হৃদয়ে মুজিব || পিওনা আফরোজ
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শীতের এক সন্ধ্যা যখন গাঢ় হয়ে নামল, তখন স্টেশনে নেমে অপুর নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছিল। আশেপাশে পরিচিত কেউ নেই। জমিয়ে শীত পড়েছে। স্টেশনে পড়ে রয়েছে ছিন্নমূল মানুষজন, দূরের গ্রাম থেকে আসা ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ কিছু যাত্রী।
হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকার ভেদ করে অপু স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে। কতদিন পর এ শহরে এলো সে। কতবছর পর আবার গ্রামে ফিরছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি! মা তো আসতে দিতে চায়নি তাকে। মায়ের নিষেধের কারণটা সে জানে। তবুও কেন যে মায়ের বারণ উপেক্ষা করে গ্রামে এলো,বারবার প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি নিজেরি কাছে।
স্টেশনের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গলির মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়ে খালার বাড়ির দিকে রওনা হয় সে। খানিকটা এগিয়ে যাবার পর শরীরে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হয় অপুর। এই ঠান্ডা বাতাসই মনে করিয়ে দিচ্ছে সামনেই নীলদিঘি। ডানদিকের পথটা চলে গেছে পোরকরা গ্রামের দিকে আর বাঁ দিকেই খালার বাড়ি।
খালার বাড়ির আগেই নোবেলদের বাড়ি ছিল। সে ছিল অপুর ছোটবেলার বন্ধু। রিকশা যখন নোবেলদের বাড়ি পেরুলো তখন দূর থেকে অন্ধকারের মাঝেও বড় বড় গাছপালার ভিতর দিয়ে খালার ঘরের হারিকেনের টিমটিম আলো চোখে পড়ে।
একসময় রিকশা এসে খালার বাড়ির উঠোনে থামে। কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে রিকশা থেকে নেমে দরজায় কড়া নাড়ে অপু। খালা দরজা খুলে দাঁড়ান। খালার পরনে ছাই রঙের তাঁতের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা টানা। হাতে তসবিহ। সম্ভবত নামাজ শেষ করে উঠেছেন। অপুকে দেখে চিনতে পারলেন না তিনি। অপুই বলল, ‘খালা আমি অপু।’
অপুর কথা শুনে খালা ছলছল চোখে অপুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এতদিন পর খালারে দেখতে এলি! কত বড় হয়ে গেছিস তুই! চল ঘরে চল।
তারপরই অপুকে পাশে বসিয়ে জানতে চাইলেন,‘তোর মা তোকে একা আসতে দিলো?’
‘মা আসতে দিতে চায়নি। আমি জোর করে এসেছি। অনেকদিন বাবার কবরটা দেখা হয় না। বাবাকে খুব মনে পড়ছিল।’
‘তোর মায়ের কি দোষ বল! সে তোর বাবারে খুব ভালোবাসতো। আর তোর বাবার দেশের জন্য ছিল অনেক টান। শেখ সাহেব ছিলেন তার আদর্শ। তার কারণেই তোর বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। সে বলত, এরকম নেতা শত বছর পরেও জন্ম নেবেন কি না সন্দেহ আছে । যেদিন ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ হলো, সেইদিন তোর বাবাও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গেছিল। বাড়ি ফিরে রাতভর তোর মায়ের সাথে শেখ সাহেবের গল্পই করেছে। তিনি কীভাবে মঞ্চে উঠে আসলেন, কী পরেছিলেন, কী কী বলেছেন সবকিছু তোর মাকে বলেছে। তারপর পঁচিশে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর শুনেই তোর বাবা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে সে আর ফেরেনি। আর সেই সুযোগে তোর ছোট চাচা সম্পত্তির লোভে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তোর মাকে গ্রামছাড়া করেছে। স্বামীকে হারিয়ে শুধুমাত্র স্বামীর শেষ স্মৃতিচিহ্ন তুই আর তোর বাবার ভিটেমাটিকে আঁকড়ে ধরে এ গ্রামেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না। রাজাকার মকবুল ওকে থাকতে দিলো না। জানিস অপু, ভেবে আমার খুব অবাক লাগে, এক ভাইয়ের দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এত টান আর অন্য ভাই দেশের শত্রুর সাথে হাত মিলায়! আপন রক্তের ভাতিজা আর তাঁর স্ত্রীকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে? কী করে সম্ভব?’
কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপুর খালা। এরপরই একটু জোরালো গলায় বলেন, ‘শোন বাপ, ঐ বাড়িতে তোর যাওয়ার কোনো দরকার নাই।’
অপুর আসার খবর শুনে আশেপাশের দুই-এক ঘরের লোকজন অপুকে দেখতে এসেছে। তার মধ্যে মনিন্দ্র দাদাও ছিল। অপুকে দেখেই সে বলল, তুমি অবিকল তোমার বাবার মতো হইছ। কথাটা শুনেই অপুর বুকের ভেতর বাবার জন্য গর্ববোধ হয়! বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তার বাবা যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেননি। রাতে ছোটবেলার বন্ধু আরজু আসে অপুর সাথে দেখা করতে। একসময় তারা খুব ভালো বন্ধু ছিল। একই স্কুলে পড়ত। একটাকায় চারটা লজেন্স কিনে দুজনে ভাগ করে খেত। স্কুল ছুটির পর মাঠে ফুটবল খেলত। রোদেলা দুপুরে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ত একসাথে। কী সুন্দর ছিল ছোটবেলার সেসব দিনগুলো!
‘কিরে অপু, কেমন আছিস?’
অপু কাছে ডেকে খাটেই তার পাশে বসতে ইশারা করে। আরজু তার পাশে খাটের উপরেই পা তুলে আরাম করে বসে। মিষ্টি হেসে নরম স্বরে জানতে চায়, ‘শহরে গিয়ে একেবারে ভুলেই গেলি?’
‘না রে! ভুলি নাই, তুই আমার বন্ধু, তোকে কী ভোলা যায়?’
‘হুঁম। বুঝতে পেরেছি। কথা তো ভালোই বলিস। আচ্ছা, শোন, কাল আমার সাথে স্কুলে যাবি?’
‘কেন? স্কুলে কী?’
‘একটা অনুষ্ঠান আছে। তাছাড়া অনেকদিন তো হলো, স্কুলের কারো সাথে দেখাও হয় না তোর। শরীফ স্যার, হোসাইন স্যার এখনো তোর কথা বলে।’
আরজু চলে গেলে অপু বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের কথা মনে করে। মাকে একা রেখে এতদূর কখনো আসেনি। মা কেমন আছে কে জানে! হয়তো মন খারাপ করে রাতে খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়েছে। মাকে ভাবতে ভাবতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় অপু।
ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই আরজু আসে অপুর কাছে। দুজনে মিলে বেরিয়ে যায়। মেঠোপথের দু-পাশে সরষে ফুলের হলুদ ফুল আর ছক কাটা সবুজ ধানের ক্ষেতকে মনে হয় যেন দিগন্তবিস্তৃত রঙিন চাদর। এরই ফাঁকে ফাঁকে লাল শাক, সবুজ পালং আর মটরশুটির খেতগুলোকে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে নকশাকাটা ফুলের পাপড়ি।
আরজুদের বাড়িতে বিশাল উঠোনে বসে গরম গরম ভাঁপা পিঠা খেয়ে আর ঘোরাঘুরি শেষে স্কুলের অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে আসে। আরজু আর অপু একসঙ্গে স্কুলে যায়। হেডস্যার, শরীফ স্যার, হোসাইন স্যার অপুকে কাছে পেয়ে খুশি হন।
প্রথম সারিতে অনুষ্ঠান দেখার মর্যাদা পায় অপু। কতদিন পর গ্রামে এসেছে! তার ওপর এমন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারা ওর জন্য ভীষণ আনন্দের। হঠাৎ একটি ছেলেকে দেখে সে চমকে ওঠে। ছেলেটি হুবহু বঙ্গবন্ধুর মতো সেজে এসেছে। পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, তার উপরে কালো কোট। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। তাকে দেখে অপুর মনে হলো, ছেলেটি শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাবনত বলেই তাঁর মতো সাজার চেষ্টা করেছে। নেতার গায়ে এই পোশাক দেখেছে আর তা পরতে পারার যে আনন্দ তা তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। ভালোভাবে লক্ষ করে দেখল অপু, ছেলেটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে অবিকল বঙ্গবন্ধুর ভঙ্গিমায় হাত তুলে বক্তৃতা করছে। অপুর টিভিতে দেখা ৭ই মার্চের উত্তাল দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। রাসেল বক্তৃতা করছে অবিকল সেই ভরাট কণ্ঠে আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়…
আরজু পাশ থেকে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল, ‘দেখছিস, একজন নেতাকে কতটা ভালোবাসলে এমন করে তাঁর কথাগুলো হুবহু বলা যায়! ছেলেটা বাবার মতো হয়নি। যেমন তোর বাবার সাথে রাসেলের বাবার কোনো মিল নেই।’ আরজু চমকে ওঠে। সে অবাক হয়ে কপাল কুঁচকে জানতে চায়, ‘এই রাসেল কে?
কার ছেলে? ওদের বাড়ি কোথায়?’ ‘আরে ও তো তোর চাচাতো ভাই। মকবুল চাচার ছেলে।’ আরজু তার কথা শেষ করতেই দেখল মঞ্চ থেকে রাসেল নামছে। তাকে দেখে আরজু কাছে ডাকল। তার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলল, ‘দারুণ হয়েছে। তুই খুব ভালো পারফর্ম করেছিস। দেখে নিস, এবারের পুরস্কার তুইই জিতবি।’ আরজুর সাথে অপুও গলা মিলিয়ে বলল, ‘স্বাধীনতার এই ভাষণটি তুমি ভালোই রপ্ত করেছ।’
অপু জানতে চাইল, ‘তুমি শেখ মুজিবুর রহমানকে চিন?’
‘জি চিনি। মায়ের কাছে ওনার অনেক গল্প শুনেছি! তিনি আমাদের জাতির পিতা।
মা বলেন, এর বাইরেও তাঁর আরেকটা বড় পরিচয় আছে- তিনি একজন বড় মাপের কবি ছিলেন।’
অপু আর আরজু বিস্ময় নিয়ে রাসেলের কথা শোনে।
মায়ের কাছে শুনেছি- তিনি তাঁর জীবনে মাত্র দুই লাইনের একটি কবিতা লিখেছিলেন।
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
রাসেলের কথা শেষে সে অপুকে ঈঙ্গিত করে আরজুর কাছে জানতে চাইল, ‘উনি কে? এর আগে তো কখনো দেখিনি।’ আরজু হেসে জবাব দেয়, ‘ও অপু। ঢাকায় থাকে। আমার ছোটবেলার বন্ধু। এছাড়াও কিন্তু তার আরেকটা পরিচয় আছে।’ কৌতুহলভরা দৃষ্টি নিয়ে রাসেল আরজুর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় পর
জানতে চায়, ‘কী?’
‘ও তোর ভাই।’
‘আমার ভাই?’ অবাক হয়ে জানতে চায় রাসেল।
‘হ্যাঁ। তোর চাচাতো ভাই। শহিদ হাবিব চাচার ছেলে অপু।’
ঠিক সেই সময়ই মাইক্রোফোনের শব্দ কানে ভেসে এলো। শরীফ স্যার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছেন, ১ম হয়েছে-রাসেল রায়হান। ক্লাস সেভেন। রাসেল আরজুর কথা শুনে অপুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ভাইয়া। এতদিন পর আপন মানুষকে কাছে পাওয়ার আনন্দ যেন বিজয়ী হওয়ার আনন্দকেও ছাড়িয়ে গেছে।’
অপুর চোখে মুখে তখন খুশি লুটোপুটি খাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, হয়তো এমন সুন্দর কিছু মুহুর্তের জন্যই এতদিন ধরে সে অপেক্ষা করছিল। আর এ জন্যই হয়তো সে গ্রামে ছুটে এসেছে। ঠিক তখনি অপুকে বুকে জড়িয়ে রেখেই রাসেল বলে, ‘চলো ভাইয়া আমার সাথে বাড়ি চলো। মা তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।’
==================