You are currently viewing শেলী জামান খানের কবিতা

শেলী জামান খানের কবিতা

শেলী জামান খান

 

একজন নেতা চলে গেলেন

 

আমি একাত্তর দেখেছি,

মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি!

বঙ্গবন্ধু’র বজ্রকণ্ঠের ভাষন শুনেছি।

কিন্তু কখনও তাঁকে চোখে দেখিনি।

 

ছোটবেলায় পত্রিকায় তর্জনি উঁচু করা ছবিটি দেখেছি!

আব্বা বলতেন, এই মানুষটার  জন্ম হয়েছে নেতা হওয়ার জন্য।

তাকে নেতা হিসেবেই মানায়।

 

সেই বয়সে আমি নেতা বুঝিনি!

তবে গমগমে কণ্ঠের জাদু বুঝতাম।

বুকে তোলপাড় হত, সেটা জানতাম।

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠা টের পেতাম।

তার বিশেষ  কিছু ছবি দেখলেই মনে হত,

এ’যেন আমার পিতা’র মুখ।

 

থুতনির ভাঁজে,

ব্যাকব্রাশ করা চুলে,

ভারী কালো ফ্রেমের চশমায়,

হাতের টোবাকে পাইপে!

বড় পরিচিত সেইসব ভঙ্গিমা!

হাতা কাটা গেন্জিতে

চেকচেক লুঙ্গিতে,

মুখের হাসিতে,

তাকানোর ভঙ্গিতে!

আব্বা বলতেন,

৭ মার্চের ভাষন ছিল ছাইচাপা আগুন।

 

সেই ভাষণে যাদু ছিল!

মানুষের রক্তে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আগুন।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আমরা কেবল রেডিও শুনতাম।

লেপের তলায় লুকিয়ে,

আওয়াজ কমিয়ে!

বাহাত্তরে তিনি দেশে ফিরলেন।

তার কণ্ঠ তখন ভঙ্গুর,

কান্নাবিজড়িত।

 

রেডিওর পাশে গোল হয়ে বসে আমরা তা শুনেছি!

সেদিন আমাদের সবার চোখ ছিল অশ্রুসজল।

৭৫ এর সেই রক্তাক্ত দিনটি আজও

মনে আছে।

আব্বা’র মুখ জুড়ে সদ্য তৈরি করা সেভিং ফোম!

হাতে রেজর!

টেবিলের বড় আয়নার সামনে নিথর বসে আছেন তিনি।

একপাশের দাড়ি অর্ধসমাপ্ত।

 

রেডিও বাজছে!

আব্বার হাত থরথর করে কাঁপছে,

নির্বাক চোখ!

চক্ষু শুস্ক, দৃষ্টি বিভ্রান্ত!

আমরা একে একে রেডিও ঘিরে গোল হয়ে বসেছি।

 

আমাদের ঘরে তখনও টেলিভিশন আসেনি।

একজন নেতা চলে গেলেন।

আমরা কেউ তাকে চোখে দেখিনি!

কেবল তার কণ্ঠ শুনেছি।

“রক্ত যখন দিয়েছি; রক্ত আরও দেবো”!

এভাবেই বাঁশি বাজিয়েছিলেন, বাঁশিওয়ালা।

মানুষ দলে দলে, ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত দিয়েছিল।

 

অবশেষে, জাতির জনক স্বয়ং গুলিবিদ্ধ হলেন!

তারই রক্তে প্লাবিত হল স্বাধীন বাংলাদেশ।

বড় হতে হতে উপলব্ধি করলাম,

শেখ মুজিব ‘নেতা’ হতেই জন্ম নিয়েছিলেন!

শাসক হতে নয়!

নেতাদের কখনও শাসক হতে নেই!

 

‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই! ‘

একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে,

স্বাভাবিক মৃত্যুর  নিশ্চয়তা বড় প্রয়োজন!

 

চামেলি হাউস

চামেলি হাউস আজও ঠাঁয় দাড়িয়ে আছ গলির মোড়ে ।

বিষন্ন চোখে সারাদিন সে পথচারীর আনাগোনা দেখে।

ক্লান্তি জমেছে  শুন্য, জরাজীর্ণ লেটারবক্সের  শরীরে

যেন যে কোন সময় সে ধ্বসে পড়বে পথের পড়ে।

আশেপাশের বাড়িগুলো প্রতিক্ষণ আড় চোখে তাকে দেখে,

উদাস ছায়া তাদেরও চোখেমুখে।

ইশ, কেউ কি নেই ওর?

কেন কেউ করে না কোন খোঁজ!

আহা, কত শ্রী ছিল একদিন চোখেমুখে।

ঘাড় ঘুড়িয়ে সেও দেখতো  অন্য বাড়িগুলোকে।

ওর দক্ষিনের বারান্দাতে,

সকালের রোদ্দুর বসতো আসন পেতে,

গোটা চারেক আচারের বয়াম রোদ লাগাতো গায়ে।

পত্রিকা হাতে, অধ্যাপক মশাই এসে বসতেন ইজিচেয়ারটাতে।

 

বারান্দার কোনে কাঠের তেপয়াতে,

‘লা নুই বেঙ্গলী’র সাথে দুটো চায়ের কাপ শোভা পেতো তাতে।

যতক্ষণ না সন্ধ্যার ছাঁয়া ঘণিয়ে আসতো,

মির্চা এলিয়াদ না মৈত্রেয়ী দেবী, কার ছিল বেশী ভালোবাসার বড়াই,

এই নিয়ে ঝাঁকড়া চুলের যুবকটির সাথে চলতো চামেলির লড়াই।

কাঁঠাল গাছে বাঁধা দোলনাটি আজও আছে,

বাতাসে খানিকটা দুলছে মাঝেমাঝে।

যেন বসে দুলছিল কেউ,

এইমাত্র উঠে চলে গেছে।

উঠোনের নেড়ি কুকুরটি ঘাড় বাকিয়ে ঘরের ভেতরে দেখে,

খাবারের খোঁজে সে আশালতা দেবীকে খোঁজে।

বদ্ধ দরজার ওপাশে আলো-আঁধারির খেলা।

শার্শিভাঙ্গা জানালা টপকে মাঝেমধ্যেই হেরোইনসেবীরা আড়াল খোঁজে।

পাটের দড়িটি উঠোনের আমগাছে সেভাবেই বাঁধা আছে।

যেখানে মেলে দেয়া শাড়ি, ব্লাউজ শুকাতো রোদে।

ফটকের শ্বেতপাথরের নেইমপ্লেটটি এখনও জ্বলজ্বলে।

ঘোষনা করছে, চামেলিরা একদিন ছিল এ বাড়িতে।

কড়িবর্গার পোড়া দাগগুলো, দেয়ালে গুলির ফুটো

বলে দেয়, বাড়িটি ধর্ষিত হয়েছিল একাত্তরে!

 

======================