স্মৃতির ভেতরে জেগে থাকে মতিহার
মেহনাজ মুস্তারিন
অ্যালামনাই মানেই পুরোনো স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলা। কার কাছে কেমন লাগে জানি না, আমার কাছে বরাবর এ এক মহালগ্নের অভিজ্ঞতা― একদিকে পুরোনো স্মৃতি, অপরদিকে নতুন করে পুরোনো সম্পর্কগুলোকে আবিষ্কার করা। গত ১৮-১৯ মার্চ , ২০২২ ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের দশম সন্মেলন। দুটো দিন কীভাবে কেটেছে বলতে পারবো না। সেখানে কাটানো মুহূর্তগুলো এখনও আমাকে এমনভাবে আবেশিত করে রেখেছে যে, এই এতদিন পরেও তার রেশটুকু কাটেনি। পরবর্তীতে নানা ব্যস্ততায় ব্যস্ত হয়ে গেলেও মন বারবার ছুটে যাচ্ছে সেই ফেলে আসা ক্ষণে, মনে হচ্ছে যেন এতগুলো বছরকে আবারও নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে এলাম।
নানা কারণে আমাদের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে। একটু ভালো লাগার জায়গা খুঁজতে, পিছুটান-দায়িত্ব-কর্তব্য সবকিছুকে পাশে রেখে অল্প সময়ের স্বস্তির আশায় সেদিন বেশ সকাল সকাল ছুটে গিয়েছিলাম প্রাণের মতিহার ক্যাম্পাসে। তারপর নয়ন মেলে খুঁজলাম পুরনো সম্পর্ক, হৃদয় খুঁড়ে বের করলাম অসংখ্য স্মৃতি, আবারও নতুন করে ঝালাই করে নিলাম ফেলে আসা অনেক কিছু। আচ্ছা তখন কি স্বাধীন ছিলাম? হবে হয়তো, তা না হলে কেন বারবার মনে হয় যে তখন জীবন অনেক সুন্দর ছিল। এটা তো ঠিক যে, এখনকার মতো এত জটিলতা তখন ছিল না। এখন যেভাবে বুঝতে পারি স্বাধীনতার অর্থ, তখন আসলে সেভাবে বুঝিনি, বুঝতে চেষ্টা করেছি সেটাও হলফ করে বলা যাবে না। মুক্তি কী? অনেকদিন থেকেই প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। এখন যখন এসবের একটা মানে দাঁড় করাতে চেষ্টা করি, তখন বিভ্রম জাগে, মনে হয় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি কোন স্রোতে― কালের যাত্রায় ভেসে যেতে দিয়েছি নিজেকে। এখন কারণে-অকারণে যখন খুঁজতে শুরু করি স্বাধীনতা― কীভাবে একটু মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়, কীভাবে একটু নিজের মত করে নিজের জগতে কাটানো যায়, তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারি না আমি আসলে কী চাই। হয়তো সেই অভিপ্রায় থেকেই নিজের ইচ্ছেকে বড় করে দেখেছিলাম এবার। দ্বিধা ছিল মনে, এতদিনের পুরোনো অভ্যাস, সকলকে মানিয়ে চলা, সকলকে খুশি রাখার অভ্যাস, এসব তো কম যায় না। তা সত্ত্বেও দ্বিধা-দ্বন্দ পাশ কাটিয়ে রেজিস্ট্রিশন করে ফেললাম একদিন। সত্যি বলতে কী, ইউনিভার্সিটির দীর্ঘ সময়জুড়ে যাদের সাথে ছিলাম তাদের মধ্যে বেশিরভাগ আসবে না শুনে প্রথমে মন সেভাবে সায় দিচ্ছিল না, ইচ্ছেগুলোও হয়তো-বা একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তবুও কেন জানি এবার আর পিছু হটিনি।
রেজিস্ট্রেশন করার পরেই আজব সব ঘটনা ঘটতে শুরু করলো মনের মধ্যে। বারবার মনে পড়ছিল পরিচিত সেই গাছগুলোর কথা যেখানে বসে জীবনের সূবর্ণ মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি। ঠিক সেখানে গিয়ে খুব বড় করে শ্বাস নিতে পারবো, তেমনটি মনে হচ্ছিল বারবার। আর একবার যদি পৌঁছাতে পারি সেই অতীতে, যদি ছুঁয়ে দিতে পারি সেই পুরোনো দূর্বাঘাস, তো নিশ্চয়ই চুপিচুপি ওদের বলে দেব সেই লুকানো ব্যথার কথা― তোদের কাছে রেখে এসেছি আমার তারুন্য, আমার উচ্ছ্বাস, আমার সরল মনের ঠিকানা। জানি বড় যত্নে আগলে রেখেছে সেগুলো। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি আমার এবেলার যত ঋণ, যত সচেতনতা-বিবেক-ভালো-মন্দ দেখবার চোখ, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার যত কৌশল। এখন ব্যস্ত জীবনের বাঁকে বাঁকে ছুটে চলছি আর চলছি। কীসের পেছনে ছুটছি, কেনই-বা ছুটছি, আর এর শেষটাই-বা কোথায়? প্রতিনিয়ত কে জানে কানের কাছে বলে, তোকে আরও ছুটতে হবে, সফলতার সিঁড়ির শেষ ধাপ যত উঁচুতেই থাক, প্রতিনিয়ত তাকে আবিষ্কার করে নিতে হবে। জানি না কী দেখব সেখানে। পথের শেষে হয়তো দেখবো শুধুই অন্যের জন্য এই ছুটে চলা। নিজের তৃপ্তির কথা, মনের আর্জির কথা কি কখনো আমলে নিয়েছি? আমাদের কাছে প্রকৃতির বা সমাজের যে চাওয়া, তার কতটুকু পুরণের কথা ভাবি আমরা? ইউনিভার্সিটির এই এতো এতো পুঁথিপাঠ নিরবে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। অবাক চোখে অপেক্ষা করে আছে কোন এক ভবিষ্যতে সুদিন আসবে যেদিন জাগ্রত হবে বিবেক আমরা স্মরণ করবো আমাদের শিক্ষকদের শেখানো আদর্শগুলো। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, যা শেখার ছিল, তার অনেকটাই হয়তো শিখতে পারি নাই। সেদিন ক্যাম্পাসে আসার পর কেন জানি উদাস লাগছিল, খুটিনাটি ভাবনাগুলো সব এক হয়ে ফিরে যাচ্ছিল সেই তারুণ্যে। মনে পড়ে যাচ্ছিল সব সবকিছু।
ভর্তি পরীক্ষার কথাই ধরা যাক। মাত্র ৫ নম্বর কম পেলাম বলে সামাজিক অনুষদে সুযোগ পেলাম না। ভর্তি হলাম কলা অনুষদের ইতিহাস বিভাগে। সে কি মন খারাপ আমার! অনেক দিন সেই খারাপ লাগাটা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমাকে। হয়তো সেই বেদনা থেকে মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিতাম। কিছুদিন পরে জানলাম সাবজেক্ট চেঞ্জের সুযোগ আছে। বড় আশা নিয়ে আবেদন করলাম। প্রথম আর দ্বিতীয় পছন্দ দিলাম সমাজকর্ম আর বাংলা। আমরা চারজন আবেদন জমা দিয়েছিলাম। জানতে পারলাম, দু-জনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। পরে শুনেছিলাম যে ওই দু’জনের ঘনিষ্ট আত্নীয় ছিল ইউনিভারসিটির বিশেষ পদে কর্মরত, তাতেই তাদের বরাতের লিখন বদলে গিয়েছিল। বলে রাখি, ওদের চেয়ে আমার নম্বর বেশি ছিলো। বরাতের লিখন যে এভাবেও পাল্টানো যায়, সেটা তখন বুঝতে পারিনি।
যাহোক, বিভাগ পরিবর্তন করতে না পেরে নতুন করে আবারও মন ভেঙে গেল। মেনে না নিয়ে কোন উপায় ছিল না। মেনে নেওয়ার সেই যে শুরু তা এখনও অব্যাহত আছে। বলি কি আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। তো এখন যা করতে হয়, অর্থাৎ মেনে-টেনে নিয়ে কর্তব্যে নেমে পড়ি, তখনও তাই। যথারীতি মনোযোগ দেবার চেষ্টা করতে লাগলাম। ক্লাসে গেলাম, সেখানে পরিচিত হলাম একঝাঁক নতুন বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে। এখন বলতে দ্বিধা নাই এবং বেশ আনন্দের সাথে বলতে হয় যে, আমার বন্ধু ভাগ্য বরাবরই ভালো। তো ভাগ্যগুণে পেয়ে গেলাম পপি, মায়া, শিরিন, লিচু, আন্নি, এ্যানি, কনক, শিল্পি, সুমি, কলি, লিটু, উদয়, নূরহোসেন, মজিবর, আনোয়ার, তানভীর, নাজমুল, হান্নান সহ অনেককে। এদেরকে পেয়ে নতুন করে আবিষ্কার করলাম জীবনের অর্থ। তারপর থেকে ক্রমশ: এক মায়ার জালে আঁকড়ে নিলো ক্যাম্পাস। আহ!সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও শিরশির করে সমস্ত চেতনা।
মনে পড়ে ক্লাস শেষে চা খেতে চলে যেতাম ক্যাফেটেরিয়ায়। ক্লাসে উপস্থিত না হলে লিটু মাঝে মাঝে প্রেজেন্ট থাকার প্রক্সি দিত। গাছের নিচে নানা খুনসুটির আড্ডার সেই মুহূর্তগুলোতে কোন পিছুটান ছিল না, ছিল না ঘরে ফেরার কোন তাড়া। যেদিন দুই বেলা ক্লাস থাকতো, সেদিন পপির রুমে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিতাম।
১৯৯৭ সালের কথা। অনার্স পরীক্ষা। আমার প্রথম সন্তান মর্ম জগতের মুখ দেখবে বলে গর্ভ থেকে বাইরে চলে এসেছে। একদিকে আনন্দ, অপরদিকে? উহ! কী যে কষ্ট! পরীক্ষা দিতে পারবো কিনা সেই সংশয় মনজুড়ে। বন্ধুরা ছিল আর তাদের দিক থেকে সব রকম সহায়তা ছিল বলেই পাশ করে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম। এখনো সেই ভয়ংকর পরীক্ষার স্বপ্ন দেখি আমি। কেনই-বা দেখব না? সেবার ভয়ানক শীত পড়েছিল দেশজুড়ে। ছোট্ট মর্মকে নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া তো সহজ না। ওকে সারাদিনধরে দেখভালের পরে যেটুকু সময় পেতাম চেষ্টা করতাম পড়তে। মর্মর বাবা তখন টাঙ্গাইলে। এমন দিন গেছে সারাদিন বই ধরতে পারিনি। আমি যে নির্ঘাত ফেল করবো তা নিয়ে কোন সন্দেহ ছিল না মনে। একদিন ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে রাগ করে অনেকগুলো নোট, বই ছিড়ে ফেললাম, ঠিক করলাম পরীক্ষাই দেব না, যা হয় হবে। তারপর মন শান্ত হলে ছুটে গেলাম বন্ধুদের কাছে। আবারও সব সংগ্রহ করে সংগ্রামে নামলান। পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে দেরি হবে বলে একটা পাত্রে মর্মর জন্য বুকের দুধ গলিয়ে রেখে যেতাম। সে এক মহাযজ্ঞ। এভাবেই অনার্স পর্ব শেষ করলাম।
মাস্টার্স-এর সময় বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম অনেকটা। সংসার, বাচ্চা, বিবাহিত জীবনের নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তবেই ক্লাস আর পড়াশোনা। সবমিলিয়ে বেশ কঠিন সময় পার করছিলাম। ছাত্রজীবনের মজাগুলো হঠাৎ করেই থমকে গেল যেন-বা। তবে, তখন সেটা সেভাবে বুঝতে পারিনি। এখন যখন পিছন ফিরে তাকাই দেখি বন্ধুরা কত ধরনের মজা করেছিল― পিকনিক, এটাসেটা, শিক্ষকদের সাথে সময় কাটানো, নানা মজা । অনেক কিছু শিখছিল, জানছিল, এখন বুঝতে পারি নিজেকে কতভাবেই না বঞ্চিত করেছি। সেই অতৃপ্তি এখনও বয়ে বেড়াই। বাকি জীবনে এটা যে পুরণ হবে না, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারি। এই দুইদিন ক্যাম্পাসে এগুলোই বারবার মনকে দগ্ধ করে গেছে। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি: আমার কেন এত বেশি করে পেছনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? কেন মনে হয় যে, সবকিছু আবারও নতুন করে শুরু করা দরকার।
জীবনের অনেকটা সময় হেঁটে এসে মধ্যাহ্ন অতিক্রম করে আমরা সকলেই এখন দিগন্তে পরন্তবেলা দেখতে পাচ্ছি। মানি কি না মানি, যতটা পথ হেঁটেছি আগামীতে আর ততটা পথ হাঁটা হবে না। এখন থেকে নিয়মিত বিরতিতে আমরা আমাদের বন্ধুদের চলে যাওয়ার কথা শুনতে পাবো। কে কীভাবে যাবে জানি না, কিন্তু যাবে যে সেই সত্য দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। যতদিন যাবে তত বেশি করে এই সত্য আমরা উপলব্ধি করব― মৃত্যুকে আমরা কেউ-ই ফাঁকি দিতে পারবো না। তবে কেন ঠিক এই সময় আবারও নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে? কেন আবারও বন্ধুদের সাথে সময়গুলো কাটাতে চাই? কেন ইচ্ছে করে তারুণ্যতা আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরি? কত কিছুই তো অজানা! কেন জানি মনে হয় এখন দু-হাত পেতে ফাঁকগুলো, ফাঁকিগুলো পূরণ করি। সেই ইচ্ছের খানিকটা পুরণ হলো সেদিন। বারবার মনে হচ্ছিল হঠাৎ করেই যেন সেই পুরোনো সময়ে হাজির হয়েছি। অন্যদের কথা বলতে পারবো না, আমার কিন্তু সবচেয়ে ভালো লেগেছে শিক্ষকদের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। এক সময় যাঁদের দেখলে যতটা পারতাম দূরে দূরে থাকতাম সেই শিক্ষকদের এত নিকটে আসতে পেরে মনে হলো পূরনো দিনের কোন কাছের জনকে খুঁজে পেয়েছি। এই দুইদিন কী অবলিলায় কত সহজে সব জড়তা কাটিয়ে স্যারদের সাথে একান্ত হতে পারাটা ছিল সত্যি অসাধারণ। পাশাপাশি মন খারাপ করার মতো বিষয়ও যুক্ত ছিল। কিছুদিন আগে আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ড. আতাফুল হাই শিবলী স্যারকে হারিয়েছি। এবারের অনুষ্ঠানের সবটুকু জুড়েই ছিলেন তিনি। ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ঢাকায় গ্রীনলাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে যাওয়া অনন্তলোকের এই যাত্রীটি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস এ্যালামনাই এসোসিয়েশনের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা।
বাংলাদেশে ইতিহাস বিষয়ে উচ্চশিক্ষা এবং এর প্রসার ও গবেষণায় ড. শিবলীর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে একথা বলতেই হয় যে, তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন মেধাবী ইতিহাসবিদ ও প্রথিতযশা শিক্ষাবিদকে হারিয়েছে। ১৯৭২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ইতিহাস বিভাগের অভিভাবক। তাঁর নেতৃত্ব ছিল অতুলনীয়। কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই না, বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। আমাদের ইতিহাস বিভাগকে তিনি স্থাপন করে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়, সেজন্য আমরা গর্বিত। তাঁর স্মৃতি চির অমলিন থাকবে আমাদের মনের মনিকোঠায়।
যে কয়েকটি বিভাগকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছিল সেই ১৯৫৪ সালে, তার মধ্যে ইতিহাস অন্যতম। ভাবতে বেশ লাগে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই বিভাগ থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এবার এই সম্মেলনে ১৯৬১ ব্যাচ থেকে ২০১৯ ব্যাচের অনেকে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের পদচারনায় সবুজ মতিহার চত্বর যেন আনন্দ-বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। নানা আনুষ্ঠানিকতায় দুইদিন যে কীভাবে কেটে গেল, পুরো সময়জুড়ে কারো চোখে মুখে কোনধরণের ক্লান্তি ভর করলো না, এখন ভাবতে অবাক লাগছে! এখন মনে হচ্ছে সময়টা বড্ড অল্পই ছিল। এ এক অদ্ভুত অপূর্ব অনুভূতি! সেই অনুভূতিকে ধারণ করে আবারও সকলে ফিরে এলাম নিজ নিজ বাস্তবতায়। রেখে এলাম সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের এক অটুট বন্ধন। সেই সাথে দৃঢ় বিশ্বাস। আগামীতে এসোসিয়েশনের সমস্ত পদক্ষেপ আরও সুচারু হবে এবং নিয়মিত দ্বি-বার্ষিক সম্নেলনসহ অন্যান্য কার্যক্রমে আমাদের সংযুক্ত থাকাটা আরও দৃঢ় হবে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন সুস্থতার সাথে যেন বেঁচে থাকি আর ফিরে আসি আবারও আমাদের ফেলে যাওয়া সময়ের কাছে, যেখানে আমরা খুঁজে পাবো পুরোনো স্মৃতি, নেব বুক ভরে বাতাস, আমাদের নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে নামবে সবুজ ঘাসের বুকে খুঁজে নেবে আমাদের অস্তিত্বের ঠিকানা, আমরা নতুন করে খুঁজে পাবো বেঁচে থাকার রসদ। তখন পুনরায় হারিয়ে যাবো ফেলে আসা মুহূর্তের মতো সেই পুরোনো ভালোলাগায়। শেষ করছি একটা কবিতা দিয়ে:
শেষ বিকেল, মতিহারের সবুজ গাছ, নিরব নিথর, পাখিগুলো এ-ডালে ও-ডালে,
বিষাদের ছায়া তাদের চোখে, আমাদেরও―
তারা খুঁজে চলেছে আমাদের রেখে যাওয়া পায়ের চিহ্ন,
করিডোরে কোলাহল, ক্লাসের পেছনে চোখে চোখ, না বলা কথা, স্মৃতি ফেলে রেখে আসা,
সবুজ ঘাসে আলতো করে বুলিয়ে দেয়া আদর; এসব নিয়ে উড়ে যায় তারা।
― আচ্ছা, তুই এত আদুরে কেন রে!
অকপটে বলে ফেলতো পপি কি মায়া কি শিরিন কি লিচু;
হেঁটে যেতে যেতে কনক কি শিল্পি কি সুমি কি কলি থমকে যেতো। পিছু
নিতো যে ছেলেগুলো, তারা আড় চোখে তাকাতো, ভাবতো― পাগলের দল!
অথবা, সুন্দরীদের মেলা দেখে তারা তাকিয়ে থাকতো,
যেভাবে পাখিদের নজর টকটকে লাল গোলাপের দিকে,
তেমন মায়াভরা চোখে তারা খুঁজতো তারুন্য, দেহ পল্লবের ছন্দ,
টুকিটাকি এটাসেটা,লাইব্রেরীর চওড়া সিঁড়ি, ক্যাফিটেরিয়ার ভাঙাচোরা চেয়ার,
কোনাভাঙা কাপপিরিচ, সর্বত্র পাখি ও পুরুষ খুঁজতো আমাদের।
সোনালী ভোর, দুপুরের রূপালী খরোতাপ, আর বিকেলের
গলে পড়া স্নিগ্ধ আলো প্রেমিকের মতো হাত বাড়িয়ে ডাকতো আমাদের।
এসব দেখার মতো সময় ছিল না তখন―
পড়ন্ত বিকেলে পাখিদের নীড়ে ফেরার মতো
আমাদের তারুণ্যকে হারিয়ে যেতে দিতাম কালের যাত্রায়।
সেই কালের স্রোতে ভেসে গেছে যৌবন, থেমে গেছে উচ্ছ্বাস,
হারিয়ে গেছে অকারণ ব্যস্ততা; এখন কোলাহল সারাক্ষণ,
বেড়েছে দূরত্ব―
ভালো মন্দের মিশ্রনে বেঁচে থাকা আর কাটিয়ে দেয়া দিনক্ষণ।
তবু কোথাও জানি লুকিয়ে থাকে পুরোনো খুনসুটি,অলস দুপুর, এলোমেলো কথা,
দুষ্টামি, বাদামের খোসার মুডমুড শব্দ,চায়ের কাপে তোলা ঝড়, আর না বলা সেই কথা―
ভালোবাসি তোদের।
লুকিয়ে রাখা স্মৃতির পাতা থেকে পাখির পালকে চেপে তারা বারবার ফিরে আসে,
শুভ্র শিশির বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ে চোখের কোণে।
রাজশাহী। মার্চ ৩১,২০২২।
লেখক পরিচিতি:
মেহনাজ মুস্তারিনের জন্ম রাজশাহী শহরের মহিষবাতানে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ইশকুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়, সবই রাজশাহীতে। দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীর একটি বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক পদে কাজ করছেন। লেখালেখি স্বভাবজাত। পারিবারিকভাবে নানা ও মায়ের প্রভাবে শৈশবেই লেখালেখিতে হতেখড়ি। কবিতা, ছোটগল্প তাঁর প্রিয় বিষয়।