You are currently viewing ৫টি কবিতা > লুইজ গ্লিক।  ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর

৫টি কবিতা > লুইজ গ্লিক। ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর

৫টি কবিতা

লুইজ গ্লিক

ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর

 

পুকুর

 

রাত্রি তার পাখার নিচে ঢেকে রাখে পুকুর

আজ চাঁদের চারপাশে একটি আলোর চাকতি

আমি কিন্তু এমন করতেই পারি-

তুমি সাঁতরাচ্ছো ছোট ছোট মিনোও মাছের সাথে

আর উপরে নক্ষত্র কাঁপছে সংরাগে।

রাত্রির বাতাসের নিচে পুকুরে জলের পিঠ

স্থির, অনড় ধাতব।

 

প্রাণান্তরে তোমার চোখজোড়া সজাগ।

আমি টের পাই তোমার চোখের পিছুটান

আমাদের স্মৃতি বসত করে ওই চোখে- আমরা

একসাথেই ছোট থেকে ডাঙর হয়েছি।

পাহাড়ের কাঁধে চড়ে বেড়াতো আমাদের ঘোড়া

ধূসরতার উপর সাদা ডোরাকাটা আমাদের অশ্বদল।

তারা এখন ফেরি করে মৃতদের সাথে

যেন তারা ঘোড়া নয়- নেহায়েত শিশুদের দল

যারা উৎকন্ঠায় নিরাপত্তার চাদরের নিচে মুহ্যমান।

 

আমাদের থেকে পাহাড় অনেক দূরে

ওরা কালো, শৈশবের থেকেও ঝিম কালো।

তোমার কপালে ভাবনার বলি রেখা-

আকাশ পাতাল কী এমন ভাবছো জলের সিথানে শুয়ে?

তুমি যেই না জলের অতলে চেয়ে দেখো-

মন বলে, তোমাকে ছুঁই, একবার ছুঁয়ে দেখি

না- নিজেকে সামলে রাখি-

মনে হয়, কোন এক আর জনমে আমরা

হয়তো বা এক রক্তের জ্ঞাতি ছিলাম।

Luise Gluck : The pond.

 

প্রজাপতি

 

দেখো, দেখো প্রজাপতি।

তুমি কি প্রজাপতির কাছে মানত করেছো?

ওর কাছে বর চেয়ো না।

তোমরা তা করো। তুমি কী তাই করেছো?

করেছি তো।

মনে রেখো না।

Luise Gluck : The butterfly.

 

শিক্ষার্থী বাছারা

 

আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সামনের দিকে যায়

তাদের মায়েরা লাল আর সোনালি নাইমলা আপেল কুড়াতে ব্যস্ত

যেন তারা ভিনদেশী ভাষা থেকে একটা একটা শব্দ তুলে আনে।

 

বোধ ও বোধি জারণের দিকে

অধীর অপেক্ষায় অমূল্য উপঢৌকন পাবার আশায়

ওদিকে হাত বাড়িয়ে আছে তারা।

 

তারা কতোটাই না শৃঙ্খলার নিগড়ে

সংহত হয়ে ওঠে-

তারা পরণের কোটগুলো ঠিকঠিক আঙটায় রাখতে জানে।

 

তাদের শিক্ষকগণ পাঠদান করে নীরবতায়

মায়েরা বেরিয়ে আসার মুখে ফলবাগান গুছিয়ে আসে

পাকা ফলভারে খয়েরি ডালগুলো সাবধানে

তাদের দিকে টেনে নামায়-

যেখানে গোলার বদলে ফলের সম্ভার ফুটে আছে।

Luise Gluck : The school children.

 

লাল পোস্তাদানা

 

কারো মন আছে

এটিই হতে পারে না

সবচেয়ে বড় কথা। মোক্ষম জিনিস বোধ :

ওটাই আছে আমার।

ওরাই আমাকে পথ দেখায়।

স্বর্গে আমার এক পরমেশ্বর আছেন

যিনি সূর্যের অধীশ্বর,

সূর্যের ভিতরটা উন্মোচন করেন

আমারই প্রাণের আগুনে নিজেকে রাঙান

অগ্নি তারই অবস্থিতির জাগর।

প্রাণের মহিমা ছাড়া এমন সম্ভ্রম

আর কিসেই বা হতে পারতো?

ওহে আমার ভাই ও ভগ্নিগণ-

মানুষ প্রাণি হয়ে ওঠার বহু আগে তোমরা কী

একবারের জন্যও আমাকে মায়া করেছিলে?

তুমি কী স্বজ্ঞানে খোলসের বাইরে

বেরিয়ে এসেছিলে একবার, কেবল একবার

যারপর আর কখনোই বাইরে আসোনি?

সত্যের নাভিমূলে দাঁড়িয়ে এখন আমি কথা বলছি

তুমি যেভাবে তা করো।

 

আমি কথা বলছি-

কেননা আমি  এখন খণ্ডিত, টোটাফাটা।

Luise Gluck : The red Poppy.

 

সকাল সকাল অন্ধকার

 

কোন ভরসায় তুমি বলো

দুনিয়া আমাকে উৎফুল্লতা দেবে?

যা কিছু জন্ম নেয় সবই আমার উপর

চেপে বসে।

তোমাদের সবার জন্য আমি একচুল এগুতে পারিনি।

 

তুমি আমাকে চালাতে চাও

তুমি চাও তুমি বলবে আমি শুনবো

শোন, তোমাদের মধ্যে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ-

যাকে দেখতে বেশি আমার মত লাগে।

আর তুমিই জীবনের মোক্ষমকে অন্তরে রাখো

আলাদা হতে চেয়েও পেরে ওঠো না

তা তুমি বুঝতে দাও।

 

যদি নিজেদেরই বুঝতে না পারো

তাহলে  বুঝতে চাওয়া সোনার পাথরবাটি।

তোমার স্মৃতি এতোটা শক্তিমান নয়

যা এতো দূরের কিছু তুলে আনতে পারে-

 

কখনও ভুলে যেও না তোমরা আমার সন্তান

এ কারণে ভোগান্তি সইছো না যে

তোমরা একজন আরেকজনকে স্পর্শ করেছো

তোমরা এভাবে নাকাল হচ্ছো

কেননা তা জন্মের সঙ্গে এসেছে,

এটি জীবন- যা তোমাকে আমার থেকে

আলাদা করেছে।

Luise Gluck : Early Darkness.

লুইজ গ্লিক ২২ এপ্রিল ১৯৪৩ সনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

লুইজ গ্লিক কবিতায় ব্যক্তিগত বেদনা ও নিঃসঙ্গতার  ফোঁড় তোলেন, ব্যক্তির ব্যথাকে সামগ্রিক অভিজ্ঞানে আঁকতে জানেন তিনি- ২০২০ সনে নোবেল কমিটি গ্লিকের কবিতার অবদান বর্ণনা করার সময় এভাবেই কথাটি বলেন। ব্যক্তিগততা থেকে কবি-কে আলাদা করে একজন দর্শকের কাতারে সরিয়ে আনার বিরল সৃজনশীলতায় ঋদ্ধ লুইজ গ্লিক।

গ্লিকের কবিতা বাস্তবের নিটোল সুতোয় বোনা- যার মধ্যে নানা বর্ণ ও স্তরের সমাহার ঘটে। তিনি তাঁর সুখ্যাত ওয়াইল্ড আইরিসে প্রণম্য মুন্সিয়ানায় গ্রিক ও রোমান পুরাণ ব্যবহার করেন- একবিংশ শতকে পশ্চিমের পারিবারিক জীবন, যৌনতা, মিলন ও বিচ্ছেদের চালচিত্র পৌরাণিকতার সূত্রে কবিতায় প্রাণিত করে তোলেন।

এ ভিলেজ লাইফ বইয়ের কবিতাগুলো উপন্যাস ও ছোটগল্পের মনোভঙ্গিমায় লেখা; ওখানে তাঁর অভীক্ষা ছিল কৃষিপ্রধান গ্রামের নাই হয়ে যাওয়ার একটি ঔপন্যাসিক বিবরণ কবিতার কাঠামোয় তুলে আনা; এ-যেন কবিতার শৈলীতে বলা এক হাসুলি বাঁকের উপকথা।

সামগ্রিক কবিতাযাত্রার ভিতর দেখি- জীবন ও কবিতা নিয়ে লুইজ গ্লিকের ধোঁয়াশাবিহীন বোঝ ও অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে তাঁর সমকালে অন্যদের থেকে মৌলিক অনন্যতায় চিহ্নিত করে- যিনি অবলীলায় ব্যক্তিকে সামষ্টিকতায় আর সমষ্টিকে ব্যক্তির আয়নায় প্রতিবিম্বিত করতে জানেন।

****************************

বদরুজ্জামান আলমগীর

অনুবাদক, কবি ও নাট্যকার

==================