You are currently viewing শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিচূর্ণ ভাবনা /পারমিতা ভৌমিক

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিচূর্ণ ভাবনা /পারমিতা ভৌমিক

 

শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিচূর্ণ ভাবনা /পারমিতা ভৌমিক

 

শক্তি চট্টোপাধ্যায় মানবপ্রেমের কবি। প্রকৃতিপ্রেমেরও কবি। সামগ্রিকভাবে প্রকৃতির দুটি দিক—মানব প্রকৃতি ও নিসর্গ প্রকৃতি। প্রেমের এই সামগ্রতাই  শক্তির কবিতার উপজীব্য। শক্তি নিজের জগৎ গড়েছেন নিজের মতন করে ।সেখানে বিষণ্নতা আছে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি আছে প্রসন্নতা ।শক্তির প্রেম প্রকাশে রয়েছে প্রাণের স্পন্দন আর মুক্ত বিহঙ্গের উড়ান-আনন্দ ।প্রেমের বাঁধনে থেকেই যেন তিনি মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন ও পাঠককে দিয়েছেন ।এই সূক্ষ্ম অনুভূতির মাটিতে দাঁড়িয়েই সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছেন তিনি। তবে বলতেই পারি প্রেমই তাঁর কবিতার উপজীব্য ।একথার সমর্থনের বোধকরি প্রমাণ লাগেনা। মধ্যযুগের ও তারও পূর্বে বাংলার প্রেমের কবিতার ধারাটি আজও বহমান। পাওয়া না-পাওয়া কে কেন্দ্র করে সুদীর্ঘ সময় শক্তি প্রেমের কবিতা লিখেছেন ।সে সব কবিতা যতটা জীবনসম্পৃক্ত ততটাই কিন্তু জীবনবিবিক্ত। শক্তির কবিতায় পাই-

১) রোমান্টিকতা

২) প্রচ্ছন্ন মৃদু উচ্চারণে ধৃত আন্তর ব্যাকুলতা

৩) হৃদয় স্পর্শী সূক্ষ্ম অনুভূতি

৪) একাকীত্বের গূঢ় ব্যঞ্জনায় প্রেমের অবিকল্প আনন্দ।

ব্যক্তিগত অনুভব ছাড়াও শক্তির প্রেমের কবিতায় মিশেছে জীবন,মৃত্যু, প্রকৃতি ও নির্জনতার প্রসঙ্গ । আশ্চর্য এই যে একমাত্রিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রেমও শক্তির কলমে পেয়েছে বহুমাত্রিকতা। অবশেষে আবার সেই প্রেমই হয়ে উঠেছে সার্বভৌম।

ব্যক্তিগত জীবনে  শক্তিকে কোনদিনও স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হয়নি, তবুও স্বেচ্ছাচারী ভালোবাসার টানে পথে পথে বেড়িয়েছেন শক্তি ।ঘর বোধহয় তাঁর অনিকেত-প্রেমকে বাঁধতে পারেনি। প্রেমের এমন অন্তরচারী কমনীয় ভাবটিই শক্তির প্রেমের কবিতার সম্পদ।শক্তি চট্টোপাধ‍্যায় প্রেমের কাঙাল…এবং তা তিনি পেয়েছেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি ও উপলব্ধির সমীকরণে।আসলে নারীকে কাছে পাওয়ার চেয়ে তাকে ঘিরে স্বপ্নসত্য রচনা করাই ছিল শক্তির কবিস্বভাবের বৈশিষ্ট্য ।প্রিয়তমাকে কাছে না পাওয়ার বেদনাজাত হাহাকারকে তিনি কাছে না পেয়েই বুঝতে চেয়েছেন। কখনো কখনো অবশ্য শরীরী আবেদনেও তাঁর কবিতায় নতুনত্বের আবির লেগেছে।

প্রেমের একটা দীর্ঘস্থায়ী কোমলস্পর্শে বাস্তবের তীক্ষ্ণতাকে ও তজ্জাত যন্ত্রণাকে তিনি পেরিয়ে গেছেন। তাঁর–“হে প্রেম হে নৈঃশব্দ”—এ পাই তাঁর প্রেমের গোপন মুহূর্তের স্বগতোক্তি ।শত আশঙ্কার মাঝেও কবি প্রেমকে শাশ্বত বলেই জেনেছেন—-

” বাগানে অদ্ভুত গল্প ,এসো ফিরি আমরা দুজনে/ হাতের শৃঙ্খলা ভাঙো,পায়ে পড়ে কাঁপুক ভ্রমর/ যা কিছু ধূলার ভার ,মানসিক ভাষায় পুরানো /তাকে রেখে ফিরে যাই দুজনে দুপথে মনে মনে “(নিয়তি)।

এই বিরহের মধ্যেই কবির অন্বিষ্ট প্রশান্তিটুকু আত্মগোপন করে আছে। পাঠক তার স্পর্শ পায়। কবিতার অন্তর্চেতনা থেকেই শক্তির প্রেমের কবিতাগুলো উঠে এসেছে। নির্জন অনুভব ও নিবিড় আত্মকথনেই বারবার কবি কড়া নেড়েছেন তাঁরই হৃদয় মন্দিরে—” সবার বয়স হয় আমার বালক বয়স বাড়ে না কেন”( পরস্ত্রী)।

শক্তির কবিতা মূলতঃ একোক্তিমূলক। সুখের মিলন নয় ,বিরহের মাঝে সুখের পরশই শক্তির কবিতার অভিমুখ নির্দেশ করে । তাঁর কবিতায় প্রাপ্তির আনন্দের চাইতে হারানোর বেদনা অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। আক্ষেপ বিষণ্ণ পঙতি—- “রজনী কখন প্রিয় করে হা রে হৃদয় জানে কি”( চতুরঙ্গ)। এই আক্ষেপের উপশম আক্ষেপানুরাগেই স্থিত—” তোমায় কিছু দিয়েছিলাম প্রীতির ছায়া তলে /নীলাঞ্জনা, ঝরিয়া গেল রম্য চিত্রপট।

শক্তির কাব‍্যভূমিতে নিসর্গ ও মানবপ্রেমের সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে অলৌকিক কোনো আত্মিক প্রেম— নিসর্গ কখনো কখনো হয়ে উঠেছে প্রেম পার্সনিফায়েড। একটি স্মরণযোগ্য পংক্তি—-
“ও ঝর্ণা ওগো ঝর্না তাহাকে ভালবাসবে কি, ভালোবাসবে কি” (ঝর্ণা)। ভালবাসার ভালোবাসাময় অতীত কখনো কখনো কবিকে চঞ্চল করেছে _”আমি এই যুবতীর উজ্জল
চোখের মতো একটি দিন পেয়েছিলাম” (সংলগ্ন)।

আবার দেখেছি প্রশান্তির অন্বেষণে কবির ঘোষণা—“আলো জ্বলছে ক্রুর,এ তোর বিরহ হলো লম্বমান সূর্য /আকাশ সাদা ফনার মতন শুধু ঘুরছে করুন অক্ষ পথে /তেমন ভালবাসার আকাশ কোথায় পাবো” (সম্মলিত প্রতিবন্ধী)।

কখনো নাগরিক কদর্যতা ফুটেছে তাঁর কবিতার বাস্তব দলিলে ।কখনো এসেছে প্রেমে সর্বময়ী-প্রকৃতির অমূল্য বাতাবরণ। মানুষের আদিম যৌনপ্রবৃত্তির উজ্জ্বল উদ্ধার _”গহ্বরে মাংসের বিড়ে মাড় মুতফুল রক্তপাত” “বুকের বনাত খাদ মুচিডাব দারুণ গরম” “যোনির মাড়ির খিল হাট করা ,বেহায়া পাংশুতা,,,,”( জন্ম এবং পুরুষ)।

নৈঃশব্দ থেকেই আসে শব্দেরা ।আবার শব্দে শব্দেরাই ফেরে নৈঃশব্দে। শব্দ ছাড়া নৈঃশব্দকে ধরা   যায়না।সৃষ্টির ঊষালগ্নের কথা ও এই নৈঃশব্দে ই। শক্তির কবিতায় ওই নৈঃশব্দ্য একটা অদ্ভুত না-বলা জগতে এনে ফেলে পাঠক কে ।সে এমন নীরবতা যা শুধু অন্তর্নিহিত উপলব্ধি ও অনুভবকে নাড়া দেয়। উৎস হারানোর বেদনায় কবি ,যখন বলেন-” আমাকে তুমি আনলি কেন ফিরিয়ে নে।”(জরাসন্ধ) তখন দেখি জননী জঠরের নৈঃশব্দের মধ্যেই কবির শান্তি অন্বেষণ পথ খুঁজেছে।

” ধর্মে আছো জিরাফেও আছো” শক্তির দ্বিতীয় কাব্য সংকলন ।হিজলিতে বসে লেখা। তিনি
গ্রস্ত হতেন ।কবিতা যেন নেশার মতন ছিলো—–“অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে”—-এ কবিতায় বিরহের আর্তি ধ্বনিত হয়েছে কবিকণ্ঠে। দূরবর্তী মায়াবী পরশ কবির পায়ে পায়ে জড়িয়ে রয়েছে ।কবি কল্পনা ও বাস্তবের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, প্রকৃতির ছায়াঘন স্নিগ্ধতায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়েছেন—-

” বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা/দৌড়ে গিয়ে ,ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা/ হতো মেঘ বৃষ্টিতে শিউলি গাছের তলে,,,/”( যখন বৃষ্টি নামল)।

ছন্দের জাদুতে “সোনার মাছি খুন করেছি” কাব্যগ্রন্থটি অনন্য। এখানে রয়েছে কবির মধুর দাম্পত্যের স্পর্শ ।উপমার চমৎকারিত্বে এ গ্রন্থের কবিতার পংক্তি উজ্জ্বল —“যেখানেই যাই —তুমি আছো ,এঁটে আছো আমার শরীরের নানান জোড়ে/ রক্তপিপাসু জোঁকের মতন/আছো আলোর ভিতরে কেরোসিনের ফিতের মতো আঠায় ভিজে “(একদা এবং আমি /সোনার মাছি খুন করে।