হেমিংওয়ের বুড়ো সান্তিয়াগো ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা
রওশন জামিল
আলবেয়ার কাম্যুর লেখায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রভাব লক্ষ করে মজার একটা কথা বলেছিলেন জঁ-পল সার্ত্র। হেমিংওয়ে ছোট ছোট কাটা কাটা বাক্যে তাঁর লেখা বিন্যস্ত করেন নিজের মেজাজের প্রতি অনুগত থেকে। তিনি যা দেখেন সেটাই লিখে থাকেন। কিন্ত কাম্যুর বেলায় ব্যাপারটা অন্যরকম। হেমিংওয়ের কৌশল অনুসরণ করেছিলেন তিনি সচেতন ও সুচিন্তিতভাবে। কেননা অনেক ভেবেচিন্তে কাম্যুর মনে হয়েছিল জীবনের অর্থহীনতা বিষয়ে তাঁর যে দার্শনিক অভিজ্ঞতা, তা যথাযথভাবে বলার জন্য এটাই হচ্ছে সেরা উপায়।
সার্ত্র সম্ভবত একথাই বলতে চেয়েছেন, যে, কাম্যু যেখানে একজন অস্তিত্ববাদী লেখক, হেমিংওয়ে সেখানে আপন আনন্দে লেখেন। এটা ঠিক, দর্শন শাস্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা হেমিংওয়ের ছিল না, তবে তাঁর সৃষ্টিকর্মে তিনি জীবনের অর্থ অনুসন্ধানই তাঁর অনিষ্ট ছিল। বলতে কি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক অভিঘাতে পাশ্চাত্যে যখন ঈশ্বরে আস্থা একরকম অবসিত এবং সনাতন মূল্যবোধ পর্যুদস্ত, তখন বিশুদ্ধ নান্দনিক ও নৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে সত্তা আবিষ্কারের মধ্যে মানুষ নিখিল নাস্তিকে মোকাবেলা করতে চেয়েছিল।
হেমিংওয়ের গল্প-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্বদীর্ণ, সত্যসন্ধানী মানুষের উপস্থিতি দেখা যায় যারা, তাদের স্রষ্টার মতোই, অসীম আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে শেষপর্যন্ত উপনীত হয় বোধের এক জ্যোতির্ময় জগতে—যেখানে পরাভবের মধেই তার বিজয় সূচিত হয়। মানুষ সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অপরাজেয়।
কাম্যুর মতে জীবন মূলত অন্তঃসারশূন্য। জগৎসংসারে এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই যা মর্মকথার উৎস হতে পারে, আর তাই জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা আসলে এক অর্থহীন অনুশীলন। এমন অবস্থায় ‘দর্শনের যথার্থ জটিল সমস্যার নাম আত্মহত্যা।’ কেননা ‘জীবনে বেঁচে থাকার মূল্য আছে কি নেই বিচার করার মধ্যেই দর্শন তার মৌল জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পায়।’
ক্যাম্যুর বিবেচনায় নাস্তিবাদী শূন্যতা হচ্ছে অর্থহীনতার অবিচ্ছেদ্য চালিকাশক্তি। এটা মানুষের সব উদ্যোগ ও চিন্তনকে শেষবিচারে অর্থহীন প্রমাণ করে। তিনি বৌদ্ধিকভাবে এই অর্থহীনতাকে প্রতিরোধের রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন এক অনমনীয় বিদ্রোহের মধ্যে যা জীবন ও তার প্রাবল্যকে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি শেষপর্যন্ত মহাজাগতিক শক্তির সামনে এই প্রতিরোধের নিস্ফলতার কথা মাথায় বিবেচনায় রাখে।
কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়ক তার জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পায় সিসিফাসের পুরাণে। দেবতাদের সঙ্গে রসিকতা করেছিলেন সিসিফাস। পরিণামে তাঁকে চরম দণ্ড দেওয়া হয়: একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ড তাকে নিরন্তর ঠেলে তুলতে হবে পর্বতের মাথায়, এবং সেখান থেকে আপন ভারেই সেটা গড়িয়ে পড়বে নিচে। দেবতারা মনে করেছিলেন ‘নিষ্ফল ও সম্ভাবনারহিত শ্রমের চেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি আর কিছুই হয় না। এটা মর্ত্যের প্রতি তার ভালোবাসার অনিবার্য ক্ষতিপূরণ।’ কিন্তু সিসিফাস এই ‘নিষ্ফল অর্জনের’ মধ্য দিয়ে কার্যত ‘সেই সমুন্নত পৌরুষের শিক্ষা দেন…যা দেবতাদের অগ্রাহ্য করে এবং পাথর ঠেলে তোলে’ কেননা ‘শীর্ষদেশে পৌঁছুবার সংগ্রামই একজন মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করবার জন্য যথেষ্ট … [আর তাই] একথা ভাবতেই হবে, সিসিফাস সুখী।’
হেমিংওয়ের সিসিফিয়ান নায়ক সান্তিয়াগো একটি নির্বিচার, দৃশ্যত অপকারী শক্তির ঘূর্ণাবর্তের মুখোমুখি হয় যা তার ভালোবাসা আর সাফল্যেও স্বপ্ন চুরমারে উদ্যত। অন্ধকারের এই শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মূল অস্ত্র সনাতন মূল্যবোধ: মর্যাদা, সাহস, শালীনতা, ঔদার্য আর নিরাসক্ত দৃঢ়তা। এই মূল্যবোধইÑ‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু কখনও পরাজিত হয় না’Ñমহাজাগতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানবীয় মর্যাদার আশ্রয় প্রতিষ্ঠা করে, যদিও জানে শেষপর্যন্ত তার স্বপ্নের দ্বীপ বিধ্বস্ত হবে।
কাম্যুর সিসিফাসের দেহ যেমন ‘প্রস্তর-ঘনিষ্ঠ পরিশ্রমে নিজেই পাথর হয়ে’ যায়, তেমনি হেমিংওয়ের বৃদ্ধ জেলে সান্তিয়াগোর মুখে ঘাড় অবধি ‘অসংখ্য বলিরেখা,’ ‘গালে রোদে পোড়া ক্রান্তীয় সমুদ্রের প্রতিফলনে হিতৈষী ক্যান্সারের বাদামি ফুসকুড়ি,’ আর হাত দুটে বড়শির ভারী দড়ি টেনে ক্ষতবিক্ষত যেগুলোর ‘কোনওটিই তাজা নয়—মাছহীন মরুভূমির ক্ষয়ের মতোই প্রাচীন।’ এই প্রস্তরবৎ অবয়ব, বিক্ষত চেহারা এগুলোই সিসিফাস আর সান্তিয়াগোর জন্য তাদের অস্তিত্বের তাৎপর্য প্রতিষ্ঠা করে। সিসিফাসের জন্য পাথরটার কাছে তাঁর ফিরে আসার ওই ক্ষণই হচ্ছে চৈতন্যোদয়ের মুহূর্ত যখন তিনি ‘তাঁর নিয়তির চেয়ে গরীয়ান; তাঁর প্রস্তরের চেয়েও শক্তিমান।’ একইভাবে, বৃদ্ধ সান্তিয়াগোর বিজয় সূচিত হয় যখন সে উপলব্ধি করে কেউ তাকে পরাজিত করেনি। সে ‘সীমা লঙ্ঘন’ করেছিল।
দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী হেমিংওয়ের নিরীক্ষাধর্মী গল্প। বৃদ্ধ সান্তিয়াগো এক নিঃসঙ্গ জেলে, মেহিকো উপসাগরে মার্লিন, হাঙর আর স্রোতের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত। তিন দিনের লড়াইশেষে পরাজিত হয় সে, ‘চূড়ান্ত ও প্রতিকারহীনভাবে।’ আর তার গোটানো পাল আরও বেশি করে ‘স্থায়ী পরাজয়ের পতাকার’ মতো দেখায়। এই গল্পের প্রতিবেশ মেহিকো উপসাগর, যা মহাকালের অনাদি প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত। সান্তিয়াগোর সংগ্রাম সেই প্রবাহের একটি ক্ষুদ্র অধ্যায়মাত্র, তার পরাজয়ের পরও যা আপনমনে বয়ে চলবে। টেরাসে দাঁড়ানো পর্যটকদের ‘পানির ভেতরে খালি বিয়ারের টিন আর ব্যারাকুডার ভাগাড়ের মাঝে একটা বিশাল শ্বেতশুভ্র মাছের কাঁটা দেখতে’ পাওয়া উপসাগরে বৃদ্ধের নাটকীয় সংগ্রামের বাইরে সংঘটিত বহমান জীবনের ছবি।
সান্তিয়াগো, সমুদ্র আর সমুদ্রের অধিবাসীকুল—এরাই মূলত এই উপন্যাসের চরিত্র। ছোটখাট ব্যতিক্রম, যেমন মেকো হাঙরের বর্ণনা, বাদ দিলে গল্পের ফোকাস আগাগোড়া বৃদ্ধের ওপর স্থির। গল্পটি বলছেন সর্বজ্ঞ লেখক নিজেই, শুধু অন্তর্গত কিছু সংলাপ ছাড়া। প্লট বিন্যাসে ধ্রুপদী ধারার ঐক্য রক্ষিত হয়েছে, বিশেষ করে স্থানের ঐক্য। কোনও পার্শ্ব-প্লট বা অ্যাকশন নেই। সম্ভবত মূল চরিত্রের প্রতি অখণ্ড মনোযোগ, অ্যাকশনের তীব্রতা ও আবেগের টানাপোড়েনের কারণেই উপন্যাসটিতে অধ্যায়-বিভাজন নেই, অনেকটাই বড় গল্পের ধাঁচে।
দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি-এর কাহিনি-র্বণনা সরল কিন্তু নাটকীয়। শুরুতেই বৃদ্ধ সান্তিয়াগো, বালক ম্যানোলিন ও সমুদ্রের কথা জানতে পাই আমরা। তারপর কাহিনি আপনাআপনি এগোয়। মাছটা শেষ পর্যায়ে পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে শূন্যে বৃদ্ধের মাথার ওপরে একটু সময় স্থির থেকে পানিতে আছড়ে পরার আগে অবধি, এর লয় যত বৃদ্ধি পায়, অনেকটাই বৃদ্ধকে মাঝে রেখে মার্লিনের চক্রাকারে পাক খাওয়ার মতো, প্রতিটা আগেরটার চাইতে সংক্ষিপ্ত এবং অপেক্ষাকৃত উচ্চ স্তরে, সর্বজ্ঞ কথকের কণ্ঠস্বর ততই যেন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসে এবং নিছক ঘটনা বর্ণনার বাহন হয়ে ওঠেমাত্র। আমরা কথকের কথা বিস্মৃত হই, নড়েচড়ে বসি, এবং ঘটনায় অখণ্ড মনোনিবেশ করি—বৃদ্ধ সান্তিয়াগোর অস্তিত্বের লড়াই শেষ হওয়া পর্যন্ত।
সান্তিয়াগো বৃদ্ধ বটে, তবে নির্জীব নয়। তার মধ্যে শক্তির প্রকাশ আছে। আফ্রিকার উপকূলে শাদা কেশরলা সিংহের স্বপ্ন দেখে সে; দেখে একজন কৃষ্ণাঙ্গের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তার স্বপ্ন-স্মৃতিতে এই তারুণ্যের অভিজ্ঞতা সুপ্রোথিত। ফলে তার অন্তর্ময় কিশোর তার সঙ্গেই থাকে। ম্যানোলিনের সঙ্গে বৃদ্ধের সোহার্দ্যময় সম্পর্কের মূল কারণ এটাই: ম্যানোলিন তার স্মৃতিময় কিশোরের বাস্তব রূপ। এই কিশোর বৃদ্ধের স্বপ্নের সৈকতে শাদা সিংহ আর মাছ ্ও হাঙরের সঙ্গে তার লড়াইয়ের অদৃশ্য সাক্ষী।
ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কিশোরকে তার পাশে কামনা করে সান্তিয়াগো; শেষ দফায়, মার্লিনটা যখন আচমকা লাফিয়ে ্ওঠায় গলুইয়ে রাখা কাটা গলফিনের টুকরোগুলোর মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে সে তখন, পর পর তিনবার গভীর আবেগের সঙ্গে। সৈকতে সিংহের স্বপ্ন দেখছিল সে যখন মাছটা লাফিয়ে উঠে তাকে চমকে দিয়েছিল। ম্যানোলিনকে ্এ সময় পাশে পাওয়ার আকাক্সক্ষা আসলে তার নিজের অন্তর্গত কিশোরের অনুষঙ্গ; তারুণ্যদীপ্ত শক্তির জন্য সান্তিয়াগোর রোম্যান্টিক আকাক্সক্ষা। মাছটাকে হত্যা করার পর আর সেই কিশোরের কথা ভাবে না সান্তিয়াগো। মাছটাকে বধ করে তার বরং একজন ভ্রাতৃহন্তারক মনে হয় নিজেকে এবং অনুশোচনায় ভরে যায় মন। ‘আমি একজন পরিশ্রান্ত বুড়ো। তবু এই মাছটাকে, আমার ভাইকে আমি মেরেছি। এবার আমাকে ক্লান্তিকর আর জঘন্য কাজগুলো করতে হবে।’ বার কয়েক ডি মাজ্জোর কথাও ভাবে সে, শবভুক হাঙরগুলো হামলা করার আগে অবধি। ওদের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে তার প্রেরণা ও প্রত্যয়ের দুই উৎস—কিশোর ও ডি মাজ্জো—তার কোনও কাজেই আর আসে না।
দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী-এর একটি বড় বৈশিষ্ট্য কাহিনি বর্ণনায় সর্বনাম পদের ব্যবহার। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সান্তিয়াগো। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে তাকে সম্বোধন করা হয় ‘বুড়ো,’ ‘সে,’ এবং ‘লোকটা’—এই তিনটি সর্বনামে। বৈশিষ্ট্যটি মূলত এই উপন্যাসের মর্মকথার সম্পূরক। একজন মানুষের যন্ত্রণা ও সাফল্যের চিত্রকল্পের মধ্য দিয়ে বিশ্ববেদনায় একাকার হতে চেয়েছেন হেমিংওয়ে। সেজন্যই সর্বনাম পদের ব্যবহার, যেন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের মাঝে নিজেকেই আবিষ্কার করতে পারে একজন পাঠক।
অনুবাদে সাধারণত দুটি ধারা বিদ্যমান: আক্ষরিক ও ভাবানুবাদ। আক্ষরিক অনুবাদ কাজ করে শব্দের সমার্থতার এলাকায়: এটি উৎস পাঠে প্রাপ্ত শব্দগুলোর সমার্থবাচক শব্দ জোগানের চেষ্টা করে এবং এর অভিনিবেশ থাকে উৎস পাঠের অর্থের দিকে। ভাবানুবাদ, অন্যদিকে, অনেকটাই উৎস পাঠের সাংস্কৃতিক অভিযোজন, মূলত উদ্দিষ্ট ভাষার পাঠকের সহজবোধ্যতার প্রয়োজনে। আমি অনুবাদে এই দুই ধারার মেলবন্ধনের পক্ষে। বিভাজনের একদিকে আছেন ভ্লাদিমির নবোকভ। অন্যদিকে নরম্যান ঠমাস ডি জিওভান্নি। প্রথম জনের পরিচয় দেওয়া ঔদ্ধত্যের শামিল। অনুবাদের ক্ষেত্রে তিনটি স্খলনকে অপরাধ ভেবেছেন তিনি: অজ্ঞতা অথবা বেপথু জ্ঞানপ্রসূত ভুল, অনুধাবনের চেষ্টা না করে অথবা পাঠক বুঝবে না মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে মূলের অংশবিশেষ বাদ দেওয়া, এবং পাঠকের বোধ বিবেচনায় নিয়ে মূলের সৌন্দর্যবর্ধন করা। ডি জিওভান্নিকে বেশিরভাগ চেনেন বোর্হেসের একজন অনুবাদক হিশেবে। তিনি বোর্হেসকে অনুবাদ করেছেন চার ধাপে: প্রথমে আক্ষরিক অনুবাদের পর তার সম্পাদনা, তারপর ইংরেজি ভাষার নিজস্ব রীতি অনুসারে পুনর্লিখন ও তার সম্পাদনা। অনুবাদ করার সময় এঁদের আমি দুই পাশে মাস্টারমশাইয়ের মতো বসিয়ে রাখি।