হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার
(কিস্তি-৪)
খালেদ হামিদী
৭
লিকোভিকের মুখে হঠাৎ সারা দেহেরই রক্ত উঠে আসায় প্রথমবারের মতো অবাক হয় খোকন। জানতে চাওয়ার আগেই সে শোনে:
রাজকুমারের পছন্দ অনুযায়ী কোনও বিমানবালা না পেলেও সন্ধান মেলে বোস্টনের একুশ বছরের তরুণী ক্যাথির, যে কি না এক ইউএস বৈমানিকের স্ত্রী। কিন্তু রাজপুত্র জনির কথা মতো ক্যাথি এই আরবেই আসতে রাজি নয়, জনির আল খার্জ্-এর প্রাসাদে তো নয়ই। প্রিন্সকে খুশি করতে না পারলে আমাদের গভার্নমেন্ট আমার ওপর বিরাট ব্যর্থতার দায় চাপাবে। চাকরি হারানোর চেয়েও সেটা অনেক বড় দাগ ফেলবে আমার ক্যারিয়ারে। এখন আমি কি করি! কি করি!!
ফ্লাইওভারের প্রশস্ত পিলারের এক পাশে পেট-কাটা ইউ আকৃতির ধরনে শাড়ির বেড়-দেওয়া এক চিলতে জায়গায় হাঁটুতে হাত রেখে উপুড় হয়ে পাশাপশি দাঁড়ানো দুই কিশোরী আর তাদের দিকে ধীরে এগিয়ে-যাওয়া মোট দশ-পনেরো জন বিভিন্ন বয়সী পুরুষের দুটি লাইন দেখতে পায় খোকন। অমনি, কদমতলী থেকে মনসুরাবাদের দিকে উড়াল-দেওয়া সেতুটির নিচে জেব্রা ক্রসিঙে হাঁটার সময় লিকোভিকের কথাগুলো কানে বেজে ওঠে ওর। আল খোবার থেকে দেশে ছুটিতে এসে মধ্যরাতেরও পরে, প্রায়-অন্ধকারে, গোপন অথচ প্রকাশ্য ওই সক্রিয়তা দেখে সে ভীত হয় না তেমন। তবে সন্তর্পণে স্থানটি ত্যাগের সময় মেয়ে দুটির আর্ত সংলাপ খানিকটা বুকে বাজে তার।
পরের দিন সন্ধ্যায় হোটেল গ্রিনের বারে জুনিয়র ফ্রেন্ড শরৎ এবং সমবয়সী কাজিন তরু মিলে পারস্পরিক স্বাস্থ্য পানের এক পর্যায়ে খোকন আগের রাতে দেখা বিষয়ের বিবরণ দেয়। বন্ধুরা তাকে আকণ্ঠ পানের পরে সেভাবে রাস্তা পেরিয়ে বাসায় ঢুকতে নিষেধ করলে ছাত্রজীবনে ভোররাতেও নির্বিঘেœ বাড়ি ফেরার সেই কালপর্বের জন্যে হাহাকার বোধ করে সে। লিকোভিকের সঙ্গে ওর সখ্যের প্রসঙ্গটিও নিজের আত্মমর্যাদা অটুট রাখতেই বুঝি আড্ডায় উহ্য রাখে খোকন। তাছাড়া রাজপুত্রের পুরো ব্যাপারটাই গোপন রাখার শর্তে তাকে জানায় লিকোভিক, এ কথাও ভোলেনি সে। কিন্তু রাত সাড়ে দশটায় বাসায় ফিরে ডিনার সেরে বিছানায় এলিয়ে পড়তেই লিকোভিকের সাথে ফোর্ড গাড়িতে আল খোবার থেকে দাম্মামের দিকে ছোটে খোকন। পরক্ষণেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে ফ্লাইওভারে, আল খার্জ্-এর পথে, যেখানটায়, একটির ওপরে আরেকটি- এই ক্রমানুসারে নির্মিত, পাঁচটি বিশাল প্যারাবোলা আকারের উড়াল সেতু জুড়ে ছুটে চলেছে যেন দুনিয়ার সব গাড়ি। লিকোভিক প্যালেসে ঢুকলে প্রতিবারই খোকনকে ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হয় অদূরবর্তী রাজ-উদ্যানে। ফ্লাওয়ার গার্ডেনে নয়, আঙুর-বাগানে। কাঁটাতারের বেড়ায় ঘেরা কয়েক হেক্টর মরু জুড়ে এই আঙুরের চাষ। বাগানের অনেকটা জুড়ে চোখে পড়ে মিহি সবুজ সেমাইয়ের মতো ঘাস, এমেরিকা থেকে এনে প্রযুক্তির সহায়তায় রোপিত। উদ্যানের সামনের দিকে, ডান কোণে মসজিদ আর এর পেছনে ক্যারাভানের মুখোমুখি দুই সারি, যেখানে বাস করে খোকনের স্বদেশী গার্ডেনাররা। সে বিস্মিত হয় মসজিদের ইমামও অভিন্ন দেশের নাগরিক শুধু নয়, খোদ তার জেলারই লোক জেনে। মার্কিন বন্ধুর সাথে এসে দ্রাক্ষাকুঞ্জের শান্ত-সমাহিত পরিবেশে সে বাংলার গ্রামকেই কিছুটা ফিরে পায় মাসে কমপক্ষে একবার। তবে কষ্ট বোধ করে শ্রমিক ভাইদের মাসিক আয় সে-দেশীয় মুদ্রায় অর্ধ হাজারের বেশি নয় বলে।
রাজবাগানের গার্ডেনার হিসেবে ওরা বেতন কম পায়। যদিও, প্রাইভেট কোম্পানিগুলির কোনও কোনোটা বেতন না দিয়ে শুধু ফুড অ্যালাওয়্যান্সই দেয়!
কিন্তু তরুণ ইমাম সাহেব খোকনের এ-কথার জবাব দেয়ার পরিবর্তে নিজের সারা মুখে আত্মমুগ্ধতার হাসি ছড়িয়ে, ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা তুলে ভি চিহ্ন দেখিয়েই কেবল বলেন:
হাজার পাই।
তাঁর মাসোহারা প্রতিবেশি একজন শ্রমিকের মাসিক মজুরির চেয়ে চার গুণ বেশি। এটা বুঝিয়ে দিয়ে, তিনি আরো যোগ করেন: আলহামদুলিল্লাহ্।
শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ানোর আইনি অনুমোদন না থাকায়ও তিনি অসন্তুষ্ট নন। এই দেশে পঁচিশ-তিরিশ বছর চাকরি করলেও আগের মতো আমাদের কারোর নাগরিকত্ব মেলে না কেন জানতে চাইলে ইমাম ফসিহউল আলম খোকনকে বলেন:
বাঙালির রক্তে দোষ আছে। তারা খাঁটি ইমানদার হয় নাই এখনো।
স্মৃতির এমন সব বর্তমানতার মধ্যে, ছুটি চলাকালীন পঞ্চদশ রাতের মতো, ঘুমিয়ে পড়ে খোকন। পরের দিন সকালে উঠে হঠাৎ দুঃখ বোধ করে সে, পঞ্চাশ দিনের ছুটি আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে বলে।
কতো আগের ঘটনা যে স্মৃতিতে গতকালের মনে হয়!- মা-বাপ বেঁচে থাকতে বিয়ে করে ফেলা ভালো। দুই বছর পরপর দেশে আসতেছস। এবারও, এই সাঁইত্রিশ বছর বয়সেও, বিয়ে থা না করে চলে যাবি?
তরুর এই প্রশ্নে সেদিন রাতে উড়াল সেতুর নিচে দেখা দুটি কিউ তার চোখে ঝলসে ওঠে কেন, বুঝতে পারে না খোকন। শুধু মনে মনে বলে:
আমার বাবার যদি ওই দেশের নাগরিকত্ব থাকতো তাহলে দশ বছর আগেই আমাকে সেখানে বিয়ে দিতে পারতো। এখন তো সেই নিয়মও বাতিল হয়ে গেছে।
ছুটি শেষ হতে আর সপ্তাহ দুই বাকি। বিয়ে আর সম্ভব নয়। ওর পিতা-মাতারও এ-বিষয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই বলেই মনে হয়। সাড়ে সতেরো বছরের প্রবাসে যেন মদ্য ছাড়া আর প্রায় সবই পেয়েছে বলে দেশে এলে শুধু বারেই ছোটে সে। কেবল ওর বন্ধুরাই জানে, আল খার্জ্ বা আল খোবার, দাম্মাম কিংবা আল বাহা, কি তায়েফ কি দাল্লা সে-দেশের কোথাও একটা সিনেমা হল পর্যন্ত নেই। আছে শুধু শিশা বেথ নামের অনেক হুক্কাখানা যেগুলোর একটিতে বসে এক সন্ধ্যায় মাত্র দুইবার ধোঁয়া টেনেই পৃথিবী আঁধার হয় খোকনের আর বমিতে খালি হয় গোটা পাকস্থলি। প্রথম দিকে, গোপন প্রবৃত্তি-ব্যবসার এক-আধটু খবর তার কানে আসতো। এখন তো, আইন আগের মতোই কঠোর রয়ে গেলেও, মোবাইল ফোন ও ফেস বুকের সুবাদে তরুণ-তরুণীর বন্ধুত্ব উদ্যাপিত হয় আড়ালে। কোনো অঘটনে আটক হলে প্রবাসীদের উকিল নিয়োগের সুযোগ না থাকার দরুন সেই ভূখন্ড একাকী নির্বাসনেই দিনরাত্রি কাটে নিয়ন্ত্রিত খোকনের।
ছুটি ফুরাবার দিন দশেক আগে বন্ধু শরৎ, তরু, শোয়েব ও লাভলুর সামনে লিকোভিকের শর্ত ভেঙে সেই বিষয়টির মোড়ক উন্মোচন করতে চায় খোকন এই ব’লে :
আমাদের স্বাধীনতার সেই প্রথম দশকে একমাত্র জনিই নাকি চুক্তি সইয়ে রাজি হয়নি।
সরু প্রথম জিজ্ঞাসু হয়:
কি চুক্তি?
খোকন এবার, লিকোভিকের শর্তে নেয়া শপথের কথা মনে পড়লেও, কিছুটা খুলেই বলে:
এমেরিকার সরকার আরব দেশটার রপ্তানিযোগ্য সব তেল কিনবে। তেল বিক্রির টাকা জমা হবে, বিক্রেতা দেশের পক্ষে, ক্রেতা রাষ্ট্রেরই কয়েকটা ব্যাংকে। ওই ব্যাংকগুলি আবার ইউএস গভার্নমেন্টাল বন্ডগুলি কিনবে। এতে যে ইন্টারেস্ট মিলবে তাতে তেলওয়ালা দেশটায় নতুন অবকাঠামো স্থাপন করা হবে। রাজা প্রথমে সম্মত না হওয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। চুক্তিটা করলে রাজপরিবার দীর্ঘকাল ক্ষমতায় টিকে থাকবে। এই আশ্বাসে বাদশা ও তার পরিবারের প্রায় সবাই প্রস্তাবক পক্ষের সাথে সমঝোতা করে ফেলে। পরে লিকোভিককে দেওয়া হয় ওই প্রিন্স জনিকে রাজি করানোর দায়িত্ব।
শুনে খোকনের বন্ধুরা রীতিমতো চমকে ওঠে। ধর্মভীরু শোয়েব খানিক সংশয় ছুড়ে দেয়:
কি বলিস! এগুলি কি সত্য?
খোকন শুধু বলে:
লিকোভিক তো কয় সে এই বিষয়ে একটা বই লিখবে।
এবার লাভলু সরব হয়:
সেসব তো কয়েক যুগ আগের কথা। দুই দেশের অর্থনীতি কি তাহলে একই থেকে যায়?
সেটা জানি না। তবে চুক্তিতে নাকি এই শর্তও থাকে যে, উভয় দেশের পররাষ্ট্র নীতি হবে অভিন্ন।
খোকনের এই উত্তর সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই লাভলু আরো বলে:
তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
তরুণ শরৎ যেন নতুন করে সপ্রতিভ হয় এই কৌত‚হলে:
কিভাবে প্রিন্সকে রাজি করায় লিকোভিক?
খোকন পাল্টা প্রশ্ন তোলে:
সেটা আমি কি করে বলি?
দেশে বসেই নিজেকে প্রবাসী বলে টের পায় কেন নিজেও যেন বুঝতে পারে না সে। লিকোভিকের ক্যাথি-প্রসঙ্গ তাই আর আলোচিত হয় না। বান্ধববেষ্টিত খোকন সংকুচিত হয়ে পড়ে অনেকটা। দেশে অনেক প্রেমের কবিতা পড়ে, বিদেশে অসংখ্য হিন্দি রোমান্টিক ছবি দেখে সে ভীরু ও লাজুক হয়ে ওঠে প্রায়।
খোকনের বাসার কাছের কেএফসিতে বন্ধুরা কেক ছাড়াই ওর বার্থ ডে সেলিব্রেশনে মিলিত হয়। এর দু’দিন পরেই শেষ হয় ছুটি। এয়ারপোর্টে আরব ইমিগ্রেশন অফিসার ওর ব্রিফকেসে বই দেখে হঠাৎ তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে এবং অন্য কয়েকটা বইয়ের সাথে জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্রটিও খানিক দূরে লাগেজের চলমান বেল্টের ওপর ছুড়ে ফেলে দেয়। লিমোজিনে উঠে নিঃশব্দ খোকন কান্না সামলাতে ব্যর্থ হলে তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে পাসপোর্টের প্রচ্ছদে। সঙ্গে সঙ্গে সিনিয়র চাচাতো ভাই হাশেমের স্মৃতি ঘিরে ধরে তাকে, দেশত্যাগের আগের দিন সকালে যে শফিককে বলে:
শিক্ষিত লোকেরা ওসব দেশে যায় না। তুই এখনো থাইকা গেলি সেখানে?
এতে খোকন পরিহাসের খোঁচা টের পেলেও কথাটার গ্রহণযোগ্যতা এখনই প্রথম অনুভব করে।
৮
পৈতৃক ঘরবাড়ি বিক্রি করে যে স¤প্রতি দেউলিয়া হয়, সেই হাশেমকে কোনোদিনই আপন জ্ঞান করতে পারেনি খোকন। আবু কাকার একমাত্র ছেলে বখে-যাওয়া হাশেমের অনেক অসামাজিক সংযোগ থাকায় পাড়ার কেউই তাকে সুনজরে দেখেনি। খোকন ও তার চাচাদের অভিন্ন উঠানের বিপরীতে আবু কাকার নতুন ও পুরোনো বাড়ি। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রলম্বিত দীর্ঘ দোতলা মাটির দালানে, পার্টিশন ওয়ালে পৃথক হয়েও, পাশাপাশিই থাকে খোকনের বাবা ও তার তিন চাচার পরিবার। সংলগ্ন দখিনা ভিটায় আরেক চাচা নিজেই পাকা দালান তোলে এক তলা। এই দুটি ইমারতেরই বিপরীত দিকের কিংবা উঠানের ওপারের জায়গা কয়েক বছর ধরে আস্তে আস্তে দখলে নেয় আবু কাকা। আবু সদাগর নামে পরিচিত এই চাচা শত কেজি ওজনের শরীর নিয়ে বেশ ভালো দুনিয়াদারিই করে। খোকনের বাবা-কাকার ফুফাতো ভাই আবু নানাবাড়ির সম্পত্তি হিসেবে অতো বড় জায়গা যে পায় না তা জানা থাকা সত্তে¡ও তার দখলদারিত্ব প্রতিরোধের প্রশ্নই কখনো আসে না সংশ্লিষ্ট কারোরই মাথায়। খোকনের আবু কাকার বিরল আধ্যাত্মিকতা সবাইকে আচ্ছন্নই করে রাখে প্রায় সারা জীবন। চিকন পাড়ের নিছক শাদা লুঙ্গি, ধবধবে সফেদ পাঞ্জাবি আর একই রঙের অর্ধ চন্দ্রাকৃতির টুপিতে আবু হয়ে ওঠে অত্র এলাকার একমাত্র ব্যতিক্রমী সদাগর। কেননা তারই আয়োজিত সব মিলাদ মাহফিলে মহল্লার আবালবৃদ্ধবনিতাই অংশ নেয়, বলা যায়। চার খুঁটির খানিক উঁচু পিঁঁড়িতে বসে আবু চাচা পরওয়ারদিগারের নামে অবিরল মাথা নেড়ে জিকির করতে করতে, ঘেমে একেবারে নেয়ে ওঠে, সিলিং ফ্যানের নিচেও। মোনাজাতের সময় কাঁদে অঝোরে। খোকনের প্রপিতামহের রেখে-যাওয়া লম্বা কাচারি ঘরটাই মিলাদের জন্যে নিজের জিম্মায় রাখে আবু কাকা। প্রতি বর্ষায় মাটির এই ঘরের টিনের চালায় বেজে ওঠা বৃষ্টির প্রচন্ড সঙ্গীতকেও হার মানায় জিকিরের সম্মিলিত আওয়াজ। ঘরের মাঝামাঝি স্থাপিত ফলস্ সিলিং না-ছোঁয়া বেতের মোবাইল পার্টিশনের দক্ষিণ পাশে মা-বোনদের বসার ব্যবস্থাও রাখা হয় প্রতি মিলাদেই। খোকন এখন ভেবে অবাক হয় কিভাবে মাসে কমপক্ষে দুবার মিলাদ অনুষ্ঠিত হতে পারে কারও বাড়িতে।
স্মৃতি মানুষকে কোত্থেকে যে কোথায় নিয়ে যায়! এয়ারপোর্ট থেকে লিমোজিনে ভিলায় ফেরার আগেই কিশোর খোকন আবু কাকার অদূরে বসে জিকিরে মাথা ঝাঁকায়। মিলাদ শেষে লভ্য নাশতার কল্পনায় চ ল চিত্তে বসেও থাকে। কেবলই কি তাই? সেই চাচা-আয়োজিত মেজবানের দিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে গরু জবাই, মাংস কাটা, পেঁয়াজ-রসুন বাটা, উঠানে বাবুর্চির রান্না ইত্যাদি নিবিষ্ট হয়ে দেখে সে। দু’তিন মাস পরপরই আবু কাকার মেজবানে আত্মীয়-পরিজনের ঢল নামে। রাতের অনুষ্ঠানের পরের দিন সকালে শামিয়ানা খোলার দৃশ্যও রীতিমতো পরখ করে বালক খোকন। আল ইয়ামামা কমপাউন্ডে নিজের ভিলার সামনে এসে পড়লে খোকনের মন খারাপ হয় ওয়াশ রুমে আবু কাকার মৃত্যুর ঘটনা দ্রæত সামনে চলে আসায়। সেই রাতে তার দেহত্যাগের পরপর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। খোকন তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সে লক্ষ করে, আবু কাকাকে শহরের উত্তরাংশের গ্রামতুল্য ওই এলাকার মোড়ল মানেনি কেউ। নিজেকেও কখনো সর্দার ভাবেনি আবু সদাগর। ক্রিসমাসের দিন গোটা ক্রিম কেক নিয়ে আসা, কালীবাড়ি মোড়ের বিহারীর দোকান থেকে প্রায়ই খাসির মাংস কেনা, ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের ওপর গুরুত্বারোপ, নিজ চাকরিজীবী পিতার ইত্যাকার সীমিত সৌখিনতার সঙ্গে সোনায় সোহাগা হয়ে আবু কাকার মেজবানও খোকনের শৈশব-কৈশোরকে বর্ণাঢ্য করে তোলে। যদিও, সেই ঐন্দ্রজালিক আবহ থেকে সে বেরিয়ে আসে ঢের আগে। এদিকে নিজের রুমে ঢুকতেই নারী-পুরুষের সেই গুঞ্জন আবার স্পষ্ট শুনতে পায় সে। নিজের আড়ত থেকে বাড়ি ফিরে আবুু সদাগর রিকশাওয়ালাকে কোনোদিন ন্যায্য ভাড়া দেয় নাই। কোনও মেজবানেই কাঙালদের খেতে দেয় নাই। একেক প্রচন্ড ধমকে তাদের তাড়িয়েছে। খুব পরিষ্কার থাকার অজুহাতে বাড়ির সব দরজা শুধু নয়, জানালাও সবসময় বন্ধ রেখেছে। বাড়িতে এসি স্থাপনের যুগ তখনো আসেনি। কখনো ওর বউ-ঝিয়েরা খিড়কি খুললে দেখা গেছে আবু ঘাড় কিঞ্চিৎ বাঁকা করে, চশমা চোখে, অসম্ভব ভালোবেসে একটা একটা করে টাকা-পয়সা গুনছে। খোকনও এতো মায়াবী, নিবিড় গণনা আর কখনো দেখেনি। তাছাড়া কখনো উত্তেজিত, কখনোবা কাঁদো-কাঁদো রিকশা চালক আবু কাকার দেওয়া কম ভাড়া না নিয়ে সদাগরের বন্ধ দরজার নিচে অথবা খোলা জানালার গ্রিলে রেখে চলে যাচ্ছে-এমন দৃশ্যও আর কোথাও ওর চোখে পড়েনি। এদিকে বিছানায় তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে হতে খোকনের কানে বেজে ওঠে কাওয়ালি। ম বানিয়ে কাওয়াল ডেকে, আঙিনার সফেদা গাছটির ডগায় মাইক লাগিয়ে, ভক্তির সুরেলা ইন্দ্রজাল সারা এলাকায় অনেকবার ছড়িয়ে দেয় আবু কাকা। বিশেষ করে, প্রসঙ্গটি মনে পড়লে হু-হু করে ওঠে খোকনের সমগ্র অন্তর। আবু কাকা কৈশোরে পিতৃহীন হলে তার মায়ের সাথে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরে মাকেও হারালে গামছা বেচে যৌবন পার করে। এই জনশ্রুতি মনে পড়ে খোকনের। আল ইয়ামামায় পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আর স্বগত উচ্চারণে বলে ওঠে : আহা আবু কাকা! হায় তার স্বর্ণযুগ!!