You are currently viewing হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার (কিস্তি-৩) >  খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার (কিস্তি-৩) > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার

খালেদ হামিদী

কিস্তি: তিন

খোকন টের পায়, এই আরবে এ নিয়ে নিজের ত্রিশটি বছর সে পচিয়ে ফেলে। প্রকল্প ব্যবস্থাপকের সহকারী হিসেবে চাকরি করেও বেতন পদবীর অনুরূপ না হওয়ার দরুন, প্রয়োজনীয় স য়ের অভাবে, চিরতরে দেশে ফিরতে পারে না সে।

এদিকে তার বাবা-কাকা কিংবা মা-চাচীরা জেবাকে আড়ালে খানকি ডাকলেও এতোদিন যাবৎ তার কাছেও অভিধাটি স্বাভাবিক ঠেকে। কিন্তু শেষ জীবনে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়েও তার জেঠি মা জেবার নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার ঘটনায় এখন চোখে লবণ জমে খোকনের।

জেসিকার সাথে সাক্ষাৎকালে মোফার তাকে সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিলেও এতোদিন খোকন তা নানাভাবে এড়িয়ে যায়। কিন্তু স¤প্রতি যে-কোনো নতুন সম্পর্ক বিষয়ে সে কৌতূহল বোধ করতে শুরু করে। তাই সে এক কার্র্যদিবসেই, এ-দেশের প্রায় সব অফিসই বেলা আড়াইটায় ছুটি হয় বলে, সোমবার বিকেল চারটায়, মোফার  এবং আরেক সহকর্মী আলেক্সের সাথে, খাজ্জান স্ট্রিট থেকে দাল্লা আবাসিক এলাকার দিকে লিমোজিনে রওনা দেয়। যে ভিলার বন্ধ গেটের সামনে তারা নামে এখানকার অন্যান্য বাড়ির মতোই সেটিরও চারদিকের দেয়াল জেলখানার প্রাচীরের ধরনে ঢের উঁচু। সংকোচপ্রবণ খোকন সঙ্গী দুজনের অবতরণস্থলের ঠিক বিপরীত দিকের ফুটপাতে গিয়ে দাঁড়ায় আর নিজেকেই বলে:

সাক্ষাৎ সত্যিই সম্ভব হলে ওরা সাথে আমাকে আনতোই না! তাছাড়া আবাসিক এলাকায় নাছোড় পুলিশের আনাগোনা কম জেনেই আমি তাদের সঙ্গী হতে রাজি হই।

কেননা ছিমছাম, নিঝুম এলাকায় খোকন অচিরেই দেখে, প্রথমে আলেক্স একটি নীল পলিথিনের ব্যাগ বাহির থেকে ভেতরে ছুড়ে মারে। তারপর ওই অনেক উঁচু বন্ধ গেটের ওপার থেকে অনুরূপ আরেকটি ব্যাগ বাইরে ছোড়া হয়। তারপর সেটা কুড়িয়ে নিয়ে গেটে কান পেতে ওপাশের প্রেয়সীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আলেক্স। আলাপ শেষে সে সুযোগ দিলে একইভাবে খামবন্দি চিঠি, আপেল ও আরো কিছু উপহার সামগ্রীসমেত পলিব্যাগ বিনিময়ের পর মোফারও একই পদ্ধতিতে প্রেমালাপ শুরু করে। মোফার ও জেসিকার কথোপকথন শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ খোকনের ডান দিকে, জেসিকাদের কোম্পানির শাদা, বড় খালি স্টাফ বাস এসে থামে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই, আপাদগ্রীবা সফেদ পোশাকে আবৃত মধ্যবয়সী আরব চালক ক্রোধোন্মত্ত হয়ে দ্রæত নেমে,

আনা কালাম কালাবুশ, আলহিন ইনতা ফি জিঞ্জির!

আমি পুলিশ ডাকছি, এখনই তোকে হাতকড়া পরাবে!

বলতে বলতে মোফারের দিকে বিদ্যুৎ বেগে ছোটে।  অমনি অদূরে দাঁড়ানো আলেক্স আপন কণ্ঠ চিরে মোফারকে ডাকলে শুরু হয় তাদের উভয়ের প্রাণান্তকর দৌড়। তৎক্ষণাৎ মোফারের দেহের সমস্ত রক্ত যেন উঠে আসে ওর সারা ফর্সা মুখে। ওই বাস এবং তাদেরও আসার রাস্তার বিপরীত দিকে, হতভম্ব খোকন ওই ঊর্ধ্বশ্বাস পলায়নে যোগ দেয় কয়েক মুহূর্ত পরে, অসম্ভব সন্ত্রস্ত দুই প্রেমিকের তড়িৎ আহŸানে। এর আগে কোনোদিন কেউ তাকে অমনভাবে ধাওয়া করেনি। কিন্তু ডানে-বামে, সামনে-পেছনে এঁকেবেঁকে, অত্র আবাসিক এলাকার নানান রাস্তায়, প্রধান সড়কের খোঁজে, তিন জন ছুটতেই থাকে। এই অবস্থায় আলেক্স পেছন ফিরে বলে:

সে আর আসছে না! সে আর আসছে না!!

এ কথা মানতে নারাজ মোফারও চিৎকৃত হয়:

সে রাস্তা বদল করে যে কোনো পাশ থেকে এসে পড়তে পারে!!

মোফারের সাথে তাই বাকি দু’জনও কেবলি দৌড়াতে থাকে।

 

যা মিলবে না তার পেছনে ছোটা প্রায় প্রাকৃতিকভাবেই হয়ে ওঠে না খোকনের। খেলার সঙ্গীদের গালমন্দময় ভাষার কবল থেকে মুক্ত রাখতে তার বাবা হাডুডু-গোল্লাছুটের পরে তাকে ফুটবলের মাঠ পর্যন্ত যেতে না দেওয়ায়ও উদ্দেশ্যহীন দিনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে। খোকন নিজেই আজ বিস্ময় মানে কিভাবে ইউনিভার্সিটি পর্বে, ওর বিপরীত প্রক্রিয়ায় বেড়ে-ওঠা পাঁচ বন্ধু, ওর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কেবল তা-ই নয়, তারা তার সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রপ্রিয়তারও হয়ে ওঠে অসম্ভব প্রিয় অংশীদার। তবুও রিয়াদে আসার আড়াই মাস পর থেকে সে এমন  ভীরু হয়ে ওঠে যেন তার দেহ কেবল নয়, প্রাণও যে কোনো সময় হতে পারে হুমকির সম্মুখীন। যদিও, মাঠে-ঘাটে ক্রীড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলেও, সে দেশে নিজ পিতৃপরিবারে এবং বন্ধুমহলে রেখে আসে তার নির্ভীকতারই ইতিহাস। তা মনে পড়ার এক পর্যায়ে, ডায়েরিতে ওভার রাইটিঙে অ-পাঠ্য করে তোলা সেই সংবাদের বিষয়, যা পড়ে ফেলে ফজলুল এবং বুঝতে পারে না, হঠাৎ ভেসে ওঠে খোকনের চোখে। আসলে কোনও কিছু না লিখে যেন সে থাকতেই পারে না। হাই স্কুলে পড়ার সময় আট আনার পেঁয়াজু খাওয়ার কথাও লিখে রাখতো সে।

তথাকথিত ফ্রি ভিসায় এ-দেশে আসার মাস ছয়েক পরে খোকন কিভাবে যেন এক মেইনটেন্যান্স কোম্পানির সাব-কনট্রাক্টে এমেরিকান কমপাউন্ডে চাকরি জুটিয়ে নেয় নিজেই। ক্ষুদে ব্যবসায়ী কফিল বা আরব স্পন্সর বাংলাদেশ থেকে লোক এনে নিজের অধীনে না রেখে অন্যত্র চাকরি করার সুযোগ দেয়। কোনো কোনো কফিল মেয়াদভিত্তিক এই অনুমোদন পত্র নবায়ন না করলে চাকরিপ্রার্থীকে জেলে যেতে হয়। এ-দেশের সরকার তাকে বা তাদেরকে কয়েক মাস জেল খাটিয়ে স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়। খোকন ভাগ্যবান এ জন্যে যে, ওর কোম্পানি পরে নিজেই এই  স্পন্সরশিপ নিয়ে নেয়। কিন্তু তারপরও তার অন্তরে নতুন এক হেয়বোধ সৃষ্টি হয়। চাকরিটা সাব-কনট্রাক্টের অধীন হওয়ার দরুন খোকনের বেতন মাত্র এক হাজার রিয়াল বিধায় সে তার চাচাতো মামা মন্টু সাহেবের সূ² তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। ওর মামা আল ব্যাংক আল সাউদি আল ফ্রান্সিতে চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত থাকায় সপরিবার, প্রায় রাজার হালে, রিয়াদে বসবাস করছেন। শুরু থেকেই এই মামা তাকে অপছন্দ করে আসছেন, খোকন টের পায়। এখানে এসেই বোনের বাসায় আশ্রিত অবস্থায়, ওর ভগ্নিপতি, এখানকার সরকারি চাকুরে, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রহমান ওকে মামার বাসায় এক মাসের জন্যে এনে দেন। ভেতরে ভেতরে পুরো বিষয়টি অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে। মামা খোকনকে ওই ফ্রান্সি ব্যাংকে চাকরি পাইয়ে দেবেন মর্মে নিশ্চিত থাকেন রহমান। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় খোকনকে রেখে রহমান সপরিবার বিদায় নিলে মন্টু মামা বাইরে যান এবং অসন্তোষময় চেহারায় ফেরেন অনেক খাদ্যসামগ্রীসমেত। কিন্তু খোকন প্রায় আত্মমর্যাদাবোধশূন্যই থেকে যায়।  এসির ঠাÐা হাওয়ায় কম্বল মুড়ে রাতে ঘুমালে সকাল ন’টা/দশটার আগে ওঠেই না। তার নিদ্রাকাতরতা অবশ্য আশৈশবের। মামা অফিসে গেলে মামীকে গার্হস্থ্য কাজে কোনো সহায়তা করার সামান্য বোধটুকুও সে হারিয়ে ফেলে। অথচ মামী একদিন তার হাতে রিয়াল ধরিয়ে দিয়ে ‘খোকন, যাও, চাল নিয়ে আস!’ বলতেই তার চোখ ভিজে আসে অপমানের মারাত্মক অনুভবে। মন্টু সাহেব রাতে টিভিতে রেসলিং দেখলে সে অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু এক পর্যায়ে মামার সাথে সে রাজনৈতিক তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। মামার পাকিস্তান ও আরবপন্থী বাক্চাপল্যে সে অনিরাপদও বোধ করে কখনও কখনও।

রহমানের দেওয়া টাইপরাইটার খোকন ব্যবহার না করায় একদিন ক্ষিপ্ত হন মন্টু মামা এবং রহমানকে নালিশ দিয়ে বসেন। এতে ওর অব্যবহিত ছোট বোনের স্বামীও অসম্ভব বিরক্ত হওয়ায় খোকন চূড়ান্তরূপে নিগৃহীত বোধ করে। এক সঙ্গে তার মনে পড়ে আরো কিছু অপমানের স্মৃতি। এক রাতে অনেক মেহমান দাওয়াত খেয়ে যাওয়ার পর বোন কিচেনের সিঙ্কে বাসন-কোসন ধোয়ার সময় হঠাৎ রহমান খোকনকে ডিশ ওয়াশিংয়ের হুকুম দেন। আরেকদিন দাঁত মাজার সময় খোকনের পেস্টের ছিটা বেসিন সংলগ্ন আয়নায় পড়লেও ক্ষিপ্ত হন ওর ভগ্নিপতি। আরেক সন্ধ্যায় রহমানের কেনা সফ্্ট্ ড্রিংকস্-এর কার্টন উত্তোলনে খোকন অপারগ হলে লিভিং রুমে বসা অতিথির সামনে তাকে শুনতে হয়: ‘এটাও আলগাতে না পারলে আর কি পারবে!’ এর চেয়েও হয়তো সে বেশি মর্মাহত হয় চাকরি মেলার এক মাস পর, প্রথম বেতন পেয়ে, ছোট ছোট ভাগ্নিদের জন্যে ওয়েফার বিস্কিট, কেক ইত্যাদি নিয়ে যাওয়ায় তার নিজের বোন যখন ‘এগুলি কেন এনেছ!’ বলে, ওকে অবাক করে দিয়ে প্রচÐ রেগে যায়। কোম্পানির ভিলায় ফিরে সে অনেক রাত অব্দি কাঁদে। প্রথম আয় থেকে দেশে বাবার কাছে দশ হাজার টাকা পাঠালেও দ্বিতীয় মাসের বেতন পাওয়ার পর থেকে সে ভগ্নিপতির ঋণ শোধ করতে শুরু করে। রহমান দেশে ভিসা না পাঠালে খোকনের তৎকালীন বেকারত্ব কতো দীর্ঘ হতো বলা যায় না। মাস্টার্স পাশের পর প্রায় দু’বছর দেশে ভালো কোনো চাকরি মেলেনি তার।

খোকনের কম্পিউটার লিটারেসি যা অর্জিত হয় আরাব-যাত্রার প্রাক্কালে তাতেও ভালো চাকরি লাভের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অপূর্ণ থেকে যায়। তদুপরি টাইপিং স্পিড মিনিটে ৮০ শব্দ না হলে ফ্রান্সি ব্যাংকে জব মিলবে না, মন্টু মামা সাফ জানিয়ে দেন খোকনকে। ‘কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে আমি টাইপিস্টের চাকরি কেন করবো!’- মনে মনে এমন যুক্তিতে অটল খোকন মামার বাসা থেকে বোনের বাসায় ফেরে দুই হাতে বেকারত্বের প্রচÐ সব অভিশাপ নিয়ে। এর আগে মামীকে সে ক্রীড়ার অভাবে নিজের দৈহিক শ্লথ গতির বিষয়টি জানিয়ে ফেলে। এতেও পরে মামা রুষ্ট হন। এসবের বছর খানেক পরে, মামা দেশে এক মাসের ছুটি কাটিয়ে ফিরলে খোকন দেখা করতে যায়। ওর মায়ের দেওয়া দেশীয় শুকনো নাশতা, চিঠি ইত্যাদি মামীর হাত থেকে সে নেবার সময় মন্টু মামা রোষে ফেটে পড়েন প্রায়:

তোমার বাবা বলছে তুমি নাস্তিক! কমিউনিস্ট! তোমার ওপর সে ক্ষেপে থাকবে না তো কি করবে? আমি তো এসব জানতাম না! আরও হাবার মত তোমার মামীকে বুঝাইছ তোমার বাবা বদরাগী! বাবার আচরণের কারণে ছেলের মন কি দুর্বল হয়? তুমি নিজেই বদ! এখানে শুধু না, দেশেও তুমি কেরানির চাকরি ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়া আল্লাহর দেশে বসে কতলের, আল্লাহর আইনের, বদনাম কর!

স্তম্ভিত ও প্রায় অশ্রুসজল খোকন বলে না যে সে কেরানি নয়, এমেরিকান কমপাউন্ডের আল-ইয়ামামা লাইব্রেরির ইন-চার্জ।

এতো কিছু সত্তে¡ও খোকন ওর মামার বাসায় যাওয়ায় ক্ষান্তিÍ দেয় না। এদিকে এমেরিকানদের কেউ কেউ মাঝে-মধ্যে কমপাউন্ডের বাঙালি ক্লিনারদের টিনবন্দি মটরশুঁটি, বাদাম, মাশরুম ইত্যাদি দান করে। ওদেরই একজন পাওয়ার পরে এরকম অনেক কৌটা খোকনকে উপহার দিলে সেগুলো সে একদিন মামার বাসায় নিয়ে যায়। ভাবে, সেখানে সেই এক মাস শুয়ে-বসে খাওয়ার লজ্জা খানিকটা ঘুচবে এতে।

আরেকদিন মামার বাসায় যাবার পথে, লিমোজিন থেকে নেমে হাঁটার সময়, হঠাৎ খোকনের পাশে এসে দাঁড়ায় এক আরব যুবা। খোকনকে দেখে চোখ মারে। এরপর তার বাসায় আশা করে নেতিবাচক উত্তর মেলায় ছেলেটি নিরাশ কিংবা রুষ্ট হয় না। তারপর খোকন চার তলা দালানের দোতলায় তার মামার রেন্টেড ফ্ল্যটের কলিং বেল বাজাতেই মামী দরজা খোলেন আর ছোট্ট মামাতো ভাই আরাফাত বলে:

ভাইয়া, ভাইয়া, আপনার সেদিনের খাবারগুলি খেয়ে আমাদের সবার পেটের অসুখ হইছে! আম্মু পরে দেখছে, ওইগুলির ডেইট এক্সপায়ারড্ ছিল!

নিজেও ওগুলোর এক্সপায়ারি ডেট চেক না করায় তড়িতাহতের অনুভবে খোকন বুঝতে পারে না তৎক্ষণাৎ সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পড়বে কি না।