিল সে সবের সাক্ষী আমরা অনেকেই। শাহিদ সরাসরি রাজনৈতিক মনস্ক কবিতার ভেতরে ডুবে যায়। জঘন্য অসদ্গুণ শাসনতান্ত্রিক স্বৈরাচার সরকারের খুন – খারাবি এবং রাজনৈতিক ধর্মান্ধতা জনগণের সিনার ওপর আছড়ে পড়ে। শাহিদ উর্বর উত্তেজিত শব্দের অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
একটি কবিতায় ;
হৃদয় আমার দোলে
শোকার্ত মিছিলের পুরোভাগে দোদুল কফিনে,
বন্ধু আমার, কালো
এ – ব্যাজ পরিয়ে দাও চোখের জলের মতো  জ্বলজ্বলে এই আলপিনে
আমি বখে যাওয়া ছেলে, আমি ঢিল ছুড়ে মারি
মাছি ভন ভন এই রোঁয়া ওঠা জেনারেল যদি নাড়ে ল্যাজ
সেলিনা আখতার তুনি প্রস্তুত রেখো, দেখ ভুলো না আবার
প্রিয় নীল শাড়িটির নীল আঁচলের কাটা নীল কিছু ব্যান্ডেজ
কবিতা ; আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার ”

সামরিক স্বৈরাচার যখন গেঁড়ে বসে জনজীবনে। সর্বত্র অচল অবস্থা অন্ধকার ৪৮ ঘণ্টার অবরুদ্ধ সাধারণ জীবনাবস্থা। সমাজ রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি যখন
শূন্যের কোঠায় শাহিদের ঝাঁঝালো শব্দের প্রতিবাদের আগুনে ঝলসে ওঠে। ;
সাংবাদিকেরা বলছেন Normal life is restored.
আই হেইট
এই রক্ত পুঁজময়, কালো, ফোস্ কাবৃত
ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবস্হা।
রজঃস্রাবের মতো, থুতু ও কফের মতো
কসাই দোকান দেখা, কাটা মোষের মাথার মতো ব্যথা- ভরাতুর জোড়া নীলাভ চোখের মতো এই বাতিল জীবন –
আমরা চাইনি ফেরৎ পেতে
চাইনা ফেরৎ পেতে
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
অসহ্য যন্ত্রণায় দ্বগ্ধ এক-ই কবিতার একটি অংশে তাঁর অস্বাভাবিক উচ্চারণ ;
আমি ব্লেড দিয়ে কাটবো নিজের গলা
আমি আমার সমস্ত নখ উপড়ে ফেলবো
সারা রাজপথে লাল পথনির্দেশ দেবো
আমি,,, জঘন্যভাবে খুন করবো তোমাদের!
ওরা বারবার বস্তবন্দী এই বাতিল জীবন
ফেরত পাঠাবে –
কবিতা – “আটচল্লিশ ঘণ্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন”।
একজন অস্থির সুবোধ কবির মারণাস্ত্র তাঁর শব্দ। সে-ই শব্দ দিয়েই সে প্রতিবাদ করতে পারে যাবতীয় অচলায়তনের। শাহিদ সমকালীন রাজনৈতিক সংকট এড়িয়ে যেতে পারেন নি সচেতন কবির দায়িত্ব জ্ঞান থেকে।

কবি-র  রাজনৈতিক চেতনায় ছিল সমাজতন্ত্র এবং  সাম্যবাদী দীক্ষা। একটি সুষম কল্যণধর্মী পরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতা বিরাজ করুক রাষ্ট্রে সে-ই স্বপ্ন ছিল তাঁর সীমানা। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অসমদর্শী ব্যবস্থাপনা তাঁকে ভীষণ বিচলিত করতো। লুণ্ঠন পুঁজিবাদ, লগ্নিপুঁজি এবং রাষ্ট্রের লাম্পট্য পুঁজি, যখন ধীরে ধীরে বিষমুখো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজদেহে কবি স্বাভাবিকভাবে তা মেনে নিতে পারেন নি। কবি-র  মধ্যে  কবিসত্তা  ও রাজনৈতিক সত্তার মধ্যে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা জিইয়ে ছিল।  সেটি ছিল শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থার একটি সদর্থক দৃশ্যমান পরিবর্তন। সর্বমানুষের যুক্তি-ই ছিল তাঁর কবিতার সারগাম।  প্রাপ্তি না ঘটাতে ক্রমশ শারিরীক বৈকল্যের শিকার হয়। সিজোফ্রেনিয়ার মতো কঠিন মানসিক ব্যামো, সারাক্ষণ মেন্টাল ডিসঅর্ডার, সমনেম্বিউলেন্স এবং সন্দেহবাতিকগ্রস্ত রোগে আক্রান্ত। এ-ই সংকট মৃত্যু না হওয়া অবধি তাঁকে ছাড়েন নি। শাহিদের আফসোস এ-ই অসুস্থ সমাজকে চিকিৎসা দিতে পারেন নি।
স্বপ্নাক্রান্ত কবি অতঃপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জীবন কে বড্ড অভিমানে সামনে নিয়ে গেছেন। তাঁর কবিতার মানুষের ব্যাকরণ ছিল আকাশচুম্বি। শেকড়ের টান প্রবল। কষ্ট নীল সমুদ্রের জেলিফিশের মতোন বেদনা মথিত। অনেক কাল আগে একটি কবিতা পাঠ করে ভীষণ স্তম্ভিত হয়েছিলাম ;
“চিতা যখন জ্বলছে
তোমরা চাও আমি আলোর কথা বলি
বলবো আলোর কথা ”
( শঙ্খঘোষ – ধুম লেগেছে হৃৎকমলে )

উদ্বৃত এ-ই কবিতাটি আমাদের মানস চৈতন্যকে দীনহীন করে দেয়। এক অনির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যায়। এখানে দেখার বিষয় যন্ত্রণাদ্বগ্ধ অঙ্গার সময়, প্রগাঢ় বেদনার নিরন্তর রক্তমোক্ষণ। এই অনিবার্য নিয়তি, নৈরাশ্য মানব মনের বিশেষ কোনো সময়ের দ্বগ্ধ চিহ্ন হয়ে থাকতে পারে। শঙ্খঘোষ পরিশীলিত পর্যবসিত ছন্দময় সুক্ষ্ম ইঙ্গিতের কবি। উচ্চকিত কিংবা রংদার নন। মৌলিকভাবে তাঁর কবিতা লিরিকধর্মী। শাহিদের মধ্যে দেখি, বড় জীবন যন্ত্রণার স্কুল। তাঁর আকাশের মেঘগুলো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গাভীর মতো কোথা থেকে এসে কোথা চলে যায়। আর অশান্ত অস্থির বৃষ্টি হয়ে ফিরে আসে। কবি শঙ্খ ও শাহিদ উদ্ভুত এক-ই পরিস্থিতি সামাল দেন নিজেদের  শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে। কোথাও একটা সীমানা পাড়ি দিয়ে রক্তাক্ত হয়ে নিজেদের ভিন্ন অস্তিত্বের ঘোষণা করেন। শাহিদের দীর্ঘ কবিতা খুবই কম। যা আছে তা-ও আবার জর্জিয়ান কবিদের মতো ক্লিশে এবং ক্লান্তিকর নয়। দীর্ঘ কবিতায় শব্দের কিংবা অনুভাবের শ্লীলতাহানি নেই। অসাধারণ মৌলিকত্ব দিয়ে চিত্ররূপ ও মেটাফরের তরতাজা নতুনতর বাক্য বিন্যাসের বিস্ময় মাখানো।

দীর্ঘ বক্তব্য প্রধান ও বর্ণনামূলক পাঠে যখন বিঘ্ন সৃষ্টি হতে থাকে বা পাঠকরা হাঁপিয়ে ওঠেন তখনই সুদক্ষ ইমেজিস্ট কবিরা মুক্তির আকাঙ্খা মেলে ধরেন । প্রসঙ্গক্রমে এজরা পাউন্ডের গবেষণালব্ধ সে-ই সময়জীর্ণ সংজ্ঞাটিও স্বরণে নেওয়া যায় ; An image is that which presents
an intellectuals and emotional complex in an instant of time. আবার  অন্যভাবে ইমেজ হলো Unification of disparate Ideas,   অর্থাৎ বিপরীত দুই ভাবের একত্রীকরণ। ইউরোপীয় কবিতায় যেভাবে বিপরীত দুই ভাবের একত্রীকরণ দেখি এবং যন্ত্রণার ছারখার আবেগের ওলট-পালট দেখি, বাংলা কবিতায় হয়তো সেভাবে দেখি না। তথাপিও একটা ইমিটেশন উনিশ শতকের কবিতা আন্দোলনে সর্বদা বর্তমান ছিল।
শাহিদ বড় ও বক্তব্য প্রধান কবিতার কিছু পঙক্তির উচ্চারণে ;  ;  ;  ;  ;  ;  ;  ;  ;  ;
“সবকোণ থেকে,দিক থেকে, লেন বাই – লেন, রোড,   রাজপথ থেকে সুড় সুড় ফিরে আসে এ মহাজীবন ”
কবি ছাড়া কে জানবে সব কবি-ই মহাজীবনের সড়কে নিজ নিজ জীবনকে পাহারা দিচ্ছে।
পরিবার যাপন করেও ব্যক্তি শাহিদ একদম নিঃসঙ্গ একা মানুষ। বন্ধু পরিবার মহল্লা আত্মীয় – স্বজন থেকে বিচ্ছিন্নজন। তবে, সার্বক্ষণিক যে বন্ধু স্ত্রী কবি তাঁকে  আগলে রেখেছিলেন, তিনি কবি সেলিনা শেলী। কবি শেলী’র আদর ও যত্ন পেয়ে শাহিদ অবিরাম ক্লান্তিকে তুচ্ছ করেন ;
“আমার নিজের দুঃখখানি
তুচ্ছ অতি তুচ্ছ,,
,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আমার নিজের দুঃখখানি
নেই তো সবুজ বৃন্ত
আমার নিজের দুঃখখানি
বালির মতো বন্ধ্যা।”
তাঁর এ-ই বন্ধ্যাত্ব শারীরিক হলেও মন কখনো বন্ধ্যা ছিলনা। দুঃখের অতল জারীগান ছিল উৎস।  তাঁর আত্মারা গান গাইতো চুপিচুপি। অদৃশ্য আত্মার সংগীত যেন।  অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনা এবং ধ্যান ও আত্মার গরিমা নিয়ে সুফিবাদ। অন্য অর্থে তাসাউফ।  এক হচ্ছে পরিশুদ্ধ আত্মা নিরাকার আল্লাহর সাথে অবস্থান করা। কীসের মাধ্যমে কী উছিলায়!  ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে!! অপরটি আল্লাহর নূরের পাহাড়ে স্থায়ী লুপ্ত হয়ে যাওয়ার নাম বাকাবিল্লাহ। যৌবনের কবি শাহিদ আনোয়ার চলনে- বলনে আধুনিক স্মার্ট ও বামপন্থা বিশ্বাসী সৌখিন চিন্তার তরুণ। তিনিও দম নিতে নিতে উচ্চারণ করেন ;
“সবুজ বাগান থেকে ফল ছেঁড়ে মেরুণ
পাতকি
সুফির চোখের মণি চোখ নয় ম্লান
হরিতকী
বিষাদ অন্ধ আত্মার দ্যুতি গলে গলে
,,,,,,,,,,,,,
সুফিকে অন্য সুরে ডাক দেয় বনের ঘুঘুরা
ভিন্ন বিষাদ নিয়ে হেসে ওঠে মন তানপুরা
হৃদয় যূথিকা ছেঁড়ে অবিরাম আয়ুর করাত
রজনিগন্ধ্যা খায় বিধুমুখী বিরহের দাঁত ”
” রুবাইয়াৎ ”
সুফিবাদ, ভিন্ন বিষাদ, ভিন্ন তরিকা, একদম ভিন্ন তাসাউফ। সর্বোপরি অন্য রুবাইয়াৎ আত্মার ঘটঘটানি নিয়ে হকচকান।
সিবগাতানল্লাহ অর্থ আল্লাহর নূরানী রঙ।
সিবগাতানল্লাহ ওয়ানমান –
আহসান মিনাল্লাহে সিবগাতান।
আমরা আল্লাহ -র রঙে রঞ্জিত হয়েছি
আর কে এমন আছেন এমন সুন্দর?
রুপোলি বর্ণে খুব মোহময় হয় বুঝি আল্লাহ-র ক্লান্ত দুখানি চোখ
কালো পর্দা অন্তরালে জলপাই নিয়ে খেলে
বালিকাবেশি পরলোক
,,,,,,,,,
ধূসর রুপোলি রঙে রঞ্জিত আল্লাহর
বাহুর ইঙ্গিত যেন বাবরের ধূসর কামান।
,,,,,,
তরঙ্গিত রুপোলি বর্ণে নিতে দীক্ষা এখন দূরে
সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে ভিক্ষু যতদিন
পরলোকে ঠোঁট রেখে আল্লাহ সবুজ বর্ণ তার চোখ
খোলে যেন অশালীন
প্রাণী এক, রক্তাভ ঠোঁট তার, খুলে নেবে বুভুক্ষু জোছনা
চাদর
পরকাল ম্লান হেসে স্তনবৃন্ত থেকে ঢেলে দেয়
বাইকাল ছন্দের ম্রিয়মাণ গোলাবি আদর।
সিবগাতানল্লাহ ওয়ানমান, আহসান মিনাল্লাহে সিবগাতান
রুপোলি বর্ণ থেকে হয় মানব ও মানবীর নয়া খান্দান
কবিতা “আল্লাহর রঙে ”
আপাত দৃষ্টিতে কবিতাটি ভীষণ সাবলীল ও সুন্দর। অন্তর্গত বিষয় ও স্বরায়ণে বাবরের ধূসর কামানের মতো পানিপথের প্রথম যুদ্ধের একটা রণ কৌশল, একটা রহস্য আছে ধারণা করছি। সম্রাট বাবর লোদি রাজবংশের সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে উক্ত কামান দিয়ে পরাভূত করেন।
কবিতাটির শুরুতে অন্য রকম একটি প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে এর উচ্চারণে এবং অর্থবোধকতায় ;
যেমন ; সিবগাতিল্লাহি ওয়ামান
আ্হ সানু মিনল্লাহি সিবগাতান  ;
আমরা গ্রহন করলাম আল্লাহর রঙ। আর রঙে আল্লাহ অপেক্ষা আর কে অধিকতর সুন্দর।
সুরা আলবাকারা আয়াত ১৩৮। কিন্তু যখন -ই  বাইকাল ছন্দের ম্রিয়মাণ গোলাবি আদর লেপ্টে দিতে চায় শুরু হয় এর নড়চড়। বাইকাল যদি বিকালের ছন্দ হয় তখন ধূসর ক্ষণস্থায়ী  না পাওয়া জীবনের হাহুতাশ ওঠে আসে। মানুষ শেষ জীবনে এসে হিসাব মেলায় পাওয়া আর না পাওয়ার। সেখান থেকে নতুন করে শুরু হয় সমর্পণের শিক্ষা। অথচ বাইকাল যদি “শামানিজম” এর সঙে সম্পর্কিত থাকে তা’হলে নতুন করে ভাবতে হবে। শামানিজম একটি বহুদেবদেবীর ধর্ম, যেখানে প্রকৃতিতে বিভিন্ন ঘটনাবলীর উৎসারকে সাধারণত দেবদেবীরূপে গণ্য হয়, এবং আশে পাশের বস্তু আত্মার সাথে সম্পৃক্ত। শামানকে নির্বাচিত একক বলে মনে করা হয়। এবং এটি-ই শামানিক অসুস্থতা। তাদের কাছে আত্মার গুরুত্ব অভিভাবক। শামানিজম এর কিছু লক্ষণ ;
১) শারিরীক অস্বাভাবিক চিহ্ন হতে পারে, জন্মের চিহ্নগুলি,
২) ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য দ্বারা পরিচালিত। সম্ভাব্য শামান্স প্রকৃতির একান্ত ভালোবাসা
৩) শামানিজমে থাকে অতিপ্রাকৃত শক্তির উপস্থিতি,যা থেকে ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয়। ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ স্বপ্নে, মৃতদের আত্মা দেখার সুযোগ ঘটে।
শাহিদের ভবিষ্যদ্বাণী ; রুপোলী বর্ণ থেকে হয় মানব ও মানবীর নয়া খান্দান।
শামানিজ আসক্ত যারা, তারা ভীষণ মেধাবী হয়। কল্পনার স্তর থাকে উচ্চ থেকে উচ্চতর।
কবি শাহিদ আনোয়ার কবিতা নিয়ে দর্শন নিয়ে চরকির মতো ঘুরেছেন।  একটি খোয়াবের নাম আসলেই শাহিদ, যারা কবিতা ও শিল্পসমজদার তাদের খোযাবে ঘুরবে অনবরত। কাব্যত্মা কখনো মাটি ফুঁড়ে, কখনো আসমানে ভাসমান, কখনো সামাজিক পুঁজির অসাম্যে,কখনো বা কদর্য রাজনীতির চাতালে, হা পিত্যেশ করবে পঞ্চদশ শতকের মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির বিরহ যাপন কে কেন্দ্র করে কবিও শূন্যমন্দিরে ঝরায় বিষাদ। পাপ ও বেদনা খচিত দুঃখের শিল্পিত প্রশিক্ষক হতে চায়।
বিদ্যাপতি তে আছে ;
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর, মাহে ভাদর
শূন্য মন্দির মোর ”
শাহিদ বিদ্যাপতিকে উর্ধ্বকমা দিয়ে উদ্ধৃত করেন ;
‘ এ দুখ – হামারি সখি, নাহি ওর
ভরা ভাদর, মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর ”
হতে পারে মুদ্রণপ্রমাদ কিংবা অসচেতনতা। বিদ্যাপতি রচিত পদটি ময়ুর বিরহের। কৃষ্ণের দূর দেশে গমন। একদিকে রাধার মিলনে ব্যাঘাত, অথচ প্রচণ্ড গর্জন করতে করতে অবিরাম মেঘ বাতাস। বন  ময়ুর পেখম খুলে নৃত্য চঞ্চল, দাদুরীর মত্ততা। বিরহ কাতর বিদ্যাপতি মানব মনে জন্ম দিয়েছে তুমুল উষ্ণতা। শাহিদ দিয়েছেন কষ্ট বেদনার ধারাপাত।
” এক ঐশী ক্লান্তিকর, অভ্রের অনুভূতি –
আমার দু’ চোখে মেলেছে ডানা –
ঈশ্বর
আমার এই পঙ্গু, নুলো, নশ্বর হাতের মুঠোয়
তোমার ঠিকানা ”
” কবিতা – “এক ঐশী ”
আজন্ম দুঃখদ পরমাণু, বস্তুত বেদনার ভায়োলিন বেজে ওঠে শূন্য মন্দিরের কাঁসরে। আত্মসমর্পণ দেখেছি, তবে নিঃশব্দ দাবাড়ুর পুরো বোট জুড়ে অসহায়ত্ব, অসুখে জর্জর বিছানায় শুয়ে থাকা, উঠতে না পারা, একাকিত্ব যাপন, এ-সব মিলে আর্তগোঙানি দেখি নি।
শাহিদ আনোয়ার এর যাবৎ প্রকাশিত ৪ টি কবিতা গ্রন্থ ;
১) শুঁড়ি খানার নুড়ির মধ্যে
২) কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে
৩) দাঁড়াও আমার ক্ষতি
৪) বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে
শুঁড়ি খানার ৪৪ টি পদ প্রাগুক্ত ৪টি গ্রন্থের ৯১টি কবিতা এবং অগ্রন্থিত ১৩ টি সহ সর্বমোট ১৪৮ টি কবিতা শ্রেষ্ঠ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি, ধাত্রী, নার্স এবং ভিন্ন কিছু কবিতা পাঠক আলোচনায় সর্বদাই থাকেন।
তবে, আরও কিছু উৎকৃষ্ট কবিতা এতে সন্নিবিষ্ট করা আছে। শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থে সর্বাধিক আলোচিত কবিতা দুটো আমারও ভীষণ প্রিয়। ঝম ঝম করা অনুভূতি খচিত সে-ই কবিতাদ্বয় পাঠকের রুচির সত্য পরিচয় ; আংশিক উদ্ধৃত অংশ। সেই আঁখি দাশগুপ্তা,,,,
“তুমি চিতায়
এবং যখন চিতায় যাই
তুমি পুড়তে পুড়তে অঙ্গার!
শুধু দুটি পোড়া পায়ের পাতা
দেখতে পেয়েছি
পরক্ষণে তুমি পা ‘ গুটিয়ে নিয়েছ ” এ – কবিতার পাঠক যুগ যুগ ধরে আঁখি দাশগুপ্তাকে খুঁজবেই। কিন্তু পাবে না।কেননা আঁখি মরতে মরতে দু’ পা গুটিয়ে নেন। পা ‘ ই যদি না দেখা হয় তা’হলে আঁখিকে সম্পূর্ণ চোখ দিয়ে দেখা হবে না। জীবনানন্দ বনলতা সেনে মাতোয়ারা ছিল। বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতেও খোঁজে  ফিরেছে। শাহিদ, হাসপাতাল আর বাসায়  খোঁজে যখন ক্লান্ত বিপর্যস্ত  প্রেমের বরাহনগরে তখন তৃণভোজী চাঁদ ওঠে। খেয়ে ফেলে জ্যোৎস্নার সব আলো। প্রকৃত আঁখি দাশগুপ্তা, হাসপাতাল, ঘরে কিংবা শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবনে নেই। শাহিদ যেদিন শেষ দস্তখৎ দিয়ে চলে গেলো পরলোকে, আঁখিও ভারমুক্ত হলো। বাঙালির ঘরে ঘরে আঁখি ও শাহিদের পারলৌকিক সংসার।
কবি শাহিদ আনোয়ার সারাজীবন মুক্তি চেয়েছে জড়তা থেকে, অন্ধত্ব থেকে, অসুরের  দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে। মুক্তি চেয়েছে মানবিক সংকট থেকে। মুক্তি চেয়েছে কঠিন জটিল সিজোফ্রেনিয়া রোগ থেকে। একদিন প্রবল ঝড়ের পর প্রকৃতি যখন শান্ত স্থিতধী, তখন কাজল বঁধুর গাঁ এর খোঁজ  দিতে পারবেন। এটি ছিল তাঁর দর্শন, সুফি অনুরাগ। ধাত্রী কবিতায় সে-ই মুক্তির ফরমান ছিল। বিবেক ও চিন্তার মুক্তি। জড়তা ও অন্ধকারের মুক্তি। একটা সময় গর্ভবতী মা – ও অস্থির হয়ে ওঠে কখন আরাধ্য শিশুর মুক্তি ঘটবে। শাহিদ বুঝেছিল উৎস থেকে খুলে ফেলার সময় এসেছে ;
“উৎস থেকে আমায় ফেলো খুলে
মিথ্যা থেকে আমায় লহো তুলে
স্বপ্ন ছিঁড়ে দোলনা কাছে আনো
ধাত্রী আমায় দুহাত ধরে টানো।”
কবিতা – ” ধাত্রী ”
কী অদ্ভুত ছন্দময় মুক্তির দর্শন! শৈল্পিক উৎকর্ষতার সেরা নিদর্শন এই কবিতা খুব গোপনে বিপ্লবের আলো প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে। ধাত্রী সমাজ বাস্তবতার নিন্মবিত্ত ছোট জাত। ধাত্রী মানে নিন্মবর্গীয় ক্ষুধা। সে-ই ধাত্রীকে এক পর্যায়ে যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠতে হয়, ভ্রুণতারাটি সফলভাবে মুক্ত করার লক্ষ্যে। এ-ই মানবিক বিপ্লবে যখন ধাত্রী “কি -নোট “তখন আমাদের  বুঝতে অসুবিধা হয় না কবি-র  ধাত্রী’র প্রকৃত স্বরূপ।
কবি কি মা’জন্মেরও পূর্বে কোথাও জন্ম নিয়েছিল?
না হলে এসে কেন ধাত্রী থেকে মুক্তি চাইবে!
পুঁজিবাদের প্রবল অহংসময়, সভ্যতার ক্ষয়, মানবিক বিপর্যয়ে ঘোর অন্ধকার, সর্বোপরি মানব প্রকৃতিতে কারেন্সি সভ্যতার সার্বিক ধ্বংসাত্মক ক্ষরণ – কীভাবে পুঁজিবাদ মানুষকে তার Species Being বা প্রজাতিগত সত্তা থেকে ক্রমশঃ বিয়োজিত করে হৃত সর্বস্ব ক্ষুদ্রতায় পর্যবসিত করছে, মার্ক্সীয় বীক্ষার এ-ই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি শাহিদ জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন, রক্তরুক্ষতা, বিকার এবং বিশ্বাসভঙ্গের অভিঘাত কত ভয়ংকর হতে পারে। শাহিদ অস্ত্রের বদলে শব্দকে ধরেছিলেন এবং গোটা কবিতা তাঁকে ধরে বেঁচেছিলেন শাহিদ বাংলা কবিতার জ্বলন্ত উনুনে গর্ভ – উত্তর ক্ষত – বিক্ষত পলান মাস্টার।