আলী সিদ্দিকী
(শাহিদ আনোয়ার, পরম বন্ধু মনোময়)
ঘুমালে নাকি মনোময়?
মনোময় ও মনোময়, ঘুমালে নাকি?
রাত দাবড়ে এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে গেলে?
ছেড়ে দিলে দুলে দুলে পুঁথি পড়া মৃদু আলোয়
যাত্রা সার্কাসে মগ্ন হয়ে থাকা দীপ্ত চোখ
কিংবা কবিগান আর কীর্তনের উদ্দাম আনন্দ?
ভুলে কি গেলে শহরের বুক চিতিয়ে থাকা
দেয়ালগুলো তোমার রক্তাক্ষরে জ্বলে উঠতো,
তেতে থাকা রাজপথ উন্মুখ থাকতো বজ্রকন্ঠের
জলপাই ট্যাংকে পিষ্ট প্রাণ জাগতো তোমার স্পর্শে?
মনোময় ও মনোময়, জেগে কি আছো?
প্রভাতফেরির শোক মিছিলে কুহেলির সাদা শাড়ী
রক্তাক্ত হয়ে গেলো ঘাতক বুলেটে
নুর হোসেনের ফুটো বুকে মুক্তির গান ছিনতাই হলো
কায়েমি হন্তারক চেপে বসে তীব্র অন্ধকারময়
কালোরাত ভারী হয় কুহেলির বুকের ওপর
সে তোমাকে ডাকে মনোময়, তোমাকে চায়।
মনোময়, ও মনোময়, ঘুমালে নাকি এই কালরাতে?
মৌন মনোময়
সবাই দেখেছে তোমার ঝড়-চুরমার ভাবলেশহীন চোখ
জানি আমি কোথায় গেঁথে আছে তোমার দৃষ্টি উৎসুক।
মিছিল ছিলো রক্তধারায় ভালোবাসায় অন্তহীন কুহেলি
শব্দের সংসারে করেছো রচনা নীরবতায় দীপ্র অন্তর্জলী।
পথের সখা ছিলে তুমি প্রতি কদমে অগাধ ভালোবাসা
পথমানুষের হাসি ছিলো আমাদের উজ্জীবিত বাতাসা।
প্রভাতফেরি পিকেটিং শ্লোগানে-শ্লোগানে দেয়াল লিখন
গর্জনে হুঙ্কারে ক্ষরণে ক্রন্দনে সুচারু তোমার বীক্ষণ।
দেখছে সবাই চতুর সময়ের আজ হয়েছে জয়জয়কার
সাম্যের অবিনাশী পণ তবুও সে পারেনি করতে ছারখার।
আমাদের সময়েরা জেগে আছে দ্রোহের কাব্যকলায়
হৃদয়ে হৃদয়জুড়ে গড়েছি ভালোবাসার অপার উপায়।
২০ জানুয়ারি, ২০২০
অমানিশার উপবাস
( কবি শাহিদ আনোয়ার আপনার করকমলে )
তাপস চক্রবর্তী
ভেঙে যেতে যেতে এখন আর কেউ দাঁড়ায় না…
ভয়ে নয়–
শীতের রাতে শুয়ে থাকে প্রিয় প্রান্থজন
হাসপাতালের বেডে।
অথচ ভেঙে যেতে যেতে দেখি পাতার ভাঁজে
তমাল আঁধাররা যেমন খেলে–
খেলে গেছে আমপারা ভোরের হাওয়ায়।
ভুলে গেছি– ওরা ছিল নিরেট পাথর।
যেবার লেনিন ভেঙে পড়েছিল মস্কোর রাস্তায়
কেউ কেউ হেসেছিল সাহারায়
রজনীগন্ধায়
একে একে রাষ্ট্র– মশগুল রাতের আঁধার।
অথচ আঁধার শেষ কাঠগোলাপে আলাপে
দলপাড়ার মেয়েরা নেমে আসে
গত ভোরে।
অর্থনীতির মন্ত্রে বাংলার বামহস্তে
কবির জন্য জাগে ফুল।
ফুলে ফুলে কবিতায় হয় অমানিশার উপবাস।
আয়ুর বাকল পিষে দিলেন
আজিজ কাজল
উৎসর্গ: প্রয়াত কবি শাহিদ আনোয়ার
খুব কমকিছুর জন্য হাসতে চেয়েছেন—
অল্পায়ু শব্দের বাকল ধরে, ভিন বাক্যগ্রহে বিপ্লবের ডাক দিতে চেয়েছেন; এতো নরম সংবেদনা-প্রেম বহুদিন বইতে বইতে কর্কষ্য পৃথিবীর নিঠুরতাও কম পুষে রাখেন নি বুকে; আপনার শিল্পায়ু আর জীবনায়ু দু’জনই পাঞ্জা মেরে লড়াই করছিল; অথচ সেই মরমটুকু বুঝার সময় না দিয়ে, ফুরুত করে উড়িয়ে দিলেন দমের চড়ুই।
কুঁকড়ে ছিলেন মনোটোনাস গর্ভে; মায়ের উৎস থেকে নিজেকে খুলে ভরাতে চেয়েছেন নন্দনের সুষমাচন্দন; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
নিজ-ক্ষতির বারোটা কে অকৃপণে করেছেন বরণ—কৃত্রিম আঁষটে-ধোঁয়া পুষ্পে নয়; চেয়েছেন সহি-পুষ্পের নব পৃথিবী;
দূর শুকতারার প্রেম-অরণ্যে ঝলক মারতে চাইলেন— আঁধার মারা জরায়ুফুলেরও আছে যে আলাদা রূপ-শুষমা, তার নজল ধরতে চাইলেন।
শিল্পবাসরে আপনি শয্যা পেতেছেন—হতে চাইলেন শিল্পবর, সুরাপুত্র, হতে চাইলেন সাকি; অভিমানের পাথরটুকুও ফুলে ওঠেছে; ক্ষীণ-পৃথিবীর পেটে হুল ফুটাতে না পেরে ফুটিয়ে দিলেন অমরফুল।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হৃদয়ে মেখে, হতে চাইলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক; একটি অসম পৃথিবীর বল্কল ছিঁড়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন সাম্যের প্রেম-পৃথিবী।
শুধু এক শেলীই ধরতে পেরেছিল, আপনার হৃৎপিণ্ডের চটকানো ব্যথার গোপন; আপনার জন্য, ন্যুনতম শিল্প-শুশ্রুষা, একটি কণ্ঠকহীন মৌলিক বাগান-অন্তত তৈরি করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন— এবং সে দৃষ্টান্তের মরমটুকু ধরার আগেই নাই হয়ে গেলেন!