সুপার হিরো বাবা
আদনান সৈয়দ
মেয়েটা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে দেখলে মনে হয় যেন কোন দেবশিশু। কী নিষ্পাপ তার চেহারা! কত স্বর্গীয় সেই দৃশ্য! আমি প্রাণভরে সেই দৃশ্য দেখি। কিন্তু আমার স্ত্রী সেই দৃশ্য আমার মতো করে দেখতে পায় না। সে শুধু কাঁদে। মেয়েটাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু আমি কাঁদি না। আমি মনে করি মেয়েটা সুস্থ হয়ে বেঁচে আছে এইতো বেশি। এ নিয়ে এত ভাবনা কেন? তার চেয়ে বরং মেয়েটিকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলাই হবে আমাদের একমাত্র কাজ। কিন্তু আমার স্ত্রী সে কথা শুনবে না। তাঁর একটাই কথা। এমন কেন হলো?
আমার পুঁচকে মেয়েটার বয়স পাঁচ বছর। নাম মাটি। মাটির মতোই সে নরম। মাটির মতোই সে খুব সাদাসিধে। মেয়ের সঙ্গে আমার অনেক বন্ধুত্ব। স্কুল শেষে বাড়ি আসার পর থেকে আমরা দুজনেই নিত্য নতুন খেলা আবিষ্কার করি। তার ধারণা, আমি হলাম এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এক বাবা। আর আমি নাকি তার ভাষায় ‘সুপার হিরো বাবা’। তার ধারণা আমি সুপারম্যান অথবা স্পাইডারম্যানের মতো শক্তিশালী কোন মানুষ। ইচ্ছে করলেই অনেক কিছুই করে ফেলতে পারি। ইচ্ছে করলেই অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা আমার আছে। সম্ভবত সব মেয়েরাই তাদের বাবাদের সুপার হিরো ভাবে। আমিও এর ব্যতিক্রম হবো কেন? অথচ আমিতো জানি, আমার শক্তি কত সীমিত! আমার বর্তমানে আর্থিক যে দশা, তাতে করে বড়জোর আমার কন্যার জন্য দোকান থেকে একটি ভ্যানিলা আইসক্রিম কিনে খাওয়াতে পারি। কিন্তু সে কথাটি আমি আমার কন্যাকে কখনই জানতে দিই না। কেন জানতে দেব? মেয়েটা তার বাবাকে যেমনটা জানে, আমি ঠিক তেমনটাই হয়ে থাকার অভিনয় করি। এই ধরুন সেদিনের কথা। হঠাৎ করে মেয়েটা আমার গলায় ঝুলে একটা বায়না ধরে বসল।
‘বাবা, আমরা এত ছোট বাড়িতে থাকি কেন? এই বাড়িতে আমার নিজের কোন রুম নেই। আমার জন্য বড় একটা বাড়ি কিনে দেবে?’ আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘আচ্ছা দেব, কিন্তু তুমি এত বড় বাড়ি দিয়ে কী করবে মা? মেয়েটা ঝটপট উত্তর দিল, ‘বড় একটা বাড়িতে আমার জন্য আলাদা একটা রুম থাকবে। সেই রুমটার রং হবে নীল। সেই রুমটায় আমি তোমাকেই শুধু ঢুকতে দেব।’
আমি বললাম ‘বাহ! তোমার মামনিকেও ঢুকতে দেবে না?’
কিছুক্ষণ ভেবে সে তখন বলল, ‘ঠিক আছে, মাঝে মাঝে দেব।’
হায়! আমি কী সত্যি সুপার হিরো? জানি মেয়েকে এত বড় মিথ্যা স্বপ্ন দেখাতে নেই। কিন্তু মানুষ তো তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়? আর এই পুঁচকে মেয়েটার গায়ে জগৎ সংসারের কঠিন আর কুৎসিত বাস্তবতার ছোঁয়া এখনো লাগেনি। সে যখন আরও একটু বড় হবে, তখন ঠিক সবকিছু বুঝতে পারবে। আমি আমেরিকায় মোটামুটি চলনসই একটা কাজ করি। নিউইয়র্কের মতো শহরে বাসা ভাড়া দেওয়ার পর হাতে জমানো আর কিছু থাকে না। একটা ভালো চাকরির জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছি। এখনো চেষ্টা চলছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, চাকরি খোঁজার মতো এই আপদকে এখনই বিদায় জানিয়ে দিই। ভাগ্য চাকা ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে আমার সীমিত আয় এবং টানাপোড়েনের জীবনযাপনের সব আয়োজনের মধ্যেও নিজের কন্যার শখ আহ্লাদকেই সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিই। মেয়েটা কী খেতে পছন্দ করে, তার নতুন কী কী খেলনা লাগবে, সে কী জামা পরতে ভালোবাসে—সব আমার নখদর্পণে। আর থাকবেই না কেন? আমি না সুপার হিরো! সুপার হিরোদের এসব কিছুই খেয়াল রাখতে হয়।
সেদিন মজার একটা ঘটনা ঘটল। আমি মাটিকে স্কুল থেকে আনতে গেছি। সাধারণত প্রতিদিনের মতো আমি ওর স্কুলের সামনে একটা মেপল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর অপেক্ষা করি। হঠাৎ দূর থেকে দেখি, মাটি স্কুলের খুদে ছাত্র-ছাত্রীদের ছোটখাটো একটা দলের সঙ্গে বের হচ্ছে। আমি দেখতে পেলাম, মেয়েটি তার ছোট আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে শিক্ষককে কী যেন বলছে। আমি কাছে যেতেই সে তার শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ‘এই হলো আমার বাবা। আমার সুপার হিরো।’ আমি ওর কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। ওর শিক্ষকও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আমাকে অভিবাদন জানালেন। আমি তখন মনে মনে ভাবছিলাম অন্য কথা। মেয়েটি আমার মধ্যে এমনকি দেখতে পেয়েছে! আমি ওর জন্য এমন কী করেছি যে, সে আমাকে সুপার হিরো ভাবে?
সেদিন হঠাৎ করেই মেয়েটার গা কাঁপিয়ে জ্বর এল। মেয়ের গায়ে জ্বর আর সে আমার চোখের সামনে কাতরাবে আর এই দৃশ্য দেখার মতো সহ্য ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দেননি। আমি তাকে প্রায় কোলে করে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে চলে গেলাম। এখানকার ডাক্তারও বেশ অদ্ভুত। বাচ্চাদের জন্য কোন ওষুধই তারা সহজে লিখতে চান না। ডাক্তার বললেন, ‘ঘাবড়াবেন না। ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। সে কারণেই জ্বর। ভালো হয়ে যাবে। এই সিরাপটি লিখে দিচ্ছি। নিয়ম করে খাওয়াবেন।’ মেয়েকে বাসায় নিয়ে এলাম। তার শরীর তখন অনেক দুর্বল। সে নিথর শুয়ে আছে। আমি ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। এমন সময় সে অল্প করে তার চোখের পাতা খুলল। চোখ খুলতেই আমাকে দেখে সে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল, ‘বাবা, এলসা’। আমি এই কথার অর্থ কিছুই বুঝতে না পেরে ওর মার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। ‘এলসা’ কী? ওর মা তখন আমাকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করল, ‘এলসা হলো একটি অ্যানিমেশন সিনেমার জনপ্রিয় চরিত্র। এটি বাচ্চাদের খুব প্রিয় আর মাটি এই এলসা পুতুলটা খুব ভালোবাসে। সেই কবে থেকে পুতুলটা কেনার জন্য সে বায়না ধরে আছে।’
আমার চোখে পানি চলে এল। এই সামান্য একটা পুতুলও কিনে দিতে পারছি না! এ কেমন সুপার হিরো বাবা আমি? ওর মাকে বললাম। আমি পুতুলটা কিনে নিয়ে আসছি। কোথায় পাওয়া যাবে? দাম কত? দামের কথা শুনে মাটির মা চুপ হয়ে গেল। তারপর ফিস ফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘টয়স আর আস’ দোকানে পাওয়া যায়। আমি সেদিন দেখে এসেছি। অনেক দাম! চল্লিশ ডলারের ওপর। এত দাম দিয়ে এখন মেয়েকে পুতুল কিনে দিতে হবে না। তোমার চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার মতো ভালো কোনো শার্ট নেই। এক জোড়া ভালো জুতো নেই।’ আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর মার কথা শুনে। হায়! আমি নতুন শার্ট দিয়ে কী করব? নতুন জুতা পরেই বা আমার কী হবে? আমার মেয়ের শখ আহ্লাদই যদি পূরণ করতে না পারি, তাহলে আমি আবার কিসের সুপার হিরো? এই কথা বলতে বলতেই আমি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম ওর ‘এলসা’কে আনার জন্য। জানি এই মুহূর্তে আমার টাকা পয়সার ঝামেলা অনেক। এ কথাও জানা আছে, এই মুহূর্তে আমার কাছে চল্লিশ ডলার অনেক বড় অর্থ। হয়তো এই চল্লিশ ডলার দিয়ে আমার প্রায় এক সপ্তাহের বাজারও হয়ে যাবে। কিন্তু ভাবুন! এই টাকার বিনিময়ে আমার মেয়ের মুখে যে হাসিটা ফুটবে, সেটির মূল্য কি এই টাকা দিয়ে হবে? সেই স্বর্গীয় সুখটাকে টাকা দিয়ে কিনতে পাওয়া যাবে কি! পুতুলটা কিনে ঘরে ঢুকেই দেখি, মাটি তখনো বিছানায় শুয়ে আছে। আমি খুব ধীরে ধীরে পুতুলটা বাক্স থেকে কায়দা করে খুলে তার বিছানার এক পাশে রাখলাম। তারপর আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বিছানার এক কোনায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি, সে একটু নড়েচড়ে উঠল। কপাল কুঁচকে সে বার কয়েক আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। তারপর চোখটা গিয়ে পড়ল পুতুলটার ওপর। আর কী! এই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখব বলেইতো আমি এতক্ষণ অপেক্ষায় বসে ছিলাম! সে প্রথমে ছোঁ মেরে পুতুলটাকে তার কোলে তুলে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই দ্রæততার সঙ্গে সে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার বুকে আমার প্রিয় কন্যা। আর কন্যার বুকে তার প্রিয় পুতুল এলসা। মেয়েটা আমার বুকে তার নাক ঘষতে ঘষতে বলল, ‘মাই সুপার হিরো বাবা!’ আমার চোখে তখন জল চলে এল। ভেজা চোখ সে যেন আবার দেখতে না পায়, সে জন্য মুখটা একটু কায়দা করে লুকিয়ে রাখলাম। মেয়েটা সেদিনই সুস্থ হয়ে গেল।
আজ মাটি স্কুল থেকে এসেছে ওর মায়ের সঙ্গে। আমি বাসায় ঢুকতেই দেখি মা ও মেয়ে তাদের দুজনের মন খুব খারাপ। এতই খারাপ যে, মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিল না। চোখ লাল হয়ে আছে। দেখি আমার স্ত্রীর চোখেও জল। মেয়েকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে আমার স্ত্রীরও রাতে ঘুম হয় না। কিন্তু সেদিন কিছু যে একটা হয়েছে, তা আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। কী হয়েছে বলতেই স্ত্রী তার চোখ মুছতে মুছতে আমার সামনে এসে বসল। তার কথা শুনে জানতে পারলাম, আজ মেয়েটা যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল তখন তার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে এক স্কুল বন্ধু উপহাস করছিল। সেই থেকেই মেয়েটির কান্না শুরু হলো। মন তার ভীষণ খারাপ। আর কান্নাতো করবেই। আমরা কখনোই তাকে বুঝতে দিইনি যে, ওর বাঁ পা একটু ছোট এবং সে যখন হাঁটে তখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। মেয়েটা আমাকে দেখেই স্বভাবমত আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর অবাক করে দিয়ে সে আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘বাবা, আমি নাকি খোঁড়া! আমার পা নাকি কখনই ভালো হবে না!’
মেয়ের এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি ঝাপসা চোখেই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর বললাম, ‘কে বলেছে তুমি খোঁড়া মা? কে বলেছে তুমি হাঁটতে পার না?’ মেয়েটা আবার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা, তুমি না আমার সুপার হিরো? তুমি কি আমার জন্যে একটা ভালো পা কিনে এনে দিবে? প্লিজ! বাবা আমার পা’টা ভালো করে দাও!’
আমি তখন আমার সব অক্ষমতাকে ঢাকতে আমার হাত দিয়ে চোখ দুটোকে ঢাকছিলাম। আমি যে বাবা হিসেবে কত অক্ষম সেই কথাটি এই পুঁচকে মেয়েটাকে বোঝাই কীভাবে?