১০টি কবিতা
উমা বন্দ্যোপাধ্যায়
আবাহন
তোমার হাতের থেকে ওই দেখো ঝরে গেল ফুল
আমিও তো নতমুখে ধুলো মুছে তুলে নিই রঙ
একার একলা ফুলে কখনও হয়নি মালা গাঁথা
তুমি দোরে রেখে দাও, আমি খুলে দিই পুজোঘর ।
সরল পথের রেখা নাম লেখে একা চৌকাঠে
কে যেন নদীর জলে ভরে গেছে মঙ্গলঘট
আমিও নিভৃত সুর বুনে দিই আলপনা ছকে
শঙ্খধ্বনিতে তুমি বাজো হয়ে জাগরণ স্তব ।
কোজাগরী ছলে আমি শুভনাম রেখে দিই দূরে
পঞ্চশস্যে মেখো জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া সাধ
নীল ঝরোকায় এক কুন্ঠিত মেঘ বসে আছে
মধুর শ্লোকের স্নেহে মুছে দিও তার সন্তাপ ।
দুর্নাম এঁকেবেঁকে পুজোঘরে রেখে গেছে ঋণ
তুমি এসো, আমি যাই, সব ব্যথা ছন্দবিহীন…..
স্বর্গীয়
দেহটি রেখেছিলে পাথরে
দেহটি ধুয়ে গেছে ঝর্ণায়
দু’জোড়া নীল ডানা অপরূপ
স্বর্গ-বাগানের গান গায়
চেয়েছ রক্তিম কিংশুক
ফেলেছ ছুঁড়ে প্রিয় বসবাস
দেখেছ অবিরল ঝর্ণায়
সবুজ পাহাড়ের উল্লাস
তবুও প্রথামত ডানাদের
প্রাণিত কর সঞ্চালনায়
স্বর্গ-বাগানেও তারা কি
জীবন যুদ্ধের গান গায় ?
সোনালি উৎসব
দুর্ভিক্ষের দেশে যাই
সোনালি উৎসবে
এসো ঘর খুলে রাখি
যা হবার হবে
এসো বৃক্ষ, পাতা,ঘুম
সহচর পাখি
বীতশোক স্তব্ধ জল
শুয়েছ একাকী !
এসো দীন লতা গুল্ম
গাঢ় অবিশ্বাস
স্থির থাকো প্রথাসিদ্ধ
প্রাজ্ঞ আকাশ….
রেখা
স্থির বিন্দুর থেকে একটি সরলরেখা টানি ।
সে কোথায় যেতে চায় গোপন গুহায় সাবধানী !
প্রিয় অক্ষরগুলি বসে গেছে তার ওপরে, জানো!
কাঙাল হাতের রেখা মোছাতে শেখেনি অভিমানও।
বুঝতে শেখেনি, কার হৃদয়ে নদীর শব্দ হয় ;
ভোলাতেও পারে না সে ভোরের স্বপ্নে লেখা ভয় ।
তুলতেও পারে না সে হাত ধরে নতমুখী লতা ;
সোহাগী শব্দ পোড়ে, পুড়ে যায় সব ঝরা পাতা ।
অন্তরাল বোঝে না সে, চেনে না নিভৃত আশ্রয়;
না-বলা কথার মাঝে, বোঝে না,দিগন্ত রাখা যায় ।
উড়ন্ত বাঁশির মুখে বুনে দেওয়া যায় কত সুর;
আলো ছায়া ছক বোনে আলাপী প্রেমিক রোদ্দুর।
সে বোঝে চলন শুধু, বিসদৃশ পথের প্রলাপ
কে তাকে চেনাবে মুখ ! গহন পথের সংলাপ!
অর্থহীন
অন্ধজনে আলো দাও, মৃতদেহে গেঁথে দাও প্রাণ
বীতশোক গুহাগাত্রে লিখে দাও ফুলের বাগান।
এসব কথার কোনও হয় নাতো মানে, মঞ্জরী
চিঠির কাগজ ছিঁড়ে জমা জলে ভাসিয়েছি তরী।
সে তরী ঠেকেছে কত ঘাটে কত আঘাটায়
ভাঙাচোরা ছন্দেই কত চিঠি আসে, ফিরে যায়!
প্রহর গুনেছে কত ভুল বানানের অনুনয়
ঘোলা জলে স্মৃতি ডোবে অন্ধেরা ভোলে পরাজয়।
মুখ তুলে গাও তুমি পথহারা পথিকের গান
ভেসে ওঠে হেরে যাওয়া সব অক্ষর অম্লান….
মায়া
ডানাতে রইল ধরা
অভাবী বৃষ্টি খেলা
রিন রিন ঋণ ঋণ
বেজেছে দুপুর বেলা
টান ছিল নীল আকাশে
মেঘমায়া উড়তে মানা
বিকেলের উদাস আঙন
একবুক ঘোমটা টানা
বিরহী যক্ষপুরে
ছুঁড়ে দেয় টুকরো আলো
এমনই রঙবাহারে
কে যেন বাসতো ভালো !
কে যেন শুকোচ্ছে চুল
উঠোনের চিলতে রোদে
এঁকেছে বৃষ্টি কোলাজ
মায়াতে মরছে কেঁদে !
সেই পাখি
এই পাখিটিকে আমি চিনি
যে এসে বসেছে আজ জানলার পাশে
রোজ বসে এসে ,
সোনার গোধূলি নিয়ে ঠোঁটে
চলে আসে ,
চুপ করে বসে ভাষাহীন
সুর নেই , ডাক নেই ,
কথাটিও নেই তার মুখে
তবু তাকে চিনি আমি
তার কথা লেখা থাকে চোখে ,
তার নীরবতাটুকু
মেলা থাকে ধূসর ডানায় ।
এই তো সে আসে রোজ
আমাকে যে জীবন শেখায় …
আঁচল
বাগানে এক আঁচল ছিল
তাহার ছিল তিনটি রঙের জবা ;
ভোরের আলোর বিধান ছিল
সবারই নাম রাখবে মনোলোভা ।
ঘাটের ছলাৎ পুষতে বুকে
তাদের রঙীন হৃদয়টি কমদামী;
তোমার বাড়ি, আমার বাড়ি
ফেলবে আলো বিকেল অস্তগামী ।
দীঘির জলে ডুবন্ত পা
উড়ছে তাদের অভিমানী চুল;
অলক্তরাগ মিশছে জলে
কাঁপছে রেখা, ভুল হয়েছে ভুল !
ধুলোর সাথে পরাগরেণু
মিশতে মিশতে খুলছে বনের সাজ;
বর্ণময়ী বাগান ভোলে সৃষ্টিকথা
আঁচল শুধু লজ্জা ঢাকে আজ !
গান
তুমি যদি ভালো
তবে সকলেই ভালো ।
একথা বলেছে নদী, রোদ, জনপদ
এবং শস্যকণা ।
অনেক রোদের দিনে
বাতাসের কথা নাকি গান হয়ে জাগে …
নদী শোনে—
মুখরিত দিন, ঠোঁটে নিয়ে নিত্যকার খুঁটিনাটি–
শালিক, চড়ুই আর মাছরাঙা শোনে…
জেলে-ডিঙি নদী-বুকে
এই গান গেয়ে যায়,
ছুঁয়ে যায় অপসৃত মাঠ- বন- ক্ষেতের ফসল ।
এই গানই বুকে নিয়ে
বেড়ে ওঠে অন্ধ যুবতী..
ফেরিওলা
ফেরিওলা হেঁকে যায় ;
ডাক – জীবনের প্রয়োজনে – হৃদয়প্রেরিত ;
ওঠে , নামে সপ্তসুর ;
গৃহস্থের ছাদে গান্ধার লাগে ;
সিঁড়িতে মধ্যম ;
হরবোলা শুভনামে , ঘুম ভাঙানিয়া , মায়াময় ;
টেনে রাখে – মেলে রাখে –
বালখিল্য অভিমান , দামী খেলাঘর
বেঁধে দেয় – খুলে দেয় – জুড়ে দেয় –
বিরহবিধুরা বালা , গৃহগত প্রাণ ;
একচোখে ভয় ; অন্যচোখে চোরাটান ;
গুপ্তকথা বালিশের নীচে –
ভাঙে খিল , একদিন , শব্দহীন ;
সাধ-সাধ্য চৌকাঠ ডিঙোয় ;
ফেরিওলা সাহস ও মুক্তি ফেরি করে ..