সাহিত্য সমালোচনার এ-পিঠ ও-পিঠ
লিপি নাসরিন
মানুষ সাহিত্য চর্চা কেনো করে সে প্রশ্ন, বলা ভালো কৌতূহলের জবাব সাহিত্য চর্চাকারী থেকে বহু সুপণ্ডিত দিয়ে গেছেন। কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, জলের নিচে চাঁদের ছায়া দেখে যদি তোমার মন কেমন করে তাহলে তোমার মধ্যে কবিসত্তা আছে। কথাটি তিনি বিশিষ্ট ভারতীয় তথ্য চিত্র নির্মাতা ও লেখক সৌমিত্র দস্তিদারকে বলেছিলেন এবং তাঁর কাছেই কথাটা আমার শোনা। তাহলে মন কেমন করা একটা ব্যাপার থাকে,আর এই মন কেমন করা থেকে অন্তর ভাবরসের জারণে সিক্ত হয়। ভাব থেকে ভাবনা ,ভাবনা থেকে ভাষা যেমনটা বলেছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট কবিতার সংজ্ঞা টানতে গিয়ে। যারা সাহিত্য চর্চা করেন তাদের ভেতরে আলাদা একটা জগত তৈরি হয়ে যায়, যে জগত তার ভাবনাকে সুবিন্যস্ত করে একটা কাঠামোর মধ্যে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সাহিত্য চর্চাকারীর মননে ধারাবাহিক পরিশীলিত চর্চার মাধ্যমে যে উৎকর্ষতা তৈরি হয় তাই তার চিন্তা বা ভাবনার দিগন্তে একটা শুদ্ধ পরিমণ্ডল গড়ে দেয়। সাহিত্যের প্রতি টান মানুষের আদি এবং চিরন্তন সেটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না।
সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে একজন পাঠক এর রস আস্বাদন ও আনন্দ উপভোগ করে তার অবসর বিনোদনের উপায় হিসেব, সেটা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ বা নিবন্ধ যেটিই হোক না কেনো, যদিও এই সত্যের বাস্তবতা আজকের এই আকাশ সংস্কৃতির যুগে কতোটা বাস্তব সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। একজন লেখক তার নিজের জারিত অনুভূতি থেকে লেখে তাই পাখির গান করার আনন্দের মতো কে পড়লো আর কে পড়লো না তা তার উদ্বেগের বিষয় না হলেও একটা সময় এসে পাঠকের প্রতি লেখকের দায়বদ্ধতা থেকে যায় বৈকি এবং কালপর্বে তা যদি কখনো সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে এগিয়ে চলে তখন লেখক পাঠকের মনের রসবোধ, আনন্দ-বেদনা বা সামাজিক নৈমিত্তিক চেতনার বিষয়টি মাথায় রেখেই সাহিত্যকর্ম রচনায় নিজকে নিয়োজিত করেন, অবশ্য কলা-কৈবল্যবাদীরা কেবল Art for art’s sake এ বিশ্বাসী এবং পাঠকের হৃদয়ে এক অনৈসর্গিক বিশুদ্ধ আনন্দের উপায় হিসেবে তাঁরা শিল্পমাধ্যমকে দেখে থাকেন (Art for art’s sake means for its adepts the pursuit of pure beauty – without any other preoccupation- Pierre Jules Théophile Gautier)। তবে যারা সমাজ থেকে উৎসারিত চিন্তা- ভাবনাকে তথা বিরাজমান সমাজ বাস্তবতাকে শিল্প- সাহিত্য সৃষ্টির সূতিকাগার ভাবেন তারা এই সংঙ্গার সাথে একমত নাও হতে পারেন।
এইখানে ভালো সাহিত্য এবং মহৎ সাহিত্য এই দুটি বিষয় এসে যুগপৎ দাঁড়িয়ে যায়। তুচ্ছই সহজ, মহতের জন্য দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত essayist এবং critic (১৮৩৯-১৮৯৪) Walter Peter-এর বক্তব্যে এটি সুস্পষ্ট। যখন তিনি বলেন, ‘Good art depends upon the mind and great art depends upon the mind and the soul.’
‘উপলব্ধি গভীর হলে কবিতা হবে মহৎ, এবং প্রকাশ যথাযথ হলে কবিতা হবে উৎকৃষ্ট’ – কবিতা বিষয়ক আবু সয়ীদ আইয়ুবের এই উক্তি শিল্পের যে কোন মাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য।
আবার আমরা Walter Peter-এর দ্বারস্থ হতে পারি। তিনি Art বিষয়ক Modern style theory-তে বলেছেন,’ style reveals the artist’s soul itself. Good art is not necessarily great art because great art has something impressive in the quality of the matter it informs of control. It is related to great and not of revolt and largeness of hope.'(রচনাশৈলী নিজেই একজন শিল্পীর নিজস্বতা প্রকাশ করে. ভাল শিল্পকে অগত্যা মহান শিল্প না হলেও চলে কারণ মহান শিল্পের বস্তুগত গুণমানের মধ্যে চিত্তাকর্ষক কিছু থাকে যা এটি নিয়ন্ত্রণের কথা জানায়। এটা মহান বিদ্রোহ এবং আশার আয়তনিকের সাথে সম্পর্কিত নয়।)
লেখক পাঠকের আবেগকে তার লেখার মধ্যে দিয়ে সঞ্চারিত করে যদি একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে, যে সেতুর অপর পাড়ে পাঠক নিজেকে দেখতে পায় তখনই একটি জনপ্রিয় সাহিত্য ধ্রুপদী সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে; লেখক তখন দৃশ্যপট থেকে সাময়িক অপসৃত হয়ে তার সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়( It is the reader who breathes the meaning into the text, following Raland Barthes, one can declare that the author is dead and the reader is the author or the creator)। পারফর্মিং আর্টের ক্ষেত্রে হয়তো ভিন্নরকম ভাবনা থাকে কিন্তু গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতার যে সুক্ষ্ম অনুরণন পাঠকের হৃদয়তন্ত্রীতে গোপনে জেগে ওঠে সে অনুভব একান্তই নিজের সাথে নিজেকে বুঝে ওঠার ব্যাপার। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, সব লেখক কি তার লেখার মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ের পরিশীলিত রূপটি তৈরি করে দিতে পারে কিংবা যে সব লেখক পাঠকের রুচিতে অভিঘাত সৃষ্টি করছে তাদের লেখার উৎকর্ষতা পরিমাপের মাপকাঠিই বা কী?
আধুনিক সমালোচকরা কবিতার ক্ষেত্রে যথার্থই বলেছেন, যে কবিতায় একই বা একজাতীয় অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে তার চেয়ে উঁচুদরের বলে গণ্য হবে সেই কবিতা যাতে একাধিক বিভিন্ন ভাবের সমাবেশ ঘটেছে, অবশ্য যদি অনুভূতির প্রকাশ দুটোতে সমান রূপদক্ষতার সঙ্গে হয়ে থাকে। যেমনটি রিলকে বলেছিলেন টেরিবলনেস এবং ব্লিস একই সত্তার এ -পিঠ ও-পিঠ।
কেন জয়েসের Ulysses আজও রহস্যের সৃষ্টি করে চলেছে পাঠক বা একাডেমিক বোদ্ধাদের মনে। ‘April is the cruelest month’ লাইনটি প্রতিবার উচ্চারণেরও পাঠকের মনে এক অন্য অনুভূতি দোলা দেয়।
‘Don’t say what is it
Let us go and make our visit’ (T. S Eliot)
কী আছে এইসব লাইনের মধ্যে, চেনা জানা শব্দের ভেতর খেলে বেড়ায় অন্য কোন বোধ, অন্য কোন শব্দ যা এই কোলাহল থেকে পাঠককে নিয়ে যায় দূরে কোথাও যেমন করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, দূরে কোথাও,দূরে … যেখানে পাঠক লেখক একাকার হয়ে যায়। তাহলে লেখকের যেমন অন্তর্জ্বালা (সৃজনের) আছে তেমনি পাঠকের থাকতে হবে সেই বোধকে(সৃজনের আনন্দ যন্ত্রণা) ধারণ করার ক্ষমতা। সব লেখা যে পাঠক গ্রহণ করবে এমনটিও নয় সেখানে ভালো লাগা না লাগার ব্যাপারটা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। যদি একজন সাধারণ পাঠককে জিজ্ঞেস করা হয় কেনো কোন বিশেষ লেখাটি ভালো লেগেছে তখন পাঠক তার বোধের মাত্রা থেকে উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করে আর এখানেই আসে সমালোচনার ব্যাপারটি। কোন লেখাকে উৎকর্ষতার যাদুর কাঠির ছোঁয়া দিয়ে সোনা করে তুলতে হলে তাকে আলোচনা, (এবং বর্তমানে এটিকেই সমালোচনা হিসেবে ধরা হয়) সমালোচনার মধ্যে দিয়ে যেতেই হবে আর এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্যের আর এক তাত্ত্বিক শাখা সমালোচনা সাহিত্য।
কীভাবে সাহিত্য সমালোচনা করতে হবে বা সাহিত্য সমালোচনার সময় একজন সমালোচককে কোন বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে সেটা সমালোচক ,লেখক উভয়ের জন্য একটা ব্যাপার বটে। সাহিত্য সমালোচনার অনেক ধরন আছে যেমন- প্রচলিত সমালোচনা, সমাজতাত্ত্বিক সমালোচনা, নতুন সমালোচনা, পাঠক-প্রতিক্রিয়া সমালোচনা, নারীবাদী সমালোচনা, মার্কসবাদী সমালোচনা, মিডিয়া সমালোচনা ইত্যাদি।
যাঁরা সাহিত্যের তাত্ত্বিক ক্রিটিক তাঁরা এ-সমস্ত পদ্ধতি অনুসরণ করেই সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক অভিসন্দর্ভ লিখে থাকেন। এরিস্টটলের ‘পোয়েটিকস’ থেকে রেনেসাঁ (ইউরোপিয় ইতিহাসে মধ্যযুগ থেকে আধুনিকযুগে পদার্পণ) কিংবা উনবিংশ শতাব্দীর সমালোচনা (হেগেল, মার্কস, নিটশে, টলস্টয় প্রমুখ ) থেকে নব্যসমালোচনা (ফ্রয়েড, সস্যুর দেরিদা,সাত্র ,চমস্কি, সাইদ এবং তদসমুদয়) সাহিত্য সমালোচনার ইতিহাসের একটা প্রতিকৃতি থেকে বিমূর্ত-ভাববাদ- প্রয়োগবাদ কিংবা ভাষার কাঠামোবাদ বা উত্তোরকাঠামোবাদ প্রভৃতি দর্শনাশ্রয়ী আলোচনার মাধ্যমে সমালোচনার রূপরেখা প্রণয়ন সম্ভব। সাহিত্যের দর্শনদৃষ্ট সমালোচনাকে আমাদের সাহিত্য সমালোচকরা কতোটা প্রাধান্য দেন বা আদৌও দেন কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে বা আমার মতো যারা প্রাতিষ্ঠানিক দর্শনহীন মানুষ(পাঠক) তারা সাহিত্যকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে।
পাঠক সাহিত্যকে গ্রহণ করে তার সাধারণ উপলব্ধি , সংস্কৃতি কিংবা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। কবিতা আমাদের কল্পনাকে আরো দূরে নিতে সাহায্য করে, কিন্তু গল্প যা আমাদের নিজেদের নয় সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দেয় সাঁকোর অপর পাশে। যেখানে লেখক পাঠকের কাছে বিস্মৃত হয়। সাঁকোর ওপাশের দৃষ্টিবিভ্রম (যদি মরীচিকা থাকে) থেকে আমাদের আলো দেখায় সাহিত্য সমালোচনা যা টেক্সটের গভীরে ঢুকে সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিককে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জানার সুযোগ করে দিয়ে লেখকের মানসকে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করে পাঠকের সামনে একটি সুস্পষ্ট বোধের জন্ম দেয়। তবে মনে রাখতে হবে সাহিত্য হচ্ছে একজন লেখকের মৌলিক সৃজনকর্ম এবং এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সাহিত্য সমালোচনা। সে-ক্ষেত্রে সমালোচকের হৃদয় হবে উষ্ণ। হার্দিক উষ্ণতা নিয়েই- নিন্দা বা বিরূপ মন্তব্য না করে কিংবা স্তাবকতায় লেখককে না ভাসিয়ে সৃজনকর্মের সাথে নিজস্ব রসবোধের জোয়ার আনতে হবে, তবেই সমালোচক সফল হবে পাঠকের মনে নির্মল আনন্দ ও নান্দনিকতাবোধ সৃষ্টি করতে।
মননের যে গহনগভীর বোধ থেকে একটি সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি হয়, সেই বিশেষ ক্ষরিত উদ্দীপনার উৎস ও রূপকুশলতার বিশেষত্বটি বুঝতে গেলে একজন সচেতন, বোদ্ধা(esoteric) পাঠকেরও প্রয়োজন। সমালোচক হচ্ছে এমনি বোদ্ধা পাঠক যিনি সাহিত্যকর্মটিকে ব্যাখ্য ও বিশ্লেষণ করার জন্য নিজকে প্রমাণিতভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছেন, এবং যিনি তার সহৃদয় পদ্ধতিগত কুশলতায় নিজস্ব আবেগ ও মনন শক্তিতে পুরো সৃজন প্রক্রিয়াটিকে সাধারণ পাঠকের কাছে তার বোধের ভেতর থেকে আরেক নতুন বোধ সৃষ্টিতে পারঙ্গমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাই একজন সমালোচককে হতে হয় তাত্ত্বিকভাবে প্রাজ্ঞ। তিনি জনরুচির পরিশীলিত রূপটি গড়ে দেবার এক নৈর্ব্যক্তিক শিল্পী ।
Wolfgang Iser ( উফগিং আইজার ১৯২৬-২০০৭) জার্মান লিটারেরি ক্রিটিক- তাঁর রিসেপশন তত্ত্বে (Reception theory ) পাঠক প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব( Reader response theory) সম্পর্ক বলতে গিয়ে বলেন, Reader response theory emphasizes the idea meaning of a literary work is the result of an interaction between the text and the reader, as “an effect to be experienced”, not an “object to be defined”. অর্থাৎ সাহিত্যকর্মের অর্থ টেক্সট এবং পাঠকের মধ্যে মিথোস্ক্রিয়ার ফলাফল অভিজ্ঞতার প্রভাব হিসাবে, তা সংজ্ঞায়িত করার মতো কোন বস্তু নয়।
এভাবেই সমালোচনা সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ করে, মূল্যায়ন করে, তুলনা করে এবং অনুবাদ(interpretation)করে। বিংশ শতাব্দী থেকে লিখিত সমালোচনা সাহিত্যের জন্ম কিন্তু শিল্প এবং সাহিত্যের অন্তর্লোক অবলোকনের কাজটি শুরু হয়েছিল প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের সময় থেকে। সাহিত্য সমালোচনা এবং সাহিত্য তত্ত্ব দুটি ভিন্ন জিনিস। সাহিত্যতত্ত্ব সাহিত্যকর্মকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যস্ত করে যেখানে একজন সাহিত্য সমালোচককে একটি বিশেষ সাহিত্যতত্ত্বকে ধরে সমালোচনার একটা কাঠামো তৈরি করতে হয়।
উফগিং আইজারের দুটি প্রধান রচনা, The implied reader (১৯৭২) এবং The act of reading (১৯৭৬)। The implied reader -এ বেশ কয়েকটি ইংরেজি উপন্যাস পরীক্ষা করার পর, আইজার এই বইয়ের একটি অংশে The reading process: A Phenomenological approach শিরোনামে তার পদ্ধতির রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি পরামর্শ দেন যে, আমরা সাহিত্যকর্মটিকে দুটি মেরুযুক্ত বলে মনে করতে পারি: “শৈল্পিক” মেরুটি লেখক দ্বারা তৈরি করা টেক্সট, এবং “নান্দনিক” মেরুটি “পাঠকের দ্বারা সম্পন্ন উপলব্ধি” (IR, ২৭৪) বোঝায়। আমরা টেক্সট বা পাঠের উপলব্ধি দিয়ে সাহিত্যকর্মকে চিহ্নিত করতে পারি না; এটি অবশ্যই “দুইটির মধ্যে অর্ধেক পথ” পড়ে থাকবে এবং প্রকৃতপক্ষে এটি কেবল টেক্সট এবং পাঠকের মিলনের মাধ্যমেই অস্তিত্বশীল হয় (IR, (২৭৫)। এখানে তার বক্তব্য হল পড়া একটি সক্রিয় এবং সৃজনশীল প্রক্রিয়া। এটি পাঠ যা পাঠ্যটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে, যা “তার সহজাত গতিশীল চরিত্র” (IR, ২৭৫) প্রকাশ করে। লেখক যদি কোনোভাবে একটি গল্পকে পুরোপুরি উপস্থাপন করতেন, তাহলে পাঠকের কল্পনার কিছুই করার থাকবে না; কারণ টেক্সটটিতে অলিখিত প্রভাব বা “অবস্থান” রয়েছে যা পাঠককে সক্রিয় এবং সৃজনশীল করে নিজের জন্য কিছু কাজ করতে পারে। এর মানে এই নয় যে কোন পড়া উপযুক্ত হবে। টেক্সটটি তার নিজস্ব অলিখিত প্রভাবগুলিকে সীমিত করতে বিভিন্ন কৌশল এবং ডিভাইস ব্যবহার করে, তবে পরবর্তীগুলি পাঠকের নিজস্ব কল্পনা দ্বারা তৈরি করা হয় (IR, ২৭৬)।
Wolfgang Iser – এর মতে পাঠকের সম্ভাবনাও অফুরন্ত এবং যুগপরিক্রমায় একজন পাঠক একজন লেখককে ভিন্ন ভিন্নভাবে আবিষ্কার করে তাই লেখকের সৃজনকর্মটির অর্থপ্রবাহে বাঁধ দিয়ে পাঠককে খুঁজে নিতে হয় অফুরান আনন্দ আর নান্দনিকতার ভাণ্ডার।
তবে সমালোচনার প্রাথমিক পর্যায় থেকে বর্তমানেও লেখক ও সমালোচকের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিরোধ ও অবিশ্বাসের এক অদৃশ্য দেয়াল। এটা সর্বকালেই সমভাবে বিদ্যমান। লেখক যেমন সমালোচকের সমালোচনাকে ( বিশেষভাবে নেতিবাচক) গ্রহণ করতে পারেন না, তেমনি কোন কোন সমালোচকও বিভিন্ন সাহিত্যরচনার ইতিবাচক দিকগুলোর চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলোকেই প্রাধাণ্য দিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহিরে প্রবৃত্ত হন। কখনো আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রদান করে লেখকের সমুদয় সাহিত্যকর্মকে রদ্দিমাল প্রমাণ করতেও দ্বিধাবোধ করেন না, তাই লেখকও সেই সমালোচকের জ্ঞানের ব্যাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে কুণ্ঠিত হন না মোটেই।
বিশেষ করে কবিতার সমালোচনা নিয়েই সমালোচক ও লেখকের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিতর্ক বা যুদ্ধের প্রমাণ আমাদের হাতের কাছেই আছে। নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ সমালোচকদের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে লিখেছেন,
“বরং তুমিই লেখো নাকো একটি কবিতা-/ বলিলাম ম্লান হেসে ছায়াপি দিলনা উত্তর;/ বুঝিলাম সেতো কবি নয়-সে যে অরূঢ় ভণিতা/ পান্ডুলিপি, ভাষ্য, টিকা কালি আর কলমের ‘পর বসে আছে সিংহাসনে-কবি নয় অজর অক্ষর/ অধ্যাপক দাঁত নেই-চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি/ বেতন হাজার টাকা মাসে-আর হাজার দেড়েক পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি/ যদিও সেসব কবি ক্ষুদা আর আগুনের সেঁক/ চেয়েছিল-হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি। (সমারূঢ়: জীবনানন্দ দাশ)
কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আধুনিক কবি ও কবিতার সমালোচনাকারীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উচ্চারণ করেছেন,
ধর্ষকামে মত্ত ছিল তারা/ আহা প্রাজ্ঞজনা বিত্তশালী সমালোচনায়/ ও বোন কবিতা তুই কেন গিয়েছিলি সেমিনারে?/ এ যদি উপমা খোঁজে, বাকিগণ রূপক সন্ধানী/এ যদি কৈবল্যবাদী বাকিগণ ছন্দবিশারদ/ এ যদি শৃঙ্গার প্রিয়, বাকিগণ সঙ্গমবিলাসী/ এ যদি করেছে চিৎ বাকিগণ উপুর করেছে/ সাধু, সাধু প্রাজ্ঞজনা…কামশাস্ত্রে পার্থক্য খচিত/ ধর্ষকামে মত্ত ছিল তারা/ (কবিতা বিষয়ক সেমিনার: আবু হাসান শাহরিয়ার)
আত্মসমালোচনা,পরমতসহিষ্ণুতা, দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি, সমালোচনার তাত্ত্বিক জ্ঞান, সহানুভূতি, লেখকের মনোভূমিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, কল্পনা এবং নিটোল রসবোধ সমালোচককে দেখাতে হবে কোন সাহিত্যকর্ম সমালোচনার ক্ষেত্রে। এ জন্য সমালোচকের দায় অনেক বেশি। একজন মেধাবী ,সৃষ্টিশীল সমালোচকই পারেন একটি সাহিত্য বা শিল্পকর্মের উৎকর্ষতা বা অনুৎকর্ষতার মান নির্ণয় করতে। সেক্ষেত্রে শিল্পসাহিত্যের সব নিয়ম-রীতি মেনেই একেবারে নির্মোহ দৃষ্টিতে সেটি করতে হবে।
আবার কখনো সমালোচকগণ একই লেখকের সাহিত্যকর্ম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাই নজরুলকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সৈয়দ আলী আহসান বুদ্ধদেব বসুর সাথে একমত হতে পারেননি।
সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অমীয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন,’সুধীন্দ্রনাথ দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন- মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ – সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’ তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভব তিনি বুঝতে পারতেন, তাই তাঁদের দুজনার দৃষ্টিভঙ্গির এই পার্থক্যকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদগতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আধুনিক কবিতার গতি -প্রকৃতি এবং তার নিরিখে রবীন্দ্রনাথকে ভেঙেচুরে নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর এই গ্রন্থের সমালোচনা করে কবি অরুণকুমার সরকার একটি অসাধারণ সমালোচনা লিখেছিলেন এবং আইয়ুব সে সমালোচনার উত্তরও দিয়েছিলেন খুবই যৌক্তিক শিল্পকুশলতায়। দুটি লেখাই উল্লিখিত বইতে সংযোজিত আছে।
আমাদের দেশে সাহিত্য সমালোচনা পুস্তক পরিচিতি, বুক রিভিউ বা নিছক আলোচনার মধ্যে আটকে আছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঘেরাটোপে বন্দি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার আলো বাঙালিদের চোখে-মুখে লাগার সাথে সাথে শিল্প- সাহিত্যেও নতুন গতি সঞ্চারিত হতে লাগলো। ইংরেজ পণ্ডিতদের কাছে শিক্ষা লাভ করে বাঙালি ছাত্ররা ইউরোপীয় সাহিত্য- সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাংলা সাহিত্যের কিছু কিছু সমালোচনা লিখতে শুরু করলে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘প্রভাকর’ পত্রিকায় সে-সবের বিরোধিতা করে লেখা ছাপা হতে থাকে। সাহিত্যের আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে ঈশ্বরগুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ, টেকচাঁদ ঠাকুর, প্রমুখ।
বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা ইংরেজ ও বাঙালি সমালোচকরা ইংরেজি ভাষায় লিখতে শুরু করেন ১৮৪৪ সালে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর এই পত্রিকাতে। ‘রহস্য সন্দর্ভ’ ও ‘সোমপ্রকাশ’ এবং ১৮৭২ সালে প্রকাশিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের একটা নতুন ধারা নির্দেশিত হতে থাকে । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে ছদ্মনামে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) ও ‘মৃণালিণী” (১৮৬৯) প্রকাশের পর ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক সমালোচনা লিখেছিলেন ইংরেজিতে। পরবর্তীকালে ‘ভারতী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনাকে সৌকর্য দান করলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সমালোচনাকে জীবন দিলেন আর রবীন্দ্রনাথ দিলেন মরকতমণির দ্যুতি।
সমাজ এবং রাষ্ট্রে পরিশীলিত, মননশীল, সৃষ্টিপ্রিয় মানুষ গড়ে তুলতে সমালোচনা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্যতা অনস্বীকার্য। আমাদের সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বেলায় এ সমালোচনা সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে গ্রাহ্য। আমাদের সমালোচনা সাহিত্য এখনো সীমাবদ্ধ আছে সূচনাতেই। হাঁটতে গিয়ে অন্ধগলির মধ্যে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে।
**************************************
লিপি নাসরিনঃ কথা সাহিত্যিক ও গবেষক
**************************************