হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার
খালেদ হামিদী
১
ফ্লাইওভারে ধাবমান গাড়ি থেকে কাল রাতে খোকন কীভাবে যে যানসমেত অথবা একাই, একই সঙ্গে তেরছা এবং ঝটিকা টেক অফের মাধ্যমে, আকাশে উড়ে যায় আজ সকালে তা নির্ণয়ে সে নিজে সক্ষম হয় না। তবে বুঝতে পারে, তার বেঁচে থাকার ইতিহাসে সংঘটিত প্রথম ও একমাত্র উড্ডয়নের এই পুরো প্রসঙ্গ সে কোনোদিন ভুলবে না। দেশে, ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র থাকা কালে, শুরুতে দোচুয়ানি আর শেষে ফোট্টি (স্থানীয় বিশেষ্য, আদতে ফর্টি কি না তার জানা নেই) সহযোগে পানপর্ব সেরে আসে খোকন। এই রিয়াদে আসার সাড়ে তিন বছর পর থেকে ঢাকার মীরপুরের কায়েস, ফয়েজ আর টুকুর সাথে তার পরিচয়। ওরা খোকনের চেয়ে বয়সে ঢের ছোট হলেও চারজনই পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে দ্রুত। সকলে আবার সহকর্মিও নয়। খোকন এক মেইনটেন্যান্স কোম্পানির প্রকল্প ব্যবস্থাপকের সচিব আর বাকি তিনজন অনুরূপ আরেক কোম্পানির শ্রমিক। চট্টগ্রামের মনসুরাবাদের খোকন এদেরকে মীরপুর বাহিনী বলে অভিহিত করলে কায়েস নিজেকে সঙ্গী দুই অনুজের নেতা ভেবে বসে। তার উদ্যোগে ও আয়োজনেই খোকন কাল সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো সেবনে নির্দ্বিধ হয় কাশির সিরাপ পামেলা। সিটি থেকে খানিক দূরবর্তী কায়েসদের ক্যারাভানে, চারজনের ওই ঢাকাই আসরে, খোকনের এই প্রথম অংশগ্রহণ। কায়েসদের কেউ এসএসসি, কেউবা এইচএসসি হলেও খোকনও তাদের মতোই চাকুরে পিতার সন্তান বলেই সমাবেশে হারিয়ে যায় নিঃসংকোচে। ওই ওষুধ খেতে খানিকটা যে ভয় সে পায় না তা নয়। তবে বন্ধুদের ধরনে এক টানে ওষুধের ফাইল শেষ করতে পারে না সে। তথাপি ক্যারাভান থেকে কিছুটা দূরবর্তী আধ-নোংরা প্রায়-খোলা গণটয়লেটে প্রস্রাব করতে গিয়ে খোকন আঁতকে ওঠে। পেশাবের বেগ সত্তে¡ও যেমন তা থমকে থাকে তেমনি সে তার অঙ্গটিও খুঁজে পায় না। লিঙ্গান্তর নয়, বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ার মারাত্মক আশঙ্কায় বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকে সে। শেষে টুকু তাকে খুঁজতে এলে কোনোমতে টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে তারই অবরুদ্ধ পেশাবের মাত্র কয়েকটি ফোঁটা। এই দফায় প্রাণে বেঁচে যাওয়ার অনুভূতিসহযোগে লিমোজিনে নিজ ভিলায় ফেরার সময় কয়েক মিনিটের জন্যে হঠাৎ আসমানে ছুটে যায় খোকন।
আপনার ছোট ছোট বয় ফ্রেন্ডদের লগে কাইলকা কি কি করলেন?
দশ কক্ষসঙ্গীর একজন ফজলুলের এই আপত্তিকর প্রশ্নে কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে খোকন বলে :
নিজ দেশের মানুষকেও আরইব্যা পুরষদের লাহান মনে করেন নাকি যে, আইনের কারণে গার্ল ফ্রেন্ড না পাইয়া আমিও পোলা লইয়া যা-তা করুম? কথাবার্তা হিসাব কইরা কইয়েন। আমি আপনাগো লগে মিশি বইলা আমার অফিশিয়াল অবস্থানের কথা ভুইলা যাইবেন, তা তো হইবো না!
শ্রমজীবী ফজলুল এতে সাংঘাতিক অপমানিত বোধ করেই ঘোষণা দেয় :
আপনি সিঙ্গেল রুম নিয়া থাকতে পারেন না? আপনের লগে আর কথাই কমু না!
শুক্রবারে, ছুটির দিনের এই সকাল সোয়া দশটায়, ঘুম ভাঙার পরপরই এরকম তিক্ততায় ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে খোকন। স্মৃতিতে তৎক্ষণাৎ ভারতীয় আলী আজম ঝিলিক দিলে দুঃখেও খুব ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে সে। কোম্পানির কালচে নীল পোশাক পরিহিত ক্লিনার আজমের হাস্যোজ্জ্বল আন্তরিক গোল মুখখানা আনন্দের সঙ্গে বেদনাও বয়ে নিয়ে আসে। এক বিকেলে কোম্পানির বাসে কর্মস্থল থেকে ভিলায় ফেরার সময় কয়েকজন ফিলিপিনোর পাশাপাশি আজমের মশকরাও হঠাৎ কিঞ্চিৎ অসহনীয় হয়ে ওঠে। আর, খোকন নিজের পদমর্যাদা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আজম খোকনের গায়ে একটু চিমটি কেটে কিংবা শার্ট টেনে মজা করলেও তাতে কোনো ব্যক্তিগত ইশারা থাকেনি। তবুও খোকন কেন অমন জবাবে আজমকে বিমুখ ক’রে তোলে নিজেই ঠিক বুঝতে পারে না যেন। সকালে পার্ট টাইম কাজ (যা এ দেশে নিষিদ্ধ) সেরে কর্মক্ষেত্রে আসতে আজমের আধ থেকে পৌনে এক ঘণ্টা দেরি হয়। তাই সে স্বেচ্ছায় খোকনের ব্রেকফাস্টের দায়িত্ব পালন করে অনেক দিন যাবৎ। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে অফিস শুরু হওয়ায় আরামপ্রিয় খোকন ভিলায় নাশতা খাওয়ার সময় তো পায়ই না, কোনো কোনোদিন প্রাতঃকৃত্যও সারে অফিসে এসে। তাই আজমের কাছ থেকে প্রায়-বন্ধুত্বপূর্ণ সুবিধা নিয়ে বিলম্বিত উপস্থিতির সাজা থেকে তাকে খোকনের অমন মুক্তি দান। আন্তরিক সম্পর্কের এক পর্যায়ে আজমের বাগদত্তার ছবি পর্যন্ত দেখে সে। মাস তিনেক আগে আজম অন্য প্রজেক্টে ট্রান্সফার হবার পরে এই প্রথম তাকে মনে পড়ে খোকনের। আজমের এই স্থানান্তরের প্রায় পাঁচ মাস আগে থেকে আজ অব্দি কিনে ব্রেকফাস্ট সারছে সে। এর আগে অনেক মাস ধরে খোকন কি তাহলে ঘুষ নেয়? নাকি আর্থিক সাকুল্য নিশ্চিত করতে আজমকে সহায়তা করে? ইত্যাকার জিজ্ঞাসার দংশনে সম্মান খোয়ানো আর মানুষকে হারানোর দ্বৈত প্রশ্নের দোলাচলে খোকন অনেকক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থাকে। ততোক্ষণে, ভিলাস্থ গণগোসলখানায় যাওয়ার আগেই, চারিদিকে জুমার আজান শুরু হলে (অন্যদিনও জোহরের আজান হয় বেলা এগারোটার দিকে) হঠাৎ খানিকটা ভয় পায় খোকন। এবং, আচমকাই, ফজলুলের হাত ধরে প্রায় ক্ষমা চেয়ে বসে। ভীতি লাভ আর ওই হাত ছোঁয়ার মাঝখানে সে ভাবে, পাঁচ ওয়াক্ত দূরে থাক, তার জুমাও কায়েম না করার বিষয়টি তো ফজলুলসহ রুমের সকলেই মেনে নেয় এবং এই তথ্য বাইরে ফাঁস না করে তাকে বাঁচায়। সে কেন নিজেকে আলাদা করবে? যদিও, নাস্তিক নাকি? প্রশ্নে কেউ কেউ খানিকটা সমালোচনাপ্রবণ হয়ে উঠতে চায়, তবুও, ওরা সকলে মিলে তার জন্যে প্রতিরক্ষা ব্যূহই তৈরি করে। এমনটিই অনুভব খোকনের। কেননা মোথাওয়া (সরকার-নিয়োজিত, স্বাভাবিক আরবীয় পোশাকে সজ্জিত বাহিনী। চলমান জনস্রোতে ব্যাঘাত ঘটায় না। এবাদতের প্রাক্কালে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় ফুটপাতে অথবা টেলিফোন বুথে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আলাপরতরাই কেবল ধৃত হন তাদের হাতে। উপাসনা করিয়ে আটককৃতদের ইকামা বা পরিচয়পত্রে লাল কালির একটা দাগ এঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারো ইকামায় পরপর তিনটি দাগ পড়লেই, অবশ্যই তিনি ভিনদেশি চাকুরে বা শ্রমিক হলে, তাঁকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়।) জানলে তার কি দুর্দশা হতে পারে আতঙ্কে তা সে কল্পনা করতেও অপারগ। মোথাওয়া তো ভিলায়ও হানা দেয় কখনো কখনো।
খোকন স্নান সেরে বেরুলে, অভিন্ন ভিলার ভিন্ন কক্ষের অধিবাসী বাশার, গার্ডেনার, তাকে মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রণ জানায় এই ব’লে :
বুটের ডাল দিয়া গরুর মাথা পাকাইছি। আজ ক্যান্টিনে খাইয়েন না। দুপুরে আমার লগে খাইয়েন।
খেতে খেতে বাশার বলে :
আপনেরে কয়েকবার দেখছি ডাইরিতে কি যেন লেখেন। ফার্সোনাল কিছু লেখলে ডাইরিডা ছুপায়া রাইখেন। আপনের রুমমেটদের হগলে কিন্তু ভালা মানুষ না।
খোকন চাটগাঁ আর বাশারের দেশের বাড়ি কুমিল্লার লোকজনের ভোজন-রসিকতার প্রশ্ন তুলে বিষয়ান্তরে যায়। তবুও বাশার তার প্রসঙ্গটিকে আরেকটু বিস্তৃত করতে চায় এই জিজ্ঞাসায় :
হুনছি আপনি দেশে নাকি লাল দল করতেন? মাইনষে কয় ওই দলের লোকেরা আল্লাহ-খোদা মানে না। কিন্তু আল্লাহর দেশে আইসা আমরা কি দেখলাম আর কি পাইলাম! এই কোম্পানি তাও ভালো, আমাগোরে বেতন দেয় ৩০০ রিয়াল আর খানা বাবদ ১৫০। অনেক কোম্পানি তো বেতনই দেয় না। কিছু কোম্পানি প্রতি মাসে দেয় মাত্র ১৭২/১৭৮ রিয়াল। পরশুদিন আরেকটা কোম্পানির খবর শুইনা বরফ হয়া যাই। সেটা দেয় ১৫০ রিয়াল! সাধারণ দেশীয় খাবার খাইতেও তো মাসে ১৩০/১৪০ রিয়াল লাইগা যায়। আমাগো দেশের এসব মানুষ কীভাবে বাঁচে! কীভাবে টেকে তাদের পরিবারগুলা!
খোকন বাশারের কথায় পূর্ণতা দেয় এভাবে :
তদুপরি রাস্তা-ঘাটে পর্যন্ত আমাদেরকে আরো কতো পরিহাস আর অপমান করা হয়! অথচ আমরা একই ধর্মেরই লোক!
বাশারের কণ্ঠে এবার জোর আসে :
আরে ওসব কিছু না, বুঝলেন? টেকা, দুনিয়াতে টেকাই সব। আমরা গরিব দেশের লোক বইলাই তারা অমন অসম্মান করে। খালি কি তাই? হেরা তো আমাগোরে আসলে মানুষই মনে করে না।
বাশারের এই কথায় খোকন সংকুচিত হয়ে আসে মনে মনে। গ্লানি ও পরিতৃপ্তির এক অদ্ভুত বিমিশ্র অনুভবে তার মুখাবয়বে অচেনা এক পরিবর্তন আসে। এতেই বাশার হঠাৎ অবাক হয় :
কি হইল খোকন ভাই? আপনের চেহারা অমন হইয়া গেল ক্যান? আমার খাওয়া শেষ, আর আপনে অহনতরি ভাত নাড়তাছেন! কি হইল!
না, কিছু না! ব’লে আহার সম্পূর্ণ ক’রে উঠে যায় খোকন। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বাশারকে ধন্যবাদ দেয় সে আর যোগ করে :
বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়া, লুকায়া পার্ট টাইম কইরা আপনি নিজের ও পিতৃপরিবারের সবার জন্যই টেকা পাঠান। এজন্য আপনাকে অভিনন্দন।
খোকন রুমে এসে নিজের সিটে বসতেই তার আরেক কক্ষসঙ্গী, ক্যান্টিনের কুক, কেরানিগঞ্জের মধ্যবয়সী মফজল হঠাৎ জানতে চায় :
আপনি তো এখানে আসার আগে ওয়াদিলেবানে, বাদশার প্রাসাদের পেছনে, আমেরিকান কম্পাউন্ডে তিন বছর আছিলেন। আচ্ছা কন তো, আরইব্যারা আমেরিকানগো বাপ মানে ক্যান? গত সাপ্তায় সিগনাল না মানায় আমাগো ড্রাইভার আলমগীররে ২০০০ রিয়াল জরিমানা করে পুলিশ। কিন্তু আইজ সকালে দেখলাম, সামনের মোড়ে, সিগনাল অমান্য করল এক আমেরিকান আর পুলিশ তারে সেল্যুট দিল।
খোকন উত্তর দেবার আগেই নিজের সিটে শুয়ে ঢাকার উত্তর বাসাবোর বাবলু বলে :
আমেরিকানগো ধোন বেশি বড় তো তাই ইজ্জত করে আরকি! আমেরিকা তো সারা দুনিয়ার মাতবর!
খোকন মফজলকে রাজনীতিটা বোঝাতে চেয়েও পারে না। কাপাশিয়ার রহমত সঙ্গে সঙ্গে বলে :
আরইব্যারা আমাগো গোয়া মারতে চায় ক্যান? আমি একটা কালা পোলা। দেখতে সোন্দর না, বান্দর। আমার পাছায়ও হাত দিয়া থোয় আর ফারাফারি করে!
এই কথায় রুমের সকলেই একযোগে হেসে ওঠে এবং এই হাসির শব্দ হাসপাতালের ওয়ার্ডপ্রতিম দীর্ঘ ও প্রশস্ত কক্ষটিতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। মফজল শুধু জানতে চায় :
এই ঘটনা কোথায় ঘটে?
রহমত বলে :
কিং খালেদ বিল্ডিংয়ের পেছনে, এক বাকালায় (মুদির দোকানে)।
খোকন অমন না হেসে শুধু বলে :
তেলসম্পদের কমপক্ষে আশি ভাগ একাধিক এমেরিকান কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আছে। বিমান বাহিনীভিত্তিক প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থাও এমেরিকানির্ভর। একেকটা কম্পাউন্ডে সমস্ত সুযোগসুবিধা দিয়ে এমেরিকানদের রাখা হয়। টয়লেট পেপারও কিনতে হয় না তাদের।
এদিকে বাবলু টিভি অন করতেই খবর শুরু হয়। সংবাদ পাঠক বরাবরের মতো বলে :
হাদা মামলাকাতিল আরাবিয়াতুস সৌদিয়া (সৌদি আরবের সাম্রাজ্য)।
সাথে সাথে বাবলু কিছুটা মান বাংলায় সজোরে ব’লে ওঠে :
কিং ফাহাদ এইমাত্র ফিরলেন জর্জ বুশকে পোন দিয়া!
এতে আবারো হাসির ঢেউ ওঠে এবং তা মহাতরঙ্গ হয়ে কেবল রুম নয়, বুঝি ভিলার বাইরেও গড়িয়ে-ছড়িয়ে পড়ে।
খোকন আবারো খানিকটা ভয় পায়। সকলকে হাসি কমাতে নির্দেশ দিয়ে, এসির শৈত্য বাড়িয়ে, কম্বলে নিজেকে ঢেকে দেয় সে। আর,ওই অন্ধকারে, কাল রাতের আড্ডার স্মৃতি ছবির পরে ছবি হয়ে জ্বলে ওঠে। ওষুধটির পামেলা নামের স্ত্রীবাচকতায় কায়েসরা তাদের হারানো প্রেয়সীদের বুঝি ফিরে পায়। তারা পান করে প্রেম এবং সেই সঙ্গে বিরহের কালিক বিস্তৃতি। এদিকে তেত্রিশ বছরেও প্রেম না হওয়ার আক্ষেপের চেয়েও খোকন তখন ডুবে যায় নিজের ভবিতব্যহীনতায়। ভাতা ছাড়া প্রাপ্ত মাত্র এই এক হাজার রিয়াল বেতনে ওর পক্ষে দেশে নিজের জন্যে কোনো ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। তাই সে এক অতল খাদের কিনারে নিজেকে আবিষ্কার করে আর কাঁদে। তাছাড়া ভীরুতার কারণে তার পক্ষে নিষিদ্ধ পার্ট টাইম বা সাফাইয়ের কাজ করাও সম্ভব নয়। কিন্তু পাতালে পতনের আশঙ্কা থেকে আকাশে উত্তরণের ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে? নিজেরই এই প্রশ্নে কাবু খোকন আস্তে তলিয়ে যায় ঘুমের সমুদ্রে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় অনেকেই বেরিয়ে পড়ে। রুমে থাকে শুধু মফজল আর ওর শ্রদ্ধাপ্রবণতায় মুগ্ধ খোকন। মফজল কথা পাড়ে :
হুনছি, দেশে সেই বড় রাজাকারকে যেদিন নাগরিকত্ব দেওয়া হয় সেদিন আপনি রাইতে ভাত খান নাই। ক্ষোভে-দুঃখে সারা রাইত কাঁদছেন। খবরটা সকালে পাইলে মনে হয় দিনের ভাতও খাইতেন না। এই রকম ঘটনা আর শুনি নাই। কিন্তু ভাই, দেশে তো দেশপ্রেমিকদের ঠাঁই নাই। ওই আমেরিকান পজেটে (প্রজেক্টে) দেশের রাজাকারগুলাই মনে হয় এক জোট হইছিল। আপনে সেদিন আমাগো লগে থাকলে এই রুমের ভিতরেই হগলে প্রতিবাদে ফাইট্যা পড়তাম। অমন কইরা কাঁদতে হইত না।
খোকন মুখ খোলে, হঠাৎ তার সা¤প্রতিক অভ্যাসবিরোধী প্রায়-প্রমিত বাংলায় :
ওই ঘটনার পরে এরাব নিউজে তখন, অদ্ভুতভাবে, ওই ভয়ংকর রাজাকারের বিরুদ্ধে লেখা বাঙালি এবং পাকিস্তানিদেরও অনেক চিঠি ছাপা হয়। এই দেশে চাকরি করে এমন এক শিক্ষিত পাকিস্তানি ওই রাজাকারের বিচার দাবি কইরা বসে। আমি চিঠিটার ফটোকপি ঢাকায় এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে পাঠাই। পরে দেশে প াশ দিনের জন্য ছুটিতে গেলে জানতে পারি, সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত দৈনিকে সেই চিঠিটার অনুবাদ শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের আঁকা ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনসহযোগে ছাপা হয়, ‘বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ’ হিসেবে। খবরটা প্রথমে দেয় আমার একমাত্র ভাই ফাহাদ। সে তখন হিসাব বিজ্ঞান ১ম বর্ষের ছাত্র। কিন্তু পত্রিকাটা বাড়িতে পাওয়া যায় না। ফাহাদও জানতো না যে সেই বিশ্বস্ত সূত্র আমি নিজেই। সাংবাদিক বন্ধুও পত্রিকাটির আর্কাইভ থেকে আমাকে কপি নিয়া দিতে পারে নাই।
শ্রদ্ধায় আরো বিগলিত মফজল চোখে-মুখে মুগ্ধতা ফুটিয়ে বলে :
তাতে কি হইছে। আপনে তো একটা বিরাট দায়িত্ব পালন করছেন। গাছে ফল দেয়। কিন্তু গাছ কি নিজের নাম মাইনষেরে কইতে পারে? নিজের নাম ছাড়াই আপনে তো প্রতিবাদ জানায়া লাইছেন। আপনেরে হাজার হাজার সালাম জানাই।
খোকন যোগ করে :
সালাম সেই ন্যায়বান পাকিস্তানিকেও।
মফজল আরো বলে :
আচ্ছা, এই দেশে রাজনীতি তো নিষিদ্ধ। পত্রিকাডা চিঠিগুলা ছাপল ক্যান?
খোকনের উত্তর :
জানি না। জুতা মাইরা গরু দানের মতো এটা একটা তামাশাও হইতে পারে।
মফজল কয় :
ঠিকই কইছেন। এই দেশের সরকার তো পরথমে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিই দেয় নাই। আমরা কপালের দোষে এইখানে মরতে আইছি।
খোকন নিছক ভাগ্যকে দোষী করার লোক না হলেও আর কিছু বলে না।
সেই শুক্রবারেই, রাত আটটার দিকে, খোকন একাই ভিলার বাইরে আসে। কাছের ফুটপাতে জহুরের দেখা মেলে হঠাৎ। পেশায় ড্রাইভার, চট্টগ্রামের কালুরঘাটের জহুর, ষোল বছর ধরে আরবে থাকায় আরবি বলতে পারে বিস্ময়কর দ্রুততায়। খোকন তা টের পায় তার সাথে পাশাপাশি হাঁটার সময় এক উঠতি আরব যুবক হঠাৎ পেছন থেকে দৌড়ে এসে দুজনকেই ধাক্কা দিলে। যুবাটি দুজনের মধ্যখান দিয়ে সামনে ছুটে গেলে জহুরও দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে অসম্ভব সাহসিকতায়। আর, অনর্গল আরবিতে সে ছেলেটিকে শাসালে খোকন বরাবরের মতো ভয় না পেয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি হয়তো আজ সুদর্শন খোকনকে একা পেলে পাকড়াওয়ের চেষ্টাই করতো।
রাতে ক্যান্টিনে যাবার আগে রুমের প্রায় সকলেই যে-যার সিটে শুয়ে-বসে আড্ডায় মাতে। কক্ষসঙ্গীরা এই সময়টায় অথবা শুতে যাবার আগে এভাবেই ছুটির দিন ভাগ করে নেয় পরস্পর। কোলাহলের মধ্যেই আজ নিঃসঙ্গ বোধ করে খোকন। সশব্দ সমুদ্রের মাঝখানে নিঝুম দ্বীপ সে, শূন্যে তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে তার, মায়ের চাচাতো ভাইয়ের সাথে এক আপার বাসায় যাওয়ার পথে এক দল স্থানীয় ছোকরা ডিম ছুড়ে মারে তারই ওই মামার ফোর্ড গাড়িতে। অথচ মামা আল ব্যাংক আল সৌদি আল ফ্রান্সির একজন ভালো ব্যাংকার। আরব তরুণরা বাঙালিদের সাইকেলও চালাতে দেয় না অলিতে-গলিতে। সাইকেল থামিয়ে একেক ধাক্কায় চালককে সুদ্ধ রাস্তায় শুইয়ে দেয়। মামাই একদিন জানান কিং ফয়সাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের ডাঃ সাইফুল্লাহ খানের কথা যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের, ইংল্যান্ড থেকে পাশ-করা, একজন অধ্যাপকও। ক্লাসে এক স্থানীয় ছাত্র তাঁকে, বাংলাদেশের লোক বলেই, সাদিক (বন্ধু) সম্বোধন করায়, চাকরি ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। খোকন মর্ম থেকে উৎসারিত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে :
আমি, এই আমরা, কোথায় যাবো? এখানে চাকরি বদলের তেমন সুযোগও তো নাই!
সে আরো ভাবে :
একবার সপ্তাহ খানেকের জন্যে রিয়াদে কাজে-আসা তাদের কোম্পানির জেদ্দা প্রজেক্টের ক্লিনার্স সুপারভাইজর কামরুল জানান, এই আরব ছোকরার দল সেই বন্দর নগরীতেও পায়ে পাথর ছুড়ে তাঁকে রক্তাক্ত করে।
আহা, কি সরল মানুষটা! ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্নাতকোত্তর।
নিম্ন কণ্ঠের স্বগত সংলাপে খোকন নিজেকেই আরো বলে :
কামরুল ভাই আমাকে সেই আবু লাহাবের কথা মনে করিয়ে দেন যে চাচা হয়ে নবীজিকে একইভাবে আহত করে নিজের সমকালে নতুন ধর্মের আবির্ভাব মেনে নেয়নি ব’লে। আর, সুপারভাইজর সাহেব আমাকে জিগ্যেস করেন আমরা এখানে বিরুদ্ধ কোনো ধর্ম প্রচার করতে এসেছি কি না!
ভাবনার এক পর্যায়ে খোকন হঠাৎ সিটের নিচে-রাখা স্যুটকেসটা খুলে ডায়েরিটা হাতে নেয়। রুমের জনসমাবেশেও গোপনীয়তা রক্ষা করেই যে খোকন ডায়েরি লেখে এবং পড়ে সে-ই ভুলে নিজের খাটে তা আধখোলা রেখে বাথরুমে যায়, সেই শুক্রবার রাতে। রুমের অন্য সবাই তখন ক্যান্টিনে। কিন্তু খোকন রুমে ফিরতেই তাকে হতবাক ক’রে ফজলুল এক নিঃশ্বাসে বলে :
মুশকিলা কাতির (সমস্যা অনেক)! আমি খালি খালি সন্দেহ করি নাই। আপনের ডাইরির একটা পাতায় দেখলাম, কয়েকটা লাইন লেইখা এমনভাবে কাইট্টা দিছেন কিছু পড়াই যায় না! এমন কইরা কেউ কলম ঘষে? নিশ্চয় নিজের খারাপ কামের কথা লেখছেন। লেইখা আবার কাটছেন! পরে ডরাইলেন ক্যান? ওসব করার সময় ডর লাগে নাই?
ডায়েরি পড়ে ফেলার অপরাধ কিংবা এই অননুমোদিত হস্তক্ষেপের কারণে ফজলুলকে শাসানো অথবা প্রশ্নে আহত করার পরিবর্তে, বজ্রাহতের অনুভবে খোকন, ফজলুলেরই চোখে প্রথমবারের মতো, বদলে যেতে শুরু করে। তার গৌর মুখাবয়বে ভিড় করে জগতের সব পান্ডুর বর্ণ। বুকের গভীরে এমন ধাক্কা সে টের পায় যে তাতে শরীরে রক্তপ্রবাহের গতিপথও বুঝি পাল্টে যায়। বুক ভেঙে তার চোখে উঠে আসার উপক্রম হয় আজন্মের সব কান্না। খোকন শুধু কোনোমতে, কিন্তু প্রবলভাবেই, কাঁপতে কাঁপতে প্রাণান্তকর দ্রুততায় বলে:
না। আপনে কিছু পড়েন নাই। আপনে কিছু দ্যাখেন নাই। আপনে কিছুই শোনেন নাই। পড়লেও কিছুই বোঝেন নাই। না, না! আপনে কিচ্ছু জানেন নাই!!
বলতে বলতেই সে ডায়েরির ওই ক’টা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু পারে না। মনে মনে শুধু বইয়ের অক্ষরের চেয়েও ক্ষুদ্রাকারে কুচি কুচি ক’রে সে স্মৃতির পাতাগুলি ছিঁড়তে থাকে অনন্ত অবধি। কয়েক মিনিট পরেই খোকন নিজের নির্বুদ্ধিতা এবং অদ্ভুত ভীরুতার জন্যে নিজেকেই ধিক্কার দেয়, তাও আপন মনে। ফজলুলকে আসল কথাটা বলতে চেয়েও, বলে না। এমন অদ্ভুততা তার। কায়েস, ফয়েজ আর টুকুর মুখে শোনা ঘটনাই সে লেখে দিনলিপিতে। তিন আরব যুবক, শহর থেকে অনেক দূরে, মরুর এক পাহাড়ের নিচে, ভারতীয় এক সুদর্শন তরুণকে ধর্ষণের পর খুন করে লাশ বালুচাপা দেয়। কিন্তু এই সংবাদ এরাব নিউজ বা সাউদি গেজেটে প্রকাশিত না হওয়ায়, খোকন নিজেকেই বলে:
আমি ডায়েরিতে লিখেই মুছে দিয়েছি।
আবার ভাবে:
কেন মুছলাম! অমন তো আমার সাথে ঘটেনি! কেউ আমার ডায়েরি যে পড়ে ফেলবে তা কল্পনায় না এলেও বিনা অপরাধে সন্ত্রস্ত আমি কি টের পাই যে এ-দেশে দেয়ালের কান শুধু নয়, চোখও আছে!
২
এই, শাকিবের মা বেহুঁশ হইছে! শাকিবের মা বেহুঁশ হয়া গেছে!!
বাড়ির সামনের বড় পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে চড়–ইভাতিতে নিমগ্ন কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ জন চাচাত-জেঠাত ভাই-বোনের মধ্যে কে যে এভাবে খবরটা ছড়ায় তা বাকি চৌত্রিশ জনের আর মনেই থাকে না। শোনা মাত্র সমাবেশের একজন বাদে আর সকলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যায় শাকিবদের একতলা দালানের উত্তর-পশ্চিম জানালা সংলগ্ন আমতলায়। প্রাইমারি ও হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী চড়াইভাতির আমুদে এই কিশোর-কিশোরীদের সাথে তরুণ, যুবক ও বয়স্কদেরও কেউ কেউ ওই জানলার গরাদপ্রতিম গ্রিলে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই দেখে, অজ্ঞান জেঠির মাথায় পানি ঢালছে তাঁর ক্রন্দনরত সন্তানেরা। ছোটরা বড়দের মুখে শুনতে পায়, জেঠি মা এক সাথে পনেরো-বিশটা ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেললে এই দশা সৃষ্টি হয়। এতে পুকুরপাড়ের আয়োজন খানিকটা শ্লথ হয়ে এলেও ব্যাহত হয় না।
চাল, ডাল, তরকারি ও মাছ-মাংস একেক পরিবার থেকে একেক পরিমাণে পাওয়ার ভিত্তিতে, হাই স্কুলছাত্রী আপাদের রান্নার সুবাদে, এমন পিকনিকের আয়োজন, কিছুদিন পরপর, অব্যাহতই থাকে। ওদিকে শাকিব ভাইজানের মা-বাবার ওসব ঘটনা দেখতে সপ্তাহে ন্যূনপক্ষে দু’বার তাদের ছুটে যাওয়াও থামে না। ওই পরিবারের আর্ত ও ক্রুদ্ধ চিৎকার এবং কান্নার রোলে চাক্ষুষ সাড়া দিতে, মায়েদের আকস্মিক বাধার মুখে, একবার শুধু অপারগ হয়ে পড়ে কেরানি বাড়ির এই ছেলেমেয়েরা। সেদিন ওরা কেবল শোনে, শাকিবের মা ওর বাবার অÐকোষ চেপে ধরেছে।
দেশের স্বাধীনতার প্রথম বছরটি, বন্দর নগরের বাণিজ্যিক নাভিস্থল বাদামপুরস্থ গ্রামসদৃশ কেরানি বাড়ির অধিবাসীদের, এভাবেই কেটে যায়। একত্রিশটি পরিবারের এই বিশাল বাড়ির মধ্যে নয় ফ্যামিলির বালক-বালিকারাই কেবল মিলেমিশে থাকে। এবং, এ-বাড়ির দু’জন ব্যবসায়ী বাদে আর সকলেরই মতো শাকিবের বাবা বাবুলও চাকুরে হলেও অনেকটা বণিকদের ধরনেই সৌখিন এবং সচ্ছল। তার আবাসিক দালানটির সামনে এবং দক্ষিণ পাশে শোভমান বাগান প্রতি সন্ধ্যা-রাতে সৌরভ ছড়ায় আর রেলিঙবিহীন ছাদে প্রায় প্রতি বিকেলে হারমোনিয়াম বাজিয়ে উর্দু সঙ্গীতের চর্চায় নিরত থাকে তারই স্ত্রী জেবা। শাকিবদের এই ঘরটির সামনের খোলা জায়গাটিতে কেরানি বাড়ির সব অতিথির যানবাহন এসে থামে। উন্মুক্ত স্থানটির দক্ষিণে সেই পুকুর আর সিমেন্টিক ঘাট। এই ঘাটে এসে মেশে সরকারি প্রধান সড়ক থেকে শুরু-হওয়া বাড়ির প্রবেশপথ। বাবুলের ঘরের উত্তরে একটি এক তলা বাসার পরেই শাকিবের চাচাত কাকা গৌর, সুদর্শন আলমের দোতলা বাড়ি।
রিয়াদের কর্মস্থলে বসে স্মৃতিমগ্ন খোকন কাজের ফাঁকে হঠাৎ চমকে ওঠে গুলির শব্দে:
বাবুল চাচা গুলি মারতেছে! কাক পড়তেছে একে একে!!
খেলার সাথীদের, যারা জেঠাকে বড় কাকা কিংবা কেবল চাচা বলেই ডাকে, কেউ এমনটি জানাতেই, যে যেখানেই থাকুক সেখান থেকে, সবার ভোঁ-দৌড়। সে আর স্মৃতি নয়, নিত্যবৃত্ত বর্তমান। খোকন তাই এখনো দেখে, পাকিস্তানি সিকান্দার ব্র্যান্ডের এক নলা বন্দুকের গুলিতে ভূপাতিত দশটি মৃত কাকের চারদিকে সে এবং সঙ্গীরা চক্রাকারে দাঁড়িয়ে আর মাথার ওপরে বুঝি দশ হাজার কাকের কানচেরা আর্ত প্রতিবাদ। কেবল অফিসে নয়, ওলাইয়া স্ট্রিটের ভিলা বা বাথার বাংলাবাজারেও কখনো চকিতে খোকন দেখতে পায়, ওর আপন চাচা আলীর কাজের লোক তরুণ জলিলকে তুলে আছাড় মারে তার চাচাত কাকা বাবুল। জলিলের অপরাধ সে বাবুলের গৃহপালিত এক জোড়া জালালি কবুতরকে ঝিমোতে দেখে জবাই ও রান্না শেষে খেয়ে ফেলে। আলী চাচার পরিবারও কইতর খায় বিধায় চাচাত ভাইয়ের ওপর ক্রোধ ওভাবেই বর্ষণ করে বাবুল চাচা। পাকিস্তান আমল থেকেই অমন পাষণ্ড ও দাপুটে এই চাচার সংসারে অগ্নিকান্ড কিভাবে ঘটে খোকন তা বুঝতে পারে পরে।
করাচির নারী জেবা আ লিক বাংলাও বলেন উর্দুর স্বরভঙ্গিতে। বাংলার স্বাধীনতার ঢের আগেও শাড়ির সঙ্গে হাতাবিহীন ব্লাউজ আর কখনোবা বব কাট চুলে, সর্বত্র বোরকাহীন জেবা, সমগ্র অস্তিত্বে নিজেরও বাস্তবাতীত আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলে। হালুয়া, হালিম আর বিরিয়ানির বৈচিত্র্য সৃজনে পারঙ্গম, খোকন ও তার সঙ্গীদের এই জেঠি, তার জাদের ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতার খানিক শিকার যেমন হয়, তেমনই, তারই দেবর-ভাসুরদেরও করে তোলে দুর্মুখ। কিন্তু কেরানি বাড়ির গৃহিণীদের কিঞ্চিৎ হেয়বোধ এবং গৃহকর্তাদের ওই দুর্নামপ্রবণতা সক্রিয় থাকে নেপথ্যে। বাবুলের একচেটিয়া ত্রাস প্রতিষ্ঠার ফলে বাড়ির পেছনের দুটি পুকুর এবং খালি ভূমিতে অনেকেই হারিয়ে ফেলে স্বত্বাধিকার। খোকনের মাথায় প্রশ্ন দাঁড়ায়: একমাত্র আলম চাচাই কি কাবু করে বাবুল কাকাকে? চাকরিজীবী, পীরভক্ত, নহর ভান্ডারির অনুরক্ত, মাজারে ও নিজগৃহে ঢোলক ও মন্দিরার তালে নেচে-গেয়ে উপাসনায় অভ্যস্ত আলম অফিস শেষে নিজের ঘরে না ফিরে, সে-সময়ে প্রতি বিকেলেই, ঢোকে জেবার কক্ষে। আলম নিজের চার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে, স্ত্রী আর দুই ছেলে রেখে কি রহস্যে যে জড়িয়ে পড়ে শাকিবের মায়ের সঙ্গে, তা বোঝার সামর্থ্য নয় বছরের বালক খোকনের তখনও হয়নি। বাবুলের একক ইমারতটির সামনের দিকের বাগান সংলগ্ন দক্ষিণ অংশের সিঙ্গল বেডের ছোট্ট রুমটাই জেবার। এতে যে-কারোর প্রবেশই প্রায় নির্বিঘ্ন। সারা কেরানি বাড়িতে সক্রিয় গোপন সমালোচনা এক পর্যায়ে এমন সিদ্ধান্তরূপ অনুমানে পৌঁছে যে, আলম ও জেবার সন্তানকে জন্মমাত্রই জেবাই হত্যা করে বাড়ির পেছনের নর্দমায় ছুড়ে মারে। খোকন এখনও দেখে, ওই প্রশস্ত নালায় নোংরা কালো পানির ক্ষীণ স্রোতে স্থির ভেসে আছে গুঁড়ো দুধের বড় টিনের ভেতর মাথা ঢোকানো ফুটফুটে সদ্যজাত শিশুকন্যার রক্তাপ্লুত মরদেহ। নালাটির কিনার ঘেঁষে স্কুলে যাওয়ার সময় পরে আরো অমন মৃত মেয়ে বাচ্চা চোখে পড়লে খোকনের স্মৃতিতে তখন বাক্সময় হয় পাঠ্য পুস্তকের ভাষ্য: আরবের লোকেরা কন্যা সন্তানকে, জন্মের পরপরই, জীবন্ত কবর দিতো।
ওদিকে বাবুলের গৃহেও একদিন অকল্পনীয়রূপে ভোররাত অব্দি ওই ভান্ডারির সাঙ্গীতিক জিকির চললে প্রতিবেশিদের সমালোচনা প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে তীব্রতর হয়। তবুও দেরিতে, অমন উপাসনারও তিন-চার মাস পরে, বাবুল তার স্ত্রীর সঙ্গে আলমের সম্পর্ক বিষয়ে প্রশ্ন তুললে শুরু হয় গৃহদাহ। স্ত্রীকে বাবুলের প্রহার, জেবার বেশ কয়েকবার আত্মহননের প্রয়াস এবং আরো অনেক কিছুর কম-বেশি সাক্ষী হয়ে ওঠে মহল্লার আবালবৃদ্ধবনিতা।