You are currently viewing সোনার তরী’র মাঝি/ শোয়েব নায়ীম–

সোনার তরী’র মাঝি/ শোয়েব নায়ীম–

বহুমুখী এবং বহুবাদী বিবিধ অর্থকে ধারণ করে উপলব্ধি-প্রধান কবিতাকে প্রতীকী-নির্ভর কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে প্রথম সূত্রপাত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৯২ সালে যখন তাঁর বয়স প্রায় একত্রিশ বছর, তখন লিখেছিলেন বহু-পরিচিত আর বহু-পঠিত ‘সোনার তরী’ নামক প্রতীকী-নির্ভর কবিতাটি। প্রতীকী কবিতায় সবসময় যথার্থ অর্থ অনাবিস্কৃত থাকে, বিশ্লেষণে অস্পষ্টতা থাকে আর ভাবনায় কেবলি বিস্তৃত হতে থাকে। বিরাট লৌকিকতা কল্পনার সহায়ক রূপ বা ভাবপ্রকাশের পদ্ধতিতে কাব্য সাহিত্যে প্রতীকীবাদ বা symbolism এর যৌক্তিক ব্যবহার রবীন্দ্রনাথ’ই প্রচলন করেছিলেন।

‘সোনার তরী’ কবিতাটি পাঠ করিলে কখনো মনে হয় প্রবাহমান মহাকালের এক দার্শনিক তত্ত্বনির্ভর যাপিত জীবনের কাল আর মহাকালের ইঙ্গিত, কখনো মনে হয় স্রষ্টার প্রতি এক সৃষ্টিজীবের প্রার্থনার বয়ান, কখনো মনে হয় সাম্যবাদের নিরিখে সামন্তবাদী সমাজের শোষক-শোষিত দ্বন্দ্বের সম্প্রসারিত চিন্তার এক কাব্যিক রুপায়ণ, আবার কখনো মনে হয় নর-নারী সম্পর্কের জটিল প্রতীকী আখ্যান এই ‘সোনার তরী’ ।

একটি নির্দিষ্ট উপলদ্ধিকে প্রতিষ্ঠিত করতেই উপমা আর চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রতীকীতে বৈশিষ্ট্যময় করেই রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু পাঠাকের কাছে এর অর্থ যদি অন্যভাবে অধগত হয়, তাহলে এই লেখাটি পাঠকের বিবেচনায় সেটি যথাযথভাবেই সমাদৃত হবে। আবার এই কবিতায় যেমন আছে অস্পষ্টতা তেমনি আছে অবাস্তবতাও (‘শ্রাবণগগন ঘিরে/ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে’), শ্রাবণমাসে কখনো ধান পাকেনা, আর কৃষক কখনো এই বর্ষাকালে ফসলমাঠে ধান কাটেনা, যাপিত জীবনের প্রতিফলন খুঁজলে এই কবিতায় এমন অসঙ্গতিও পাঠকের চোখে উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু প্রতীকী অর্থে দেখলে এই ‘শ্রাবণ’ মাসকে কান্না-ভেজা হৃদয় সংকেতের পঙতি মনে হয় উপরোক্ত এই দুই স্তবককে।

এই কবিতাটি নিবিড়ভাবে অনেকবার পাঠ করলে একটি সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়, তা’ হচ্ছে পরিচয় উদ্ধারের সমস্যা। নদীকূলে অপেক্ষমান ছিলেন যে একজন ব্যক্তি আর ঘন বরষায় নদীতে নৌকা চালিয়ে আসছিলেন আরেকজন যে ব্যক্তি- এই দুইয়ের মধ্যেকার জেন্ডার পরিচয় ভূমিকা কবি রবীন্দ্রনাথ সমগ্র কবিতায় অনিচ্ছুক অস্পষ্টতায় এবং নির্লিপ্ততার গুণ্ঠনে  ঢেকে রেখেছিলেন। হয়তো-বা এখানে দু’জনেই ছিলেন পুরুষ বা দু’জনেই নারী, অথবা একজন পুরুষ-অপরজন নারী…. এমন রহস্যময় ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রেখেছিলেন সমগ্র-কবিতায়।

এই কবিতার একাধিক অর্থ বা যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ থেকে এটিই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কোনোটিই অপরটির থেকে ‘অধিকতর’ সত্য নয়। ভিলফ্রেদো প্যারিটো (১৮৪৮-১৯২৩) নামক একজন প্রাজ্ঞ, প্রাচীন এবং ইটালীয় গণিতজ্ঞের তত্ত্ব থেকে প্রমেয় যে, একাধিক বিশ্লেষণ এবং পরস্পরবিরোধী প্রয়োজনীয়তার নিরিখে যদি শ্রেষ্ঠতম সিদ্ধান্তটির অনুসন্ধান করা হয়, সেক্ষেত্রে ‘শ্রেষ্ঠতম’ আখ্যায় একাধিক সিদ্ধান্তকেই ভূষিত করতে হবে, আর একাধিক বিশ্লেষণ থেকে যেকোনো একটিকে নিজ নিজ বিবেচনাক্রমে বেছে নেওয়া যেতে পারে। এই প্রমাণিত গাণিতিক প্রতিপাদ্য এই ‘সোনার তরী’ কবিতার ক্ষেত্রেও যদি অনায়াসে প্রয়োগ করা হয়, সেক্ষেত্রে এই কবিতার একাধিক যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ গ্রহণ করতে পাঠকের চিন্তায় কোনো অনীহা তৈরি হয় না। এমন নির্ধারণীয়কে মেনে নিয়েও প্রতীকধর্মী কবিতায় অন্য দ্বিতীয় তথা বিকল্প অন্য পাঠের সন্ধান করতে পাঠক প্রবৃত্ত হবেই।

‘গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে’- দূরন্ত নদী বেয়ে গান গেয়ে গেয়ে সবল শরীর আর কঠিন হৃদয়ের এই তরী-মাঝী চরিত্রে আকার নেওয়া এই মানুষটি আসলে কে? কোনো ধরণের প্রতীকী-এর আড়াল থেকে কখনো এই নৌকার মাঝির পরিচয় পাঠকমহল থেকে কখনো অনাবৃত করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা এই কবিতাকে ইংরেজীতে অনুবাদ করে এই কাব্যের সেই রহস্য উম্মোচন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন এই ‘সোনার তরী’ রচনার সেই তরণীর পোতাধ্যক্ষ হচ্ছেন একজন নারী !

The rain fell fast.

The river rushed and hissed.

It licked up and swallowed the island,

while I waited alone on the lessening bank with my sheaves of corn in a heap.

From the shadows of the opposite shore

the boat crosses with a woman at the helm.

I cry to her, ‘Come to my island coiled round with hungry water,

and take away my year’s harvest’.

She comes,

and takes all that I have to the last grain;

I ask her to take me.

But she says, ‘No’—

the boat is laden with my gift

and no room is left for me.

 

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা

ধান কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা

খরপরশা।

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।

একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,

চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।

পরপারে দেখি আঁকা

তরুছায়ামসীমাখা

গ্রামখানি মেঘে ঢাকা

প্রভাতবেলা—

এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ভরা-পালে চলে যায়,

কোনো দিকে নাহি চায়,

ঢেউগুলি নিরুপায়

ভাঙে দু-ধারে—

দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,

বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।

যেয়ো যেথা যেতে চাও,

যারে খুশি তারে দাও,

শুধু তুমি নিয়ে যাও

ক্ষণিক হেসে

আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।

যত চাও তত লও তরণী-’পরে।

আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।

এতকাল নদীকূলে

যাহা লয়ে ছিনু ভুলে

সকলি দিলাম তুলে

থরে বিথরে—

এখন আমারে লহ করুণা করে।

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী

আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

শ্রাবণগগন ঘিরে

ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,

শূন্য নদীর তীরে

রহিনু পড়ি—

যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।