গুজব
মোস্তফা তানিম
পঁয়তাল্লিশ মিনিট মাংস কষানোর পরে বেশি পানি দিয়ে আরও প্রায় ঘন্টা খানেক সিদ্ধ করতে হয়। তখন খানিকটা অবসর পাওয়া যায়। সেই অবসরে লুবনা ভয়ে ভয়ে দেশে ডায়াল করে। তার আব্বুর বয়স পঁচাত্তর, আম্মুর আটষট্টি। তারা হাই রিস্ক। তার উপর আব্বুর ডায়েবেটিস, প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রামের মেটফরমিন খেতে হয়। আম্মুর শরীরও ভালো না, লো ব্লাড প্রেসার। লো ব্লাড প্রেসার হাই ব্লাড প্রেসারের থেকেও খারাপ।
তাও ভালো দুজনের কারো করোনা হয় নি। তাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বার হাজার মাইল দূর থেকে লুবনাকে খবর নিতে হয়। যদি জিজ্ঞেস করে ব্লাড সুগার মেপেছ কিনা, তার উত্তর হলো, “শরীর তো ঠিকই আছে।”
“কি খেয়েছে সকালে।” কাল তার উত্তরে পাওয়া গেলো, “চিড়া আর দই।” ডায়েবেটিসের রোগী মিষ্টি দই খাবে কেন? উত্তর, সেটা নাকি খেজুরের গুড় দিয়ে মিষ্টি করেছে। খেজুর আর আখের গুড়ের মিষ্টিতে উপকার আছে। এনেছিলেন তার বেয়াই, মেজ ভাইর শ্বশুর। তিনিও বলেছেন একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না। এমন “একদিন খেলে কিচ্ছু হবে না” মানুষ প্রতিদিন অন্ততঃ একজন পাওয়া যাচ্ছে। তারা কেউ ডাক্তার নন, কিন্তু ডাক্তারের চেয়ে ভালো বোঝেন। যেমন মেজভাইর শ্বশুর রিটায়ার্ড এয়ারফোর্স অফিসার। শরীরের বিষয়ে তার পরামর্শ রিটায়ার্ড বায়োলজি অধ্যাপক শুনছেন। কেউ যদি নিজের শরীর নিজেই ঠিক রাখতে না যায়, তার জন্যে কী ওষুধ লুবনা বুঝতে পারে না। যেভাবে আত্মীয় স্বজন বেড়াতে আসছে, তাতে করোনা কোনদিন হয়ে যায়, কে জানে?
তিনি ভ্যাক্সিনও নিতে চাইছেন না।
তাঁর এক উত্তর, “নাঃ, এস্ট্রাজেনেকা ইন্ডিয়ায় তৈরী, আমাদের দেশের মতোই একটা দেশ। কি না কি দিয়ে রেখেছে? ”
প্রতিদিন এই নিয়ে লুবনার মেজাজ খারাপ হয়। তার আব্বু এমনকি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বাস করা শুরু করেছে! আর্টিফিসিয়াল জেনেটিক মেটেরিয়াল, সেটা ঢুকবে শরীরে! যদি জেনেটিক কোনও পরিবর্তন শুরু হয় যায়? কোনও দেশ যে কোনোও ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছে না, তাই বা কে বলবে? তিনি কালিজিরাও খাওয়া শুরু করেছেন। এলোপেথির উপরে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। জীব বিজ্ঞানের এক সময়ের ডাকসাঁইটে অধ্যাপকের আজ ভ্যাক্সিনের উপরেও ভরসা নেই। তার ভরসা অবসরপ্রাপ্ত বন্ধু বান্ধবদের পরামর্শের উপরে।
মা ফোন ধরলো। প্রথমেই লম্বা একটা কাহিনী। কাহিনীর বিষয়বস্তু হলো ময়না বলা নেই কওয়া নেই, কাজ ছেড়ে চলে গেছে। লকডাউনের মধ্যে কীভাবে গেলো? লকডাউনে নাকি সব চলছে। মার আশঙ্কা, সে হয়ত তার বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়েছে। কাজের মেয়ে ময়নার শয়তানী আরও বিস্তারিত বলতে যাচ্ছিলো, যেমন তার তিনটা বয় ফ্রেন্ড, সারারাত ফোনে কথা বলতো, এইসব, কিন্তু এদিকে লুবনার চুলার মাংস পুড়ে যাচ্ছে। রান্নার পরে সবাইকে খাইয়ে কাল সকালে সাতটায় যেতে হবে ডিউটিতে। লুবনার রোগীদের মধ্যে যাদের আন্ডারলাইং কন্ডিশন আছে, তাদের সবাইকে সে ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু নিজের বাবা মাকে সে নেওয়াতে পারছে না। “তোর আমেরিকার ব্যাপার আলাদা, ওইসব বাংলাদেশে খাটবে না। সব ভেজাল। ” এই হলো মায়ের কথা। আর বাবার কথা হলো, “সাবধান, জেনেটিক পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে!” লুবনা যখন বলল, “এ তো সেলের নিউক্লিয়াসে যাচ্ছেই না, জেনেটিক চেঞ্জ হবে কী করে? নিরাপদই যদি না হয়, তাহলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেসম্যান, বিলিয়নিয়ার, সবাই ভ্যাক্সিন নেবে কেন?” তাতে বাবা হেসে বলেছিল, “তুই এসব পলিটিক্স বুঝবি না। ”
এদিকে ময়নার ব্যাপারটা থেকে মা বের হতে পারছেন না। ঘটনাটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণও, কিন্তু এই মুহূর্তে লুবনার শোনার মন নেই। “একদিন রাত দুইটায় দেখি ময়না ফোনে…” মাকে থামিয়ে দিয়ে লুবনা বললো,” বাবাকে দাও।”
“তোর বাবা যা করেছে না… ”
লুবনা বললো,” বাবার কাছেই শুনি কি করেছে, আমার সময় নাই। এখানে এখন ডিনারের টাইম মা। ”
“ওহ, মনেই ছিল না। তুই একা সব করিস, জামাই যদি একটু রান্নাটাতেও সাহায্য করতো। তোর বাবা তো এখনো রান্না… ”
“বাবাকে দাও।”
শেষে ফোন হাত বদল হলো। ওদিকে বাবার গলায় খুশির রেশ। “একটা ভালো খবর আছে।”
নিশ্চয়ই নিম পাতার রস খেলে কী কী রোগ সারে, তাই আরেকজন রিটায়ার্ড ব্যাঙ্কারের কাছ থেকে শুনেছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে, সঙ্গদোষ শুধু যৌবনে নয়, বৃদ্ধকালেও সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লুবনা রাগতঃ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “সুগার লেভেল কতো?”
সেকথার উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, “আজকে আমি এবং তোর মা, দুজনেই ভ্যাক্সিন নিয়েছি।”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যা সত্যি। দেখ, অন্য ওষুধগুলো যে খাচ্ছি, তার অনেকগুলোই ইন্ডিয়া, বা ব্রিটেন, আমেরিকা থেকেই আসছে। অক্সিজেন আসছে বাইরে থেকে। তো ক্ষতিকর কিছু দিতে চাইলে ওরা কতোকিছুর মধ্যেই না দিতে পারে। ভ্যাক্সিনের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে দেবে কেন? এখানে শিশুদের টিকা দিচ্ছে না, সেগুলো কি সব দেশের তৈরী? ওর মধ্যেই তো দিতে পারতো? ”
একটা ভার যেন লুবনার বুক থেকে নেমে গেলো। বাবা তাহলে গুজব থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে! এই দীর্ঘ নয় মাসে এটাই বোধহয় তার দেশ থেকে শোনা সবচেয়ে ভালো খবর।