আমার লেখালিখি বেশীদিনের নয়। মূলতঃ ২০১৫ তে নিয়মিত পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করি । অনিয়মিত লেখা ছিল । প্রথমদিকে কবিবন্ধু প্রমোদ বসু লেখা চাইতেন । দিতাম। তার মাধ্যমেই প্রথম পরিচয় হয় কবিবন্ধু অগ্নি বসুর সঙ্গে। অগ্নি বসুই সুধীর দত্তের কথা প্রথম আমাকে বলেন । ইতিমধ্যেই সুধীর দত্ত “তাঁবু মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়ে গেছেন। অগ্নি বসুই এই বইটি আমাকে দেন। বইটি পড়তে শুরু করি। কিন্তু কিছুই তো বুঝতে পারছি না ।পড়ছি, পড়েই চলেছি । একেবারে নতুন ভাষাপথ ,একেবারে নতুন ভাব , একেবারে নতুন চিত্রধর্ম ও অজানা সব তথ্য এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। ছাড়তেও পারি না ধরতেও পারিনা। ইতিমধ্যে একদিন খোদ সুধীর দত্তের সঙ্গেই আলাপ হল । অগত্যা তাকেই জানালাম আমার না বোঝার অক্ষমতার কথা। তিনি হাসলেন। বললেন তবুও পড়ুন। ভালোলাগাটুকুও বা কম কি ? এরপর ভয় কাটিয়ে আস্তে আস্তে বইগুলো পড়তে থাকি। একসময় কলমও ধরি। এভাবেই যেমন কবি সুধীর দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়,তেমনি তাঁর কাব্যসম্ভারটিও প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। কবি সুধীর , মানুষটি সহজ-সরল সৎ। কাছ থেকে দেখতে পেলাম তাঁর প্রতিভার ছটা। আভাস। এভাবেই পড়তে পড়তে চোখ আটকে গেল তাঁর “নিষিদ্ধ আঙ্গিক” কাব্যগ্রন্থে। এ কোন সুধীর? ভাব, ভাষা,প্রকাশ—সবটাই কেমন যেন আলাদা মনে হল ।অতলান্ত গভীরতায় একটা চিরন্তন প্রেমের সুর বইছে।ব্যাস, বসে গেলাম কিছু বলব বলে—-
প্রথমেই পড়লাম, “সুড়ঙ্গ অনিঃশেষ” কবিতাটি–সুধীর দত্তের ” নিষিদ্ধ আঙ্গিক” কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা এটি। বইখানির চাবিকাঠি। পড়তে পড়তে কতরকম ভাব যে এ ওকে ধাক্কা মেরে জায়গা করে নিতে চাইছে, ভাবলে অবাক লাগে।স্বীকার করতে বাধা নেই এই
কবিতাটা আমাকে স্তব্ধ করে দিল—–
“শেষ হবে না এই পাঠ, উদ্ধার হবে না কোনওদিন
গোপন সংকেতগুলি, কেউ
কুহক টানেলে ঢুকে দেখবে সুড়ঙ্গ অনিঃশেষ
এবং দশদিকে গলি,
রূপকল্পের আড়ালে
যে গমন বস্তুত সম্যক, তার লিপি
যে ভাবে পাঠ করে সেই ভাবে…
কেউই জানবে না কোন উৎস থেকে অক্ষরের আলো
চিরে ফেলছে অন্ধকার উপর্যুপরি”
—- কি অদ্ভুত রহস্যঘনতা নেমে এল কবিতা জুড়ে। শেষ হবে না এই পাঠ , উদ্ধার হবে না কোনো গোপন সংকেত, কেবল সুড়ঙ্গপথটির অভিমুখটি কবিই জানেন। একটা রহস্যঘনতায় মুখ ঢেকেছে কবির অনিঃশেষ প্রেমভাবনা। পাঠক আমি।পাঠকের সামনে বিরাট প্রশ্ন—এ কোন প্রেম যার গোপন সংকেত অজানা কুহক হয়ে কণ্ঠে জড়ায় ? কুহক টানেল কি কোনো MAZE ??
কেনই এমন শব্দকুহক বুনে চললেন কবি সমস্ত কাব্যগ্রন্থটিতে? রূপকল্প তো অনুরূপের কথাই বলে। যাজ্ঞবল্ক্যের চতুর্থ আশ্রম যে কবির রূপকল্প রচনা করে তাঁর মনের গভীরে কোন সে কুহক টানেল যা আড়ালের প্রয়োজনে ব্যবহৃত?
আশ্চর্য এই যে, ঐ সুরঙ্গপথটি কিন্তু দশদিকে দশগলিতে বিন্যস্ত। দশদিকের পরিব্যাপ্তি যার মধ্যে গুটিয়ে রয়েছে সে কোন রহস্য? এই বিস্তীর্ণ আকাশভূমিতে পাঠক পারবে কোনো হদিশ পেতে? কবি দেবসখা। তিনি কি ইচ্ছে করেই লুকিয়ে রাখছেন কিছু সত্য যা তাঁর কাব্যকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দেবে?
রূপকল্প একধরণের মুখচ্ছদ। তার আড়ালে কোন সে গমন যা বস্তুত সম্যক? আশ্চর্য হই কবির ইঙ্গিতময়তায়। কেবল হাতছানি দেয়। ডাকে।
তার লিপি এভাবেই পাঠ করি।করতে হয়।
যখন কবির মিস্টিক ভুবন ঘোষণা করে– কেউ জানবেনা উৎস,কেউ জানবেনা কোথা থেকে এলো কবির অক্ষরেরা আলোর মতন তখন সেই সান্দ্ররহস্যের ম্যাজিক পাকে পাকে জড়ায় না কি পাঠককে? অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে ওঠে ঐ আলো নয়, তার নীচের অন্ধকারটাই। মনে হয় কোন সেই অন্ধকার যা চিরে ফেলছে কবির অবসন্ন প্রেম,হৃতগৌরবের দিনগুলোকে এক দুর্নিবার আলোসন্ন্যাসের জন্য?
এ কি তীর্ণতা? ট্রান্সফর্মেশন !!!????আশ্চর্য হয়ে দেখছি,
সুধীর দত্তের কাব্য গ্রন্থ—নিষিদ্ধ আঙ্গিক পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের জ্ঞান।হারিয়ে ফেলছি স্থানিক অনুভব। কবিতার ছত্রে ছত্রে যাজ্ঞবল্ক্যের প্রেমে নিষ্ণাত হচ্ছে গার্গী — যাজ্ঞবল্ক্য একা তবু ফিরছেন, সামনে সন্ন্যাস !!! এই আবর্তনেই ডানা ছড়িয়ে ঢেকে দিচ্ছেন কবি গার্গীর আকাশ,কাব্যে শব্দে সুষমায়,বাকে।
যাজ্ঞবল্ক্য একা ফিরছেন।একা কেন? এইই নির্ধারিত। তাই একাই ফিরছেন ঈশ্বরের মতো। উজান যাত্রা। ঈশ্বর কি একা? অসঙ্গ?? এসব খুঁজে নিতে পূর্বাপর একটা অতিসরণ দরকার। সেসব আমরা খুঁজে নেবো সুধীর দত্তের কবিতাতে। নিষিদ্ধ আঙ্গিক ইজ এ জার্নি। প্রেমপথে। বৃষ্টিতে কেবল অভিসরণ ঘটে তা নয় বৃষ্টি বিরহকেও গভীর করে তোলে। অদ্ভুত প্রাকৃতিক বর্ণনায় কবি সাজাচ্ছেন অপ্রাকৃতিক কোনো সূচনাকে।
“বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি,ক্রমাগত বাকলে ও শাঁসে
চারিয়ে উঠছে শীত।”—-বাকলে ও শাঁসে চারিয়ে উঠছে শীত—স্ট্রাকচারড্ টাইম কবিতাতেই পেয়ে গেলাম।নন্দন নৈশঃব্দ্য। যাজ্ঞবল্ক্যই কি একা নাকি কবিসত্তা নিজেই একা !
অস্তিত্বের নিজস্ব বিবরে প্রবেশ করলেন কি কবি? আর সেখান থেকেই সত্তার নিস্ক্রমণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। নিষিদ্ধ যে আঙ্গিক তাতেই কেন লিখেছেন কবি এমন একটা কোণার্ক-কিন্নরী প্রেমকথা?কবিতা গ্রন্থটি পড়ে আমার এইসবই মনে হচ্ছে।
যাজ্ঞবল্ক্য এই বিবরেই প্রবেশ করতে বারণ করেছিলেন গার্গীকে। প্রেমের খাঁটিত্ব আর স্থায়িত্ব এক জিনিস নয়। এক লহমার প্রেমও চিরকাল থেকে যায় ধ্রূবতায়।তবে কেন নিস্ক্রমণ ? মানুষের এই একা হয়ে ওঠা যতখানি ছড়িয়ে পড়বে কবির ভাষা ততটাই বিশ্বজনের হয়ে উঠবে।
সুধীরের কবিতায় অনুষঙ্গ ব্যবহারে রয়েছে কেলাইডোস্কোপিক ভিউ। চমৎকার ইম্প্রেশনের কোলাজ। দূর থেকে ক্যানভাসে নিরাসক্ত হগব্রাশে রঙ ছুঁড়ে দিয়ে পরে কাছাকাছি এসে দুএকটা রেখায় প্রতীয়মান করে তোলা অন্য আরেক অর্থকে।অনুষঙ্গে সেজে ওঠে প্রেম—
“সোঁদা গন্ধ
জানলার বাইরে লেবু গাছ।”— সেখানেই তবে ঘুমের দেশ? কবি কি কল্পনারীকেই প্রশ্ন করলেন—
“তুমি কি ঘুমের দেশে গিয়েছ কখনও?”
এইবার কবির গভীরে খুলে যাচ্ছে এ্যাঞ্জেলিজম্-এর দোর। একটা সাররিয়্যাল ছবি আস্তে আস্তে শেপ নিচ্ছে। সব রহস্যই কি ঐ ঘুমের দেশে লুকোনো আছে?কবির প্রশ্ন —
“দেখেছ অমূত্র লোক?তারও পারে
যে নির্ঘুম জেগে থাকে ঘুমের ভিতর?”—-ঘুমের ভেতরে নির্ঘুম কি কোনো বিশেষ অনাশ্রয়িতা যা আশ্রয়ের সঙ্গে আড়াল রচনা করলো? প্রত্যহধর্মী শব্দে বাক্যে যাজ্ঞবল্ক্যীয় উদাসীনতা কে রূপবদ্ধ করে ফেললেন কবি। যাজ্ঞবল্ক্য কি সংসারে শেষ পর্যন্ত নির্জিত?
এইখানে আসল রহস্য অপেক্ষা করছে একটা কিছু উন্মোচনের। কে লিখেছেন পদ্য? ডানহাতে খয়ের কাঠের স্রুবা,তাতে ঢালছেন সোম —কে? যজ্ঞ হতে চলেছে? নিস্ক্রমণ তারপর??অনন্ত বিরহ ! কী গভীর ব্যথাবাজে শব্দে ও ধ্বনিতে–“তুমি দিয়েছিলে শান্তি, কান্তিমান আর এক জীবন;/ তোমাকে ডাকবো না,হয়তো অক্ষর ক’টি/মৌপোকা—/গুনগুন করবে চারপাশে,”
“হয়তো” শব্দের পুনঃ ব্যবহারে নিশ্চয় নয় সংশয়টুকুই বোধকে গভীরতর করেছে। প্রবীণব্যথায় বেজে উঠেছে প্রত্যহের অপ্রাত্যহিক সমূহ শব্দগুলো, যেন তারা বাঁচবার ক্ষিপ্ত আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে সুধীরের কলমের মুখে মুখোমুখি দাঁড়ালো। এরই বাই প্রোডাক্ট একটা বন্ধনমুক্ত বিকল্প শব্দার্থমালা কিম্বা দলছুট ওপেন ওয়ার্ক।
কবিই কি তবে বাকস্পৃষ্ট হয়ে ঋষিই এখন? ভালোবাসার গান্ধর্ববীণায় ওদিকে তবে বেজে চলল কেন এমন সুর? সে কি কবির অন্তর সন্ন্যাস?—-“নেই—-/কেউ কোথাও নেই,”— আর “শুধু চাপা একটি শ্বাস”…
“হয়ত ডানার শব্দে ঘুম ভাঙবে, নেই—“—মহাবিহঙ্গের ডানার বিপুল শব্দে ঘুম ভাঙলে প্রেমের কিম্বা প্রেমিকার অনুভবের জন্য সেখানে পড়ে থাকবে একটা অতিজাগতিক হাহাকার —যাজ্ঞবল্ক্য নেই! যাজ্ঞবল্ক্য নেই! হে গার্গী সময় আসন্ন অন্য এক ভোরের।
সেই ভোরে যাজ্ঞবল্ক্য ফিরবেন একা। ঈশ্বরের মতো।উদাসীন।তখনো কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই,শুধু চাপা একটি শ্বাস
দীর্ঘ হতে হতে যবে একখণ্ড ভোরের আকাশ হয়ে যাবে—সে কার দীর্ঘশ্বাস !?
——- কি অসাধারণ expression….এ যেন ম্যালার্মের সাদা কাগজ মেলে ধরা । ভাষা ও পরম শব্দকে অভ্যর্থনা করে নেওয়ার মত । সুধীর দত্তের ভাষায় তেমনই একটা স্তোভধ্বনি শুনি—- “ক্রমাগত বাকলে ও শাঁসে /চারিয়ে উঠছে শীত।” শীতার্ততার এমন ব্যাখ্যা অচিন্ত্যনীয়। মনে হয় সুধীর দত্তের কবিতা বাংলাভাষাকে একটা নতুনদিকে বাঁক দিতে চলেছে। ভাষা বহতা নদী হলে বাঁকে বাঁকেই তার শক্তি বাড়তে থাকে। এখানেও তার অন্যথা হয়নি।
সংবেদনা এখানে এত ইন্দ্রিয়ঘন যে তা গন্ধের আওতায় এসে পড়েছে। রূপের স্পর্শে আদি ইন্দ্রিয়তা কিন্তু গন্ধঘনতাকেও অতিক্রম করে আরো শরীরী হয়েছে। লেবু গাছের সঙ্গে মিশেছে সোঁদা গন্ধ। ঠিক এই সংবেদিত ইন্দ্রিয়ঘনতা দেখেছি বিভূতিভূষণের আরণ্যকের বনে, যেখানে সত্যচরণ পোড়াঘাস থেকে পেয়েছিলো বাংলার ডাকের সাজের মেটালিক গন্ধ। অনুষঙ্গ ব্যবহারের পথে পায়ে পায়ে এসেছে অন্য জগৎ—
ডান হাতে খয়ের কাঠের স্রুবা —-পাঠককে অন্যপুরাণে উত্তীর্ণ করে। ঢালি সোম— উপনীষদীয় অনুষঙ্গ যোগ করে। এভাবেই কবির স্বলোকটি চিত্রিত ও চিহ্নিত হয়ে যায়।
এরই আবার সঙ্গে মিশে রয়েছে অলক্ষ্য অভিমানের রোমান্টিক রঙ। বস্তুতঃ ক্ল্যাসিকে ও রোম্যান্টিকে কোলাকুলি করেছে এ কবিতা। সুধীর দত্তের কবিতাতে “হয়ত”–এই শব্দটির ব্যবহার সেই রোমান্সকে অতীন্দ্রিয়তার পথে পৌঁছে দিচ্ছে—–“হয়ত অক্ষর ক’টি মৌ পোকা, গুনগুন করবে চারপাশে,”
” হয়ত ডানার শব্দে ঘুম ভাঙবে”
দুটি অদ্ভুত চিত্রের মধ্যে তৈরি হল যে শূন্যতা ( space) সেখানেই যন্ত্রণা হয়ে উঠল রুচিময় কিন্তু অরূপসম্ভব। বারবার মনে ঘোরে ফেরে পংক্তি গুলো— –“নেই…/কেউ কোত্থাও নেই, শুধু চাপা একটি শ্বাস/দীর্ঘ হতে হতে যবে একখণ্ড ভোরের আকাশ”
সেই আকাশ বা space এর মধ্যেই ততক্ষণে বেজে উঠেছে অন্য কোনো প্রত্যাবর্তনের সুর ! ….
যাজ্ঞবল্ক্য ফিরছেন ….! ?? একা..!?? তিনি পরাকবৃত্ত আজ আর তাই ঈশ্বরের মতো শান্ত, উদাসীন, একা।……..
ভাষা ও ছন্দের পরিশীলিত শ্রুতি সুধীর দত্তের আত্মগত বৈশিষ্ট্য। আলোয় আঁধারে, মসৃণে অমসৃণে, অন্তরীক্ষে পাতালে, স্বর্গে নরকে নিয়ত বিচরণ করতে পেরেছেন বলেই সুধীর মৃত শব্দেও প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছেন ।
কবিতা শরীরে ভাস্করের পৌনঃপুনিক খোদাই চিহ্নিত করেছেন কবি। এতে কবিতা দেহ বারবার হয়েছে অমসৃণ। কবিতার লাবণ্যময় ত্বক অবিন্যস্ত খসখসে রূপে দৃশ্যমান। শুধু তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে সৃষ্টির নিখুঁত আদিমতা । একেই বলি ঈশ্বর ! যে সহৃদয় পাঠক প্রজ্ঞায় অতিক্রম করতে পেরেছে বোধের ও স্বভাবের তারল্য কেবল তার পক্ষেই এইসব মেধাশাসিত পংক্তি আর অপাংক্তেয় থাকে না।
এক স্বতন্ত্র প্রজাতির কাব্যসূত্র সৃষ্টি করে কবি যেন বারবার ভেঙে দিচ্ছেন কবিতা জগতের পূর্ব অভ্যাসের সীমা। এ যেন অকালে অপরিচিতার প্রতি পক্ষপাত !
CUBIST কবি সুধীর দত্ত এখানে যেন ছবির কিউব তৈরী করে কবিতা-প্রতিমাকে নতুন প্রতীতীতে জন্ম দিয়েছেন। এসব বিশ্বাস করতে কখনও কোথাও বাঁধে না…. Willing suspension of disbelief …. কাজ করে আমাদের অস্তিত্বের ভিতরে, আমাদের মগ্ন করে, মুগ্ধ করে।
কিউবিজম্ এর আদিম বলিষ্ঠতায় কখনো কখনো সুধীর দত্ত পাবলো পিকাসোর সহধর্মী মনে হয়।
অন্যত্র কখনো আবার দেখেছি, স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ভ্রমণে এই মহাবিহঙ্গের(সুধীর দত্তকে এমন বলতেই স্বচ্ছন্দ লাগে) পাখসাট শুনতে শুনতে মনে হয় সুধীর মহাকবি দান্তেরও সগোত্র। আবার কখনো মনে হয় উড়ান গুটিয়ে তিনি আমাদেরই রসুইঘরে জ্বেলে দিচ্ছেন দক্ষিণাগ্নি । কবির মগ্নচেতনার রহস্য প্রতিভাস দিয়েই তাঁর কবিতার চিত্রবিন্যাস হয়েছে। নিপুণ ভাস্করের শিল্পের মতই সুধীরের কবিতায় আছে Frozen music…একথা বারবার বলেছি। না বলে পারিনি।
কবি চিজেল ধরেছেন। কারভিং করেছেন কবিতাদেহে।
সেটি হতেই হবে নির্মেদ ও নির্ভার। তাই বুঝি তাঁর প্রতিটি স্ট্রোকেই ফুটে ওঠে ভিন্ন স্বরলিপি । এ সৃষ্টি যেন অন্য এক লোকের ! কিম্বা এরই সঙ্গে আমরাও পৌঁছে যেতে পারি অদেখা ভাবলোকে !পাঠকের দেখা হতেও পারে যাজ্ঞবল্ক্যের সঙ্গে!!
প্রশ্ন জাগে পাঠকৈর মনে, কে এই গার্গী? কবি নাকি যাজ্ঞবল্ক্য যাচ্ছেন চতুর্থ আশ্রমে? এই কি শেষ আশ্রম তাঁর? গার্হস্থের লীলাশেষে সন্ন্যাস? —
অদ্ভুত রূপকল্পের পিছুপিছু আমরাও পৌঁছে যাই ঐ আশ্রমে—সেখানে
হাতে দ্ণ্ড, কালিভর্তি
কমণ্ডলু, হাঁড়ি–
অন্ন ফোটাবেন গার্গী
কম্বল আসন পেড়ে বলবেন, নাও
আঁকাড়া ও কাঁড়া গুঞ্জমালা
আচমন করো । আমাদের পক্ষীজীবন ।—-গার্গী কেন? সেই কি যাজ্ঞবল্ক্যের শেষ মাধুকরী অণ্বষণ ? মেধামণীষার জীবন? এই
আকাশের নীচে কার
ওড়াউড়ি? মহাপাখি কবিই বিরাট ডানায়
ঝাপটাচ্ছে আকাশটাকে।
এরপরেই দেখি হুলুস্থুলু।কার ভয়? কিসের ভয়?”
দরজা খুলে
দৈবাৎ যদি
সামনে দাঁড়ান এসে,
ভয় হয়, কী চাইতে কী চেয়ে বসি”— এ ভয় কি গার্গীর না স্বয়ং কবির? যে বিহঙ্গ ডানা ঝাপটায় রতিবিলাসে, তার সামনে কে আসবে বলে তার ভয়? সন্ন্যাস ভাঙবে বুঝি? যাজ্ঞবল্ক্যকবির? সমগ্র নিষিদ্ধ আঙ্গিক টিই কবি অস্পৃশ্যা অস্পস্যা সেই গার্গী জন্যেই যেন নিবেদিত। কবি তো দেবক্রতু আর তাই তিনি শব্দ হয়ে বসে আছেন । কিসের যেন দুরন্ত আব্রহ্ম চাওয়ায় কবির ভ্রূ-পল্লব, তারও নীচে যে ওষ্ঠ অধর
কী রকম শুষ্ক, ফাটা;
কবি কি পূর্ণ করে পেতে চান পৃথিবীর সব বর্ণ গন্ধ রস স্বাদ?
তাই কি ডাকছেন গার্গীনাম্নী কোন প্রিয়নারীকে—- এসো
আমাকে চুম্বন করো, গর্ভ দিও মহাকবিতার?কবিতার শব্দজন্মেও কি শরীর আর যৌনতা এসে দাঁড়ায়? যদিও পাঠক ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে এই দিব্যযৌনতার কথা।
সুধীর দত্তের কবিতা তে অন্তস্থলের নিজস্ব অণুকণাগুলি খেলা করে নিজের খেয়ালে আর সেগুলোই উসকে দেয় কবির ভাষা ও চিত্রকল্প কে। সার্ত্রের মতে , কাব্য শিল্পের অন্তরের ভাষা মূলতঃ অনেকখানি মূক। এ শুধু প্রতিমার জন্ম দেয়। কোনো অর্থ কে সূচিত করে না। আমার মনে হয়, সেখানেই তৈরী হয় space বা নৈঃশব্দ্য। কবি যত মৌন হবেন পাঠক ততই মুখর হবেন।একেই বলি ডিকন্সট্রাকশন। কবির নৈঃশব্দের প্রকাশ হবে পাঠকের মুখরতায়—এইই কবির কাম্য।
সুধীর তাঁর চিত্রকল্পেই প্রেমবোধকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তসীমায় পৌঁছে দেন।যত ওতোপ্রতো জড়িয়ে জড়িয়ে যায় তাঁর বাকপ্রতিমা , ততই এইসব প্রত্নপ্রেমছবি কবিতা হয়ে যায় । চতুর্থ আশ্রম কি?তবে কি ঈঙ্গিতে কবি বলেন, এই আশ্রম সন্ন্যাস নয়, সৃষ্টির আশ্রয়। তাঁর কমণ্ডলু কালিভর্তি। অন্ন ফোটাবেন প্রতিস্পর্ধী গার্গী । সে কি ! আশ্রমে গার্গী। গার্গী কি প্রেম? প্রেমিকা ? অন্ন কি কবিতা?ভাবময় জগতের বস্তুরূপকেই কি কবি ধরলেন উপমা,প্রতীক, চিত্রকল্পে? গোটা কবিতাটায় আশ্চর্য একটা পারম্পর্যহীনতা দেখি।অথবা,দেখি পারম্পর্যের জটিল গিঁট । বিনুনির সুসমঞ্জস চৌখুপীর মধ্যেই শব্দদের গুটিয়ে নিচ্ছেন সুধীর। কাঁড়া ও আকাঁড়া গুঞ্জমালা !
কখনো মনে হচ্ছে যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীর মিথ এক অকল্পনীয়, বহু-বিভ্রান্তিকর রূপের বিন্যাস তৈরী করে কবিতাতে এক আশ্চর্য ধাঁধা তৈরী করেছে এবং পাঠকের সামনে কবি দাঁড়িয়েছেন সমাধানের জন্যে। একটা অবিরাম শব্দকুণ্ডলী কখনো পরস্পরকে খুঁজছে। কখনোবা ইচ্ছে করেই এড়াতে চাইছে—“ভয় হয়, কী চাইতে কী চেয়ে বসি আমি,/শব্দ হয়ে বসে আছি কবি।/এই দ্যাখো ভ্রূ-পল্লব, তারও নীচে যে ওষ্ঠ/অধর…..” এই সংবেদনশীলতার বিভিন্ন অংশে, আবেগঘন প্রাণিক একটা গতিময়তা যেন পাঠকের দৃষ্টি ও অন্যান্য অনুভূতি কে বেঁধে ফেলেছে।এ যেন জার্মান শিল্পের আদি কেল্টিক যুগের অলংকার শৈলী—–প্রথমে বিন্দু, রেখা আর ফিতে পরপর আসে , তারপরে আসে বক্ররেখা বৃত্ত উর্ধমুখে-ঘোরানো রেখা— সর্পিল আঁকাবাঁকা। এর মধ্যেই অদ্ভুত বিচিত্রতা রয়েছে। এমন বিন্যাস সুধীর দত্তের কবিতাতে প্রায়শঃই পাই। মানে মূলতঃ একটা মহাজাগতিক বিস্তারে সুধীর মেলে ধরেছেন তাঁর প্রেমের ব্যাসচেতনাকে।
বস্তুতঃ সুধীর দত্তের কবিতা সম্পূর্ণ না পড়লে যে কোনো আলোচনা অসমাপ্ত মনে হয় আর তাই আরো একটি কালাতিরিক্ত কবিতা পড়ছি —“আদি কাব্য” অসম্ভব ভালো একটি কবিতা
“শব্দদের যৌনস্নান হল।
এভাবেই জ্বলে ওঠে এক অঙ্গুষ্ঠ আলো।
আমাদের কবিতাযাপন
হবিদেবতার কাছে বয়ে নিয়ে যায় রূপ, ভাষামুদ্রা —
এই রাত্রি ঋতুমতী হোক
এবং দণ্ডের মুখে রেখে যায় গোপন আগুন
আর সে ঝলক
শ্রোণি ছুঁয়ে ঝলকে ঝলকে রুষে ওঠে
যেন-বা পুরুষ-যজ্ঞ, ধাতু পাত্র এবং অর্পণে
শব্দের গঠন ভাঙে ; গুহাজল, তোমার নিষেক–“
আসলে বলতে চাইছি সুধীরের এই কাব্যযাত্রা হল নিরবধিকালের। কাল থেকে কালান্তরের পথে চলতে চলতে সুধীর ভিজিয়ে দিচ্ছেন মাটি, সোঁদাগন্ধের মোহময়তায়–” এবং দণ্ডের মুখে রেখে যায় গোপন আগুন/ আর ঝলক/ শ্রোণি ছুঁয়ে ঝলকে ঝলকে রুষে ওঠে”…প্রাণিক চলার সুর এ কবিতার গভীরে গোপনে এঁকে চলে ভাষামুদ্রা–” শব্দদের যৌনস্নান হল।” সারফেস জড় যৌনতার বেড়া ডিঙিয়ে আমরা প্রবেশ করি ভুবনেশ্বরের দেবদেউলে। সেখানেই ব্যঞ্জনায় প্রকট হয়—“…এক অঙ্গুষ্ঠ আলো” এখানেই চলে আত্মার সঙ্গে প্রাণের রমণ ! Elan vital এর field এ পেয়ে যাই ঋতুমতী রাত… অচিন পাখির আনাগোনায়। এ যেন সৃষ্টির বিচিত্রপথে চলেছেন দেবসখা। সৃষ্টির আদি চংক্রমণ ! এখানেই তবে–” …শব্দের গঠন ভাঙে ; গুহাজল, তোমার নিষেক —” এখানেই জন্ম নেয় অজস্র নক্ষত্রলোক আদিকাব্য সৃজনের অলৌকিক অভীপ্সায়!
“নিষিদ্ধ আঙ্গিক”–এর আর একটি কবিতা না পড়লেই নয়। কবিতাটির নাম
“ইনি সেই অনুচ্ছিষ্টতা”—- কবিতাটি পড়বো এবার—
“চোখ বুজে আছে চাঁদ,বায়ু স্তব্ধ, দ্বীপে
যেমন কুয়াশা নামে,
যোনিকূটে উপচে পড়ে মধু ও গরল,এই ঋষি
অশ্বের চেয়েও জঙ্গম। নড়ে ওঠে
ক্ষীর সমুদ্র,দণ্ড, পীঠ,,কবিতা ও জলের কল্লোল;
কাঁপে দিক,দিকচিহ্ন,তুমি
পান কর সরিয়ে ফেনা সোম,
পান কর অবশেষ,অবিদিত আলো
ঘিরে থাক শব্দদের, জরা
দূর থেকে তাকিয়ে বলুক
ইনি সেই অনুচ্ছিষ্টতা
অবিদ্যার আভা মেখে মৃত্যুকে জয় করেছেন।”
“চোখ বুজে আছে চাঁদ ,বায়ু স্তব্ধ,দ্বীপে যেমন কুয়াশা নামে”
—- কি অদ্ভুত!! এভাবেই একটি বাতাবরণ তৈরি করেছেন কি কবি? মনে হচ্ছে একটা চিরকালের কাব্য কথাই নতুন সুরে শোনাতে এসেছেন সুধীর। যেন একটা আসন্ন ও অনিবার্য কাহিনীর প্রকাশলগ্নটি সমাগত—-
“যোনিকূটে উপচে পড়ে মধু ও গরল “
—এটি একটি statement যা বলে দেয় বাস্তব বক্তব্যের অনেকখানি।
” এই ঋষি অশ্বের চেয়েও জঙ্গম” আর তারি অস্থিরতায় জেগে ওঠে মৈথুনের শক্তি—অমিতায়তন এ শক্তির পূর্বাভাস এই কবিতার স্থানে স্থানে রক্ষিত।সেই শক্তিতেই নড়ে ওঠে ক্ষীর-সমুদ্র,দন্ড ও পীঠ—-erotic touch এ কবিতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন কবি। পৃথিবীর যৌনতা কে দিব্যযৌনতায় উত্তীর্ণ করার নির্মাণ কৌশলটি সুধীরের অধিগ্রহণ। স্তম্ভিত বাক রূপ পরিগ্রহ করেছে কবির কলমে । এই স্তম্ভন উচাটন টানছে পাঠককে। একদিকে তন্ত্র অন্যদিকে বেদান্ত খুলে দিয়েছেন নতুন বাতায়ন। সমুদ্রের মিথ ব্যবহারে কবিতাটি হয়ে উঠেছে সাংকেতিক এবং স্বাভাবিক ভাবেই সংহত। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এখানে সবচেয়ে কম বলে শব্দ-শক্তি এখানেই সঞ্চিত সবচেয়ে বেশি । কবি যখন বলছেন— কবিতা ও জলের কল্লোলের কথা তখনই সেটা প্রকৃত নির্মাণ হয়ে উঠেছে । মন্থনের নিগূঢ় কল্লোলে নেমেছেন চতুর্থ বাক। এভাবেই গ্রন্থনাটির শুরু। এরপর এসেছে অদ্ভুত effect ….”কাঁপে জল দিকচিহ্ন” কিংবা আরো বেশি effect তৈরি হয়েছে যেখানে কবি আনলেন synesthesia-র effect—– তুমি পান কর অবশেষে সরিয়ে নাও ফেনা সোম। “
এখানেও নির্মাণ ক্ষমতা এসেছে পরিচিত একটি মিথকে আশ্রয় করে। সোমলতা ছেঁচে দুধে ফুটিয়ে পান করার রেওয়াজ রীতি ছিল বৈদিক যজ্ঞে।স্বাভাবিক কারণেই তা হতো সফেন । “ফেনা” শব্দটি এখানে একটি অপূর্ব নির্মাণ ও ডিমিথ।সোম যদিও অবস্তু-অমৃত সেখানেও কবি তাকে অন্যভাবে image বদ্ধ করলেন।তা হয়ে উঠলো একেবারে বাস্তব।চমৎকৃত হতে হল “অবিদিত”শব্দটির ব্যবহার দেখে। ভাষাপথ খনন মাত্র নয়, শব্দের নতুন dimension পাওয়া গেল।
অবিদিত অর্থাৎ unknown /unidentified একটা আলোর কথা কবি বলেছেন ,তাই হল অক্ষরের পূর্ব অবস্থা বর্ণ।
জরা থেকে যায় দূরে কেননা প্রকাশের আগে এই আলো নেমে আসে কবির পুরুষ হৃদয়ে। ঠিক এখানেই বাকের “অনুচ্ছিষ্টতা”। অবিদ্যার আভায় তা আভাসিত ছিলো মাত্র। মুহুর্তে বিদ্যার স্পর্শে তা আল ও অক্ষরে ঝিকিয়ে উঠলো। সেই প্রজ্ঞান-ভূমি থেকে নির্মাণক্ষম হয়েই কবিতা পা রাখলেন কুশল পুরুষের হৃদয়ে। চলল বাক ও পুরুষের শব্দ মৈথুন। তাই থেকে উঠে এলো কবির অপূর্ব নির্মাণক্ষমপ্রজ্ঞা। এখানেই কবিতার স্থূলবন্ধন কেটে গেল। অবিদ্যা পরাজিত হলো, শব্দ হয়ে ওঠলো নির্ভার ,আলোময়। মৃত্যুঞ্জয়ী কবি ও তাঁর কবিতা ঠিক তখনই মৃত্যুঞ্জয় হয়ে উঠলেন।
সুধীর দত্তর কবিতা : ধ্বনি – ভাবধ্বনি
সুধীরের কবিতায় মহাশূন্যের একটা NUCLEUS- কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে। সেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন কবি সুধীর দত্ত স্বয়ং। আশ্চর্য আবিষ্ট চেতনায় তিনি লিখে চলেছেন কবিতা। অন্তরীক্ষ বিস্মিত। পৃথিবী পৃথিবীতে অন্তেবাসী নচিকেতা তিনি। অক্ষরগুলোকে একত্রিত করে সাজাচ্ছেন। কবিতায় ফুটে উঠছে রূপ।রস।সত্য।
ভূত ও ভব্যকে দিয়ে ঐ পরম শব্দ ধরা যাচ্ছে না।পরমতত্ত্বকে সাক্ষাৎকার করলে সীমাকে অপরিসীম মনে হয়। তখন চলে সীমা ভাঙার পাঠ। অসীমের চতুস্পাদ ভ্রমনে তোলপাড় হতে থাকে সুধীরের কবিতা ।
সুধীরের কবিতায় “ধ্বনি”–একটা প্রবল রহস্যময় অনুভূতি। পাঠক জানেন মৌনতাই এর একমাত্র ব্যাখ্যা। তাঁর কবিতায় রয়েছে একটা অবোধপূর্ণ স্মরণ, কাজেই কেবলমাত্র চিন্তার কৌলীন্যেই তাঁর কবিতা আদৃত নয়। সুধীরের কবিতায় ধ্বনির ক্রিয়াটি কেবলই বইতে থাকে কবিচিত্ত থেকে পাঠকের চিত্তে। কবি কবিতার দেহেই পুঁতে দেন ধ্বনির বীজ। সঙ্গেসঙ্গে পাঠকের বাসনালোক তোলপাড় হয়ে যায়। ভাবধ্বনির এই রণনই সুধীর দত্তের কবিতার শক্তি। স্থাপত্যের ভিতর লুকোন থাকে এই ধ্বনি।এই ই হল কবিতার ধ্রুপদী বয়নের আড়ালে সঙ্গীত।সুধীরের কবিতা সতত ধ্বনিকাব্য …এ হল সংলক্ষ্য ক্রম ধ্বনি—-
“তুমি কীট–
ভূর্জ পাতার গায়ে দংশন করো আর সবটাতে
আমিষের গন্ধ পাও, …..
….. স্বার্থপরতা
তোমাকে জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে…..
তুমি ক্ষিপ্র দশাসই গর্জমান চিতা
গুঁড়ির আড়াল থেকে আরো নান্দনিক
শানাচ্ছ প্রখর দাঁত, অক্ষরের নীচে
ফালাফালা ছিঁড়ে ফেলবে ত্বক মাংস–বিশুদ্ধ মসৃণ।….
… এক ঝলক বিদ্যুৎ-শিহর, ঝটকা
ঝাউয়ের আড়ালে সেই লীলাখন্ড– ব্যাঘ্ররূপে ডোরাকাটা হরি
লাজ হরণ করছেন হরিণীর।”
একটি রসানুকুল ভাব ও ছন্দ স্পন্দিত হয় এখানে।
——এই ধ্বনি, ভাবধ্বনি। এই ভাবের ধ্বনিত সুরেই বলতে ইচ্ছে করে,
“অবিদ্যার বিদ্যার আভা মেখে” এই বিন্যাসের ‘অবিদ্যা’ শব্দটা কি মধ্যপদলোপী? অবিদিত বিদ্যা? আর এই অজ্ঞেয় রহস্যময়তা কি তার অনুচ্ছিষ্টতার কারণ স্মরণে আসে উপনিষদের একটি পঙক্তি : ‘ অবিদ্য্যা মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়া অমৃতং অশ্নুতে। আর সুধীরের কবি-প্রতিভার একটা মহৎ বৈশিষ্ট্যই হল যে কোন লৌকিক অভিজ্ঞতাকে এক পরমার্থিক অলৌকিকতা দান করা।
পুনরপি,এর সংগে সম্পৃক্ত রয়েছে অর্থ ধ্বনি—-
“”সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায়
শুধু সৃষ্টির রূপ ও ধাতু অনন্ত শান্তি ও সমাপত্তির মতো
জেগে থাকে কল্পে কল্পে”
আসুন পাঠক আর একটি কবিতা পড়ি। আমি কবিতাটি পড়ে বিমূঢ়।কবিতার নামটাই ভাবিয়ে তোলে—“অগ্নিস্নান” // সুধীর দত্ত।(নিষিদ্ধ আঙ্গিক।)
” ভিতরে যখন পুরে নিয়ে গেছ কুণ্ডের আগুনে
জানু ভেঙে প্রার্থনা করেছি: মধ্যযাম, তুমিও উষার মতো
উরু আন্দোলিত করো
দেবতার গমনাগমনে।এই পথ
রমণীয়,প্রশস্তও। তিনি ত্বষ্টা,নির্মাণপটু
স্নানকালে যখন রোমকূপগুলি ভিজে যায়
এবং এক একটি দরজা খুলে যায় মাতৃকাবর্ণের
কবিকেও নিশি পায়।
আত্মহত্যাপ্রবণ শব্দরা তাঁকে ঘিরে নৃত্য করে,চলো
শূন্যের মুখোমুখি পাতাঝরা যে হেমন্ত
অভিকর্ষ ছিঁড়ে ফেলে
ঝাঁপ দিই—
নিঙড়ে নিই সোমলতা, হে নশ্বর অমরতা, অগ্নিযাপনে।”
কবিতাটি নিষিদ্ধ আঙ্গিক কাব্যগ্রন্থকে নতুন মাত্রা দিল। একটা অদ্ভুত মর্ত্যছবির ফ্রেমে কবি দুলিয়ে দিয়েছেন নতুন হোমাগ্নির ছবি।বিগত একশবছরের মধ্যে কবিতারাজ্যে এমন জীবন্ত ছবি দেখিনি। রক্তমাংসে কবিতার শরীরী উজ্জীবন বিস্ময়কর। অথচ একথাও অস্বীকার করার যো নেই যে এর সঙ্গে ওতপ্রোত রয়েছে অলৌকিক কোনো প্রেম ও প্রজ্ঞা কিম্বা বাকরূপিনী কোনো স্বয়ংপ্রজ্ঞ-গার্গীই নেমে এসেছেন পুরুষের সশরীরী হৃদমন্থনে? অপৌরুষেয় সেই বাক বৈখরীপ্রকাশে উজ্জ্বলা ভাস্বতী হতেই নামছেন কবিপুরুষের হৃদয়ে ও কলমে। বলতে স্বচ্ছন্দ লাগে সুধীর দত্ত সেই দেবকবি যাঁর প্রেমে ও প্রজ্ঞানে ঘন হয়ে এসেছে পারিজাতের সৌরভ। কবির কলমের দিকে চোখ রাখুন পাঠক।একটু একটু করে ফুটে উঠছে ছবি কবিতা হয়ে—
“ভিতরে যখন পুরে নিয়ে গেছ কুণ্ডের আগুনে
জানু ভেঙে প্রার্থনা করেছি: মধ্যযাম,তুমিও ঊষার মতো
উরু আন্দোলিত করো
দেবতার গমনাগমনে।”
—আসলে মনে হয় নিষিদ্ধ কেবলমাত্র আঙ্গিকটিকে বলা যেতে পারে। বলবেন তারাই যাঁরা অ-সুজন । লোক ও আলোকের প্রেম কখনোই নিষিদ্ধ নয় বলে আঙ্গিককে নিষেধের বেড়া দিতে যাওয়া ভুল।
“ভিতরে যখন পুরে নিয়ে নিয়ে গেছ কুণ্ডের আগুনে”—– লোকে বিতত হয়েও অলোকতীর্ণ হয়ে গেছে সুধীরের কবিতায়।
জল স্থল অন্তরীক্ষের মৈথুন এক মহাযজ্ঞ। কুণ্ড সাজিয়েছেন বাক্ স্বয়ং।সার্বভৌম সে এক যজ্ঞের কথা লিপিত হয়ে গেছে সুধীরের পংক্তিতে পংক্তিতে। কুণ্ড ইতিমধ্যেই জ্বলছে—সে কুণ্ডে প্রতিভপুরুষকে দিতেই হবে মৈথুন-ঝাঁপ। এই আয়োজনই তো চলছে সৃষ্টিকে ঘিরে। যজ্ঞসেন-কবিতার কবিতাজন্ম হবে। জেগে রয়েছে তাই কবিপুরুষের একান্তিক আশ্লেষ। কবিকেই গুহাদ্বারে হাঁটুভাঙতে হবে, হতে হবে নতজানু, এইই পথ।
সময়টা মধ্যযাম কেন? কবি কি মহাকৌলতান্ত্রিক ? তন্ত্রের অনুষঙ্গরূপে মধ্যযামযাম তাই এল?
সঙ্গে আসছে আরো একটা ছবি। কে সেই যিনি ঊষার মতো কিন্তু ঊষা নন? অদ্ভুত প্রহেলিকায় ছাইছে কবিতার আড়বাড় চারপাশ। দেবতাদের গমন আগমনই বা কিসের দিকনির্দেশ? রতিমাধুর্য? কে এই ঊষাকল্পা যিনি দেবতাদের গমনাগমনে উরু আন্দোলিত করেন? প্রাকৃতিক ঊষাকালের একটা প্রচ্ছন্ন ছবি আঁকলেন কবি মিথুনলগ্নতার প্রেক্ষাপটে।
এ এক পূর্ণমিথুনবৈভবের লোকায়ত ছবি।এখানে কি তবুও বিন্দুমাত্র জড়িয়ে নেই ব্যক্তিক ভাবমণ্ডল?
এরি মধ্যে এসে ঢুকলো অন্য মিথ।ত্বষ্টার নির্মাণের কথা, বিশ্বকর্মার কথা। এ তবে কিসের নির্মাণ ? কবিতাদেহের? তারি এই আয়োজন? প্রেমপথে?
তবে কি এখানেই শব্দদের যৌনস্নান হবে। স্নান শেষে সমাগতা ভদ্রাবাক্ কি কবিতার জন্ম দেবেন? অপৌরুষেয় পুরুষের প্রতিভায় টইটুম্বুর হবে। কবিই তো বলেছেন —
“স্নানকালে যখন রোমকূপগুলি ভিজে যায়
এবং এক একটি দরজা খুলে যায় মাতৃকাবর্ণের
কবিকেও নিশি পায়।”
—- নিশি পাওয়া তো তন্ত্রের অন্য আঙ্গিরস। কবিকেও নিশি পায়??নিশিথরমণের মোহ সে কি? জন্মের অকুস্থল ও অনুকূল সময়? শব্দশিকারী কবি সবসত্তা দিয়ে তুলে নেন রমিত শব্দদের। ভোরবেলা ত্বষ্টাকবি কবিতা গড়বেন। মাতৃকাবর্ণের দরজা খুলে ফেলেন কবি, শব্দেরা আসবে বলে। এইভাবে জৈব-অজৈব উৎসবে ফলে যায় কবিতাযাপনের ফল।
শব্দেরা নামছে বৈখরীস্বপ্নে।পৃথিবীর চোখেও মায়াকাজলের ঘোর।এত নিবিড় আয়োজন,তন্ময়তা তবু তারা আত্মহত্যাপ্রবণ কেন?তবে কি পশ্যন্তীবাক্ বৈখরী হলে তাকেই আত্মহনন বললেন কবি? এরপরেও তো প্রশ্ন আছে… অভিকর্ষ ছিঁড়ে ফেলবে কেন জীবন্ত কবিতাদেহগুলো? এই যে নতুন কবিতাজীবনের বন্ধন তাও কি সয় না? অভিকর্ষ ছিঁড়ে আবার উড়ে যেতে চাইছে মাতৃকাবর্ণের প্রচ্ছন্ন আশ্রয়েই? সোমলতার আসক্তিতে কেন তবু রয়ে যায় অলৌকিক কবিপ্রাণের সিসৃক্ষার ইতিহর্ষ!!!! মধ্যযামের কোনো অগ্নিস্নান-যাপনে !!!!
সুধীর দত্তের কবিতা সম্পর্কে কিছু ভাবনা।(নিষিদ্ধ আঙ্গিক কাব্য গ্রন্থ)
বাকের সঙ্গে কবির অনন্তমৈথুনে জেগে ওঠে শব্দ। এ যেন কবি সুধীর দত্তের অভিচারি সাধনা ।কৌলতান্ত্রিক এক কবি যেন মৃত শব্দের দেহে জাগাতে চান নতুন প্রাণ ।শব্দের ওপরে কবি ঠায় বসে থাকেন। তাঁর অপেক্ষা এই জন্য যে জীর্ণ শব্দরা দেহ ছেড়ে দেবে আর নতুন দেহে মুখর হবে। আকাশের কোণে এক অনাশ্রয় শূন্যতায় দোল খাবে ওরা। তারপর শেষ যামে জাগবে শঙ্খিনী বাক ।তার শ্রোণীভার,উচ্চাবচ, ঠেলে সে যাবেই বা কোথায়? কবি বসে থাকেন তারই অপেক্ষায়।হাতে চিজেল দুর্মর আঘাত,,,, এইতো! এইতো !মন্ত্র ফুটছে শ্রী অঙ্গে ,একটু একটু করে। প্রতিস্পর্ধী এই কবিকে দেখে দেবতাদের ও বিস্ময় জাগে। সমিধের মত পুরণোশব্দরা পোড়ে কাব্যের মহাযজ্ঞে। আত্মাহুতিতে অদ্ভুত স্তব্ধতা নামে। দেবী এখন প্রস্তুত সঙ্গমের জন্য। শুরু হোক অভিচারি ক্রিয়া। শব্দ তন্ত্রে এখনই বাজবে দেহের ঝংকার__
“আমিও দণ্ডটি ভেঙে প্রযত্ন শিথিল খেলা করি বিরাট শিশুর মত। (আকাশ আরপার)
কিংবা” সব মাত্রা ভেঙে” কবিতাতেও দেখি ওই ঝংকার
“কোথাও সুউচ্চ টিলা ,নিম্ন নাভি ,আরও নিচে
যে নাবাল ত্বক
ছুঁয়েছি গোপনে তার
স্ট্রবেরি ফলের লাল ক্ষেত।”
ইতিমধ্যে সুধীর পড়ে ফেলেছেন আত্মা অনাত্মার ভেদ, শারীরিক ভাষ্য। সেখানে ছোঁক ছোঁক আমিষ শব্দরা নির্লজ্জতায় অতিষ্ঠ করে দিতে পারে পাঠকপাড়া।তার আঁশটে গন্ধে পাঠক পেয়ে যাবে শব্দ শরীরের গোপন স্বাদ। যেন চতুর কানাই জানে সুরের মারণ——-
“দাদু গড়গড়া টানে বাবাও নিশ্চুপ আর তুমি
গোপন সংকেত রাখ,শব্দরাও আতিবাহিক
মাঝরাতে টোকা দেয়, জানতাম তিনি আসবেনই”
(জানতাম তিনি আসবেনই”)
এসব পংক্তি উচাটনে পাঠককে টানে। পাঠক পায় গমনের আস্বাদ, ঘ্রাণ । আভিচারিক শব্দ স্নানে কোন যৌবনা গোপন সংকেত রাখে স্নানবতী হয়ে। মাঝরাতে টোকা দেয়। রাঢ়বঙ্গের মাংসাশী কবি জানতেন সেই তিনি আসবেনই। কে তিনি? নিষিদ্ধ আঙ্গিক যাতে উৎসর্জিত? গার্গী? যাতে কবিই স্বয়ং ওতোপ্রোত?
কবি সুধীর জানেন সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে হবে তাঁর দিকে ।সেই অনন্তের ঘরে ।যাকে বিপথ ভাবছি সেও একটা পথ।” ইনফারনো ও পার্গেতরিয়”_র ভেতরে দিয়ে কবির যাতায়াত। এ চলা ইউলিসিস এর মত কতকটা।কবি যখন লেখেন—
” আমি কবি অনুশাসিতার, এক অদৃশ্য সুতোয় /দৃশ্যের ভিতরে দৃশ্য, আপাত অস্থির সাম্য ভেঙে/ চৈতন্য প্রবাহে গেঁথে রাখি /এ এক ঐশ্বর যোগ”।
তখনই পরিচ্ছন্ন বাসনায় কবি আবারও বলে ওঠেন—
“খেলাচ্ছলে যদি একটু নড়ে ওঠো সম্মতিসূচক ভেঙে ফেলব পূর্বাপর,
লিখব জঙ্গম এক রমণীর নিষিদ্ধ আঙ্গিক”।
(নিষিদ্ধ আঙ্গিক)
সমস্ত চিত্রকল্প এসে জড়ো হয়েছে মুক্ত অনুষঙ্গে আর কবি পাঠককে দিচ্ছেন উপহার —
“মস্তিষ্ক তোলপাড় করে/ ঋষিকল্প কাম, শরবনে /অরক্ষিত হরিণীরা, শব্দের শীৎকার ,বিঁধছ মেধাবী শায়ক” কবি নিশ্চিত জানেন——-
“নির্মাণের সারা গায়ে দেগে আছে হত্যা প্রবণতা
চন্দ্র কলঙ্কের মতো
ভিজে ও কর্কশ কামাতুর!”
(“শব্দশিকারি”)
এই বিচ্যুতি অনিবার্য ছিল ।এ একেবারে কবির শিল্পিত বিন্যাসে নতুন জন্ম পেয়েছে। জয় গোস্বামীর কবিতায় কোথাও কোথাও এই প্রকরণের কৌশলের ব্যবহার আছে।সোমযাগ, তেজস্ক্রিয় ,মুখচ্ছদ- শব্দ গুলিতেও অর্থ সংক্রমণ ঘটেছে তাদের পারস্পরিক চয়নে অর্থে ও বয়নে।চেনা জাল শব্দরাও অপরিচয়ের প্রকাশে আত্মলীন।সুধীর এই ভাবেই পারিভাষিক শব্দের ব্যবহারে নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন।
“প্রজ্ঞা পারমিতা কবিতাটি দিয়েই নিষিদ্ধ আঙ্গিক আলোচনার ইতি টানবো নিষিদ্ধ কিন্তু অসুন্দর নয়। এখানেই শিল্পের উৎকর্ষতা।
স্রষ্টা যখন তাঁর চিন্তা ও চেতনাকে উপলব্ধির গভীর ও অনন্য সংরাগকে প্রকাশ করতে পারেন না তখনই প্রচলিত সংরূপ নির্মমভাবে ভাঙতে ভাঙতে চলেন। তিনি তখন মেফিসটোফিলিস হয়ে যান ।এই ভাঙ্গাগড়া এক নতুনতম শৈলীগত বিচ্যুতির এলাকা।
প্রজ্ঞা পারমিতা কবিতাটির বামসজ্জার ঘরে রাখা লাইনগুলো চমকিত করে—-
১)”তবু তুমি মুচকি হাসো,” (বাম সজ্জা)
অনুষঙ্গ—-“খুলে তো যায়ই মুখ, সন্ধি স্থান যখন ভাঙ্গেন হাঁটু কবি।”
২)” ব্রীড়া বনত চোখ “_(অনুষঙ্গ ঐ)
৩) “ইনি প্রজ্ঞা পারমিতা” (বাম সজ্জা),
অনুষঙ্গ—- আপনি এখনো জেগে। ভাত ঘুমে ঢলে পড়ল চাঁদ”।
“অন্ধকারে আলো জ্বেলে বললেন ,জানি “এটি ও অনুষঙ্গ আরেকটি বামসজ্জার—-
“আপনি অমিতাভ”
“ডান হাতে সিঁধেলকাঠি ,নিশিকুটুম্বের মত /ইহজন্মে ঘুরে বেড়ান এ বাড়ি- ও বাড়ি।”
অসাধারণ বিন্যাস শুধু নয় বারবার দেখেছি সুধীরের বুদ্ধচেতনার আলো অজানিত আরো কোনো এক আলোর দিকে দিক নির্দেশ করে …. unidentified light…কবিতায় এ যেন ভিনগ্রহ থেকে এসে পড়া কেতুর আলো, যার চলন বাঁকা কিন্তু ঐশ্বর্যময়। পারমিতা স্পষ্ট বলেছেন
” আপনি পায়সান্ন লোভী”_ আশ্চর্য মৃদু ভৎসর্নায় স্বয়ং প্রজ্ঞাও মুখর।বাক্ কখনো কামুকী কখনো শঙ্খিনী—–
কি অনাস্বাদিতপূর্ব রোমান্টিক কবির এই শ্রেণী ও শ্রোণী বিচারের পদ্ধতি ।বাক ও মর্ত্য এক হয়ে গেছে ।সুধীরের প্রেম টেক অফ করেছে মাটির পৃথিবী থেকে কিন্তু ল্যাণ্ড করেছে সম্পূর্ণ অন্য লোকে।
কখনো বসেছে জন্মান্তরের কায়ব্যুহ রচনার আত্ম বিশ্লেষণ _কল্প যায়,চতুর্যুগ সহস্র অগণন।”
কখনো এসেছে ইতিহাস ,অনুষঙ্গ হিসাবে—-
“বড়ো জোর ইনকা মায়া ব্যাবিলন মেসোপটেমিয়া
(আহ্লাদী এক মায়া)
কখনো এসেছে পৃথিবীর ভূগোল-
“আর যাওয়া হল না।তাই /এক পাদে হেঁটৈ যাচ্ছি কিন্ডারগার্টেন।/শুরু হবে শিশুকাল,বলাকার মতো”_
এ কি বলাকা কিণ্ডারগার্টেন নামে কোন শিশু বিদ্যালয়ের প্রসঙ্গ? কবির স্মৃতি জড়ানো কোন বিগত শৈশব ?আহ্লাদী এক মায়া। কবিতায় দৃষ্টি কেড়েছে আরেকটি শব্দবন্ধ—“চাঁচর বালি চড়া”।এটির অনুরণনে ভেসে আসে বিষ্ণুদের আঘ্রাণ। সুধীর এই শব্দকল্পটিকে ব্যবহার করেছেন “অন্যপূর্বা” শব্দচিত্র হিসেবে।
এই দেখুন কথা দিয়েছিলাম “প্রজ্ঞাপারমিতা” কবিতার আলোচনা দিয়েই শেষ করব সুধীরের “নিষিদ্ধ আঙ্গিক”এর আলোচনা ,তার প্রেম ভাবনাটি। হল না। অদ্ভুতভাবে পথ আটকালো তাঁর রোমান্টিক চলনটি। তিনি আদ্যোপান্ত রোমান্টিক। তাঁর ডানায় বিহঙ্গের উল্লাস। তাঁর ওড়ায় গরুড়ের তীক্ষ্ণ স্বনন। রোমান্টিক তীব্রতায় “দ্রাক্ষাফেনায়” কবিতায় কবির আত্ম-উক্তি monologue এর মতো লিপিত হয়েছে । ভঙ্গিটি কথোপকথনের মতো যদিও —-“যা কিছু অত্যন্ত তুমি গর্হিত জেনে /ঠোঁটের ফাঁকটুকু বন্ধ রাখো, যদি/দৈবাৎ চিতার মতো হিংস্র কোন কবি” যদি “তোমার প্রত্যঙ্গ খুলে কবিতায় সংস্থাপন করে/”।
কবির বাঁহাতে তাই রেশনের থলে, কার্ড। এও কি সম্ভব? এমন শরীরে অশরীরে মিশে যাওয়া একান্ত মানবীয় প্রেম? কখনোবা তারপরেই অপ্রাপ্তির অন্যমনস্কতায় কবির মনে হয় —“এইতো কিছু পাওয়া গেল সন্ধ্যেবেলা। নিরম্বুই ভালো ,আরো নিবিড় ,ঘনিষ্ঠতর /লাজ বস্ত্র হয়ে ঢেকে থাকা “।আশ্চর্য স্থিরাবস্থায় পৌঁছে গেল উদ্বেল রোমান্টিকতা। কোনো মৃদু সুন্দর ভর্ৎসনায়—–
” বিকট অস্থির তুমি ,এই ঢের, অচল কূটস্থ হও /সমাধিবানের মতো স্থির”। (দ্রোক্ষাফেনায়)