You are currently viewing অন্তর্দহন/ পলি শাহীনা

অন্তর্দহন/ পলি শাহীনা

অন্তর্দহন
পলি শাহীনা
এলার্মের শব্দে শিখার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলতেই রোজকার মত দেয়ালে ঝুলানো ছবিটির দিকে প্রথমেই নজর পড়ে। ছবিতে শিখা পরম নির্ভরতায় শাওনের কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখছে। ছবিটি যেন এক শতবর্ষী বৃক্ষ, যে বৃক্ষের মাথায় ঝুলে আছে ইশ্বরের ছায়া! সুশীতল ছায়াতলের মায়ায় শাওনের সৌরভ মেখে শিখা আয়েস করে বসে থাকে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। এমন বৃষ্টিদিনের আস্কারায় ওদের যুগল জীবনের কত কথা মনের সরোবরে ভেসে উঠছে! বৃষ্টি যেন স্মৃতির চাপাকল, যত ঝরে তত মনে পড়ে!
যৌথ জীবনের প্রথম দিনেই শাওন বলেছিল – ‘আমরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু।’ সত্যিই, ওকে স্বামী নয় বন্ধু হিসেবেই সর্বদা পাশে পেয়েছে শিখা। ওরা একসঙ্গে শিশুর মত হৈ হুল্লোড় করে খেলতো, বন্ধুর মতো গলা ছেড়ে গাইতো, শৈশবের মত প্রাণ খুলে হাসতো। শাওনের ভালোবাসার আদরে শিখার মনেই হত না, ও আপনজনদের ছেড়ে দূরে আছে।
ওদের শোবার ঘরের পাশেই প্রশস্ত লাগোয়া বারান্দা। ভোরের মিষ্টি আলো চোখে পড়তেই শাওন জেগে উঠলেও শিখা ছিল ঠিক তার উল্টো। ভোর বেলা ওর দু-চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম নেমে আসতো। শাওনের বুকের গন্ধ মেখে ও আরও আরাম করে ঘুমাতো। কফির ঘ্রাণ শিখার খুব পছন্দ। ঘুম চোখ মেলেই কফি না হলে ওর দিন শুরু হতেই চায় না। কফি বানিয়ে শাওন বারান্দায় বসতেই ও ঠিক একলাফে হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যেত। শিখার এ কফি প্রীতি বা দূর্বলতার কথা শাওনের জানা ছিল বলে সকালে ওকে উঠানোর জন্য এ পদ্ধতিটাই ব্যবহার করতো। অতঃপর, দু’জনে একসঙ্গে বসে এক কাপে কফি খেত।
‘ ওগো বর্ষা তুমি ঝরোনা গো অমন জোরে
বর্ষা তুমি ঝরোনা গো অমন ঝোরে
কাছে সে আসবে তবে কেমন করে
রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম
এলে না হয় ঝোরো তখন অঝোর ধারে ‘
এ সময় শাওন গলা ছেড়ে মান্না দে’র গান গাইতো। মান্না দে শিখার ভীষণ প্রিয়। বিয়ের আগে ও শাওনকে বলেছিল, হানিমুনে ওরা ইন্ডিয়া যাবে, প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে দেখা করবে। মান্না দে’র মৃত্যু সংবাদ জেনে ও খুব কেঁদেছিল। শিখার প্রিয় মান্না দে জানার পর থেকেই ও কন্ঠে তাঁর গান তুলে নেয়, সময় সুযোগ পেলেই গেয়ে শোনায়। ওর গানের স্বর অপূর্ব ছিল। শিখা চোখ বুঁজে ওর গান শুনত।
শিখা-শাওনের সংসারের পরতে পরতে ছিল গান- কবিতা – গল্প, আর ওদের হাসি – আনন্দ!
বিছানা ছেড়ে শিখা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি দেখছে আর ভাবছে – কেমন করে যাবে আজ হাসপাতালে করোনার ভ্যাক্সিন নিতে! মোবাইল খুলে আবহাওয়া বার্তা দেখে শিখার চোখ চড়কগাছ! আবহাওয়ার পূর্বাভাস – ভারি বৃষ্টিতে বন্যার সম্ভাবনা! গত কয়েকমাসেও এমন ভারি বর্ষণ হয় নি।
শাওনের প্রচন্ড ভালোলাগা ছিল বৃষ্টির প্রতি। বছর চারেক আগে এক বসন্ত দিনে অনলাইন থেকে পছন্দ করে শাওন ওকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল। সর্ষে ক্ষেতের মতো হলুদ শাড়ীতে লাল রঙের হেন্ড পেইন্ট শাড়ী। আঁচলজুড়ে ছিল শিমুল ফুলের মাখামাখি। শিখাকে সারপ্রাইজ দিতে ওর খুব ভালো লাগত। ডাকযোগে শাড়িটি ওদের বাড়ির ঠিকানার পরিবর্তে শাওনের অফিসের ঠিকানায় এলো। শীতপ্রধান উত্তর গোলার্ধের প্রচণ্ড শীতের দেশ আমেরিকায় বসন্তকাল নিয়ে শিখার মনে কোন হুটোপুটি নেই। বসন্তে যখন ফুল ফোটে, পাখী গায় তখন ডুবে থাকতে হয় বরফের নিচে কিংবা বৃষ্টিতে। এদেশে ফাগুন হাওয়া মনের উঠোনে উল্লাসের ঝড় তোলে না। ঋতুরাজ বসন্তের রঙ – রুপ- রস- গন্ধের সঙ্গে হৃদয় সম্পৃক্ত হতে পারে না। তো, বসন্তের কথা অনেকটাই ভুলতে বসেছে শিখা। ও ভুললে কি হবে শাওনের কিন্তু সব বিশেষ দিন, মুহূর্ত মনে থাকে। সে অনুযায়ী শিখাকে রাঙিয়েও তোলে।
সে বছর ফাগুন মাসের প্রথম দিন হালকা তুষার সঙ্গে বৃষ্টি ঝরছিল। অফিস থেকে ফিরে বৈকালিক নাস্তার টেবিলে শাওনের আহ্লাদের শেষ থাকে না। সকাল বেলায় কর্মস্থলে যাওয়ার আগে হুড়োহুড়ি করে নাশতার টেবিল ফেলে চলে গেলেও, বিকেলে সময় নিয়ে দু’জনে খোশগল্পে, আমুদে মনে চা- নাশতা খায়। শিখাও গোটা দিন এ সময়টির জন্য তৃষ্ণার্ত চাতকের মত অপেক্ষা করে।
ডোর বেলের শব্দে শিখা দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই ওর কপালে নিত্যদিনের মত ভালোবাসার তিলক এঁকে দেয় শাওন। দরজা লাগিয়ে মুচকি হেসে ও চলে যায় বেডরুমে, ফ্রেশ হতে। শিখা ব্যস্ত হয়ে উঠে রান্নাঘরে। নাশতার টেবিলে  কনডেন্স মিল্কের দুধ চা সঙ্গে সব্জি পাকোড়া এগিয়ে দিতেই শাওন বলে উঠলো – ‘ এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন। ‘
শাওনের ভরাট কন্ঠের আবৃত্তি শুনলে শিখা যেন গোটা জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আজও এর ব্যতিক্রম হল না। চোখ বন্ধ করে ও আবৃত্তি শুনতে শুনতে মনে মনে আওড়াতে থাকে-  প্রিয়জন ছাড়া এ পৃথিবী বড্ড ধূসর। প্রিয়জনকে ছুঁয়ে এমন ম্যাড়মেড়ে দিনও মনের ভেতর কল্লোলিত সুবাসের ঢেউ হয়ে উপচে পড়ছে বুকের জাজিমে। শাওনের স্পর্শে ওর বুকে উথাল-পাতাল ভালোলাগা।
শাওনের ভেজা ঠোঁটের ছোঁয়ায় ও চোখ খুলতেই শাওন দু-হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে দেয়। শাওন না বলা পর্যন্ত ও যেন চোখ না খোলে, এ অনুরোধ করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দৌড়ে রুম থেকে শাড়িটি এনে ওর চোখের সামনে ধরে, চোখ মেলতে বলে। চোখ মেলেই শাওনের হাতে ধরা শাড়িটি দেখে ও সত্যিই চমকে যায়। খিলখিল হাসতে থাকে। তুষারস্নাত দিনে এমন উপহার পেয়ে ও অবাক হয়। শাড়িটির দিকে তাকিয়ে এ ইঁট-কাঠের শহরের ফাঁকফোকর থেকে ওর কানে এসে বাজছিল, জুয়েল আইচের বাঁশির অপরুপ সূরের মূর্চ্ছনা। ও বসন্তদিনের গান শুনছে, কোকিল ডাকছে, তুষার ভেজা শহরে যেন চাঁদ উঠেছে। ফিনফিনে জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পড়ছে ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কুড়ি ফুল হয়ে ফুটেছে, নদীতে জোয়ার এসেছে। জগতের সমস্ত আনন্দ যেন ওর দিকে ধেয়ে আসছে। আজ শুধু ভালবাসার দিন। শিখা ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। ও ভেবে পায় না কাকে জড়িয়ে ধরবে? শাওনকে নাকি শাড়িটিকে?
শাওনের বাহুতে সুদীর্ঘ চুম্বনে শিখার বিহ্বলতা কেটে ওরা জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের তুষার ফুল দেখতে থাকে। দুধের মত সাদা তুষার ফুল জমিনে পড়ে চিকচিক করছে।
– জানালাটা খুলে দাও তো শিখা।
– বাইরে শীত তো!
– আমার ভালোবাসায় শীত উড়ে যাবে!
– তোমার ভালোবাসায় সব পারি আমি!
শিখা জানালা খুলে দিতেই শীতের তীব্র হুংকারে ওরা পরস্পরকে আরও শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। ওদের চোখে তখন খেলছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার আলো, আর কানে বাজছিল রবিশংকরের সেতারের জাদুময় সুর!
সুখ – শান্তি – স্বস্তিতে শিখার জীবন এতটাই টইটম্বুর করে তুলেছে শাওন, ও যখন যতদূরেই থাকুক না কেন, ওর ছায়া শিখার পেছনে হাঁটতে থাকে!
শিখা আজ আর বৃষ্টি চায় না। ওকে যে বাইরে যেতে হবে। ওর প্রার্থনা আকাশ শুনতে পায় না। বৃষ্টিফুল হয়ে ঝরছে ওদের স্মৃতির নদী! বৃষ্টি এলেই আকাশের গ্রীবা ছুঁয়ে শাওনের ছায়া আসে,  মায়া আসে। আকাশে মেঘ জমলেই শিখার বুকে লুকানো সমস্ত আঁধার সরিয়ে শাওন আলো হাতে হাঁটে। বৃষ্টির সঙ্গে ওদের হিরন্ময় সব সময় জড়িয়ে আছে।
ওদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে আকুল করা এক বৃষ্টিস্নাত দিনে। প্রকৃতিপ্রেমী শিখা নাগরিক কোলাহলে হাঁপিয়ে উঠলেই ছুটে যেত প্রকৃতির কাছে। মানুষের ভীড়ে কিংবা উঁচু উঁচু দালানের ভীড়ে ওর নিঃসঙ্গ লাগলেও, প্রকৃতির কোলে ও পূর্ণ হয়ে উঠত, দু-চোখ ভেঙে ঘুম নামত। কর্পোরেট দুনিয়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় ও যখন হাঁপিয়ে উঠত, ক্লান্তিতে মাথা ঝুঁকে পড়ত, মনের আনন্দ উড়ে যেত, মায়ের মত প্রকৃতির ছায়া তখন ওকে বেঁচে থাকার রসদ যোগাত। বাস্তবতার টানা- হেঁচড়ায় যখন ওর শ্বাসকষ্ট হত, ইনসমনিয়ায় ভুগত, তখন প্রকৃতি ওষুধের মত কাজ করত।
শেকল পরা জীবনের খাঁচা থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মুক্তির স্বাদ পেতে, অফিস শেষে রোজকার মত সেদিনও শিখা ছুটে যায় সেন্ট্রাল পার্কের কচুরিপানা, হাঁস, পানকৌড়ি ভর্তি সে মজা ডোবার পাড়ে। ডোবার উপরে ঝুলে আছে ভারি মেঘ। ঝুলে থাকা মেঘের নিচে হাঁসের দল চক্রাকারে ঘুরছে। মেঘের খাঁজে ঘাপটি মেরে থাকা জলবিন্দু তখনও ঝরতে শুরু করে নি। সেন্ট্রাল পার্কের ভেতরের এ দৃষ্টিনন্দন জায়গাটিকে আমেরিকানরা লেক বললেও, শিখা বলে ডোবা! এ ডোবার কিনারে বসে শিখা কত কত গন্ধ পায়! কলমিলতা, শাপলা, চালতা, কদম ফুলের গন্ধ পায়! এ ডোবার জল যেন স্মৃতির নদী! জলে হাত বোলালেই গন্ধরা এসে ঝাপ্টে ধরে ওকে, কিংবা ও ছুঁতে চায় ওদেরকে! মাথার উপর ঝুলে থাকা মেঘ যেন ওকে ডেকে বলছে, ‘ যাবি আমার সঙ্গে? যাবি? ‘
শিখার যাওয়া হয় না এ দেশ ছেড়ে স্বদেশে। আমেরিকায় আসা যত কঠিন ফিরে যাওয়া তারচেয়েও কঠিন!
পাখীদের কিচিরমিচির শব্দ কানে আসে। কাঠবিড়ালি খেলছে। একটু দূরেই ঘুঘু দম্পতি। দম্পতি না হলে অমন করে ঠোঁট ছুঁয়ে থাকত! ওদের ঠোঁট ছুঁয়ে আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি নামে। সেদিনের বৃষ্টিজলে ছিল কলকে ফুলের মধু! শিখা আকাশের দিকে মুখ তুলে মধু পান করতে থাকে! ঠিক তখনই ছাতা মাথায় ওকে পাশ কাটিয়ে শাওন উল্টোদিকে হেঁটে যায়। কয়েক কদম সামনে গিয়ে ফিরে আসে।
– এদেশের বৃষ্টিতে সাধারণত কেউ ভেজে না। বৃষ্টি আমারও প্রচন্ড ভালো লাগে, তবে অসুখের ভয়ে ভিজতে চাই না। আপনাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে। বৃষ্টির শক্তিশালী জলে নিজ আত্মাকে যেন অর্পণ করেছেন!
শিখা ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
– ঠিক আছে! ধন্যবাদ!
শাওন দ্রুত পায়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলে যায়। শিখা ধীর পায়ে ওর কথা ভাবতে ভাবতে পার্কের একটা বেঞ্চিতে এসে বসে। শাওন চলে যাওয়ার সময় ওর বুকের সরোবরে কিছুটা মমতার গন্ধ ঢেলে যায়!
দেশের জন্য মন ব্যাকুল হলেই শিখা ছুটে আসে অপরুপ প্রকৃতি ঘেরা এ সেন্ট্রাল পার্কে। শৃঙ্খলিত মন ছোটবেলার মত চঞ্চল হয়ে উঠে এখানে এলে। ওর ইচ্ছে হয় বনের পাখীদের সঙ্গে দিগন্তে উড়াল দিতে। ‘পাখীর মত মন দিলেই যদি প্রভু উড়বার শক্তি কেন দিলে না’  – নিজ মনে আওড়াতে থাকে।
নিউইয়র্ক শহরে পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলের মানুষ বাস করে। মেক্সিকান, ইটালিয়ান, আফ্রিকান,চাইনিজ, আলবেনিয়ান, এঁদের চেহারা, গড়ন, প্রকৃতি দেখে চেনা গেলেও বাংলাদেশী এবং ইন্ডিয়ানদের আলাদা করতে কিছুটা সময় লাগে। শিখা সেন্ট্রাল পার্কের অরণ্য, ডোবার পাশ ঘেঁষে হাঁটার সময় গুনগুনিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার সুবাদে শাওন ওকে বাঙালি হিসেবে চিনতে পারে। আসা যাওয়ার পথে শিখা দেখত ঈগলের মত তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ক্যানভাসে শাওন ছবি আঁকত। বৃষ্টিস্নাত ওই দিনে শিখা নিশ্চিত হয় শাওন একজন বাংলাদেশি। গড়ন, পোশাক, রঙ, খাদ্যাভ্যাস একরকম হওয়ায় অচেনা বাংলাদেশী এবং ইন্ডিয়ানদের আলাদা করার জন্য কথপোকথন পর্যন্ত অপেক্ষা কর‍তে হয়।
বেশ কিছুদিন পর একটা বাক্সে ওয়াইল্ড বার্ড ফুড নিয়ে শিখা সেন্ট্রাল পার্কে যায়। পাখীদের খাইয়ে ও ডোবার পাশে গিয়ে বসে। ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস ছুটে আসে। ও ওদেরকে খাওয়াতে থাকে। বাক্সের খাবার ফুরিয়ে এলে ও উঠে আসতে দেখে শাওন ছবি আঁকা ফেলে হাঁসদের খাওয়ানোর দৃশ্য ভিডিও করছে। চেনা মুখ দেখে ও হেসে দেয়। শাওন মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও এগিয়ে দেয় ওর সামনে।
– বেশ সুন্দর ।
– পছন্দ হয়েছে?
– হুম।
– চলুন না একসঙ্গে কফি খাই!
কফি খাওয়ার জন্য পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে মত পাল্টে দু’জনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুড ট্রাক থেকে জায়রো কিনে খায়। সেদিন অবশ্য আকাশের ঠোঁট খসে বৃষ্টি না পড়লেও, ওদের বুকের জমিনে মুগ্ধতার কুয়াশা ঝরেছিল! মনের পাটাতনে বসে দু’জনে ভিজছিল। কুয়াশাজড়ানো পথে দু’জন দু’জনকে খুঁজতে খুঁজতে কমলা রঙের উজ্জ্বল রোদের উঠোনে এসে ওরা মিলিত হয়! ওদের বাহারি সময়ের ভাঁজে ভাঁজে গন্ধ বিলাতে থাকে কামিনী, মল্লিকা, গন্ধরাজ! ওদের ভালোলাগা গভীর হতে হতে ভালোবাসায় রুপ নেয়।
 ভালোবাসা অপার্থিব কিছু নয়! শাওনের ভালোবাসার আয়নায় শিখা ওর আত্মার প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। ও যেন এতদিন শাওনের অপেক্ষায় ছিল। ওর একাকীত্ব, বিষাদমাখা সময়রা শীতল হতে থাকে শাওনের ভালোবাসায়। ওরা একে অপরের প্রাণ শক্তির উৎস, যখন এ বিষয়টি নিশ্চিত হল তখনই ওরা নতুন জীবনের সূচনা করে। বিবাহিত জীবনের প্রথম লগ্ন থেকে ওরা একে অন্যের কাছে খোলা বইএর পাতার মত ছিল, যার প্রতি পৃষ্ঠা, প্রতি লাইন হতে জীবন রসের অমিয় সুধা নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করত। যে কোন সংজ্ঞাতেই ওদের সংসার ছিল একটি সুখী ও আদর্শ পরিবার।
মহামারি করোনা ঝড় শুরু হতেই শাওনের কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। ও বাসা থেকে গুগল ক্লাশ রুমে ছাত্রদের পড়াত। শিখাও ছুটি পায় কর্মস্থল হতে। করোনার এপি সেন্টার খ্যাত নিউইয়র্ক শহরের চারদিকে মৃত্যুর মিছিল তরতর করে বাড়ছে। রাতদিন এম্বুলেন্সের শব্দে ঝলমলে আলোর শহর নিউইয়র্কের আকাশে বিষাদের মেঘ জমেছে। স্বজন হারানোর বেদনায় চারপাশের মানুষ কাঁদছে। বাঁচার জন্য মানুষ আপ্রাণ লড়ছে। প্রতিটি মানুষ জীবন – মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ জানে না কখন এ মায়ার সংসার ফেলে কে চলে যাবে। ভয়ে প্রতিটি প্রাণ থরথর কাঁপছে। হাত- পা ঠান্ডা হয়ে আসে। চেনাজানা মানুষের মৃত্যু সংবাদে ওদের মন খুব বিষণ্ণ হয়ে উঠে।
মাঝ রাতে তন্দ্রা কেটে ওরা একে অপরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে থাকে। ওদের চোখে ঘুম নেই। করোনা ভয় শুধু ওদের ঘুম নয়, পুরো পৃথিবীর মানুষের চোখের ঘুম গোগ্রাসে গিলে ফেলেছে!
 গত কয়েকদিন ধরে শাওনের জ্বর, গলা ব্যথা, কাশি। সংবাদ মাধ্যমে হাসপাতালের ভয়াবহ অবস্থা দেখে শিখার কাকুতি মিনতিতে ও ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হয় নি। বাসা থেকে ডাক্তারের পরামর্শে  ওষুধ, খাবার খাচ্ছে। অক্সিমিটার দিয়ে সময়মত শরীরে অক্সিজেনের লেভেল দেখছে।
মাথার উপর মস্ত আকাশটায় তারার মেলা বসেছে! শাওন বিছানা ছেড়ে জানালার পাশ ঘেঁষে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। শিখা এসে বিড়ালের মত ওর গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই শিখা টের পায় ওর গা পুড়ে যাচ্ছে! ও তাড়াতাড়ি রান্নঘর হতে স্যুপ নিয়ে শাওনকে খাইয়ে ওষুধ খাওয়াতে গেলে, ও শিখাকে বুকের সঙ্গে মসৃণ আদরে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে,
– চরাচরজুড়ে এ দুর্যোগ কেটে গেলেই তোমায় নিয়ে সমুদ্রে যাব! আমরা একসঙ্গে স্নান করবো!
– তোমার চোখে আমি সমুদ্র দেখি! তোমার বুকের জলে স্নান করি! তুমি আমার সমুদ্র!
– এ মহামারি কেটে গেলে তোমাকে আবার সেন্ট্রাল পার্কে নিয়ে যাব! বিশুদ্ধ বাতাসে উড়ে যাবে এ সময়ের সমস্ত দুঃখ!
– তোমার একান্তে ডুব দিয়ে ভালো আছি তো। তোমার হাসিমুখ ছাড়া আর কিছু চাই না।
– এ অতিমারি কেটে গেলে তোমাকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাব। দিনভর দু’জনে ঘণ অরণ্যে লেপ্টে থাকব। রাত নেমে এলে আগুনের কুন্ডলী জ্বালিয়ে কফি খেতে খেতে দু’জনে উষ্ণতায় কাঁপব। এ বন্ধী জীবন আর ভালো লাগে না, শিখা।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে শাওন ঘামের বানে ভেসে যাচ্ছে। ওর কথার মধ্যে কিছু সময়ের জন্য শিখা হারিয়ে যায়। ওকে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। শাওনের কপালে পুনরায় হাত রেখে ও আৎকে উঠে। রাত প্রায় শেষের দিকে। ওর জ্বরের মাত্রা বেড়ে চলছে।
– আমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। শরীরটাকে আর টানতে পারছি না।
এ কথা শুনে পাগলপ্রায় শিখা দ্রুত অক্সিমিটারের সাহায্যে ওর শরীরের অক্সিজেন লেভেল দেখে নেয়। ওই সময় শাওনের শরীরের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৭ তে।
শিখা ৯১১ নম্বরে কল করে। আগে এ নম্বরে কল করলে সঙ্গে সঙ্গে ধরলেও আজ ধরছে না। ও ফোন লাইনে অপেক্ষা করছে। ফোন ধরার পর এম্বুলেন্স আধ ঘন্টার মধ্যে আসবে বলেও আসছে না। এবার অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৩ তে। শাওনের শরীর ক্রমশ হিম শীতল হয়ে পড়েছে।
 এম্বুলেন্সের অপেক্ষায় ঘরের দরজা খুলে শিখা হাউমাউ কাঁদছে। ওর কান্নার শব্দ পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটের নাতাশা উঁকি মারে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে ওরা দীর্ঘদিন ধরে আছে। একে অপরকে পছন্দও করে। কিন্তু এ মহামারি এক মানুষ হতে অন্য মানুষকে দূরে সরিয়ে যেতে শিখিয়েছে। নাতাশা অশ্রুসজল চোখে ওর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। শিখা পরে জেনেছে ও ঘরে গিয়ে ৯১১ নম্বরে কল করে সাহায্য চেয়েছে শাওনের জন্য।
এম্বুলেন্স তখনও আসে নি। ৯১১ নম্বরে পুনরায় কল করলে ওঁরা দুঃখ প্রকাশ করে অপেক্ষা করতে বলে। শিখা শাওনের মাথায় হাত রাখে। ওর শরীর ততক্ষণে নির্জীব, হিমশীতল।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর এম্বুলেন্সের সাইরেন এসে থামে বাসার সামনে। এতদিন যে এম্বুলেন্সের শব্দে ও ভয় পেয়ে শাওনের বুকে মুখ লুকাত, আজ সে শব্দে ও পাথর। শাওনের পাশে ও নিশ্চল বসে থাকে। খোলা দরজা দিয়ে পুলিশ ভেতরে এসে শাওনকে পরীক্ষা করে জানালো – ও আর নেই। ফিউনারেলে লাশ রাখার জায়গা খালি হলে ওঁরা এসে শাওনকে নিয়ে যাবে। শিখা নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে ওঁদের চলে যাওয়ার দিকে। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে।
বাড়ীর সামনের রাস্তা একদম ফাঁকা। বাইরের আলো এসে খেলা করছে ঘরের মেঝেতে। আলো ভালো লাগছে না। শিখা জানালার পর্দা টেনে দেয়। গভীর অন্ধকারে শাওনের বুকে মাথা রেখে নির্ভয়ে অনেকদিন পর ও ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
কলিং বেলের শব্দে ওর ঘুম ভাঙে। পিপহোল দিয়ে দেখে পুলিশ এসেছে শাওনকে নিয়ে যেতে।
 ‘ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নৃত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে। ‘
মহামারি করোনার এপি সেন্টার খ্যাত নিউইয়র্ক শহরের তপ্ত দুপুর এখন অনেকটা শান্ত হাওয়ার বিকেল। এ শহরে বসবাসকারীদের জীবনে প্রাক করোনাক্রান্ত সময়ের রঙ ক্রমশ ফিরতে শুরু করেছে। নিউইয়র্কের জনশূন্য পথঘাট কোলাহলময় হয়ে উঠেছে। অন্ধকারে আলো খুঁজে বেড়ানো মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর নানান প্রান্তে এখনও করোনার প্রকোপ বিদ্যমান হলেও এ শহরের মানুষ আলোর খোঁজে, মমতার খোঁজে, জনারণ্যে ছুটছে! মানবতার শত্রু কোভিড- ১৯ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে। মানবতার জয় হয়েছে। নিউইয়র্ক সহ গোটা পৃথিবীর মানুষ স্বাভাবিক জীবনের সন্ধানে, আলোর খোঁজে ভ্যাকসিন নিচ্ছে।

আজ শিখার ভ্যাকসিন নেয়ার দিন। আজও সকাল হতে আকাশ অঝোরে ঝরছে। শিখা ভ্যাকসিন নেয়ার জন্য ঘর হতে বেরিয়ে হাসপাতালে না গিয়ে অবচেতন মনে চলে যায় গোরস্থানে। গোরস্থানের প্রবেশদ্বারে পা রাখতেই ওর নাকে শাওনের ঘ্রাণ এসে লাগে। ওর বুক কাঁপতে থাকে, শিখা কাঁপতে থাকে। শান্ত গোরস্থানের গণ কবরটির কাছে যখন ও পৌঁছাল ঠিক তখনই চেনা গন্ধটা বাতাসে মিলিয়ে যায়। শাওনকে ঠিক কোথায় সমাহিত করা হয়েছে চিহ্নিত করতে না পারার কষ্টে ও আকাশের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে।