You are currently viewing ১২৫ বছরে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা : শ্রদ্ধাঞ্জলি >ফাল্গুনী ঘোষ

১২৫ বছরে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা : শ্রদ্ধাঞ্জলি >ফাল্গুনী ঘোষ

১২৫ বছরে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা : শ্রদ্ধাঞ্জলি

ফাল্গুনী ঘোষ

গভীর কবিতা অনুভবের। অনুভূতিকে প্রকাশ করা কঠিন ব্যাপার। তবুও করতে হয় সম্ভাব্য শব্দের শরীর দিয়ে। স্পেনের কবি লোরকা—- ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮ —– ১৯৩৬)।তাঁর নামের সাথে ও লেখার সাথে আমার পরিচয় ২০০০ নাগাদ। আমাদের বাম বাংলায় লোরকার জন্মের একশো বছরে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৮ এর কালে লিটল ম্যাগাজিনগুলি সরকারী ও বেসরকারীভাবে তাঁর উপরে লেখালিখি ছাপে। আমি ওই সময়ে কলেজ পাশ করে কিংবা কলেজে পড়তে পড়তে লোরকার নাম শুনি। কিছু বই কিনে পড়তে শুরু করি।
২০০৮ এর সময়ে আমি কোলকাতায় বসবাস করতে করতে স্পেনীয় ভাষা চর্চা করতে থাকি। সেই সূত্রে লোরকাকে আবার আবিষ্কার। লোরকার আগে আমি চিলির কবি পাবলো নেরুদাকে পড়ে ফেলি আমি গভীরভাবে।যাইহোক ১২৫ বছর পেরিয়ে লোরকাকে আমরা স্মরণ করছি বরণ করছি এ এক অনন্য বিষয়।
একজন কবির বড় হয়ে ওঠা কিভাবে তার শৈশব কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তা আমরা জানি।কারণ কবিতা বা শিল্প কবি বা শিল্পীর যাপিত জীবনের কণ্ঠস্বর।কবির লেখার কেন্দ্রে থাকে প্রকৃতি ও মানুষ, কখনও অতিপ্রকৃতি।লোরকার জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটছে তার পল্লীগ্রাম ফুয়েন্তে ভাকেরোস এ, যা আন্দালুসিয়া প্রদেশের অন্তর্গত। এগারো থেকে কুড়ি এই কৈশোর ও প্রথম যৌবনের দিনগুলি গ্রানাদা শহরের শান্ত ও সবুজ পরিবেশে তার বড় হয়ে ওঠা। ফেদেরিকোরা চার ভাই বোন। দুই ভাই দুই বোন। ভাই ফ্রান্সিসকো, দুই বোন কনচিতা ও ইসাবেল। বাবা— ফেদেরিকো গারসিয়া রোদরিগেজ এবং মা ভিসেন্তা লোরকা রোমেরো।
শান্ত বিজন মফস্বল শহর গ্রানাদাকে ভালোবেসেছিল কবি। সবুজের অদ্ভূত সমারোহ তুষারাবৃত পাহাড়, আলহামব্রা পাহাড়ের এলম্ ও সাইপ্রেস গাছগাছালি, ছোটো নদীর অশান্ত পথ চলা কবির কৈশোরের দিনগুলিকে এক অনন্ত আনন্দ দিয়ে যায়। কাব্যিক প্রকৃতির মাধুর্য লোরকার কবিসত্তাকে গড়ে তোলে। ১৯২০ খ্রিঃ কবি বাইশ বছরে ওই গ্রানাদাতে বসে যে কবিতা লেখেন তার প্রতিধ্বনি শুনি—
 
” সুরেলা নক্ষত্র
ঘুমন্ত মাঠের উপর,
ব্যাঙেদের পুরোনো বন্ধু
এবং ছায়াচ্ছন্ন ঝিঁঝিঁ,
তোমাদের সোনালী সমাধিফলক
চঞ্চল সূর্যের কিরণে,
যা তোমাকে যন্ত্রণাক্ত করে. মিঠেল করে গ্রীষ্মের শক্তিতে।
সূর্য বয়ে নিয়ে যায় তোমার আত্মাকে
আলোর নির্মাণে।”
(“সিগারা” , মাছি, অনিষ্ট, ৩, ১৯১৮ ,গ্রানাডা)
 
১. “এক হাজার প্রজাপতি কঙ্কাল
ঘুমায় আমার শহরে।”(“নক্ষত্রের সময়”)
২. “একটি তরুণ বাতাসের জন্য
জনতা নদীর উপর “।(নক্ষত্রের সময়)
৩. “তোমার গান ঝরে পড়ে পাখিদের আত্মা থেকে”। ( গাছগুলি)
 
এইসব লাইনগুলি পড়লে বোঝা যায় কবির কৈশোরত্তীর্ণ হৃদয়ের গান।
গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দন ফেরনানদো-র কথায় যিনি ছিলেন স্পেনীয় সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা, লোরকা গেলেন রাজধানী মাদ্রিদে, লোরকা মাত্র কুড়ি। মাদ্রিদের একটি প্রগতিবাদী স্কুলে তিনি ভর্তি হলেন ।যে স্কুল অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজের মত সংস্কৃতি ও চিন্তন চর্চার মধ্য দিয়ে একটা মুক্তমনা সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। এই স্কুলে পড়াশোনা লোরকার জ্ঞানের দিগন্তকে প্রসারিত করলো। ১৯২৪ খ্রিঃ মাদ্রিদে একটি লেকচার সোসাইটিতে তিনি সুযোগ পেলেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পণ্ডিত ও দিকপাল সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে আসার। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ক্লদেল, ভালেরি, সঁদ্রার, ম্যাক্স জাকব, মারিনেত্তি,মাদাম কুরি, এইচ.জি.ওয়েলস. চেষ্টারটন, প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
ওই ১৯২০ এর দশকে মাদ্রিদে লোরকার প্রিয় বন্ধুরা ছিলেন কবি রাফায়েল আলবের্তি, চিত্রকর সালভাদোর দালি, চলচ্চিত্রকর লুইস বুনুয়েল, দালির সাথে লোরকার বন্ধুত্ব ছিল প্রবাদিত —-
লোরকা লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা “দালির প্রতি”— গভীর ভালোবাসার সেই বন্ধুত্বে আমরা পাই—
 
“আমি এক সাধারণ চিন্তার গান গাই
যা আমাদের এক করে অন্ধকার ও সোনালী সময়ে,
যে আলো আমাদের চেষ্টা গুলোকে অন্ধ করে তা শিল্প নয়,
বরং তা হ’লো ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, ঝগড়াঝাটি।”
 
লোরকার প্রিয়তম আবেগ ছিল কবিতা, থিয়েটার এবং গান। ১৯২৭ এর কালে তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে পাঁচটি বই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। ‘কবিতার বই’, ‘গভীর গানের কবিতা’, ‘সুইটেস’ , ‘সঙ্গীত’, এবং ‘জিপসী ব্যালাডস’।
১৯২১ খ্রিঃ প্রকাশিত প্রথম বই ‘ কবিতার বই’ তে আমরা তাকে প্রকৃতি ও শান্তির অন্বেষণে ব্যস্ত হতে দেখি যা আমাদের অন্যান্য স্পেনীয় কবি খিমেনেস কিংবা রুবেন দারিয়োর প্রথম দিককার কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। লোরকার কবিতার মধ্যে আমরা অনুভব করতে থাকি আন্দালুসিয়ার লোকগান এবং নিজ সময়ের রহস্যময়তা ও ব্যক্তিসত্ত্বার অন্বেষণ। তাঁর কবিতার শরীর সংক্ষিপ্ত রূপকের দোদুল দোলায় ও বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা প্রয়োগে যা হয়ে উঠেছে তাঁর নিজস্ব পরিচিতির অনবদ্য খতিয়ান—
 
“একটি সাপের মত আমার হৃদয়
খোলস ছাড়তে থাকে
আমি ধরে থাকি তাকে আমার হাতে
পরিপূর্ণ মধু ও যন্ত্রণায়।”
( “নতুন হৃদয়”, ১৯১৮, গ্রানাডা)
 
“আমি কি তোমায় টাঙিয়ে দেবো
আমার আবেগের মিউজিয়াম দেওয়ালে,
আমার অন্ধকার ঠান্ডা
ঘুমন্ত ,মন্দ, লিলি ফুলের পাশে?”
( “মাছি, পতঙ্গ”, ১৯১৮ )
 
লোরকার ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত “জিপসী ব্যালাডস” গোটা স্পেনীয় কাব্য জগতে তাকে বিখ্যাত করে তুলল , তাতো হ’লো ,কিন্তু এই সুখ্যাতি লোরকাকে দালির থেকে দূরে সরিয়ে দিলো। এই যন্ত্রণা তিনি বয়ে বেড়াতে লাগলেন এবং তা দ্বিগুণ হ’লো ব্যর্থ প্রেমে। ১৯২৫ এ দেখা হওয়া মাদ্রিদের ভাষ্কর রূপসী এমিলিও আলাদ্রেন এর সাথে প্রণয়ের বিচ্ছিন্ন বেদনার অভিঘাতে তিনি জর্জরিত।
জিপসী কবিতা লোরকাকে শান্তি দিলো না। তিনি মাদ্রিদের স্পেনীয় সাহিত্য মহলে অশিক্ষিত জিপসী রূপে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় স্পেন ছেড়ে গেলেন। চললেন সেই বিশ্ববিদ্যালয় স্যার ফেরনানদো-র সাথে নিউইয়র্কে বক্তৃতা ভ্রমণে ১৯২৯ এ। ভর্তি হয়ে গেলেন আমেরিকার কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি ক্লাসে। কবি তখন ৩১ এর যুবক। ১৯২৯ এর জুন থেকে ১৯৩০ এর মার্চ এই প্রথম দশ মাস অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে লেখাকেই বেশী গুরুত্ব দিলেন। ওই সময়ে তিনি থিয়েটার এর কাজ করেছিলেন। কিউবাতেও গেলেন আরো তিন মাসের জন্য বিভিন্ন বক্তব্য পেশ করার জন্য। কবি হেঁটে যেতেন নিউইয়র্কের রাস্তা দিয়ে হাভানার অলিতে গলিতে পৃথিবী ও মানুষকে জানার জন্য।
১৯৩১ এর এপ্রিলে স্পেনে শুরু হ’লো নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়।স্বৈরশাসক মিগুয়েল এর সাত বছরের দোর্দণ্ড শাসন শেষ হ’লো। এলেন স্পেনের দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রেসিডেন্ট আলকালা জামোরা। লোরকা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন “বারাকা” নামের থিয়েটার দল নিয়ে গ্রামেগন্জে মফস্বলে শো করতে।
বুর্জোয়া থিয়েটারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি যে থিয়েটার শুরু করলেন তা ছিল কাব্যিক ট্র্যাজেডি যার শিকড় প্রোথিত ছিল বিয়োগান্তক গ্রীক নাটকে। মধ্যবিত্ত ড্রয়িংরুম কমেডির বিরুদ্ধে শুরু হোলো তাঁর যাত্রা। তাঁর নাটকে অভিনীত হতে থাকলো সমাজের শ্রেণীচেতনা,নারীদের ভূমিকা, সমকামিতা প্রভৃতি। এই ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ এর ১৮ -ই জুলাই স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত লোরকা শুধুই থিয়েটার নিয়ে ব্যস্ত। “ব্লাড ওয়েডিং” ( বোদাস দি সাংগ্রে) তাঁর বিখ্যাত নাটক যাতে আছে জীবনচক্র, সময়ের প্রবাহমানতা, প্রবঞ্চনা, ভাগ্য এবং প্রকৃতি। এটি একটি ট্র্যাজেডি।
পরবর্তীতে লেখা (১৯৩০ এর দশক) লোরকার প্রেমের সনেট আমাদের মোহিত করে। ১৯৩৬ এর আগষ্টে ফ্যাসিস্ত জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন এই আলোর পথযাত্রী কবি লোরকা। পৃথিবী তাঁকে মনে রেখেছে একজন মুক্তমানব ও জীবনের জয়গান গাওয়া এক বিখ্যাত কবি হিসাবে। তাঁকে আমাদের গভীর আন্তরিক শ্রদ্ধা।
 
===========================
ফাল্গুনী ঘোষ: কবি, অনুবাদক
ও সম্পাদক- চিন্তক পত্রিকা
===========================