ছায়াময়
উৎপল মান
বহুদিন পর বকুল গ্রামে এসে দেখল সে-গ্রাম আর নেই। রাজবাড়িটা তেমনই আছে। ভাঙাচোরা। মানুষগুলোও। পুরনো রাসমন্দিরে সাপ ঘোরাফেরা করত একটা সময়। আগাছার প্রভাবে বর্ষার সময় জায়গাটাকে মনে হত বন। সামনের যে পুকুরে, গ্রামের যে কোনও বিয়ে বাড়িতে, মেয়েরা জল সইতে আসত- সেখানেও এক প্রাচীনতা বিরাজ করত।
ছোটবেলা থেকেই এই রাজবাড়ির প্রতি বকুলের এক অমোঘ টান। মস্ত আটচালায় গানের আসর বসত। দোল উৎসবে কতবার বকুল ওখানে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে দেখতে পেয়েছে সেই কোন আমলের রাজার সিংহাসন, ঘোড়াশাল, হাতিশাল। অজস্র পরিচারক-পরিচারিকা। পালকি রাজা-রানির। ঠাকুরমার কাছে শোনা কথাগুলো কেমন দৃশ্য হয়ে ফিরে ফিরে আসত।
লোহার গেট পেরিয়ে সিংহদরজা। দরজার ভেতর দিকে রাজার পূর্বপুরুষদের বিশাল বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। কী সব ব্যক্তিত্বময় ও গাম্ভীর্যে ভরা সেসব ছবি! বকুল দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে ভাবত সেই ইতিহাসের কথা। যুদ্ধের কথা। জাঁকজমকের বর্ণাঢ্য পরিবেশ। তাদের এই গ্রামেই তো ছিল একদিন এইসব। কিন্তু আজ এসব ছাড়িয়ে মন ঠিক কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় অন্য এক অভিনিবেশে।
এখন রাজবাড়িটা আছে একখানা পোড়ো বাড়ির মতো। লোকজন থাকেন। উত্তরাধিকার থাকেন। এখনও নিত্য পূজা করে যান গ্রামের পুরোহিত। ঠাকুরবাড়ির বাইরের দালানে সেই পুরনো ঝাড়লন্ঠন ভাঙাচোরা অবস্থায় আজও লোহার আঁকসিতে ঝুলছে।
বকুল কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। ভাঙ্গা ঝাড়বাতির দিকে তাকাল। শারদীয়া পুজো শেষে এক অলীক নিস্তব্ধতা ওখানে। কিছু ঝুরো পাতা আর খড় দিয়ে পাখির একটা বাসা। ঝাড়লন্ঠনে বাসা করে দিব্যি আছে পাখিরা।
‘কী দেখছ এত মনোযোগ দিয়ে বকুলদি?’
‘অন্য একটা পৃথিবী। অন্দরমহল। ছোটবেলায় ঠাকুমার সাথে রাজবাড়ির অন্দরমহলে এসেছি দু-একবার। রানি বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। একজন বয়স্কা মহিলাকে সবাই বলত রানি। অন্দরমহলের ভেতরে স্নান করার পুকুর। নীল জল। রাজবাড়ির মেয়েরা স্নান করত। ঠাকুমার সময়ে রাজবাড়ির মেয়েরা নাকি বাড়ির বাইরে খুব একটা বের হতেন না। তবে আসল রাজার কাহিনি ঠাকুমারও শোনা অন্য কারও কাছ থেকে।’
‘আরে আমি বলছি ওই ঝাড়বাতিটার দিকে তাকিয়ে কী দেখছ?’
‘ওটাই তো বলছি। পাখি তো মুক্তির দূত। ওরা যেমন ঘরের অন্ধকারে ঢুকে পড়েছে আর অন্দরমহলটাও কেমন বেরিয়ে এসেছে বাইরে।’
‘বাইরে চলো, নতুন রাসমন্দির দেখবে।’
বকুল চোখ বুজে দেখতে পেল আবার, পলেস্তারা খসে পড়া মন্দিরের গায়ে গাঢ় সবুজ শ্যাওলা। বট ও অশ্বত্থের চারা উঠে গেছে লকলকিয়ে। গাছের গায়ে সাপের খোলস রৌদ্রে ঝকমক করছে। মন্দিরের আশেপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে সে। পিছনে দেবাদিত্য ঝোপের উপর ওকে শুইয়ে দিচ্ছে। দেবাদিত্যর শরীরে খুব শক্তি ছিল। কিছুতেই ওর সাথে পেরে উঠত না সে। ঝোপের উপর শুয়ে দেবাদিত্যর শরীরের ভার সে নিতে পারত না। আরও একটা ভয় তাকে ঘিরে ধরত- যেন মন্দিরগুলো ওদের গায়ে ভেঙে পড়বে। ঝোপের তলায় লুকিয়ে থাকা সাপ ওকে ছোবল মারবে। কিন্তু বাস্তবে কেউ ছোবল মারত না। না সাপ, না দেবাদিত্য।
মন্দিরের গায়ে এখন টেরাকোটার কাজ। চারদিকটা সাফসুতরো। নানা ফুলের গাছ বাউন্ডারির ভিতর। ছোট একটি রাসমঞ্চ। বহু বছর ধরে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজাদের আমলে একসময়। সেই ঐতিহ্য কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের ছেলেদের একটি কমিটির হাতে এইসবের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন রাজার বর্তমান বংশধরেরা। কোনও না কোনও অনুষ্ঠান হয় উৎসবের এই সাতটা দিনে। এবারেও হবে। বকুলকে গান গাইতে হবে একটা দিন। কিন্তু রাসমেলা শুরু হওয়ার দিন দশেক আগেই গ্রামে এসে পড়েছে সে। গান গাওয়ার আমন্ত্রণ তো কয়েকদিন পরে, তবে এখন কেন এল? বকুল জানে না। সত্যিই কি জানে না, নাকি এতদিন পর গ্রামে আসার কথা ভাবতেই অনেক কিছু হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, আর তাই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি?
এখন পুজোর ছুটি চলছে। বকুল একটি কলেজে চুক্তিভিত্তিক মিউজিকের টিচার। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি টান। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছে। এম মিউজিক। গ্রামে খুড়তুতো বোন, মধু ছাড়া আর কেউ নেই তেমন নিকট আত্মীয়। কিছুটা বেশি বয়েসে বিয়ে করা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মধুকে বকুল কতবার বলেছে ওর কাছে শহরে চলে যেতে। মধু গ্রাম ছেড়ে যেতে পারেনি।
‘চল নামবি?’
‘অনেক জল বকুলদি।’
‘জলের ভেতরে তো সিঁড়ি আছে।’
‘আছে, সত্যি?’
‘হ্যাঁ, বহুদূর অব্দি। ভেতরে প্রাসাদ। শ্বেত পাথরের তৈরি। জমজমাট সব ঘরগু্লো। সেখানে তানপুরা হাতে কোনও এক রুপসী আশ্চর্য মগ্নতায় গান গাইছে। এই গানের শেষ নেই। গান নাকি কান্না কে জানে!’
‘তুমি কি হিপটোনাইজড বকুলদি?’
‘চল নামবি? আদিগন্ত উঠোনের শেষে দেয়াল ঘেঁষে অসংখ্য গাছ। দেবদারুর লম্বা সবুজ শীর্ষগুলি যেন সূর্যকে ছুঁয়ে আছে। সূর্য থেকে উত্তাপ পেড়ে এনে সেই রূপসীর গায়ে বিলোচ্ছে। আর রৌদ্রে সেই অমল সঙ্গীত ধবল পালের মতো ভেসে আছে।’
‘বা বকুলদি, তুমি তো বেশ ছবি আঁকতে পার!’
‘আর সেই প্রাসাদের পিছনে নদী। ছাউনিওলা ঘরের মতো রঙিন নৌকা বাঁধা ঘাটে। নৌকার বাঁধন খুলে দিলে সে-গানকে ও নিয়ে যাবে বহু দূরে। অনেক অনেক দূরে।’
‘তাহলে চলো, নামি। সিঁড়ি সিঁড়ি নেমে যদি প্রাসাদ বা সেই মেয়েটিকে না পাই, তুমিই গান ধরবে তখন। দেখবে দেবাদিত্যদা মহাসিন্ধুর ওপার থেকে তোমার জন্য নৌকা নিয়ে প্রস্তুত।’
‘পাগলি! তা তুই বিয়ে-থা করলি না কেন রে মধু? ঘরের জমিজমা দেখতে দেখতে ল্যান্ডলেডি হয়ে গেলি। সংসার কর। জীবনে পুরুষ মানুষের প্রয়োজন আছে।’
‘বাপ্পাদিত্যদার কথা তুমি এড়িয়ে যেতে চাইছ, তাই না? আমি তো জানি সেইসব ইতিহাস।’
‘ইতিহাস!’
‘জীবন কেমন এঁকেবেঁকে চলে! কত বাঁক, কত রহস্য। তোমার কলেজ-জীবন তো বেশ রঙিন ছিল বকুলদি। তুমি যখন মিউজিক নিয়ে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হলে আমি তখন ছোট, স্কুলে পড়ি। তখন তো তুমি দেবাদিত্যদার কথা প্রায়ই বলতে। তোমার সাথে দেখা করতে যেত হোস্টেলে। তোমরা একদিন কোথাও পালিয়ে গিয়ে…’
‘বাদ দে মধু।’
‘বা রে, তুমি বললে না নামবে? এই তো নামছি, সিঁড়িগুলো দেখতে পাচ্ছি। কত রকমের অদ্ভুত সব সিঁড়ি! আমাদেরকে কেবলই নিয়ে যায় ডুবোপথে। তলিয়ে দেয়।’
বকুল পুকুরের পাড় ধরে যেতে যেতে পাকা রাস্তায় এসে থামল। রাস্তার ওদিকে নির্মিত অরণ্য। অরণ্যের মাঝে যমুনা বাঁধ। এ সবই রাজাদের সম্পত্তি। বাঁধের পাড়ে আগে মেলা বসত পুজো-পার্বনে। তখন এত গাছ ছিল না এখানে। এই গাছগুলো কি ব্যবসার কারণে লাগিয়েছেন রাজবাড়ির লোকেরা। হয়তো বড় হলে কাঠ বিক্রি করে দেবেন। যা শোনা যায় তাতে তো জমি-জায়গা, পুকুর, বাগানবাড়ি সব ধীরে ধীরে বিক্রি করে দিচ্ছেন রাজার এই প্রজন্মের সদস্যেরা। পরিবারের তেমন কেউ বড়ো ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরি করেন না। বকুলের আরও আশ্চর্য লাগে, এ বাড়ির একজন যুবতী সিভিক পুলিশ! আট হাজার টাকা মাইনের চাকরি করে। হা রে রাজবাড়ির মেয়ে!
মধু পিছনে এসে দাঁড়াল। ‘আজ সারাদিন ঘুরতে থাকবে নাকি? আমি জানতাম, তুমি গ্রামে এসে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়বে। মন খারাপ করবে।’
‘না রে, মনখারাপের ভেতরে ভালো কিছু একটা থাকে। এখন মনে হচ্ছে জীবনের প্রিয় দিনগুলো প্রিয় ধ্বনিগুলোকে ভুলে থাকাটা অন্যায়। এই মনখারাপ, এই বেদনাও তো সম্পদ।’ বকুল এরপর প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘মধু তুই কি কাউকে ভালবাসিসনি?’
‘হ্যাঁ বেসেছি। রোগগ্রস্ত বাবা-মাকে, যতদিন বেঁচে ছিল। বিএড কলেজের এক পার্টটাইম শিক্ষককে। তখন আমি লাইব্রেরিয়ান ছিলাম ওই বেসরকারি কলেজের। আর এক অন্ধ তবলাবাদককে।’
‘বাবা, দীর্ঘ তালিকা!’
‘তালিকায় আরও আছে বকুলদি’, বলে হাসল মধু। ‘তবে সেগুলো ঠিক ভালোবাসা না- আকর্ষণ, শরীর, খেলা।’
বকুল চকিতে মধুর দিকে তাকায়। ওর হাত টেনে ধরে রাস্তা পেরোয়। বাঁধের গায়ে গাছপালার মধ্যে ঢুকে পড়ে। আর ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হঠাৎ জানতে চাইল, ‘বিয়ে করলি না কেন?’
‘কেউ কি আমাকে বিয়ে করতে চায় বকুলদি! বয়স তো একটা ফ্যাক্টর। এখন আমাকে চায় যারা তাদের অনেকেরই নজর আমার সম্পত্তির ওপর। জমিজায়গা, বাড়ি এবং আরও কিছু মিলে যে আর্থিক নিশ্চয়তা, তারা ভাবে এই অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে রাজকন্যা না হোক, রাজত্ব তো মিলবে।’
‘আছে রে, মনের মানুষ আছে।’
‘এবার তুমি বলবে তাকে খুঁজতে হয় মনের ভিতর, তাই না?’
‘সত্যিই তাই নয় কি?’
‘ধুর, আমি তোমার মতো ঘোরের মধ্যে থাকি না। জীবনের বাস্তব এক জিনিস, আর স্বপ্ন অন্য জিনিস। সে তো তুমি বুঝেছ বকুলদি। বাপ্পাদিত্যদা কোথায় হারিয়ে গেল, চলে গেল। আর তুমি অন্ধ গায়কের মতো গান গাইতে থাকলে। দেখলে না তোমার সামনে কোনও অডিয়েন্স নেই!’
‘কিন্তু ওই গান গাওয়ার আনন্দটা তুই উড়িয়ে দিতে পারবি মধু?’
‘সে-আনন্দ যে কোথায় হাপিস হয়ে গেল বকুলদি! বয়স বাড়ল ধীরে ধীরে। এত পরে বিয়ে করে কি পেলে বলো? বিবাহিত পুরুষটিও তো তোমাকে তেমন করে বুঝতে চাইল না।’
যমুনার বাঁধে স্বচ্ছ জল। এত বড় বাঁধ। টইটম্বুর জল। এ বছর বর্ষার সময় বৃষ্টি হয়নি ভালো। কিন্তু দুর্গাপুজোর আগে এবং পরে বেশ ভালো বৃষ্টিপাত হয়েছে। যারা সাহস করে অল্প বৃষ্টিতে ধান রোপন করতে পেরেছিল তাদের জমিতে চাষ কোনোক্রমে হয়েছে। আশেপাশের কিছু জমিতে ধানে পাক ধরেছে। নভেম্বরের প্রথম দিক।
জলে গাছপালার প্রভূত ছায়া। যেন ছায়ানগরী। প্রাচীন তরঙ্গ নিয়ে খেলা করছে জলের ভিতরে। বেজে উঠছে গান। বকুল কান পেতে আছে। পেতে দিয়েছে হৃদয়। মধুর কথাগুলো তার কানগোড়ায় এসে বিলীন হয়ে গেছে বনের বাতাসে। এখন শুধু নিঃশব্দ তরঙ্গের খেলা জলের ভিতরে। অল্প জ্বলে গাছের পাতা জমা হতে হতে সামনের দিকটা কেমন বাদামি হয়ে আছে। কিন্তু দূরে আশ্চর্য এক প্রবীণ গভীরতা। এই বাঁধের তীরে পৃথিবীটা যেন উবু হয়ে বসেছে। প্রবীণ মানুষের মতো এতখানি তার নিবিড়তা।
একটু উঁচু মতো জায়গায় জলের ওপরে পা ছড়িয়ে বসল দু’জনে। নামতে হলে গভীর জলে নামাই ভালো। ভাবতে ভাবতে ছায়ানগরীর ভেতর ডুব দিল বকুল।
ও কার ছায়া, কাদের ছায়া! ছায়ারা মস্ত বড়ো উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলছে। একদিকে এক রাজকীয় যুবক। অন্য প্রান্তে একটি যুবতী। মাঝে নেট। ককটা ওখানে আটকে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ছাড়িয়ে নিয়ে ওরা আবার তাকে আঘাত করে শূন্যের ভিতরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ধরা পড়ছে অন্য ব্যাটে।
‘বকুলদি।’
‘কী?’
‘আমি কিন্তু লাইফটাকে নিতে শিখেছি, অ্যাজ ইট কামস টু মি। তোমার কাছে রাখঢাক না করাই ভালো। আমি কিন্তু বেপরোয়া। আমার তো কিছুর অভাব নেই, সুতরাং নিজেকে বঞ্চিত করে লাভ কী। ভালোবাসা-টালোবাসা আর হবে না এ জীবনে। কিন্তু ওই যে তুমি বললে না তখন, জীবনে পুরুষের প্রয়োজন আছে।’
বকুল ছায়ানগরী থেকে সরিয়ে নিল চোখ। একাগ্রতা। যেন জলে ছিপ ফেলে ফাৎনা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না- এমন এক বিহ্বলতা নিয়ে মধুর দিকে তাকাল। এখনও ঝকঝকে চোখ-মুখের লাবণ্যে ভাটা পড়েনি ওর। স্বাস্থ্য অটুট। তবু মানুষের বয়স বেড়ে চলে গোপনে। তা বাড়লেই কী। মনের আকাঙ্ক্ষা কখনও মেটে কি! কামনার আগুন এখনও বহুদিন জ্বলবে। তা মেটাতে চাইলে পাপ কোথায়?
বকুল বলল, ‘ভালো তো, সেন্টিমেন্টাল ফুল না হয়ে থাকাই ভালো। জীবনের কাছে হেরে গিয়ে লাভ নেই। যা করছিস হয়তো ঠিক। চারদিকে অঢেল আনন্দ, আশ্চর্য হাতছানি। জীবনকে লুটেপুটে খাওয়াই হয়তো ঠিক। মিছিমিছি কেন নিজেকে লোক-দেখানো আড়ালের ভেতর রাখা।’
মধু এবার বকুলের হাতে চিমটি কাটল। ‘অনেক বড়ো বড়ো কথা শুনলাম। কিন্তু নিজের বেলা?’
‘অযথা এক স্বপ্নের ভিতরে আছি, বেদনার ভেতর।’ বলতে বলতে বকুল আবার জলের ভেতর গাছের ঐন্দ্রজালিক ছায়ার দিকে দৃষ্টি রাখল। বলল, ‘গানের একটা লাইন কেবলই আমার মনে পড়ছে জানিস।’
‘কোন লাইন?’
‘এ আলোতে এ আঁধারে, কেন তুমি আপনারে ছায়াখানি দিয়ে ছাও।’
‘রবীন্দ্রনাথের গান তোমার মাথাটা খেয়ে ফেলেছিল সেদিন বকুলদি। আজও তুমি ওই প্রেমে আছ। বাপ্পাদিত্যদা কোনও দিন ফিরবে না আর জেনে রাখো।’
‘চল ওঠা যাক, সন্ধে হয়ে এল প্রায়। আর তাছাড়া বাড়িতে তো আজ আসর জমবে রাত্রে, তাই না?’
মধু হঠাৎ জোরে হেসে উঠল। এই নির্জন জায়গায় এমন উচ্চহাস্য খুব স্বাভাবিক মনে হল না যেন। ঝটপট করে কিছু পাখি গাছ থেকে গাছে উড়ে গেল। জল যেন কেঁপে উঠল। মায়াবী ছায়ারা নড়ে উঠল। বকুল মধুর দিকে সবিস্ময়ে তাকাল, কিন্তু একটি কথাও বলল না।
মধু কিছুটা উন্নাসিক হয়ে বলল, ‘তুমি ওখানে একা একা থাক কী করে বকুলদি? যখন হাজব্যান্ড ছিল তখন না হয় ঠিক ছিল। কিন্তু এখন তোমার জীবন থেকে ভ্যানিশড বিয়ে করা পুরুষ, ভ্যানিশড হয়ে গেছে বাপ্পাদিত্যদা। এই বয়সেও যথেষ্ট অ্যাট্রাক্টিভ তুমি। জাস্ট এনজয় বকুলদি।’
বকুল হাঁটতে লাগল। মধুও। ঘরে ফেরাই ভালো, না হলে মধুকে সামলানো মুশকিল। কিন্তু ঘরে তো মধু ওকে একাই পাবে। আরও বিস্ফোরক হয়ে উঠবে না তো? এভাবে সে কেন আসতে গেল! ছায়াময় অতীতটাকে আবার খনন করার কী প্রয়োজন ছিল তার? মধুটা কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আজ এতটা পাগলামি কেন রে? আমার এই ছায়াজীবন কি তোকে কোনওভাবে প্রভাবিত করছে?’
আবার হেসে উঠল মধু। ‘পাগলামি কাকে বলে তুমি দেখবে আজ বকুলদি?’
‘তার মানে?’
‘তোমার ভেতরে গভীর জলতল। অসংখ্য সিঁড়ি। ইচ্ছে হলেই তুমি নেমে যেতে পার। কাল্পনিক অবগাহনে তুমি আনন্দ পাও। তুমি এখন এক অসুস্থ মনোজগতে বাস করছ বকুলদি। এভাবে জীবন চলে না। আমি কিন্তু প্রকৃত অবগাহন চাই। আই উড লাইক টু ড্রিঙ্ক লাইফ টু দ্য লিজ।’ হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ির কাছাকাছি আসতেই বকুল টের পেল মধু কখন এগিয়ে গেছে। যাক। মেয়েটা বড়ো উতলা হয়ে উঠেছে আজ। বকুলের মনে হল মধুর বিদ্রোহআসলে নিজেরই বিরুদ্ধে। প্রতিটি মানুষকে বোধ হয় নিজের সঙ্গেই সবথেকে জোরালো লড়াইটা করতে হয়।
বকুল দাঁড়িয়ে পড়ল রাজবাড়ির দরজার কাছে। শিউলি ফুলের গন্ধ বাতাসে। গেটে আলো নেই। হায় রাজবাড়ি! গেটের মাথায় ভাঙাচোরা সিংহ- দর্পহীন, নখদন্তহীন দাঁড়িয়ে আছে। শিউলি গাছটা কোথায়? ছোটবেলায় দেখা সেই গাছটার কি মৃত্যু হয়নি আজও!
দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। লোডশেডিং নিশ্চয়। শিউলির গন্ধ বাতাসে শুশ্রূষার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বকুল সিংহদরজার ভেতরে এসে থমকে দাঁড়াল। রাস্তা দিয়ে একটা বাইক তীব্র আলো জ্বালিয়ে চলে গেল। বকুল আরেকটা দরজা পেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল। মাঝের আটচালা অন্ধকারে নিমজ্জিত। পশ্চিম দিকে আবার দরজা। ওখানে রাজার এই প্রজন্মের প্রায়-মৃত সব সদস্যরা থাকেন। দরজা খুলে কেউ যেন বেরিয়ে এল। থুত্থুরে অন্ধকারে এসে বসল। বকুল ঝটিতেই চিনতে পারল, এই সেই পাগলা বুড়ো না! দেখা হলেই প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলত। এখনও ওরকমই বুড়ো আছে লোকটা। বকুল প্রাচীন মানুষটার পাশে গিয়ে বসল।
বুড়োটা বলল, ‘ধরা পড়েছে।’
‘কে?’
‘ওই যে সেই পুরোহিত। রাজবাড়ির অষ্টধাতুর বিগ্রহ চুরি করেছিল গো, ও ধরা পড়েছে। আর ওই খুনিটাও ধরা পড়েছে।’
‘কে খুন হয়েছিল আবার?’
‘ওই যে সেই ছেলেটা গো, এ বাড়ির। কতদিন আগে। তোমার মনে পড়বে কী করে!’
‘কী নাম?’
‘নাম কী ছাই আর মনে আছে দিদিমণি! সেই যে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিল মনে নেই তোমার! রাজার বংশ বলে কথা। গ্রামের যে কোনও মেয়েকে বিয়ে করা চলে, বলো?’
‘কে খুন করল ছেলেটাকে?’
‘অনার কিলিং, বুঝলে গো। ঘরের লোকই করেছে। ওই তো অন্দরমহলের নীল অন্ধকার, নীল জল। ডুবিয়ে গলা টিপে গো।’
বকুল চিৎকার করে ওঠে। বকুল সপাং সপাং স্ম্যাশ-শটের শব্দ পায়। নেটে আটকে যাওয়া ককের গলা ধরে আবার ওটাকে শূন্যে পাঠিয়ে দেয় কেউ। বকুলের চোখে ভেসে ওঠে নীল জল, রানি, স্নান, চিৎকার চিৎকার চিৎকার।
বকুলের চিৎকার উঠোনের চারপাশে রাজবাড়ির বৃহৎ সীমানায় ধাক্কা মেরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সেই শব্দ, শিউলির গন্ধ আর এক থুরথুরে অন্ধকার ছাড়া সেখানে আর কারও অস্তিত্ব অনুভব করতে পারল না বকুল। এতক্ষণ তবে কার সাথে কথা বলছিল সে! বকুল দ্রুত বেরিয়ে এল ওখান থেকে। বাইরে রাসমঞ্চে আলো জ্বলছে। দ্রুত পা চালায় বকুল।
বাড়িতে এসে দেখল এক অন্ধ তবলাবাদক মধুকে তুমুল বাজাচ্ছে। আর মধু এক স্বর্গীয় পিপাসায় নিজেকে ধ্বনিত হতে দিচ্ছে। সুযোগ্য সঙ্গত।
বকুল সরে এল। অপেক্ষা করতে লাগল বাগানে। তারপর ছাদে উঠে এসে দেখল একফোঁটাও অন্ধকার নেই কোথাও। চাঁদের আলো ফিনফিনে এক কোমল মাখনের আস্তরণ মাখিয়ে দিয়েছে চরাচরে। সমে ফেরার চেষ্টা করল বকুল। কেমন এক স্বপ্ন এবং দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে সারাটা দিন আজ কেটে গেল। চারদিকে এই জগৎটার কোনও অভিঘাত এই আবিষ্ট মুহূর্তগুলোয় যেন স্পর্শ করতে পারে না ওকে। আকাশের দিকে তাকাল বকুল। গানের লাইন মনে পড়ল- ‘নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা।’ তার মানে সমে ফিরছে ও। কিন্তু সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ও কে? মধুও কি তবে সমে ফিরল?
মধু পাশে এসে বসল। এখন আর বেজে ওঠার শব্দ নেই। সারা পৃথিবীটা এখন নিস্তব্ধ। আশ্চর্য নীল ডানার আকাশ। ছলনার দ্যুতিময় চাঁদ। নীচে অন্ধকার আর আলোয় ভরা গাছপালার কালচে-সবুজ কুহেলিকাময় বেষ্টনী সারা দিগন্তজুড়ে। দুই বোন মুখোমুখি। একটা সুর যেন ঘনিয়ে উঠল। দু’জনেই তা টের পেল। এই সুর আনন্দ, না কি বিষাদের! বুঝে ওঠার আগেই প্রবলভাবে কান্নার এক অপার নদী ওদের বুক উথলে উঠে এল।
সারা পৃথিবী না হোক, ছাদে এই স্বপ্নের আবেশ প্রত্যক্ষ করল দুটি বোনকে- একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বাতাস ফাটিয়ে তারা অলৌকিক কান্না কেঁদে যাচ্ছে। সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে সেই কান্না শুনতে শুনতে তার বাদ্যে কোনও নতুন বোল ফোটানোর কথা ভাবতে লাগল মায়াময় এক অন্ধ তবলচি।