You are currently viewing সাক্ষাতকারঃ ওরহান পামুক এবং অ্যালাইন এলকান/ অনুবাদ- অতীশ চক্রবর্তী

সাক্ষাতকারঃ ওরহান পামুক এবং অ্যালাইন এলকান/ অনুবাদ- অতীশ চক্রবর্তী

সাক্ষাতকারঃ  

ওরহান পামুক এবং অ্যালাইন এলকান

অনুবাদঃ অতীশ চক্রবর্তী

 

পরিচিতিঃ

অ্যালাইন এলকান একজন লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিক যিনি নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন, ২৩শে মার্চ ১৯৫০। তাঁর ইংরেজিতে নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যে রয়েছে জর্ডানের প্রিন্স হাসান বিন তালালের সঙ্গে কথোপকথন ‘টু বি এ মুসলিম’, এবং শিল্পী মাইকেলএঞ্জেলো পিস্তোলেত্তোর সাথে ‘ভয়েস অফ পিস্টোলেটো’, ২০১৪ সালের শরৎকালে যা রিজোলি এক্স লিব্রিস কর্তৃক প্রকাশিত।

আলাইনজা ১৯৮৯ সাল থেকে ইতালীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা লা স্ট্যাম্পার জন্য একটি সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকার কলাম লিখেছেন।  এই কলামে চলচ্চিত্র তারকা এবং পরিচালক; ফ্যাশন ডিজাইনার এবং ব্যবসায়ী; শিল্পী, সংগ্রাহক এবং জাদুঘরের কিউরেটর; রাজনীতিবিদ এবং কূটনীতিক; অর্থনীতিবিদ এবং ঐতিহাসিক; চিন্তাবিদ এবং মানবাধিকার কর্মীরা স্থান পেয়েছেন। বম্পিয়ানি নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা ক্লাসিক সাক্ষাৎকারের ওপরে দুটি বই প্রকাশ করেছে।

অ্যালেন ফিলাডেলফিয়ার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিংশ শতাব্দীর ইহুদিদের লেখকদের বিষয়ে শেখান – তার মধ্যে ফ্রাঞ্জ কাফকা থেকে প্রিমো লেভি, ফিলিপ রথ থেকে আহারন অ্যাপেলফেল্ড আছেন। তিনি অক্সফোর্ড, কলম্বিয়া, জেরুজালেম এবং মিলানের আইইউএলএম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প, ইতালীয় সাহিত্য এবং ইহুদি গবেষণা বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি নিউইয়র্কে দ্য ফাউন্ডেশন ফর ইতালিয়ান আর্ট অ্যান্ড কালচারের (এফআইএসি) সভাপতি এবং ২০০৯ সালে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের পক্ষ থেকে অ্যালেনকে মর্যাদাপূর্ণ লেজিয়ন ডে অনার-এ ভূষিত করা হয়।

ওরহান পামুক একজন তুর্কি ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্যে ২০০৬ সালের নোবেল পুরস্কার পান। তিনি নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ আর্টসের মানবিক বিভাগের অধ্যাপক। তিনি তেত্রিশটি ভাষায় তেরো মিলিয়ন বই বিক্রি করেছেন। গত ২০শে জুন ২০২১ তারিখে অ্যালাইন এলকান ওরহান পামুকের এই সাক্ষাৎকারটি নেন।

নীচে এই সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদটি দেওয়া হল।

 

প্রশ্নঃ ওরহান পামুক, আপনি সবেমাত্র তুরস্কে “Veba Geceleri” প্রকাশ করেছেন, ইংরেজি অনুবাদ করলে শিরোনাম হয় “প্লেগের রাতগুলি”। ঠিক কোভিড -১ মহামারীর সময়ে আপনি প্লেগের রাতগুলি উপন্যাসটি প্রকাশ করেছেন এটা একটু অদ্ভুত নয়?

 উত্তরঃ না না এটা একটা কাকতালীয় ঘটনা বলতে পারেন। আমি কখনই অনুমান করিনি বা ভবিষ্যদ্বাণী করিনি যে এরকমটা হতে যাচ্ছে। এর আগে “হোয়াইট ক্যাসল” নামে একটা বই বেরিয়েছিল তাতে প্লেগের দৃশ্য ছিল। গল্পের পটভুমিকা ১৭তম শতাব্দীর কনস্টান্টিনোপলের ইস্তাম্বুল শহর। প্রায় ৪০ বছর আগে, ১৯৮৩ সালে, আমি “সাইলেন্ট হাউস” লিখেছিলাম, যেখানে একজন ইতিহাসবিদ প্লেগ মহামারী নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। আমার আগের উপন্যাস “দ্য রেড হেয়ার্ড উইমেন” শেষ করার পরপরই আমি নিজেকে বললাম যে আমার প্লেগের ওপর ঐতিহাসিক উপন্যাসটি যদিও খুব বড় একটা প্রজেক্ট হবে তবুও আমার এটা লেখা উচিত। আমি সাড়ে চার বছর আগে যখন লেখা শুরু করেছিলাম তখন আমার বন্ধুরা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে এরকম একটা অস্পষ্ট বিষয় নিয়ে একটি উপন্যাস লিখছি কেন। তারা ভেবেছিল যে কেউ আমার বইটি বুঝতে পারবে না। যাই হোক প্লেগ চলে গেছে এবং মানবতা এই কুৎসিত জিনিসগুলিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল যে আমার বন্ধুরা বোধ হয় সত্যি কথাই বলছে কিন্তু আমি এই উপন্যাস লিখতে একপ্রকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি এই মহামারীটি অনুমান করে এই লেখা কিন্তু লিখিনি। মানবতার এমন কোন ইতিহাস নেই যেখানে মহামারী আসেনি।

প্রশ্নঃ “প্লেগের রাত্রি” লেখার সময় আপনি কি আলবার্ট ক্যামু, আলেসান্দ্রো মানজোনি, ড্যানিয়েল ডিফো এবং অন্যান্যদের মতো লেখকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?

উত্তরঃ অন্য সবার মতো, আমার প্রথম যৌবনে আমি অ্যালবেয়ার ক্যামুর “দ্য প্লেগ” পড়েছিলাম। আমি একজন তরুণ তুর্কি ছেলে, যিনি একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। আমি এই বইটি পড়েছিলাম এবং অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমি আলেসান্দ্রো মানজোনির মহান জাতীয় ইতালীয় মহাকাব্য “দ্য বেট্রোথেড” দ্বারাও বেশি প্রভাবিত হয়েছিলাম। আমার ইতালীয় বন্ধুরা আমাকে বলে যে তাদের উচ্চ বিদ্যালয়ে এটা পাঠ্য ছিল এবং পড়তে হয়েছিল। এখানে প্লেগের ওপর মাত্র পঁয়ত্রিশটি পাতা আছে কিন্তু সেই পঁয়ত্রিশটি পাতা অ্যালবেয়ার ক্যামুর চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। প্লেগের ওপর এটি একটি ভাল উপন্যাস। কিন্তু মহামারীর উপর লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ বই হল ড্যানিয়েল ডিফো। ঐতিহাসিকরা আমাদের বলেন যে “রবিনসন ক্রুসো”-র লেখক ১৬৬৫ সালে লন্ডনে যে গ্রেট প্লেগ হয়েছিল তার ৭০ বছর পরে তার কাকার একটি ডায়েরি খুঁজে পেয়েছিলেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে “একটি জার্নাল অফ দ্য প্লেগ ইয়ার” লিখেছিলেন।

প্রশ্নঃ আপনার কাছে ডিফো ক্যামুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেন?

উত্তরঃ ডিফো মানুষের মনোবিজ্ঞানে মনোনিবেশ করেন, এবং বয়স্ক, যুদ্ধ, প্লেগ দ্বারা আতঙ্কিত গোষ্ঠী এবং আশেপাশের লোকদের সম্পর্কে লিখেছেন। অ্যালবেয়ার ক্যামু প্লেগকে নাৎসি দখলের রূপক হিসেবে চিত্রিত করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন।

প্রশ্নঃ আপনি “রবিনসন ক্রুসো” উল্লেখ করেছেন এবং আপনার নিজের উপন্যাস “নাইটস অফ প্লেগ”-এ আপনি মিংর দ্বীপ বর্ণনা করেছেন, যেটি একটি কাল্পনিক অটোমান দ্বীপ। সেখানে আপনি তিনটি চরিত্র রেখেছিলেন: একজন ডাক্তার, একজন গভর্নর এবং একজন সেনা মেজর। এখানে আপনি প্লেগ বিষয় নির্বাচন করেছেন কেন?

উত্তরঃ আমি ৪০ বছর ধরে মনে মনে প্লেগ নিয়ে একটি উপন্যাস রচনা করছি। যেমনটি আমি আগে বলেছি, যে আমি প্রথমে অ্যালবেয়ার ক্যামুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। যখন আমি তুর্কি অনুবাদে মানজোনির বইটি পড়েছিলাম তখনও আমি খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। আমি বরাবরই ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে পছন্দ করি। তাই আমি প্লেগ বা মহামারীর সময় নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। কিন্তু যে যে কারণে প্রথমদিকে আমি এই নিয়ে লিখব বলে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, গত ৪০ বছরে সেই কারণগুলির অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। শুরুতে আমি মনে করছিলাম এটা এমন কিছু যা মৃত্যুর মুখে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উদ্যম জাগা্বে এবং আমাদের আধ্যাত্মিক উদ্বেগকে জাগিয়ে তুলবে। জীবন, জীবনের অর্থ এবং মানুষ মারা যাচ্ছে কেন, এ সব নিয়ে চিন্তা করতে শেখাবে। যদি উপরওয়ালা কেউ থেকেই থাকেন, তাহলে কেন এই সব ঘটছে? এটা কিভাবে মেনে নেব? যদি আমি ত্রিশ বছর আগে প্লেগ নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতাম, তাহলে মৃত্যু সম্পর্কে উদ্বেগ মানুষের মধ্যে কীভাবে এক ধরণের ব্যক্তিত্ব নিয়ে আসে: কিছু মানুষ কিভাবে অন্তর্মুখী হয় এবং লেখে অথবা কিভাবে কিছু মানুষ কেবলই অযৌক্তিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় তা গল্পে উঠে আসত। আবার অন্যদিকে কিভাবে মানুষ বিবিধ রকমের দলে যোগ দেয়, তাদের বন্ধু, তাদের পরিবা্রের সঙ্গে মিলিত হয় তাও লিখতাম।

প্রশ্নঃ সময়ের সাথে সাথে আপনার জীবনবোধের কি কোন পরিবর্তন হয়েছে?

উত্তরঃ যখন আমি ২০ বছর পরে উপন্যাসটি সম্পর্কে ভেবেছিলাম, তখন অস্তিত্বগত মৃত্যুর উদ্বেগ সম্পর্কে নয়, বরং পূর্ব এবং পশ্চিমের তুলনা করার বিষয় ছিল আমার কাছে প্রতিপাদ্য হয়ে উঠছিল। ১৭তম, ১৮তম এবং 19তম শতকের ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের বইগুলিতে এই ধারণার উল্লেখ ছিল যে তুর্কি বা মুসলমানরা এমন প্রাণঘাতী জাতি, যারা শুধু ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এবং আর কিছু করে না। কিছু সময়ের জন্য আমি এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমার উপন্যাস লিখতে এবং সংগঠিত করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে মূল ধারণা হিসাবে এটিও ম্লান হতে শুরু করে।

প্রশ্নঃ এবং শেষে?

উত্তরঃ শেষ পর্যন্ত আমি চেয়েছিলাম আমার উপন্যাসটি কোয়ারেন্টাইন বা পৃথকীকরণ আরোপের সমস্যা নিয়ে হোক। ডিফো এবং মঞ্জোনির কাছ থেকে আমি এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি শিখেছি, কারণ মানবতা সবসময় একই রকমভাবে আচরণ করে, প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রথমত, রাষ্ট্র মহামারীর মত ঘটনাটিকে প্রথমে অস্বীকার করে, এবং ফলত কাজ শুরু করতে দেরি করে; এবং লোকেরাও এটি প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, বিশেষত দোকানদার এবং ব্যবসায়ী যারা স্বীকার করতে চায় না যে মহামারী রয়েছে এবং এটা রুখতে তাদের লকডাউন করতে হবে, লক ডাউনের মত সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। গুজবও সমস্যাটির একটা অংশ হয়। আমার উপন্যাসটি একটি মহামারী সম্পর্কে চিরন্তন প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করে যা সমস্ত দেশকে গত বছরে সমাধান করতে হয়েছিল। যদি সরকার তার লকডাউন কঠোর করে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় এবং সবাই অভিযোগ করতে শুরু করে। যদি সরকার তা’ না করে এবং জনগণকে বলে যে চিন্তা করো না, কিছুই হবে না, তাহলে আবার অনেক মানুষ মারা যাবে।

প্রশ্নঃ স্বাস্থ্যের চেয়ে ব্যবসা কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তরঃ  না! তা অবশ্যই নয়, মানুষের জীবন হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কিন্তু সরকার, সে গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক যাই হোক, যদি দেখে যে তাদের জনগণ অলৌকিক ভাবে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করছে, ব্যবসা বন্ধ করা অনুচিত বলে মনে করছে অথচ এটাও চায় যে এখনি মহামারী বন্ধ হোক, তখনই সমস্যা, আপনি কিভাবে এ দুটো একসাথে করতে পারেন?

প্রশ্নঃ আপনি কেন আপনার তিনটি চরিত্রকে একটি কাল্পনিক দ্বীপে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন?

উত্তরঃ আমি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ধারাটি রাখতে পছন্দ করি। এটি একটি দ্বীপ হতে পারে, অথবা, আমার “স্নো” উপন্যাসের মতো, এটি একটি তুষারাবৃত দূরবর্তী দেশের একটি ছোট শহরও হতে পারে, যা অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে সভ্যতার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই উপন্যাসে এটি একটি দ্বীপ; এবং একটি মহামারীর কারণে তারা পুরো দ্বীপকে পৃথকীকরণে রেখেছে, দ্বীপের বাইরের কারো সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। প্রেক্ষাপট হিসাবে গল্পের জন্য আমার এমন একটি পরিস্থিতির প্রয়োজন ছিল, যেখানে মানুষ বাকি মানবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কারণ আমার কল্পনা এভাবেই কাজ করে। আমার এমন লোকদেরও প্রয়োজন ছিল যারা এই কাল্পনিক অটোমান দ্বীপে পৃথকীকরণ চাপানোর জন্য দায়ী থাকবে। লেখক হিসাবে এমন একটি কাল্পনিক জায়গা বেছে নেবার স্বাধীনতা আমার আছে এবং গল্পের খাতিরে এটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রশ্নঃ কোন চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি দায়ী: মেজর, গভর্নর বা ডাক্তার?

উত্তরঃ সবসময়ই একজনই দায়ী হবে তা তো হয় না। আর আমি একজন যুবক নই, যে অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়ব এবং সরকার বা কিছু লোককে বিচার বিবেচনা না করে দোষারোপ করে বসব। আমার গল্পে কিছু চরিত্র আছে যারা লোকের মুখে শোনা কথা, গসিপ বা পরনিন্দা পরচর্চা এবং প্যারানয়েড তত্ত্বে বা ভ্রম-বাতুলতা তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। আসলে, আমার উপন্যাস এটাই বলতে চেয়েছে যে দয়া করে প্যারানয়েড তত্ত্বে বিশ্বাস করবেন না।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন যে প্লেগটি কোভিড -১ মহামারীর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল?

উত্তরঃ এটা বিদ্রূপাত্মক এবং বিপর্যয়কর। প্লেগ-এ ব্যাকটেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মধ্যে একজন মারা গিয়েছিল, যেখানে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে, একশজনের মধ্যে একজন মারা গেছে; বিশেষ করে বয়স্করা বেশী মারা গেছেন। অনুপাত দেখুন। একটি তেত্রিশ শতাংশ, এবং অন্যটি এক শতাংশ। এক শতাংশ থেকে তেত্রিশ শতাংশ তুলনা করুন এবং আমাদের মোটেও ভয় পাওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমরা ভীত। আজ একশত লোকের মধ্যে একজন মারা যাবে। কিন্তু তবু আমরা কোভিডকে প্লেগের মতো ভয়াবহ মনে করে ভয় পাচ্ছি।

প্রশ্নঃ কেন?

উত্তরঃ আমরা খুব বেশি জানি। প্রতি রাতে আমরা দেখি মানুষ শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং প্রতি রাতে আমরা খবর পাই মানুষ মারা যাচ্ছে। এক বছর আগে ইতালিতে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছিল, এবং আমরা সবাই  ২৪ ঘণ্টা টেলিভিশনের দিকে চোখ খুলে রাখতাম, হাসপাতাল এবং এই কবরস্থানগুলি দেখছিলাম। এখন আমরা ভারতে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে দেখি; তারা মানুষকে পুড়িয়ে দিচ্ছে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রক্রিয়া হিসাবে। সরকার আমাদের বলছে বাইরে না যেতে, এবং সম্ভাবনা একশ’র মধ্যে থাকলেও আমরা ভীত। এটাতো সে যুগ নয়, সেই অতীতে যখন ইন্টারনেট ছিল না, টেলিভিশন ছিল না, সংবাদপত্র ছিল না, তখন মানবতার মাত্র পাঁচ শতাংশ পড়ালেখা করত। তখন দরিদ্র দেশে বুদ্ধিজীবী ছিল না, তথ্য ছিল না, সংযোগ ছিল না; শুধু লোকমুখে খবর আসত। যখন একটি ভয়ঙ্কর প্লেগ মহামারী শুরু হয়েছিল, ভীত মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল এবং কিন্তু ঠিক কি ঘটছে বুঝতে পারছিল না, ভয় পাচ্ছিল।

প্রশ্নঃ আপনি এই সময়টা মানে গত বছর এবং কিছু মাস কিভাবে কাটিয়েছেন?

উত্তরঃ আমি সাধারণত শীতের শুরুতে (Fall season) নিউইয়র্কে শিক্ষকতা করি, কিন্তু গত বছর আমি মার্চে মানে শীতের শেষ দিকে নিউইয়র্কে শিক্ষকতা করছিলাম। তখন খবর আসছিল যে একটি মহামারী আসার ব্যাপক সম্ভাবনা। একদিন আমি কলম্বিয়ার লাইব্রেরিতে প্রবেশ করলাম। দেখলাম অনেকে হাঁচি দিচ্ছে। আমি আর লাইব্রেরিতে যেতে চাইনি। আমি ইস্তাম্বুলে ফিরে গেলাম এবং ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলাম। আমার কাছে এটা মনে হল- কি কাকতালীয় একটা ব্যাপার যে আমি গত সাড়ে তিন বছর ধরে মহামারী নিয়েই একটি উপন্যাস লিখছিলাম! মনে হল এখন এটি তাড়াতাড়ি শেষ করা দরকার, একটি বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি খুব চিন্তিত ছিলাম, কারণ না হলে অনেক লোক মনে করতে পারে, আমি বর্তমান এবং সাময়িক মহামারী বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য উপন্যাসটি তৈরি করেছি।

প্রশ্নঃ আপনি কি খুব ভয় পেয়েছিলেন?

উত্তরঃ আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম; আমার বয়স ৬৫ এর বেশি, শুরুতে খুব কম তথ্য আমার কাছে ছিল। আমি সত্যিই লকডাউনের সব নিয়ম কানুন শুনেছি এবং মেনে চলছি। এখন ভাইরাসটি তুরস্কে বাড়ছে, শুরুতে তুর্কি সরকার খুব ভালো ছিল এবং ইসলামপন্থী সরকারের মত আচরণ করেনি। ইউরোপ এবং আমেরিকার গীর্জা বন্ধ করার আগে তারা মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছিল, এবং আমি এতে খুব খুশি ছিলাম, কিন্তু এক বছর পরে তারা ব্যবসা নিয়ে বেশী চিন্তিত হয়ে পরে, মানুষের জীবন নিয়ে কম ভাবতে শুরু করে, যেমনটি ভারতে ঘটেছিল। সমস্যা হচ্ছে, দুর্বল সরকার হলে তারা ভয় পায়, মনে করে যে তারা যদি ব্যবসা বন্ধ করে দেয় তাহলে তারা জন্-সমর্থন হারাবে হবে এবং নির্বাচনে হেরে যাবে। তাই তুরস্ক এবং ভারতে উভয় দেশের সরকারই ব্যাবসা বানিজ্য সব খুলে দিয়েছে। ভারতের অবস্থা আজ তুরস্কের চেয়ে অনেক খারাপ। তুরস্ক দুর্ভাগ্যবশত গত মার্চ মাসে খুব তাড়াতাড়ি লকডাউন তুলে নিয়ে ভুল করেছিল এবং তার ফলে সঙ্ক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। আমার ভয় করা উচিত, কিন্তু যেহেতু আমার দুটি ভ্যাকসিন শট ছিল আমি ঠিক আছি। মানুষের আচরণেও অনেক পার্থক্য রয়েছে। এক বছর আগে খুব কম লোকই সত্যিই ভয় পেত, এবং অনেকেই সাবধানতা অবলম্বন করছিল না। এখন সবাই বোঝে, এবং সবাই মুখোশ পরে। শটগুলির কারণে এবং প্রত্যেকের মুখোশ পরার কারণে, আমিও কম ভয় পাই।

প্রশ্নঃ ওরহান পামুক, আপনি যখন বাড়িতে বন্দী ছিলেন এবং আপনার নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তখন একটি প্লেগ নিয়ে কাল্পনিক উপন্যাস লেখাটা কি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল?

উত্তরঃ যখন আমার সম্পাদকরা এটি পড়েছিলেন, তখন তারা বলেছিলেন যে মনে হচ্ছে যেন বাস্তবতা আমার উপন্যাসের অনুকরণ করছে। এরকম একটা ঘটনা আগে ঘটেছিল। তখন আমি “স্নো” শেষ করছিলাম, রাজনৈতিক ইসলাম সম্পর্কে আমার উপন্যাস লিখতে অনেক বছর লেগেছিল। যখন আমি এই উপন্যাস শেষ করছিলাম ঠিক সেই সময়ে ৯/১১ এর ঘটনাটি ঘটল নিউইয়র্কে।  “স্নো”-তে ওসামা বিন লাদেনের দুটি উল্লেখ ছিল, কারণ যখন আমি “স্নো” লিখছিলাম তখন একজন তুর্কি সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন যে ওসামা বিন লাদেন সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছেন তুর্কিতে। কিন্তু আমার সম্পাদকরা ওসামা বিন লাদেনকে যথাযথভাবে মুছে দিয়েছেন, কারণ লোকেরা ভুলভাবে ভাবতে পারে যে ৯/১১ ঘটনার কারণে আমি ওসামা বিন লাদেনকে আমার উপন্যাসে উল্লেখ করেছি।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন যে সাহিত্য কোন ঘটনাবলীর পূর্বাভাস দেয় এবং কি ঘটছে সে ব্যাপারে লেখকদের অন্তর্দৃষ্টি আছে?

উত্তরঃ এটা অন্তর্দৃষ্টি নয়। বিল গেটস পড়ুন। তিনি হুবহু, প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীমূলকভাবে, এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিনগুলি এবং সেই সময়ে যে ভাবে আমলাতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল তা তুলে ধরা। পৃথকীকরণ আরোপ করা একটি খুব আকর্ষণীয় বিষয় যাকে নিয়ে আমি একটি সতর্কবার্তা হিসাবে নয় বরং একটি মানবিক গল্প হিসাবে লিখি।

প্রশ্নঃ আকর্ষণীয় কারণ মহামারী বেশ গণতান্ত্রিক, মহামারীতে মৃত্যু সবাইকে প্রভাবিত করে, কোন বাছ-বিচার করেনা – তাই না?

উত্তরঃ মৃত্যু সমান, কিন্তু সংস্কৃতি ভিন্ন। যখন এই নির্মম মৃত্যু আমাদের দিকে আসে, তখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভিতরের দিকে যায়, অন্তর্মুখী হয়, নোটবুক লেখে, জীবনের অর্থ নিয়ে চিন্তা করে; অন্যদিকে অন্যেরা মসজিদে যায়, কফি হাউসে যায়, পরিবার এবং বন্ধুদের কাছে ছুটে যায়, এবং কেবল সম্প্রদায়ের কাছে নিজের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়। ইউরোপীয়রা, আধুনিকরা, ভিতরের দিকে বেশি যায়, অন্তর্মুখী হয় এবং কোয়ারেন্টাইনকে বেশি সম্মান করে। আর এদিকে আমার বিশ্বে সাম্প্রদায়িক জীবনাচরণ বেশ শক্তিশালী এবং মানুষের বেড়াজাল ডিঙিয়ে ঐতিহ্য ভেঙে ফেলা কঠিন। ১৭তম শতাব্দীর অটোমানের একটি লেখা আছে যেখানে ১৬৬৫ এ ইস্তাম্বুলেও প্লেগ হয়েছিল বলে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে একটি লোক একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকে অন্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতে, কিন্তু কখনোই আধ্যাত্মিক প্রশ্ন বা পৃথকীকরণ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে না। তারা এই ছোঁয়াচে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি, বরং ভিড়ে যোগদানের মধ্য দিয়ে সান্ত্বনার খোঁজকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।

প্রশ্নঃ শোনা যায়, আপনি একটি নতুন বই লিখতে শুরু করেছেন যা ইস্তাম্বুলের একজন শিল্পীর গল্প। এটা কি আত্মজীবনীমূলক?

উত্তরঃ হ্যাঁ. “প্লেগের রাতগুলি” সর্ব সাধারণের জন্য বলে পরিগণিত হয়েছিল। এখন আমি আমাকে নিয়ে লিখতে চাই। আমি একজন ব্যর্থ শিল্পী; আমি আমার সারা জীবন, ২২ বছর বয়স পর্যন্ত একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলাম। হাল্কাভাবে বললে আমার মাথার একটি স্ক্রু আলগা ছিল; এবং তাই এরপর আমি পেইন্টিং বন্ধ করে দিয়ে উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম।

প্রশ্নঃ কিন্তু একজন লেখক কি শিল্পী নন?

উত্তরঃ চিত্রকলা এবং লেখা উভয় ক্ষেত্রেই প্রচুর কারুকার্যের ব্যাপার রয়েছে। একটি উপন্যাস হল অনুপ্রেরণার মুহূর্ত এবং নৈপুণ্য তৈরির মুহূর্তের একটি রচনা।

প্রশ্নঃ আপনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখা কিভাবে লিখতে হয় তা শেখান। কীভাবে কথাসাহিত্যিক হওয়া যায় তা কি আসলে শেখা সম্ভব?

উত্তরঃ আমি যখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক অধ্যাপকদের এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি তারা সবসময় বলে, “মিঃ পামুক, আমাদের বই আপনার বইয়ের মতো বিক্রি হচ্ছে না এবং আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।” আপনি একজন ব্যক্তিকে মাইকেলএঞ্জেলো বা পিকাসো হতে শেখাতে পারবেন না, তবে আপনি একজন ব্যক্তিকে কীভাবে ব্রাশ ব্যবহার করতে হয়, কোন রচনা কী, কোন রং একসাথে যায় তা শেখাতে পারেন। কথাসাহিত্যেও তাই। সম্ভবত আপনার ক্লাসের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ লেখক হতে পারবে এবং বাকিরা তা না হতে পারলেও অন্য অনেক কিছু শিখবে। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, তুলনামূলক সাহিত্যের ক্লাসগুলিতে আমরা সম্পাদকীয় এবং বিজ্ঞাপন লেখার লোকদেরও শিক্ষিত করি। অনেক মানুষ মঞ্জোনি বা উম্বের্তো ইকো হওয়ার জন্য এই ক্লাসগুলিতে যোগ দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মঞ্জোনি বা উম্বের্তো ইকো হয়ে ওঠে না।

প্রশ্নঃ আপনি কি লেখবার সময়ে কলম ব্যবহার করেন?

উত্তরঃ আমি কলম দিয়ে নিজের হাতে লিখি, সম্ভবত এ প্রজন্মের শেষ ক’জনের একজন। আমি অনেকটা জাদুঘর যারা গড়ে তোলে তাদের মানসিকতার মত মানুষ এবং জাদুঘর গড়ে তুলতে যা যা করতে লাগে, সেই সব অভ্যাস আমার আছে। আমি গত ৫ বছর ধরে যে সব কাগজপত্র লিখেছিলাম তা সব যত্ন করে রেখেছি, প্রত্যেকটি কাগজের পাতা আমার সংগ্রহে আছে। পরের বছর আমার ৭০ বছর বয়স হবে। আমার প্রকাশক আমাকে নিয়ে একটি প্রদর্শনী আয়োজনের চিন্তা করছেন, যে লেখক গত ৪৫ বছর ধরে নিজের হাতে কলম দিয়ে সমস্ত উপন্যাস লিখেছেন।

প্রশ্নঃ আপনি কি কাউকে মুখে বলে যান আর তিনি লিখে নেন বা আপনি এটি একটি কম্পিউটারে টাইপ করেন?

উত্তরঃ না আমি নিজের হাতে লিখি, কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিই না। পৃথিবীতে এখনও কিছু রহস্যময় ক্ষমতার অধিকারী জাদুকর মানুষ আছেন যারা আমার হাতের লেখা পড়তে পারে। তারা এটি প্রতিলিপি করে আমাকে ফেরত পাঠায়। তারপরে আমি মার্সেল প্রুস্টের মতো নিজের হাতে সংশোধন করি এবং সংযোজন করি। তারপর এরকম আদান প্রদান চলতে থাকে যতক্ষণ না লেখাটি সম্পূর্ণ সঠিকভাবে ছাপার উপযোগী হয়।

প্রশ্নঃ আপনি কি কখনো কম্পিউটার ব্যবহার করে লেখার চেষ্টা করেছেন?

উত্তরঃ শুধুমাত্র ই-মেইল কম্পিউটারে লিখি। আমি একজন ধীর গতির লেখক এবং সারাদিন কম্পিউটারের দিকে তাকাতে চাই না; খবর পড়া বা ইমেইল পাঠানোই যথেষ্ট। আমার লেখার কিছু বন্ধু বৈদ্যুতিক-টাইপরাইটার ব্যবহার করত, কিন্তু আমি কম্পিউটারে যেতে পারতাম না, স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আমার কান্না পেত। একবার কম্পিউটারে লিখে আমি আমার সম্পাদককে আমার এমন একটা ভয়ঙ্কর লেখা পাঠালাম যে বিখ্যাত হয়ে গেলাম। সম্পাদককে সেই লেখা আবার অন্যজন কে দিয়ে পুনরায় লিখিয়ে নিতে হল!

প্রশ্নঃ আপনি কত ঘন্টা মনোনিবেশের সঙ্গে একটানা লিখতে পারেন?

উত্তরঃ আমি এমন একজন আবেগপ্রবণ ব্যক্তি যে আমার ভাল একাগ্রতা না থাকলেও আমি মনের জোরে লিখে যেতে পারি। যেমন এই বইটি আমি প্রতিদিন গড়ে ১০ ঘণ্টা করে লিখেছিলাম। সকালের প্রথম দিকে আমি ফোনের উত্তর দিই না এবং আমি ইমেল পড়ি না। আমি শুধু লিখি।

প্রশ্নঃ কখন থেকে কখন?

উত্তরঃ আমার মেয়ের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত আমি ভোর ৪টায় ঘুমাতে যেতাম এবং দুপুরে ঘুম থেকে উঠলাম। দস্তয়েভস্কি ঠিক একই রকম কাজ করতেন। তিনি সারা রাত লিখতেন, কফি এবং চা পান করতেন, এবং তারপর বারোটা পর্যন্ত ঘুমাতেন। আমার মেয়ের জন্মের পর, আমাকে তা পরিবর্তন করতে হল। এখন আমি সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠি এবং দিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত লিখি, তারপর আমি বিরতি নিই, ইমেল করি, আলাইনের সাথে একটি সাক্ষাৎকার করি (হাসি)… তারপর আবার লেখা চালিয়ে যাই।

প্রশ্নঃ ওরহান পামুক, আপনি কি অনেক পড়াশুনো করেন?

উত্তরঃ আমার যৌবনে আমি নিজেকে তৈরি করতে প্রচুর ক্লাসিক এবং উপন্যাস পড়েছি। এখন আমি আমার উপন্যাস লিখতে যা দরকার তা পড়ি এবং যেমন আমি প্লেগের ইতিহাস পড়ছিলাম। আমি তরুণ লেখকদের টেক্কা দেবার জন্য তাদের লেখা পড়ি না বা তাদের সাথে কথা বলার জন্য পড়ি না, তবে হ্যাঁ যদি কেউ আমাকে বলে যে কোন তরুণ লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন যা সত্যিই পড়ার মত, তাহলে অবশ্যই পড়ি। আমি খুব কৌতূহলী এবং ইর্ষান্বিত মানুষ, আমি প্রতিযোগিতামূলক। আমি বিশ্বে যা ঘটছে তা কক্ষনো মিস করতে চাই না।

প্রশ্নঃ আপনি কি কখনও লেখার ক্ষমতা হারানোর বিষয়ে চিন্তা করেন?

উত্তরঃ হ্যাঁ, আমি আমার মন হারানোর ভয় পাই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার স্মৃতিশক্তি কিছুটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকের যা হয় তাই আমার সাথে ঘটছে। লিখতে সক্ষম হওয়ার জন্য আপনাকে একই সাথে ছয়টি বিষয় আপনার মনের মধ্যে ধারণ করতে হবে এবং সেগুলোকে শৈল্পিক অ্যাক্রোব্যাটিক্সে একত্রিত করতে হবে। ঠিক এই সময়ে, যদি কেউ ফোন করে বা হ্যালো বলে, ছয়টিই অদৃশ্য! আমার যৌবনে, তারা অত সহজে অদৃশ্য হত না, এখন হচ্ছে।

প্রশ্নঃ আপনি একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, একজন সাহিত্যিক যিনি লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি করেন। আপনি কি ভাগ্যবান?

উত্তরঃ এটা ভাগ্যের একটি মজার বিষয়। যখন আমি ঘোষণা করলাম যে আমি একটি প্লেগ নিয়ে উপন্যাস লিখছি এবং একদিকে আমাদের করোনা ভাইরাস মহামারী আকার নিচ্ছিল, তখন তুরস্কের সবাই বলেছিল: বাহ! পামুক অনেক ভাগ্যবান! তারা এক বছর ধরে এই কথা বলেছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ দাবি করেছিল: তিনি এটা জানতেন! সে জানতো! আমার উপন্যাসের তিন লাখ কপি প্রকাশিত হয়েছিল। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে অর্ধেক বিক্রি। কিন্তু তখন ছিল লকডাউন। এখন আমি আমার পিছনে একজন দেহরক্ষী নিয়ে ইস্তাম্বুলের খালি রাস্তায় হাঁটছি, বইয়ের দোকানের জানালার দিকে তাকিয়ে দেখছি, যেখানে আমার বইয়ের স্তূপ রয়েছে। কিন্তু দোকানগুলো সব বন্ধ!

প্রশ্নঃ আপনি কি এখনও একই অনুভূতি নিয়ে কাজ করেন যা আপনার অজানা ছিল?

উত্তরঃ আমি একজন ধীর গতির লেখক, আগেই বলেছি এবং অনেক অবাস্তব প্রকল্প, অন্যান্য উপন্যাসের প্রকল্প আছে, যেখানে আমি অন্য কোন বিষয়ে লিখতে চাই, অথবা আমার জার্নালের পাতা প্রকাশ করতে চাই। আমি আমার নানা প্রকল্পের কাজ এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। ভয় এবং হতাশা আছে এবং হতাশার সময়ে, আমি নিজেকে এই সব কিছুর অর্থ জিজ্ঞাসা করি এবং আমি মনে মনে বলি: ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাকে এই বইটি শেষ করতে হবে, এটি শেষ করতে হবে এবং এটি প্রস্তুত করতে হবে, এই বক্তৃতা দিতে হবে, এরকম আর কি। তারপর আমি চালিয়ে যাই। আমার ইতিমধ্যেই খ্যাতি হয়েছে এবং যদি আমি পারতাম তবে আমি থামতাম। কিন্তু পারি না। মূল কথা হল আমি কাল্পনিক ঘটনা উপভোগ করতে পারি, তা শৈল্পিক হোক বা সাহিত্যিক।

প্রশ্নঃ আপনার সেরা উপন্যাসটি কি আপনি এখনও লিখতে পারেননি?

উত্তরঃ আচ্ছা, এটি একটি ভাল প্রশ্ন। আমি ইতিমধ্যে ১১টি লেখা লিখেছি, এবং সেগুলি খুব জনপ্রিয় হয়েছে। অনেক ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি দাবি করতে চাই না যে আমি একটি ভাল লিখতে পারব যা সব কিছু ছাপিয়ে আরও ভাল হবে। পরের লেখাটি সুন্দর বা জনপ্রিয় হবে কিনা তা আমরা জানতে পারি না, তবে বলতে পারি যে এটি অবশ্যই আসল এবং ভিন্ন হবে। এজন্যই আমি ঝুঁকি নিয়ে থাকি।

প্রশ্নঃ জেমস জয়েস “ইউলিসিস”, আলবার্তো মোরাভিয়া “দ্য টাইম অব ইনডিফারেন্স”, উম্বার্তো ইকো “দ্য নেম অফ দ্য রোজ” এর জন্য পরিচিত। এমন কোন বই আছে যার জন্য আপনি পরিচিত?

উত্তরঃ আমি খুশি হয়ে বলতে পারি – না। উম্বার্তো ইকো একবার যখন আমরা বোলগনায় একসাথে কথা বলেছিলাম, আমাকে বলেছিলেন: “ওরহান, যখনই আমি একটি নতুন উপন্যাস লিখি এবং প্রকাশ করি, দ্য রোজ বেশি বিক্রি হয়!”(হাসি)। আমার কাছে তা নেই, এবং আমি গর্ব করে বলতে পারি যে প্রতিটি দেশে আমি আলাদা বইয়ের জন্য বিখ্যাত। চীনে “মাই নেম ইজ রেড” এর জন্য। আমেরিকায় “স্নো” এর জন্য, কারণ আমেরিকানরা রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি আচ্ছন্ন। তুরস্কে এটি “দ্য ব্ল্যাক বুক” এবং “এ স্ট্রেনজেন্স ইন মাই মাইন্ড” বই দুটির জন্য। আমার সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলি সম্ভবত “স্নো”, “ইনোসেন্স মিউজিয়াম” এবং আমার আত্মজীবনী “ইস্তাম্বুল”। হয়তো একদিন আমার “দ্য নেম অফ দ্য রোজ” এর মতো কিছু লেখা উচিত! হয়ত!

প্রশ্নঃ সম্ভবত আপনার মহামারী নিয়ে একটি বই লেখা উচিত?

উত্তরঃ আপনি এটি এভাবে সংগঠিত করে তুলতে পারবেন না!(হাসি) শৈল্পিক এবং সাহিত্যিক সাফল্য হাতের কৌশলের কাজ না, পরিকল্পনা করে সাফল্য আনা যাবে না। আপনি যদি একজন সত্যিকারের শিল্পী হন এবং আপনি নিষ্ঠাভরে যথেষ্ট কাজ করেন, তাহলে কিছু একটা ঘ্টবে, সাফল্য আসবে। শেষ পর্যন্ত আপনি বিখ্যাত হয়ে উঠবেন, কিন্তু আপনি যে কারণে চেয়েছিলেন তার জন্য হয়ত নয়। যখন আমি ছোট ছিলাম আমি সবসময় সাহিত্যের খ্যাতি পেতে চেয়েছিলাম। এখন অনেক দেশে প্রচুর লোক আমার বই পড়ছে, কিন্তু এটি শান্তিপূর্ণ হয়নি, এটি সহজ ছিল না। নাটকটি সেরকম কাব্যিক হয়ে ওঠেনি, যতটা সুন্দরভাবে আমি কল্পনা করেছিলাম ততটা হয়নি। কিন্তু কি আর করার আছে, ঠিক আছে।

প্রশ্নঃ ওরহান পামুক, আজ আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

উত্তরঃ আলাইনের সাথে কথা বলে আমি উপভোগ করেছি। ধন্যবাদ।

 

অতীশ চক্রবর্তী

একজন প্রবাসী বাঙালী। ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন সপরিবারে। বহুজাতিক ঔষুধ কোম্পানীতে কর্মরত আছেন। বাগান ও ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ।