সৈয়দ শামসুল হকের বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্মের একটি বিশ্লেষণ
আলী সিদ্দিকী
বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক এক অনন্য প্রতিভা। তার সাহিত্যকর্ম বাংলার ঐতিহ্য, ভাষা, সমাজ এবং মানুষের মনোজগতের গভীর অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে নির্মিত। বাংলা সাহিত্যজগতে এককথায় সৈয়দ শামসুল হকের পরিচয় ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসেবে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ—সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার অবাধ বিচরণ এবং নবীন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ও প্রভাবশালী লেখক করে তুলেছে। তিনি ১৯৩৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহন করেন।
১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ প্ত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘উদয়াস্ত’ দিয়ে তার সাহিত্যজগতে যাত্রা শুরু হয়েছিলো । সাহিত্য ভুবনের তার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ছিলো বহু বর্ণিল। তিনি বাংলা সাহিত্যের জন্য মূল্য এক বিশাল সম্ভার রেখে গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে সৈয়দ হকের মতো এতো বিপুল সৃষ্টিকর্ম কেউ রেখে যান নি। সাহিত্যের বহুবিধ শাখায় তার অবাধ বিচরণ ছিলো ঈর্ষনীয়।
তার সৃষ্টিসম্ভার হলো:
ছোট গল্প: তাস (১৯৫৪), শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭), প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮২), সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প (১৯৯০), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক), শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৯০)
কবিতা: একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), অপর পুরুষ (১৯৭৮), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), রজ্জুপথে চলেছি (১৯৮৮), বেজান শহরের জন্য কোরাস (১৯৮৯), এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি (১৯৮৯), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯), কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০), আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০), তোরাপের ভাই (১৯৯০), শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯০), রাজনৈতিক কবিতা (১৯৯১), নাভিমূলে ভস্মাধার, কবিতা সংগ্রহ, প্রেমের কবিতা, ধ্বংস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯), সভ্যতার মনিবন্ধে (ভাষা আন্দোলনভিত্তিকঅন্তর্গত (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক)।
উপন্যাস: দেয়ালের দেশ, এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), নীল দংশন (১৯৮১), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), মৃগয়ায় কালক্ষেপ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭), এক যুবকের ছায়াপথ (১৯৮৭), স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১ম খণ্ড১৯৮৯, ২য় খণ্ড ১৯৯০), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯)বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯), কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন (১৯৮৯), শ্রেষ্ঠ উপন্যাস (১৯৯০), নির্বাসিতা (১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), খেলারাম খেলে যা (১৯৯১), মেঘ ও মেশিন (১৯৯ইহা মানুষ (১৯৯১), মহাশূন্যে পরাণ মাষ্টার, দ্বিতীয় দিনের কাহিনী, বালিকার চন্দ্রযান, আয়না বিবির পালকালঘর্ম, দূরত্ব না যেয়ো না, অন্য এক আলিঙ্গন, এক মুঠো জন্মভূমি, বুকঝিম ভালোবাসা, অচেনা, আলোর জন্য, রাজার সুন্দরী ইত্যাদি।
কাব্যনাট্য: পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক), গণনায়ক (১৯৭৬), নুরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২), এখানে এখন (১৯৮৮), কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১),ঈর্ষা, বাংলার মাটি বাংলার জল, নারীগণ।
প্রবন্ধ: হৃৎ কলমের টানে (১ম খণ্ড ১৯৯১, ২য় খণ্ড ১৯৯৫), মার্জিনে মন্তব্য।
কথা কাব্য: অন্তর্…
আত্মজীবনী: প্রণীত জীবন।
অনুবাদ: ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, এক নারীর জীবন, এবং শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯)
শিশুসাহিত্য: সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮), আনু বড় হয়, হডসনের বন্দুক।
অন্যান্য: শ্রেষ্ঠ গল্প, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, শ্রেষ্ঠ কবিতা, এবং মুখ (১৯৯১)।
কবিতা: জীবনের গভীর অনুসন্ধান
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় জীবনের গভীরতা, প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন এবং ঐতিহাসিক চেতনার প্রকাশ স্পষ্ট। তার কবিতায় ভাষার গীতিময়তা ও অর্থবহ অভিব্যক্তি তাকে বাংলা কবিতার ধারায় নতুন মাত্রা দিয়েছে।
“আমি প্রেমের কথা বলি, আমি দুঃখের কথা বলি” —এই ধরনের পংক্তিতে প্রেম, বেদনা ও সামাজিক চেতনার মিল দেখা যায়। তার কবিতায় অস্তিত্ববাদ, রোমান্টিকতা এবং ঐতিহ্যের সার্থক মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত তার কবিতাগুলোতে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের প্রভাব সত্ত্বেও নিজস্ব একটি কণ্ঠস্বর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
“পরানের গহীন ভিতর” কাব্যের একটি জনপ্রিয় অংশঃ
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কীভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।
নাটক: ইতিহাস ও রাজনীতির মঞ্চায়ন
নাটক রচনায় সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। তার নাটকসমূহে তিনি জাতীয় ইতিহাস, রাজনীতি এবং মানুষের সামাজিক সংকটের এক জোরালো চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি আদি ও অকৃত্রিম কাব্যভাষাকেই তার নাট্যভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস ও এস্কিলাস, সংস্কৃত ভাষার মহাকবি ও নাট্যকার কালিদাস এবং বিশ্বসেরা নাট্যকার উইলিয়াম সেক্সপিয়রের সজ্ঞানে অনুগামী হয়েছেন সৈয়দ হক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকগুলোর মূল সুর যেমন কাব্যিক তেমনি সৈয়দ হক তার স্বভাবজাত কাব্যভাষাকে নাট্যভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছেন যেমন নিয়েছেন টিএস ইলিয়ট। ইলিয়ট কাব্যভাষাতেই তার বিখ্যাত নাটক মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রল রচনা করেছিলেন। উত্তরাধুনিক নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেটের বিশ্বখ্যাত নাটক ওয়েটিং ফর গডো গদ্য সংলাপে রচিত হলেও কাব্যিকতায় ছিলো ভরপুর।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সৈয়দ হক প্রথম নাটক “পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়” লেখেন যেখানে যুদ্ধ এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের কাহিনী উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখিত নাটকটিতে জনাব হক রূপালঙ্কার ও উপমার ব্যবহারে নিজের পারঙ্গমতা প্রমাণ করেন। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে সৈয়দ হক নতুন মাত্রা যুক্ত করেন যা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকের পুরো শরীর জুড়ে বিস্তৃত। নাটকের সংলাপ এবং কাঠামোয় ইউরোপীয় এপিক থিয়েটারের কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে।
জনসমাজ মাতবর সাহেবের উপস্থিতি চায়, সেটাই তারা নাটকের অন্যতম চরিত্র পীর সাহেবকে জানাতে চায়।
উত্তরে পীর সাহেব বলেন–
পীর: আসবে আসবে সে, না আইসা কি পারে? ঝড়ের খবর আগে পায় বড়গাছের ডাল, বানের খবর আগে পায় যমুনার বোয়াল, খরার খবর পয়লা জানে ছিলা-শকুনের বাপ, আর জারের খবর পয়লা জানে আজদাহা সাপ, সে না আইসা কি পারে?
এমন চমৎকার গভীর তাৎপর্যময় উপমার ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে বিরল। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া অপরাধের গ্রহনযোগ্য চিত্র তিনি অবলীলায় ফুটিয়ে তোলেন।
পীর : হাবিল ও কাবিল ছিল দুই ভাই, তথাপি হাবিল নিজের আপন ভাই সেই যে কাবিল তার জান নিয়াছিল, দুনিয়ার পরথম খুন। তারপর সেই পাপ কী ভাবে সে করে গুম এই ডরে লাশ কান্ধে নিয়া সমস্ত দুনিয়া হাবিল দৌড়ায়। এমন জায়গা নাই সারা দুনিয়ায় যে পলায় – কোথাও পলায়।
আমাদের চিরকালীন সংশয়াচ্ছন্ন উপলব্ধির নাড়ি ধরে টান দিয়ে সৈয়দ হক বিশ্বপ্রভুর সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নের মীমাংসা দাঁড় করান সুকৌশলে। এক নিমিষে পাঠক ও দর্শককে নিয়ে যান জীবনদর্শনের মর্মমূলে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকে ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারকে তুলে ধরেছেন।
পীর: খবরদার, বেটি খবরদার,
তাঁর ভাষা অর্থে নয় ঈমানেই হয় পরিষ্কার।
মেয়ে: বাবা, তাই যদি হয়, তবে অন্তরে আমার
কারো চেয়ে কিছু কম ঈমান ছিল না পরিষ্কার
তবু ক্যান কিছুই বুঝি না? আল্লাতালার
নাম যদি দয়াময়
যদি তিনি সত্যই পারেন দিতে বান্দারে নির্ভয়
যদি সত্যই সকল শক্তি তাঁরই হাতে হয়
যদি সত্যই সকল বিষ তাঁরই নাম ক্ষয়
তবে, কোথায় সে দয়াময় আছিলেন, কোথায়, কোথায়?
কোথায় নির্ভয়দাতা আছিলেন, কোথায়, কোথায়?
যখন আমার ঘরে কালসাপ উইঠা আসছিল
যখন আমার দেহে কালসাপ জড়ায়া ধরছিল
যখন আমার বুকে কালসাপ দংশাইয়াছিল
বলেন, জবাব দেন, কোথায়, কোথায়?
বেহেস্তের কোন বাগিচায়
বলেন থাকলে পর বান্দার কান্দন তার কানে না পশায়?
রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত”নুরলদীনের সারাজীবন” নাটকটি বাঙালির সংগ্রামী চেতনাকে মঞ্চে উপস্থাপন করে। নুরলদীন নামক ঐতিহাসিক চরিত্রের মধ্য দিয়ে জাতির শোষিত মানুষের আহ্বান ফুটে ওঠে: “জাগো, অনাগত বিপ্লবের দূতেরা”, “জাগো ভাই কোনঠে সবায়” তার নাট্যসাহিত্যের অনবদ্য অভিঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলার মুক্তিকামী মানুষের চেতনাকে নাড়া দিয়ে যাওয়া এই নাটকটি সংগ্রামী মানুষের আজীবন অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাবে। সূত্রাধরের মুখে নাটকের প্রস্তাবনার অংশটুকু-যা আসাদুজ্জামান নূরের কন্ঠে উচ্চারিত হয়ে বাঙালীর প্রাণে উদ্বেলতা ছড়িয়েছিলো তা অনবদ্য।
নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।
আসুন, আসুন তবে, আজ এই প্রশস্ত প্রান্তরে;
যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?
সমস্ত নদীর অশ্রু অবশেষে ব্রহ্মপুত্রে মেশে।
নূরলদীনেরও কথা যেন সারা দেশে
পাহাড়ী ঢলের মতো নেমে এসে সমস্ত ভাসায়,
অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়
যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,
আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়
দিবে ডাক, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?’
উপন্যাস: মানসিক ও সামাজিক সংকট
তার উপন্যাসে ব্যক্তি, সমাজ এবং মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের গভীর বিশ্লেষণ দেখা যায়। “খেলারাম খেলে যা” তার অন্যতম উপন্যাস। এই উপন্যাসে জীবন ও নৈতিকতার অসারতা ফুটে ওঠে। খেলারাম চরিত্রের মাধ্যমে সৈয়দ হক জীবনের প্রতি এক ধরনের রসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। অনেকে এই উপন্যাসকে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেছেন। তিনি উপন্যাসের ভূমিকায় এই উপন্যাসকে ‘এদেশের সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বইটির সম্পর্কে অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল, এ সম্পর্কে পরবর্তীতে সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন,‘খেলারাম খেলে যা’ রচনার প্রায় কুড়ি বছর পরও এর জন্য আমাকে অন্যান্য রচনার চেয়ে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হয়। খেলারাম খেলে যা এদেশে সবচেয়ে ভুল বোঝা উপন্যাস। না, এ-উপন্যাসের জন্য আমি লজ্জিত নই, বরং আমি লজ্জিত তাদের জন্য, যারা উপন্যাসের নেপথ্য একটি চরিত্র– বাবর আলীর বোনকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে কেবল বাবলী বা জাহেদার কথা মনে রাখে।
“নীল দংশন” উপন্যাসের মূল উপজীব্য প্রেম, মৃত্যু এবং আত্মপরিচয়ের সংকট। এই এটি বাংলা সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের একটি উদাহরণ। “নীল দংশন” ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস। উপন্যাসে দেখা যায় যে, কাজী নজরুল ইসলাম নামে একজন বাঙালিকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা। তারা ভাবে তিনিই কবি নজরুল। লোকটি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে সে কবি নজরুল না, তাদের ভুল হচ্ছে। কিন্তু তারা সেটা বিশ্বাস করে না। টর্চার সেলে নিয়ে উল্টো নজরুলের মতো কবিতা লেখার জন্য চাপ দিতে থাকে। শুরু করে নানা ধরনের অত্যাচার।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি সমাজের বিপ্লবাত্মক রূপান্তর সৈয়দ শামসুল হককেও উদ্বেলিত করে। বাঙালির রাষ্ট্রসত্তা অর্জন সামগ্রিকভাবে কতটা ইতিবাচক ছিল, সেই প্রশ্ন অনেকের মতো তাকেও আলোড়িত করেছে প্রবলভাবে। স্বাধীন ভূখণ্ড, মানচিত্র, স্বতন্ত্র পতাকা আর বহিঃশত্রু বিতাড়নই যে যথেষ্ট ছিল না, তা সৈয়দ হক অনুভব করেছেন গভীরভাবে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অনেক লেখায় জাতীয় জীবনের এই গভীরতর সংকটের প্রতিফলন ঘটেছে।
সৈয়দ হক তার দ্বিতীয় দিনের কাহিনী উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেছেন । বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা পরম মমতায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটির পটভূমি সৈয়দ হকের সেই জলেশ্বরী। মানে কুড়িগ্রাম। সৈয়দ হকের জন্মভূমি কুড়িগ্রাম জলেশ্বরীতে। উপন্যাসটির মূল চরিত্র একজন প্রধান শিক্ষক, তাহের উদ্দীন খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধে জলেশ্বরীর ভূমিকার কথা তিনি তুলে ধরেছেন তাহেরের আত্মোপলব্ধি, অন্বেষণ ও স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা জলেশ্বরীর সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে তাহের মাস্টারের স্মৃতিচারণায়। ঔপন্যাসিকের স্মৃতিদংশন, নব-অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধি এক অনিঃশেষ ও গূঢ়সঞ্চারী তাৎপর্যে শিল্পরূপ লাভ করেছে উপন্যাসটিতে তাহেরের অভিজ্ঞতাসূত্রে। দ্বিতীয় দিনের কাহিনী উপন্যাসে জলেশ্বরীকে তিনি বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন।
নিজস্বতা বজায় রেখে সৈয়দ হক তাঁর উপন্যাসগুলো রচনা করেছেন। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে সৈয়দ হকের নাম সহজে মুছে যাবার নয়। অনাগত দিনেও যে তাঁর উপন্যাস বিপুলভাবে পঠিত হবে। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের তাঁর কাছে যেতেই হবে।
দার্শনিক প্রতিফলন
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে জীবন, মৃত্যু, সমাজ, রাষ্ট্র এবং মানবতার নানা দিক গভীরভাবে প্রতিফলিত। অস্তিত্ববাদ, জাতীয়তাবাদ এবং মানবতাবাদের মতো দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রতিটি শাখায় প্রকাশিত হয়েছে।
অস্তিত্ববাদ: মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংকট
সৈয়দ শামসুল হকের লেখায় মানুষের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং অস্তিত্বের গভীর অনুসন্ধান স্পষ্ট। তার কবিতায় অস্তিত্ববাদ স্পষ্ট, বিশেষত “পরানের গহীন ভিতর” কাব্যগ্রন্থে। এই গ্রন্থে জীবনের অর্থহীনতা এবং মৃত্যুর চূড়ান্ত বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
“আমি কিছু চাইনি, শুধু বাঁচতে চেয়েছি,
তবুও মৃত্যুর ছায়া সবখানে।”
এই পংক্তিগুলো জীবনকে বাঁচার অর্থ এবং মৃত্যুর উপস্থিতি নিয়ে মানুষের চিরন্তন দ্বন্দ্বকে প্রতিফলিত করে।
জাতীয়তাবাদ: ঐতিহাসিক চেতনা ও সংগ্রামী চিত্র
তার সাহিত্য জাতীয়তাবাদের চেতনায় সমৃদ্ধ। তিনি বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহাসিক সংগ্রাম এবং সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনের গল্পকে তুলে ধরেছেন। তার নাটক “নুরলদীনের সারাজীবন” এ বাংলার কৃষক নেতা নুরলদীনের সংগ্রাম ইতিহাসকে এক জীবন্ত চিত্রে রূপ দিয়েছে। “জাগো, অনাগত বিপ্লবের দূতেরা।” এই নাটকে তিনি শুধু ঐতিহাসিক চেতনা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন। এটি বাংলার মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং পরে জনগণের সংগ্রামী অবস্থানকে তুলে ধরে।
মানবতাবাদ: প্রেম, মৃত্যু ও মানবিক সংকট
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যে মানবিক সংকট ও প্রেমের গভীর অনুসন্ধান লক্ষ্য করা যায়। তার উপন্যাস “নীল দংশন” এ মানবিক সম্পর্কের সংকট ও জীবন-মৃত্যুর সংঘাত তুলে ধরা হয়েছে। “প্রেমে ব্যর্থ হলে মানুষ নিজেকে নতুন করে খুঁজে নেয়, কিন্তু সেই খোঁজে কখনো হয় পরিত্রাণ, কখনো হয় পলায়ন।” এই উপন্যাসে মানব মনের জটিলতা এবং প্রেমের অন্তর্দ্বন্দ্ব গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।
সমালোচনা ও পর্যালোচনা
তার রচনায় সাহিত্যের গভীরতা এবং দার্শনিক প্রতিফলন বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করেছে। তার ভাষার সৃজনশীলতা ও বিষয়বস্তুর গভীরতা তাকে অনন্য করেছে। বিশেষত তার নাটক বাংলার মঞ্চনাটকে এক নতুন ধারা নিয়ে এসেছে।
কিছু সমালোচক তার রচনাকে অতিমাত্রায় বিমূর্ত এবং জটিল বলে মনে করেন। কিছু সমালোচক তার রচনায় বিমূর্ততার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং জটিলতাকে উল্লেখ করেছেন। “খেলারাম খেলে যা” নিয়ে নৈতিক বিতর্ক রয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার কবিতা, উপন্যাস ও নাটক আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ। তার সাহিত্য ভবিষ্যতের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র
১। হক, সৈয়দ শামসুল। সংকলিত সাহিত্যকর্ম, বাংলা একাডেমি।
২। আহমেদ, মনসুরুল। “বাংলা নাটকের আধুনিক ধারা,” পৃষ্ঠা ১০২-১১৫।
৩। Chowdhury, Afsar. Literature and the Liberation War, UPL, ২০০৫।
৪। পূর্ব বাংলার রাজনীতি সংস্কৃতি ও কবিতা, সাঈদ-উর-রহমান, ঢাকা ১৯৮৩।
৫। নাট্যপরিক্রমা (চার দশকের বাংলাদেশ), রামেন্দু মজুমদার- সম্পাদিত, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৩।
৬। উত্তরাধিকার (সম্পাদক মযহারুল ইসলাম) শহীদ দিবস সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৭। সমকালীন বাংলা সাহিত্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, ঢাকা ১৯৮৯।
৮। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, মুহম্মদ ইদরিস আলী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫।
********************************************************
আলী সিদ্দিকী: কবি ও কথাসাহিত্যিক
********************************************************