দূরে কোথাও
কেয়া ওয়াহিদ
সোনালু সকালের রোদ যখন জানালার শার্শিতে, স্বলাজ পর্দা জেগে ওঠে আত্মিক টানে। অনঙ্গ রাত বাতাসের সাথে মিশে যায় মেঘের আস্তিনে। আমি ঘুমঘোর চোখ খুলে দেখি শিশু সকাল আমার হাত ধরে টানাটানি করছে ঘুম ছেড়ে ওঠার জন্য। সে কী টানাটানি, হৈচৈ!
কী আর করা! ঘুমন্ত হৃদেশের গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে আমি বিছানা ছাড়ি, উলেন স্লিপার পরে শোবার ঘর থেকে বেরোই সন্তর্পণে। বাড়ির মধ্যখান দিয়ে নেমে যাওয়া কাঠের সিঁড়িতে মৃদু আলোর লুকোচুরি খেলা চলছে, তাদের পাশ ঘেঁষে আমি ধীর পায়ে নিচতলায় নেমে আসি। পুরো বাড়িতে সুনসান নীরবতা। গায়ে পাশমিনা শাল জড়িয়ে পেছনের উঠোনের দরজা খুলি, ট্যারেসে শুন্য ফুলের টবগুলো অপেক্ষার পাটাতনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমাকে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে; মিতা___ কবে মাটি ও ফুলের চারা কিনতে যাবে? আমি মৌন উত্তর দেই, প্রকৃতিকে একটু সময় দাও_শীত বিদায়ী অনুষ্ঠান সেরে আসুক টিউলিপ বাগান থেকে।
ওহ, বলা হয়নি__ফুল, ফুলগাছ এবং ফুলের টব সবাই আমায় ‘মিতা’ বলে ডাকে আর পাখিরা ডাকে ‘বন্ধু’। শিশু পাখিরা ডাকে খালামণি। তাদের পরিচর্যার আনন্দ নিয়ে আমার আনন্দবাড়ি। একটু চোখ তুলে সোজা তাকাতেই দেখি কিশোরী ঘাসেরা হিম জড়তায় কুয়াশার চাদর টানানানি করছে। অপেক্ষার রৌদ্রগাড়ি শিগগির এসে পৌঁছাবে আপেল গাছের মগডালে। উত্তর দক্ষিণ বাতাসের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় গাছেরা দুলছে এপাশ ওপাশ।
সাইড ওয়াক দিয়ে সামনে যেতেই হাতের বামদিকে আম্মার বাসায় উঁকি দিলাম। রুমের জানালা বন্ধ ও পর্দা টানা দেখে বুঝে নিলাম দুজনই ঘুমাচ্ছেন। আরেকটু এগুতে দেখলাম পাশের রুমের পর্দা খোলা, বিছানার মধ্যখানে রেয়ালে বন্ধ কোরআন শরীফ, পাশে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখা। আম্মার পায়ের অর্ধেক কম্বলের নিচে, বালিশে হেলান দিয়ে বসা তিনি। কোলের মধ্যে পোলার আইসক্রিমের সাদা বক্স। মাঝারি ফ্রেমের চশমা চোখে খুব মনোযোগ দিয়ে ঔষধের পাতা বের করছেন। প্রেসারের ট্যাবলেট তিনি সকালেই খান, সাথে আরো কী কী যেন খান। পাশের সাইড টেবিলে পিরিচ দিয়ে ঢাকা চায়ের কাপ, মুড়ির বয়াম আর গ্লাসভর্তি পানি। আম্মার গুছানো সকাল দেখে ভালো লাগল, আমি আর তাঁকে ডাকলাম না, থাক। সামনের দিকে এগুলাম।
সামনের উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চেরিব্লসম দেখে চোখে মেঘকেটে আলো জ্বলে উঠল। ফুলের গাছে কোন পাতা দেখা যাচ্ছে না, শুধু ফুল আর পাপড়িভরা যৌবনবতী গাছ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মত বিস্ময় নিয়ে গাছতলে ঝরা ফুলগুলোও দেখছি। বাতাসের ঝাপটায় পায়ের কাছে এসে অস্ফুট কণ্ঠে ওরা যেন বলে উঠল__ ‘ঝরে যেতে হবে একদিন!’ তাদের কথায় আমার সকালটা ক্ষণিকের জন্য মলিন হয়ে গেল। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম, হাঁটুগেড়ে বসে একমুঠো তুলে নিলাম হাতে। কোমল ফুল পাপড়ি হাতে নিয়ে আমি হারাতে শুরু করলাম দূরে, বহুদূরে কোথাও….। সেই কুয়াশা ভেজা ষোড়শী ভোর, ঘাসের আদরে নগ্ন পায়ের হিমশীতল শিহরণ। আঁজলা ভরে শিউলি তুলে বাড়ি ফিরে এসে বোনের বকুনি। আহা, স্মৃতিগন্ধা কৈশোর। মন চাইলেই যেতে পারি, কেবল ছুঁতে পারি না।
এতক্ষণ পর সকালের নীরবতা ভেঙে দূর থেকে কানে আসল__ “গু…..ড মর্নি!” চেনা কণ্ঠে চেনা ডাক শুনে আমিও তাকিয়ে হাত তুললাম। তিনি রবার্ট ফ্রস্ট, পাশের নেইবারহুডে থাকেন। আদিবাড়ি আমেরিকায়। ভীষণ প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ। মাঝে মধ্যে দেখা হয় বিকেলে হাঁটতে বেরুলে। রাস্তার ঐপাড় থেকে তিনি আসছেন আমার দিকে। ফুটপাথের দুই পাশে সাদা পাথর আর কাঠের গুড়ি দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে বড় বড় গাছ, ম্যাগনোলিয়া, ম্যাপল আর দেবদারু। বিটপী পল্লবে ওখানে ইডেন পাখির বাস দীর্ঘদিনের। রবার্ট ফ্রস্ট বড় বড় পা ফেলে আমার কাছে আসছেন। কাছে এসেই ফিসফিস করে বললেন_
‘কার জন্য ফুল কুড়াচ্ছ ডার্লিং?’
অপ্রস্তুত আমি নির্দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে দিলাম তাঁর দিকে। মৃদু হেসে বললাম_ ‘এই নাও তোমার জন্যেই!’ তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন, পকেট থেকে হাত বের করে ফুলগুলো নিলেন খুব যত্ন করে। আমার হাতে হাত লাগতেই হতচকিয়ে বলে উঠলেন__ ‘এ কী তোমার হাত এতো ঠান্ডা কেন?
হাত মোজাও পরোনি দেখছি। জানোতো, ঋতুবদলের সময় এখন, ডোন্ট ক্যাচ কোল্ড, যাও যাও ভেতরে যাও!’ এই বলে আমাকে বাসার দরজার দিকে ঠেলে দিলেন। আর তিনি কবিতা আওড়াতে আওড়াতে আড়ালে চলে গেলেন…
“Two roads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both”
তাঁর আদুরে কথাগুলো শুনে আমার মনে হয় ঠান্ডাটা বেড়েই গেলো। তাঁকে বিদায় দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকলাম। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে পুরোনো গন্তব্যে ফিরি, শোবার ঘরে যেখানে উষ্ণ বিছানা অপেক্ষা করছে। কম্বল দিয়ে নিজেকে পুরো ঢেকে ফেললাম। তবুও যেন ঠান্ডা কমছে না। ওম খুঁজতে হৃদেশের পিঠের কাছে ঘেঁষলাম। তবুও ঠান্ডা লাগছে! ঠান্ডা হাত দিয়ে হৃদেশকে জড়িয়ে ধরতেই সে নড়েচড়ে উঠল। জড়সড় আমি এখনো শীতে কাঁপছি, আর ঠোঁট কেঁপে কেঁপে নিশ্বাস নিচ্ছি। হৃদেশের ঘুম জড়ানো কণ্ঠের জিজ্ঞাসা__ ‘কী হলো, কাঁপছো কেন?’ বন্ধ চোখে, ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম__ সামনের উঠোনে ঝরা চেরিফুল তুলতে গেছিলাম, করপুট ছুঁয়ে থাকা বেগুনি গোলাপি মায়াবী পাপড়িদের ছেড়ে আসতে পারছিলাম না। স্পর্শের উষ্ণতায় তখন বুঝিনি, এখন খুব ঠান্ডা লাগছে! বাইরে হালকা হিমেল বাতাসও ছিল, এজন্য হয়ত… ।
এবার হৃদেশের সত্যি ঘুম ভেঙে গেল, চট করে আমার দিকে পাশ ফিরল, চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে তার জিজ্ঞাসা__ ‘বাইরে কখন গেলে? তাও আবার এতো রাতে? …কেন?’
একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন জড়ানো শঙ্কিত মায়া ছাড়া এরপরের ঘটনা আমি আর কিছুই মনে করতে পারছিনা।