মজিবর রহমান খোকা নামেই যার পরিচয়ের ব্যপ্তি ফুটে ওঠে শিল্প-সাহিত্য জগতে। সেই কিশোর বয়সেই দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন সম্মুখ সমরে। সুদীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে জড়িত আছেন প্রকাশনার সাথে। বিদ্যাপ্রকাশের কর্ণধার। প্রকাশনা শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে এনেছেন আমূল পরিবর্তন। দেশ এবং বিদেশে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন বাংলা সাহিত্য, শিল্প এবং সংস্কৃতিকে সমুন্নত করতে। শ্রদ্ধেয় এই গুনীজনের সাথে আলাচারিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিল্প- সাহিত্যের নানাবিধ বিষয়।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি,কথাসাহিত্যিক, প্রকাশক ও সম্পাদক – জলধি নাহিদা আশরাফী এবং কবি ও কথাসাহিত্যিক নুসরাত সুলতানা
নুসরাত সুলতানাঃ আসসালামু আলাইকুম। শুভ সময়। কেমন আছেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ ভালো আছি, আপনি ভালো আছেন?
নুসরাত সুলতানাঃ আপনার জন্ম, শৈশব, পরিবার-পরিজন নিয়ে সংক্ষেপে আমাদেরকে বলুন।
মজিবর রহমান খোকাঃ আমার বাবার নাম মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন এবং মায়ের নাম মন্নুজান খানম। আমার জন্ম রংপুরে। আব্বা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সেই সুবাদে আমার লেখাপড়া রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, গুরুদাসপুর নাটোর আবার রাজশাহী। আমরা আট ভাইবোন। আমার এক ভাই মারা গেছে। বর্তমানে আমরা সাত ভাইবোন।
নুসরাত সুলতানাঃ আপনি সবার বড় ?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি ভাইদের মধ্যে বড়। আমার বড় দুই বোন আছে।
নুসরাত সুলতানাঃ প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কোথায় শুরু হয়েছিল? কেমন ছিল?
মজিবর রহমান খোকাঃ প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল বগুড়ায় সুবিল প্রাইমারি স্কুলে। করনেশন ইনষ্টিটিউটে প্রাইমারি শিক্ষার পর রাজশাহী। অই যে বললাম বিভিন্ন জায়গায় আমি গিয়েছি। আমি সর্বমোট আট -নয়টি স্কুলে পড়েছি।
নুসরাত সুলতানাঃ তখন আপনার বয়স কত ছিল? কত সালের দিকে হবে?
মজিবর রহমান খোকাঃ বয়স তো ছয়- সাতের ভেতরেই হবে। তখন আইয়ুব খানের শাসন চলছে। ১৯৬১ সাল হবে।
নুসরাত সুলতানাঃ তখন স্কুলড্রেস কেমন ছিল, স্কুলে কী লেখাপড়া করতেন, মেয়েরা স্কুলে যেত কিনা এসব বিষয়ে বলুন।
মজিবর রহমান খোকাঃ সরকারি স্কুলগুলোতে ড্রেস ছিল। অন্য স্কুলগুলোতে তেমন কোনো ড্রেস দেখতে পাইনি। একেক স্কুলে একেক রকম ড্রেস ছিল। আমি কয়েকটি সরকারি স্কুলে পড়েছি। কোনো স্কুলে পাজামা -পাঞ্জাবি ছিল আবার কোনো স্কুলে খাকি প্যান্ট সাদা শার্ট ছিল।
নুসরাত সুলতানাঃ তাহলে কী আমরা এমন ভাবতে পারি যে, তখন বৃটিশ কালচারের রেশ কিছুটা রয়ে গেছে আর পাকিস্তানি কালচার কিছুটা শুরু হয়েছে?
মজিবর রহমান খোকাঃ পাকিস্তানি কালচার কিছু ছিল না মূলত ব্রিটিশ কালচারই ছিল। ব্রিটিশরা যেভাবে ড্রেসগুলো ডিজাইন করেছিল সে ভাবেই চলছিল। আমরা তো তখন ছোট ছিলাম রাজনৈতিক ব্যাপার গুলো বুঝতাম না। পরে অবশ্য বুঝেছি ব্রিটিশ কলোনিয়াল দেশ হওয়ার কারণে ড্রেসগুলো এমন ছিল। শার্ট আর পাজামা যে ছিল সেটা ছিল মাদ্রাসা হাই-স্কুল।
নুসরাতসুলতানাঃ আপনাদের ক্লাসে মেয়েরা পড়ত? আপনার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল?
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ, প্রাইমারি স্কুলে কো-এডুকেশন ছিল। রাজশাহী গুরুদাসপুরে ক্লাস এইটে পড়তাম সেখানেও মেয়েরা ছিল।
নুসরাত সুলতানাঃ মেয়েরা যে পড়ত তাদের সাথে কথা-বার্তা, আচার-আচরণ কী সহজ এবং সাবলীল ছিল?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি গুরুদাসপুরের কথা বলছি। মেয়েরা একটা রুমে থাকত। তারা শিক্ষকদের সাথে শ্রেনীকক্ষে আসত আবার শিক্ষকদের সাথে বেরিয়ে যেত। এমনকি আমি যখন নাটোর কলেজে পড়ি তখনও এটা দেখেছি যে, শিক্ষকের সাথে মেয়েরা আসতো আবার শিক্ষকের সাথে বেরিয়ে যেত।
নুসরাত সুলতানাঃ কলেজে পড়তেন, সেটা কত সালের কথা?
মজিবর রহমান খোকাঃ ১৯৭২ সাল। এরপরে যখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি তে পড়েছি তখন আর মেয়েরা বেরিয়ে যেত না। তখন মেয়েদের ছেলেদের সাথে একসাথে বসতে, আর গল্প করতে আর কোন বাঁধা ছিল না। মোটামুটি স্বাভাবিক ভাবে মিশত তারা।
নুসরাত সুলতানাঃ তাহলে নারী বন্ধুদের সাথে স্বাভাবিকভাবে মেশার সুযোগ এসেছে বিশ্ববিদ্যালযয়েপড়ার সময়?
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে সেভাবে দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম মেয়েদের সাহচর্যে এসেছিলাম। কিন্তু আরেকটা জিনিস ছিল না যেটা এখন আমরা দেখি। এখন যেভাবে ক্লাস থ্রি থেকে মেয়েদের বোরখা পরানো হয় সেটা কিন্তু তখনকার ছাত্র সমাজে ছিল না। আমাদের স্কুলে যেসব মেয়েরা ক্লাসে আসত তারা স্বাভাবিক কাপড় পরেই আসত। এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি বোরকা পরতে দেখিনি মেয়েদের।
নুসরাত সুলতানাঃ ইতিমধ্যে অনেকখানি বলেছেন। তারপরও একটু বলুন আপনার মাধ্যমিক পর্যায়ে কখন শুরু হল এবং তখন সমাজের পরিবর্তনগুলো কেমন ভাবে ঘটছিল? ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তানি আমল শুরু হল। পরিবর্তনটা কীভাবে সাধিত হচ্ছিল?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি যখন মাধ্যমিকে তখন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনোই ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের হাতে দিতে চায় না। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থাকবে পশ্চিম পাকিস্তান। দেশভাগ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত দেখেছি ক্ষমতা তাদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন বিভিন্ন জায়গায় তিনি ভাষণ দিতেন। সেসব ভাষণগুলো আমরা শুনতে যেতাম, শুনতাম। রাজশাহী এবং নাটোরে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ প্রাঙ্গণে আমি ভাষণ শুনেছি। ওই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শোষণের বিষয়টা এবং পার্থক্যগুলো আমাদের ভেতরে তুলে ধরতেন। আমরা যে নির্যাতিত হচ্ছি, শোষিত হচ্ছি, বঞ্চিত হচ্ছি সেটা বঙ্গবন্ধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। তখন বাঙালিদের সংঘটিত হওয়ার একটা চেতনা তৈরি হয়ে গেছে প্রত্যেকের ভেতরে। বাঙালি যে শোষিত হচ্ছে সেটা বুঝে গিয়েছিল ৬৯- ৭০ বা তারও আগে থেকে।
নুসরাত সুলতানাঃ তাহলে আমরা বলতে পারি যে, আপনি যখন মাধ্যমিক পর্যায়ে ছিলেন তখনই বাঙালির আলাদা জাতিসত্তা প্রস্ফুটিত হতে শুরু করেছিল? বাঙালি যে আলাদা জাতি, আলাদা সংস্কৃতি আলাদা চিন্তাভাবনা সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে আরম্ভ করে?
মজিবর রহমান খোকাঃ তার আগে রাজনৈতিক ব্যাপারটা আমরা বুঝিনি। তবে বাসায় যে আলাপ-আলোচনা হতো তাতে আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
নুসরাত সুলতানাঃ আপনি ইতিমধ্যে বলেছেন যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আপনার গ্রাজুয়েশন। সেই সময় ছাত্র রাজনীতিতে পরমত সহিষ্ণুতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এই ব্যাপারগুলো কেমন ছিল?
মজিবর রহমান খোকাঃ এটা খুব একটা সুখকর ছিল না। স্বাধীনতার পরে যখন আমরা কলেজে ভর্তি হলাম- দেখলাম যে, ছাত্ররাজনীতির ভেতরে অসহিষ্ণুতা ও এক ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পূর্বে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন যেমন আওয়ামী ছাত্র সংগঠন ওপর হামলা করত, স্বাধীনতার পরে দেখা গেল, আওয়ামী-ছাত্রলীগ আর জাসদ ছাত্রলীগ দুটো ভাগ হওয়ার পরে গোলাগুলি মারামারি এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চরমভাবে চলতে লাগল। এটা এমন ভাবে ছড়িয়ে গেল যে, মুহূর্তের ভিতর সারাদেশব্যাপী এর সাথে যুক্ত হলো আরো অনেকে। আমি তখন রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও এগুলো আমাকে ভীষণ পীড়া দিত। কিন্তু এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমরা সংগঠিত ছিলাম না। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে আমি একটি গুপ্ত সংগঠন করেছিলাম যারা দুর্নীতি করত, কালোবাজারি করত তাদের উপর আক্রমণ করতাম। যাদের দুর্নীতির প্রমাণ পেতাম তাদের সরাসরি আক্রমণ করতাম। কয়েকজন দুর্নীতিবাজের উপর কয়েকটা আক্রমণ করেছিলাম। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি জেনে যায়। আব্বা যেহেতু সরকারি চাকরি করতেন প্রশাসনের মাধ্যমে আব্বার কানে যায় যে, আমি এই কাজগুলো করছি। তখন আব্বা আমাকে বললেন যে, তুমি এই সংগঠন করা বাদ দাও অথবা বাসা থেকে চলে যাও। এরকম কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলে আমার (আব্বার) চাকরিতে সমস্যা হবে। বাসা থেকে গিয়ে কোথায় থাকবো? তাই সংগঠনটিই বাধ্য হয়ে বাদ দিলাম।
নুসরাত সুলতানাঃ কতদিন ছিল ওই সংগঠন?
মজিবর রহমান খোকাঃ এক বছর ছিল এবং এরমধ্যে কয়েকটা ছোটখাটো অপারেশন আমরা করেছিলাম।
নুসরাত সুলতানাঃ একটা অপারেশন বিস্তারিত বলবেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ না ( মৃদুহাসি)। ওটা না বলাই ভালো। ওটা গোপন ছিল গোপনই থাক।
নুসরাত সুলতানাঃ সেই বন্ধুরা এখন কোথায় আছে?
মজিবর রহমান খোকাঃ সেই বন্ধুরা রাজনীতিতে হাই প্রোফাইলে চলে গেছে। মন্ত্রী হয়েছেন অনেকেই পরবর্তীতে।
নুসরাত সুলতানাঃ আপনি কত সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ ১৯৭৪ সাল।
নুসরাত সুলতানাঃ বাংলাদেশ তখন একটা স্টেজ অতিক্রম করছে মুক্তিযুদ্ধে কিভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমরা যখন মাধ্যমিক স্কুলে পড়ি, তখন রাজনীতিতে জড়িত ছিলাম না। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ইলেকশনের সময় মিটিং- মিছিল করছি,আনন্দ করতাম। কিন্তু নির্বাচনের পর যখন বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দিতে গড়িমসি করছে তখন আমরা সবাই খুব অস্থির হয়ে উঠলাম। তথাপি প্রতিরোধের বিষয়গুলো তখনও আমাদের মাথায় ছিল না। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাও ভাবিনি। একসময় না একসময় বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দেবেই এমনই ভেবেছি। যখন দিচ্ছে না এবং ২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধুকে এরেস্ট করে নিয়ে গেল এবং সারাদেশে নির্মম হত্যাকাণ্ড শুরু হলো, তখন নাটোরে গুজব ছড়ানো হল যে, নাটোরে বিহারী পট্টিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সিভিল ড্রেসে এসে জড়ো হয়েছে নাটোর আক্রমণ করার জন্য। তখন আব্বার কাছে বন্দুক ছিল। নাটোর মহাকুমা প্রশাসন থেকে মাইকিং করা হল, যাদের কাছে বন্দুক আছে তাদেরকে বিহারী পাড়ায় গিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদেরকে মোকাবেলা করার জন্য। তখন আব্বা গেলেন, আব্বার সাথে আরও কয়েকজন গেলেন। কয়েকজন পুলিশ ছিল। এরা সবাই মিলে গোলাগুলি করার পরে বিহারী পট্টি থেকে থেকে সাদা পতাকা ওড়ানো হলো। তারা বলল যে, আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণের পরে তাদেরকে নাটোর জেলে বন্দি করে রাখা হলো। ওই ঘটনা থেকেই আমাদের মনে হতে থাকে যে, এই ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেবে। বঙ্গবন্ধুর হাতে আর ক্ষমতা দেবে না। এরপর এপ্রিলের ১৪ তারিখের দিকে নাটোরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে। তার আগেই আমাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য শহর থেকে নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছিল। ১৪ তারিখে আমি, আব্বা আর আমার ছোট ভাই পাক বাহিনীর সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। সৌভাগ্যবশত সেদিন আমরা মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে আমরা হালদি নামক একটা জায়গায় চলে যাই সেখানে আব্বার সাইট অফিস ছিল।
এর ভেতরে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলো। আব্বা বললেন যে, আমরা দেশে চলে যাই আমি আর চাকরিতে যাব না। ওখান থেকে বড় একটা নৌকা ভাড়া করে আমাদের গ্রামের বাড়ি তেজখালী বাঞ্ছারামপুরে যাই। গুরুদাসপুর থেকে গ্রামের বাড়ি যেতে দশ দিন লেগেছিল আমাদের। নৌকায় যাওয়ার পথে আমরা দেখেছি কিভাবে শত শত মানুষ আর পশু-পাখির লাশ ভেসে যাচ্ছে পাক বাহিনীর গনহত্যায়! নদীর ধারের বাজারগুলো কিভাবে পুড়ে বিরান হয়ে গেছে! এগুলো দেখতে দেখতে আমরা বাড়ি যাই। বাড়ি গিয়ে সিদ্ধান্ত নিই যে, একটা কিছু আমাদের করতে হবে। যুদ্ধতো শুরু হয়ে গেছে আমরা জানতাম কিন্তু কিভাবে যুদ্ধে যাবো সেই পথটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মে মাসের ৩০ তারিখে আমাদের বাড়ির কাছের নদী তিতাস নদীর ঘাটে একটা নৌকা ভিড়েছিল। নৌকা থেকে কিছু লোক আর্মস, গোলা-বারুদ নিয়ে নেমেছিল। এটা দেখে সবাই ছোটাছুটি করে গ্রাম খালি হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়। তারা ডেকে বললেন যে, আমরা রাজাকার না পাকিস্তানি আর্মি ও না। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছি আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা আপনাদের এখানে কিছুদিন থাকব। রাজাকার বা পাকিস্তানি আর্মি হলে তারা গোলাগুলি করতে করতে আসত। তারা গোলাগুলি করেনি এবং একজন মুরুব্বীকে তারা ডাকছিলেন। ডেকে বললেন, এই বাসায় মুরুব্বি কে আছেন? একটু আসেন। তখন সবাই মোটামুটি আশ্বস্ত হয় যে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। এরপর আব্বা গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন। তাদেরকে ডেকে নিয়ে তিনি থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এর ভেতরে আমি আমাদের বাড়িতে ছিলাম না। আমি ছিলাম আমাদের গ্রাম থেকে দুই গ্রাম দূরে ফুপুদের বাড়িতে। খবর পেয়ে চলে আসলাম। তারপর তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তাদের দলনেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন জামান। আমাদের ঘরের ভেতরে একটা আলাদা রুমে উনারা খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম , আমি একটু আসবো? জামান সাহেব বললেন আসো। তারপর আমাকে গোলাগুলি, আর্মস দেখালেন। কোন আর্মস থেকে গুলি ছুড়লে কতটুকু যায়, মাইন, গ্রেনেড, ডিনামাইট আমাকে সবকিছু দেখালেন। আমি জানতে চাইলাম আমি কিভাবে যুদ্ধে যেতে পারি? ক্যাপ্টেন জামান বললেন তোমাকে যুদ্ধে যেতে হলে ভারতে যেতে হবে ট্রেনিং নিতে। আমি বললাম আমি ভারতে কোথায় যাব? কীভাবে যাব? ক্যাপ্টেন জামান বললেন এখানে কেউ একজন নিশ্চয় আছেন যিনি সুপারিশ করে দেন। তুমি খুঁজে বের করো। সুপারিশ নিয়ে যাও তাহলে ওখানে রিক্রুট ক্যাম্পে দিলে ওরা তোমাকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠাবে। খোঁজ খবর নিয়ে দেখলাম আমাদের বিষ্ণুরামপুর বাজারে একজন ডাক্তার আছেন। আমরা জানতাম না যে তিনি এই কাজটি করেন। তার নাম শামসুল ডাক্তার। তিনি কয়েকদিন পরপরই লোকজনকে এভাবে ভারত পাঠান। আমাদেরকেও পাঠিয়ে দিলেন। আমরা দশজন গেলাম। ওখান থেকে সিএনবি রোড আছে একটা।
সেই রোড পার হতে গিয়ে আমরা বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। পাকিস্তানি আর্মিদের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। তখনো দৈবক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম। কিছু অলৌকিক ঘটনা জীবনে ঘটেছে। বেঁচে গেছি বিভিন্ন দুর্বিপাক থেকে। কোনভাবেই বাঁচার কথা ছিল না। সামনে পড়ে গিয়েছি অন্যদেরকে গুলি করে মেরেছে কিন্তু আমাদেরকে দেখে ও হয়তো দেখেনি। তারপরে আগরতলা গিয়েছি। আগরতলা তিনদিন থেকে রিক্রুট করে আমাদেরকে আসামে পাঠিয়ে দেয়। আসামে লোহারবণ ট্রেনিং সেন্টার। ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হতো। তারা প্রথমে একমাস ট্রেনিং দিত। সেখান থেকে বাছাই করে অল্প কজনকে আরো দুই সপ্তাহ লিডারশিপ ট্রেনিং দিত। আমি লিডারশীপ ট্রেনিংটাও নিয়েছি। তারপর ওখান থেকে সিলেট জালালপুর সাব সেক্টর ওখানে দুই-তিন সপ্তাহ যুদ্ধ করেছি। এরপর ওখান থেকে ফিরে আগরতলা হয়ে আবার আমাদের বাঞ্ছারামপুর থানায় ফিরে ওখানে যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত।
নুসরাত সুলতানাঃ এমন কোন স্মৃতি আছে যা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায় বা আপনি ঘুমের ভেতরেও চমকে ওঠেন বা একা যখন থাকেন ওই স্মৃতিতে অবগাহন করেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ স্মৃতি তো অনেক আছে কিন্তু আমার একটা ব্যর্থ স্মৃতি আছে। ব্যর্থ স্মৃতি হচ্ছে, আমরা যখন বাঞ্ছারামপুরে এলাম আমাদের কোম্পানিতে একটা এলএমজি ছিল না। আমি যখন সিলেটে যুদ্ধ করেছি তখন আমি সেকশন কমান্ডার ছিলাম। বাঞ্ছারামপুরেও আমি সেকশন কমান্ডার ছিলাম কিন্তু সিলেটে সেকশন কমান্ডার থাকাকালীন সময়ে এলএমজি ছিল। বাঞ্ছারামপুরে ছিল সেল্ফ লোডিং রাইফেল বা এসএলআর। একারণে যুদ্ধ করার জন্য ভালো অস্ত্র ছিল না। ভালো অস্ত্র না থাকলেতো যুদ্ধ করা যায় না। সিলেটে ভালো অস্ত্র ছিলো। বাঞ্ছারামপুরে একশো বিশজনের জন্যও একটা এলএমজি ছিল না। যেখানে সিলেটে প্রতি দশজনের জন্য একটা করে এলএমজি ছিল। বাঞ্ছারামপুরে আমাদের এসএলআর ছিল তাও একটা কোম্পানিতে মাত্র ষোলটা এসএলআর। ও দিয়ে তো আসলে যুদ্ধ হয় না কিন্তু আমার মনোবল ছিল প্রবল। যুদ্ধ করব এই তাড়নায় যুদ্ধ করে গেছি রাইফেল আর এস এল আর দিয়েও ওদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে ঘায়েল করেছি, মেরেছি এবং আহত করেছি। তাদের থানা কম্পাউন্ড থেকেই বেরোতে দেইনি এরকমভাবে ঘিরে রেখেছিলাম। ওটা ছিল প্রবল সাহস এবং মনোবলের ফল। এভাবেই ভেবেছি যে, যুদ্ধ যখন করতে এসেছি যুদ্ধই করব। একদিন আমরা দেখলাম আমরা যখন যুদ্ধ করে ফিরে আসছি তখন ওরা লাইন দিয়ে মার্চ করে আসছিল। আমার কাছে যদি এলএমজি থাকতো তাহলে আমি নিশ্চিত থাকতাম যে, আমি বিজয় অর্জন করব। আমার হাতে আছে এসএলআর। এসএলআর দিয়ে এক রাউন্ড করে গুলি হয়। এলএমজির মত ব্রাশফায়ার হয়না। আমার দরকার ব্রাশফায়ার একসাথে সবগুলোকে টার্গেট করা। তখন আমার মনে পড়েছিল ট্রেনিংয়ের সময় বলেছিল, যদি এসএলআর দিয়ে ব্রাশফায়ার করতে হয় তাহলে সেপটিপিন খুলে নিতে হবে। আমি কোনদিন এসএলআর দিয়ে ব্রাশফায়ার করিনি। সেদিন সেপটিপিন খুলে ফেলেছি। বেশিক্ষণ গুলি হবে না কিছুক্ষণ হওয়ার পর আমার ব্যারেল মানে যেটা দিয়ে গুলি বের হয় সেটা বাঁকা হয়ে যেতে পারে। তবুও আমি রেডি আমার রেঞ্জের ভিতরে চলে আসছে। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম একসাথে কয়েকটা গুলি বের হওয়ার পর আর বের হবে কিনা জানিনা । ভেবেছিলাম যেভাবে হয় সেভাবেই আক্রমণ করব। কিন্তু ওরা আগায়নি, ফিরে চলে গেছে। ওই যে ফিরে চলে গেছে। ওই ফিরে চলে যাওয়াটাই আমার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং ব্যর্থ হওয়ার স্মৃতি। সামনে যে ছিল সে ক্যাপ্টেন ছিল যদি তাকে মারতে পারতাম আরো কয়েকজনকে মারতে পারতাম তাহলে একটা বড় অর্জন হত। এই ব্যর্থতাই আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়।
নুসরাত সুলতানাঃ যুদ্ধ করতে গিয়ে যারা সহচর বা বন্ধু তাদের সাথে একটা অন্যরকম আত্মিকতা তৈরি হয়। বাবা-মা-ভাই-বোনের চাইতে অনেক সময় তারা আপন হয়ে ওঠে। সঙ্কটের সময়টাতে তারা যেন আত্মার মানুষ হয়ে ওঠে। এরকম কোনো সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ। সেটা তো মনে পড়ে। যেহেতু আমি কমান্ডার ছিলাম দশজনের, আমরা চারজনই সবসময় একসাথে থাকতাম। তারা সবসময় আমার কাছে থাকতো আমাকে খুব সাহায্য করত জীবন-মরণের যুদ্ধগুলো একসাথেই করতাম। ও সময় মনে হতো ওরাই সবচেয়ে কাছের ওরাই সবচেয়ে আপন। অনেকে দেশ ছাড়া হয়েছে। যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে সেই দেশ থেকেই তাদের বিতাড়িত করে দেয়া হয়েছে। যে আমার সাথে সব সময় যুদ্ধ করেছে সে এখন আর এই দেশে নেই। ইন্ডিয়াতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে কিংবা যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে সে গ্রামের সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে ঢাকায় বসবাস করছে। গ্রামে থাকা সম্ভব হয়নি। এটা খুবই বেদনাদায়ক।
নাহিদা আশরাফীঃ মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন কিন্তু এই যুদ্ধে নিরস্ত্র যোদ্ধা যারা সবকিছু হারিয়েছে,তারা সবাই সাধারণ মানুষ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই সাধারন যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা কতটুকু সম্মান দিতে পেরেছি বলে মনে করেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ বিষয়টা হলো যে এই যে, একটা জনযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে সেটাতে অংশগ্রহণ করেছে কারা? কৃষক, শ্রমিক, মজুর, ছাত্র। একদম খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ। অংশগ্রহণ করেছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। উচ্চবিত্তরা এখানেই ছিল তারা বলেছে আমরা যদি চলে যেতাম তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিত কে? এটা ছিল উচ্চবিত্তদের একটা অজুহাত। এই যে উচ্চবিত্তরা রয়ে গেল আর যারা যুদ্ধ করে যারা ফিরল তাদের কাছ থেকে পুরো দেশটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা। এইযে রিলিফ চুরি, কালোবাজারি, ব্যবসায় ব্রিফকেস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি সবকিছু মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরাই করেছে। তারাই করেছে যারা পাকিস্তান আমলের সুযোগ সুবিধা নিয়েছে যারা সরকারি চাকরি করেছে। আমার আব্বা সরকারি চাকরি করতেন কিন্তু তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। তিনি গ্রামের বাড়ি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন জামান সাহেব কয়েকবার এসেছেন। জামান সাহেব ইন্ডিয়াতে গিয়ে বলেছেন, ওই ইসমাইল হোসেন সাহেবের বাসাটা নিরাপদ। তারপরও বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং করে এসে আমাদের বাড়িতে থেকেছেন। আব্বা সরকারি চাকরিতে যোগ দেন নাই কিন্তু যারা সরকারি চাকরি করে গেছেন তারা আব্বার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আব্বার অধীনস্থ অফিসাররাই আব্বার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। আব্বা মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্রয়দাতা হিসেবে খ্যাতি বা পদক তো দূরের কথা যে প্রাপ্য সম্মানটুকু পাবার তাই পাননি তিনি!
নুসরাত সুলতানাঃ দুইটা অফট্র্যাকের প্রশ্ন আছে আমার। একটা হচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে আমরা শুনেছি যে, সিক্সটিন ডিভিশন মুক্তিযোদ্ধা যারা ডিসেম্বরের পর বন্দুক গুলি কুড়িয়ে নিয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিয়েছে। আপনার জানামতে এরকম কাউকে আপনি দেখেছেন বা আপনার অভিজ্ঞতা আছে দেখার?
মজিবর রহমান খোকাঃ সিক্সটিন ডিভিশন তো পরের কথা এখন টুয়েন্টি ডিভিশন চলছে । এখন আপনি ইচ্ছা করলে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন। আপনি যদি বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করেন, মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিতে পারবেন।
নুসরাত সুলতানাঃ আরেকটা বিষয় জানতে চাই খোকা ভাই। আমার জন্ম ১৯৭৮ সালে। খুব ছোটবেলায় বিটিভিতে একটা মুক্তিযুদ্ধের নাটক দেখেছিলাম, নাম মনে নেই। আর সেখানে দেখাচ্ছিলো একটা চরিত্র বলছে, যদি মুক্তিযুদ্ধে যাই তাহলে সচিব হব, ব্যাংকের চেয়ারম্যান হব বা যেকোন ভাবে ওপারে গিয়ে নামটা লেখালেও আরাম আয়েশ করে থাকলেও চলবে। এই যে বিষয়গুলো কেউ – কেউ নিজের দেশ, মাটি আর মানুষকে ধারণ করে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে । কিন্তু তারা হচ্ছে নিম্নবিত্ত মানুষ -শ্রমিক, মজুর, দিনমজুর তারা। কিন্তু যারা উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ করেছে। এই হিসাব-নিকাশের ব্যাপারটা আপনারা তখন কতটা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ আসলে আমি যে এলাকায় গিয়েছি আগরতলায় সেখানে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট দেখেছি। সেই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ফেরার পথে আমি শরণার্থী শিবিরের পাশে বেশ কয়েকদিন ছিলাম। সে সময় দেখেছি কত অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের ভিতর তারা দিনাতিপাত করছে। যারা এখান থেকে গিয়েছিলো অনেকের আত্মীয় স্বজন ওখানে ছিল। তারা ভেবেছিল আত্মীয়-স্বজনরা তাদেরকে আশ্রয় দিবে কিন্তু আত্মীয়-স্বজনদেরও তো উপার্জনের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। একেক পরিবারে হয়তো চার-পাঁচ জন মানুষ আছে। তাদেরকে কতদিন, কতমাস আশ্রয় দেয়া সম্ভব? ওইযে উচ্চবিত্তদের চিন্তাভাবনা এখান থেকে জীবন নিয়ে চলে যাওয়া এবং ওখানে আরাম-আয়েশে থাকা সেটা তো কিছুটা ছিলই। উচ্চবিত্তদের ব্যাপারটা হচ্ছে তারা সরকারের ছায়াতলে থাকার চেষ্টা করেছে এবং সরকারের কোনো কিছুর সাথে তারা জড়িত ছিল না। তারা চিন্তা করেছে সরকারের সাথে থাকলে দেশ স্বাধীন হলে তারা বেশ লাভবান হবে এবং হয়েছেও। আরেকটা ব্যাপার হয়েছে প্রবাসী সরকারের যে দলিলগুলো ছিল সেই দলিলগুলো এরাই ধ্বংস করেছে। এই দলিলগুলো পেলে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক কিছু জানাতে পারতাম। প্রবাসী সরকারের আর কোন ডকুমেন্টস পাওয়া যায়নি একটা অফিসের তো প্রচুর কাগজপত্র থাকে। সেসব কিচ্ছু পাওয়া যায়নি।
নুসরাত সুলতানাঃ যতটুকু প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন মূলধারা ৭১ আর একটা বই আছে উপধারা ৭১ সেসব বইয়ে আমরা দেখতে পাই যে, এই নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা, নেতৃত্ব দেয়া, সেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন তাজউদ্দীন আহমেদ। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ যেহেতু বঙ্গবন্ধু নেই। কাউকে তো দায়িত্ব নিতে হবে। যেটা হয় সব পলিটিক্যাল পার্টির ভেতরেই একটা দ্বন্দ্ব থাকে, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এখানেও ছিল কিন্তু তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন নির্লোভী একজন ব্যক্তি । উনি ওনার নিঃস্বার্থপরতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে এই যুদ্ধটাকে বেগবান করতে চেয়ে ছিলেন এবং উনি পেরেছেন। অন্য কেউ হলে হয়তো কোন সমস্যা হলেও হতে পারতো কিন্তু তাজউদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে যুদ্ধটাকে সফলভাবে সমাপ্তির দিকে টেনে এনেছেন। আমরা যদি বলি এটার জন্য আশিভাগ অবদান তাজউদ্দিনের আহমেদের একার সেটা খুব অমূলক হবে না।
নুসরাত সুলতানাঃ কখন শুনেছিলেন দেশ স্বাধীন হয়েছে? কী করছিলেন তখন? শোনার পর কেমন লেগেছিল? কী করেছেন বিজয় অর্জিত হয়েছে শোনার পর?
মজিবর রহমান খোকাঃ বাঞ্ছারামপুর থানার উজানপুর যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে কয়েকদিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি তেজখালী আসি। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে আমরা নিশ্চিত হই শীঘ্রই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। ১৫ ডিসেম্বর রেডিওতে শুনতে পাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এতটাই আনন্দিত হয়েছিলাম যে, তা কখনোই প্রকাশ করা যাবে না। তবে বাঞ্ছারামপুর থানায় অবস্থানরত পাকবাহিনী আত্মসমর্পনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে লঞ্চযোগে পালাতে চেষ্টা করে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে তারা বাধ্য হয়ে নিলচর নামক স্থানে লঞ্চ ভিড়ায় সেখানে আমাদের গুলিতে পাঁচজন পাকসেনা নিহত হওয়ার পর পিছু হটে এবং ঘাগুটিয়া নামক গ্রামে আশ্রয় নেয়। ইতিমধ্যে আমি যুদ্ধ ক্ষেত্রে ফিরে যাই এবং আমার সহযোদ্ধাদের সাথে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধ করে হানাদারদের অবরোধ করে রাখি। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী এসে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করায়। সেই আনন্দ ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অংশ !
নুসরাত সুলতানাঃ অনেক ধন্যবাদ খোকাভাই আমরা আশা করব আপনার জীবনের এই অংশটুকু এই মুক্তিযুদ্ধের যে অধ্যায়টা এটা অন্তত আপনি বিস্তারিতভাবে লিখবেন এবং আমরা একসময় আপনার কাছ থেকে এটা পাব।
মজিবর রহমান খোকাঃ চেষ্টা করবো।
নুসরাত সুলতানাঃ ৭৫ এর ১৫ ই আগষ্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ব্যপারে কখন শুনেছিলেন? শোনার পরে কী ভাবছিলেন? আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপনি এবং আপনার অন্যান্য সহযোদ্ধারা কীভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ ১৫ আগস্ট আমি রাজশাহী ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা ঐদিন সকালে রেডিওতে বিভৎস খবরটি শুনি ! আমরা প্রথমে প্রোপাগান্ডা ভেবেছিলাম। বিশ্বাস করিনি। পরে শহরে বেরিয়ে সত্যতা নিশ্চিত হই। আমরা দেখে বিস্মিত হয়েছি, জাতির জনককে হত্যা করা হলো অথচ লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ নেই, প্রতিবাদ নেই I হাসি তামাশা করছে ভেবেছিলাম, আওয়ামীলীগ , সামরিক বাহিনী বা রক্ষী বাহিনী রাস্তায় নামবে। না ! কেউ নামেনি। আমরা কারো কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনাও পাচ্ছিলাম না ! কিংকর্তব্য হয়ে রেডিওতে বিশ্বের খবরা-খবর শুনছিলাম ! এভাবেই আমরা অন্যায়কে মেনে নিতে বাধ্য হলাম ! পঁচাত্তর পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রের চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়।
নুসরাত সুলতানাঃ অন্য প্রশ্নে যাচ্ছি এই যে মেয়ে বন্ধুদের সাথে মেশার সুযোগ পেলেন বিশ্ববিদ্যালয় এসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বুঝলেন যে, মেয়ে বন্ধুদের সাথে মেশা যায় কথা বলা যায়, গল্প করা যায় এর ভেতর প্রেম -দাম্পত্য -সংসার কিভাবে শুরু হল?
মজিবর রহমান খোকাঃ এটা একটা ভালো ব্যাপার। যখন নারীদের সাথে মেশা শুরু হল তখন আমি প্রাপ্তবয়স্ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যারা অনাবাসী ছাত্র ছিল তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাসগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে আসত। যারা আবাসিক ছিল তারা তো হলেই থাকত। আব্বা যেহেতু সরকারি চাকরি করতেন রাজশাহী স্টেডিয়ামের পাশে আমাদের সরকারি কোয়ার্টার ছিল, ওখানে বর্ণালী নামের একটা বাস যেত। এরকম বিভিন্ন রুটের সময় মেনে বিভিন্ন বাস যেত। ওই সময় তো ট্রাফিক জ্যাম ছিল না। কখন বাস আসবে কখন গেলে আমরা ক্লাস ধরতে পারব এই বিষয়গুলো আমাদের জানা ছিল। আমি যখন সকালে ঐ বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতাম আরেকটা মেয়ে এসে অই স্ট্যান্ডে দাঁড়াত। মেয়েটি ইংলিশ বিভাগে পড়তো। আর আমি মনোবিজ্ঞানে পড়তাম। ওখানে আরো অনেকে আসত। আরো মেয়ে ছিল কিন্তু প্রায় সব ছেলেরা ওই মেয়েটার দিকে তাকাতো আর আমার সাথে বেশি চোখাচোখি হত। তো স্বাভাবিকভাবেই একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। এর আগে কোনো মেয়ের সাথে কথা হয়নি, দেখা হয়নি,সেভাবে চোখাচোখি হয়নি। মনে হল যে, ঠিক আছে একদিন কথা বলব। তারপর কয়েকদিন যাবার পরে আমি দেখলাম যে, বাসস্ট্যান্ডে কেউ নেই, ও আর আমি একা। আমি ওকে বললাম যে, আপনার সাথে একটু কথা আছে। মেয়েটি বলল বলেন। আমি বললাম না এখন না বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে ক্লাস শেষে বলব। বলল ঠিক আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কয়টার সময়? মেয়েটি বললো, বারোটার পরে। বারোটার পরে ওর বিভাগে গিয়ে দেখলাম কেউ নেই। ক্লাস শেষ করে মেয়েটির ক্লাস রুমে একা বসে আছে। সে আমাকে দেখে ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল বলেন। এমন ভাবে তাকিয়ে বলেছে বলেন, আমার ভেতরের সব সাহস শেষ! ও মুচকি হেসে বলছে বলেন। আমি বললাম যে আচ্ছা আরেকদিন বলব যাই। ও বলল না, যা বলার আজকেই বলতে হবে। আরেকদিন বলার সুযোগ দেব না। মানে ও জানত যে, আমি কি বলতে চেয়েছি। আমি বললাম যে আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক আছে বলে আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে এসেছি। আর ওর সাথে দেখা করিনি সহজে। হয় আমি আগে চলে যেতাম না হয় পরে যেতাম। ওর মুখোমুখি আর কোনোদিন হইনি। এই হচ্ছে প্রেম।
নুসরাত সুলতানাঃ তারপর দাম্পত্য সঙ্গী হিসাবে কিভাবে কাকে পেলেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ স্ত্রীর নাম নাসরিন সুলতানা। দাম্পত্য একেবারেই পারিবারিকভাবে। যখন আমি কাবিনে সই করছি তখনও আমি জানিনা কাকে বিয়ে করছি।
নুসরাত সুলতানাঃ বাহ! ওই যে না বলা কথা আর বলা হলো না। সেই পাষাণী মেয়েটির নাম কী?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমরা একেকজনকে একেক নাম দিতাম কাউকে বর্ণালী, কাউকে অলকা, কাউকে কল্পনা । একেকজন একেক বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠত তাকে সেই নাম দিতাম। আসল নাম আমরা ওদের ভুলেই গিয়েছি। যে যে স্ট্যান্ড থেকে উঠত তাকে সেই নাম দিতাম। যেমন কল্পনা একটা সিনেমা হল হয়েছিল ওখান থেকে যে উঠত তার নাম ছিল কল্পনা এমন আর কি!
নুসরাত সুলতানাঃ অই দৃষ্টি আপনাকে তাড়া করে ফেরে কখনো?
মজিবর রহমান খোকাঃ না, আমার কাছে মনে হয় যে, আরো আগে থেকে যদি মেয়েদের সাথে মিশতে পারতাম তাহলে হয়তো সেদিন কথাটা বলতে পারতাম। যখন বলেছে, বলেন, তখন আমার সমস্ত সাহস শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি যে যুদ্ধ করেছি পাকবাহিনীর যুদ্ধের সামনে এত ভয় পাইনি, এত নার্ভাস হইনি যতটা ওর দৃষ্টির সামনে আমি হয়েছি!
নুসরাত সুলতানাঃ আচ্ছা বুঝতে পারলাম নারীদের ক্ষমতা ব্যাপক। নারীর একদৃষ্টিতে অনেক কিছু ভষ্ম হয়ে যায়। তো সন্তান-সন্ততি কতজন?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমার দুই মেয়ে এক ছেলে।
নুসরাত সুলতানাঃ দাম্পত্যের কত বছর?
মজিবর রহমান খোকাঃ ২৫ বছর। খুব একটা খারাপ না কিন্তু ভুল চিকিৎসার কারণে স্ত্রী পরলোকগত হয়েছেন।
নুসরাত সুলতানাঃ কত সালে মারা গিয়েছেন উনি?
মজিবর রহমান খোকাঃ ২০০৫।
নুসরাত সুলতানাঃ এবার অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই আপনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। সদ্য জন্ম নেয়া স্বাধীন দেশ। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের প্রচুর সম্ভাবনা সেইসব সম্ভাবনা রেখে বিদ্যাপ্রকাশ কেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ আসলে তখন আমি প্রচুর গান গাইতাম। যখন আমি গান শুরু করি নাটোরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একমাত্র শিল্পী ছিলাম আমি। যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি গান গাইতাম। নাটোরের অনেকে জানে, আমি এখনো গান গাই। আমি আর গাইনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর গানের চর্চা ছিল। একসময় ভেবেছিলাম গানটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করব। তখন এন্ড্রো কিশোর আর আমি একসাথে বাসে আসা যাওয়া করতাম। প্রায় চোখাচোখি হতো কিন্তু কখনো কথা হতো না। কিন্তু আমি জানতাম যে ও খুব ভালো গান গায়। ও যখন পেশা হিসেবে নিল তখন আমিও ভাবলাম আমিও তো নিতে পারি। এজন্য আমার মনে হয়নি যে আমি সরকারি চাকরি করব। যদিও আব্বা সরকারি চাকরি করতেন। আব্বা ঢাকা বদলি হয়ে আসলেন আমরা শাজাহানপুরের বাড়িতে উঠলাম। তখনো মনে হয়েছে যে, গানের চর্চা করি আর চাকরি বাকরি যদি কিছু হয়। বিটিভিতে দু’বছর গান গেয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ করে আমার বড় দুলাভাইয়ের রাজশাহীতে একটা বুকশপ আছে, নাম আলীগড় লাইব্রেরী। তিনি আমাকে বললেন যে, ঢাকায় একটা শোরুম নিব তুই কদিনের জন্য থেকে আমাকে একটু হেল্প কর। আমি বললাম যে, আমি তো জানি না কিভাবে কী করব? বইয়ের কাজ আমি জানিনা। উনি বললেন কিছুই করতে হবে না তুই শুধু টাকা নিবি। আমি বললাম মেমো তো আমি করতে পারিনা। কীভাবে কোন বইয়ের মেমো করতে হয়? বইয়ের দাম আবার কনভার্ট করতে হয়। ডলার থেকে, পাউন্ড থেকে, ভারতীয় রুপি থেকে টাকায়। ওটা আমার কাছে খুব জটিল লাগত। আমি বললাম যে এটা তো খুব কঠিন কাজ। যেহেতু বড় দুলাভাই বলেছেন আব্বা বললেন হেল্প করতে । যেতে যেতে যেতে এক সময় শিখে ফেললাম। তারপর দেখলাম যে বাংলা একাডেমি বইমেলা হবে। ১৯৭৭ এ বইমেলাতে অংশগ্রহণ করলাম। দুলাভাইয়ের দোকানের নামে অংশগ্রহণ করলাম তখন দেখলাম যে, প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। পাশে বাংলাদেশি বইয়ের দোকানগুলো আছে সেগুলোতে বিক্রি নাই। কারো হয়তো অল্প কিছু বিক্রি হচ্ছে আবার কারো একদম হচ্ছে না। কিন্তু পাশে আলীগড় লাইব্রেরী তে প্রচুর ভিড়। কারণ হচ্ছে আলীগড় লাইব্রেরীতে প্রচুর ভারতীয় বই আছে এবং ভারতীয় বই বিক্রির কারণ হচ্ছে তাদের উন্নত মানের ছাপা এবং বাঁধাই। তাদের বইয়ের ঝকঝকে ছাপা পরিচ্ছন্ন কাভার। তখন ব্লকে কাভার করতাম আমরা। ব্লক ডিজাইন জিংক দিয়ে দিয়ে কাভার করতাম। এটাতে ঠিক মত ইফেক্ট আসতো না। তখন আমার মনে হল যে, বাংলাদেশে তো এভাবে করা যায়, বাংলাদেশের করেনা কেন? কিন্তু বাংলাদেশে আসলে মেশিনারি ছিলনা। ইন্ডিয়া যেভাবে অ্যাডভান্স হয়ে গিয়েছিল প্রিন্টিংয়ে আমরা তখনও সেভাবে অ্যাডভান্স হতে পারিনি। তখন চিন্তা করলাম, প্রকাশনা করব। দেশে এত পাঠক অথচ প্রকাশনার এই দীনতা!
আরও পরে আমি কিছু বই করলাম। এগুলো ছিল সম্পাদিত বই। প্রেসকে বললাম যে, আমাকে হ্যান্ডকাস্ট্রী যে টাইপগুলো দিবেন একটা টাইপও ভাঙ্গা দিবেন না। সবগুলো দিবেন নিট এন্ড ক্লিন। বলল যে এটার জন্য খরচ বাড়বে। আমি বললাম,বাড়ুক অসুবিধা কী? আমি একটা টাইপও ভাঙ্গা নেবো না। কোন একটা রশিকার যদি ভাঙ্গা থাকে, ওটা মেশিনে রানের পরে কিছু কিছু ক্ষয় হয়ে যেত সীসাগুলো। তখন দেখা যেত যে, উ কার না ঊ কার বোঝা যায় না। এরকম হয়ে যায় ঘর্ষনে ঘর্ষনে। এগুলো অনেকবার ইম্প্রেশনে দিত। আমি বল্লাম যে, আমার জন্য নতুন ফন্ট কিনে আনতে হবে। ফন্ট কিনে তারপর আমাকে এই বই করে দিতে হবে। প্রেস বলতো যে, খরচ বাড়বে। আমি বল্লাম বাড়ুক আমি খরচ দেব। ওই যে শুরু, অই যে নিটনেসটা শুরু করলাম সম্পাদিত বইয়ের ছাপাটা দিয়ে প্রথমে, তারপর আর থামিনি। তারপর অফসেট মেশিন খুঁজে বের করলাম। বনগ্রাম কাপ্তান বাজারের পরে। ওখানে গলির মধ্যে প্রথম একটা অফসেট মেশিন পাওয়া গেল। এই প্রথম পুরান ঢাকায় অফসেট মেশিন আনা হল নতুন ঢাকাতে আছে সেগুলো বই ছাপার জন্য ব্যবহৃত হতো না। ওরা এনেছিল ওদের দাপ্তরিক কাজ করার জন্য। পরে ওখান থেকে আমি কাভার করলাম–চমৎকার কাভার হল। এরপরে তো শুরু হয়ে গেল। আমি যখন ১৯৮৪ সাল থেকে পুরোদমে শুরু করলাম বিদ্যাপ্রকাশ তখন এইখানে এই সোনারগাঁ রোডে ইস্টার্ন প্লাজার সামনে একটা নতুন প্রেস হয়েছিল নাম প্রকাশ প্রিন্টিং প্রেস। সেখানে খুব ভালো প্রোডাকশন হচ্ছে। আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করে কাজ শুরু করি তার আগে অফসেটে কিছু কাজ করেছি। ফটো কম্পজে কাজ করেছি। এরপর পুরোদমে কাজ করেছি। তখন কলকাতার আনন্দ পাবলিশারের বাদল বসু বললেন যে, আপনি তো ঠেলাগাড়ি থেকে রকেটে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে! তারা এতটাই প্রশংসা ও সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। বইগুলো কম্পিউটার কম্পোজে করেছি, ফটো কম্পোজে করেছি। ফটো কম্পোজ হচ্ছে ফটো থেকে স্ন্যাপ নেয়া। টাইপ থেকে স্নাপ নেয়া নিটনেস কাকে বলে! ফটো কম্পোজে প্রচুর খরচ হতো। একটা বইয়ের খরচ দিয়ে দুই তিনটা বই করা যায়।
নুসরাত সুলতানাঃ আমরা যতদূর জানি যে আপনি একজন লেখক। প্রকাশনা জগতে এসে লেখক সত্তাকে কী বঞ্চিত করেছেন? লেখালেখি বিঘ্নিত হয়েছে?
মজিবর রহমান খোকাঃ না। আমি লেখালেখি কখনো করিনি। রচনাও লিখতে পারতাম না ক্লাসে। গরু রচনাটাও ঠিক মতো লিখতে পারতাম না। সুতরাং সে দিক থেকে আমি লেখক কোনদিনই না। একটাই আমার পরিচয় সেটা হলো আমি গায়ক। আমি গান গাইতাম এবং গানই আমার জীবনের সাধনা ছিল। গান গাওয়াটা ব্যাহত হয়েছে এবং আরো অনেকগুলো কারণে ব্যাহত হয়েছে। শুধু প্রকাশনায় আসার কারণে ব্যাহত হয়নি আরো অনেক কারণেই সমস্যা হয়েছে। ওস্তাদ ছাড়াই আমি গান শিখেছি এবং গান গেয়েছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। একটা টু-ইন-ওয়ান আব্বা কিনে দিয়েছিলেন। সেই টু ইন ওয়ানে গান রেকর্ড করে শুনেছি এবং হুবহু কিভাবে গান তোলার চেষ্টা করেছি এবং পেরেছি। কিন্তু গলাটা ধরে রাখার জন্য যখন আমি ক্লাসিক শিখতে চেয়েছি। গলাটা ধরে রাখার সেই চেষ্টা হিসেবে ক্লাসিক শেখার জন্য আমি বাফা তে ভর্তি হয়েছি। সেটা ১৯৭৭ এর দিকে। ভর্তি হওয়ার পরে ক্লাসের প্রথম এক বছর খুব ভালোভাবে পাস করলাম। সেকেন্ড ইয়ারে এসে দেখলাম যে, শুধু ক্লাস করলে হবেনা ভালো করে কারো কাছে শিখতে হবে। আমার ওস্তাদ ছিলেন শাহজালাল ইমনি। আমি তাকে বললাম ওস্তাদজী আপনি যদি আমাকে একটু আলাদা করে শিখিয়ে দিতেন। তিনি বললেন যে, বাফায় দুটো শাখায় ক্লাস নিয়ে আমি সময় পাই না। আমি বললাম যে, রাতেও যদি হয়। তিনি জানালেন, রাতে হলে সময় দিতে পারব। তখন বাংলা বাজারে দোকান বন্ধ করে ওস্তাদজীর কাছে গিয়ে সপ্তাহে দুইদিন গান শিখতাম। হঠাৎ করে ওস্তাদজী মারা গেলেন। উনি খুব ভালো, ভদ্র আর এবং সুন্দর ছিলেন! তিনি কোনো নেশা করতেন না, শুধু পান খেতেন। তার এত ভক্ত ছিলাম যে, তিনি মারা যাওয়ার পরে গানের ধারেকাছেও আর যাইনি। ওই যে গান ছেড়েছি সেটাও প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। তো লেখালেখিটা আসলে কঠিন কাজ এটা আমি জানি। প্রকাশনায় আসার পর আমার প্রকাশনা থেকে যতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে প্রায় সবগুলো বই তিনবার করে প্রুফ দেখেছি এডিটিং করেছি। আমি দেখেছি যে লেখালেখি প্রকৃতপক্ষেই খুব কঠিন কাজ। আমি যা লিখি এগুলোকে লেখা বলে না। এটা আসলে যখন যা মনে আসে বন্ধুদের সাথে এক ধরনের শেয়ার করা। তবে বাচ্চাদের জন্য একটা বই লিখে ছিলাম। বাচ্চারা তো পড়তে পারেনা তাদেরকে গল্প শোনানোর মত করে লিখেছিলাম। ওই গল্পটা পড়ে যেন তাদের ভেতরে মনণশীলতা গড়ে ওঠে সেভাবে লিখেছিলাম। ওই বইটা খুব ভালো বিক্রি হয়েছে। ওই বইটা বের করেছিলাম একটু বড় সাইজের বই। ওই বইটার নাম ছিল “জন্মদিনের বেলুন”। ওই বইটা দেখে পরবর্তীতে সৈয়দ শামসুল হক,হুমায়ুন আহমেদ, লুৎফর রহমান রিটন,আহমেদ মাজহার, হাসান হাফিজ হুমায়ুন আজাদ সহ আরও অনেকে ওরকম বই প্রকাশ করেছিলেন।
নাহিদা আশরাফীঃ খোকাভাই একটা প্রশ্ন। প্রকাশনা কী আসলে বাণিজ্য নাকি শিল্প?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি কখনোই প্রকাশনাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিনি। ভেবেছি এই প্রকাশনাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে শুধু দেশ না, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতায়ও। আমি প্রথম থেকে দেখেছি বাংলাদেশের কোন বই কলকাতায় যায় না। আমি ৯৪ থেকে কলকাতা বইমেলায় অংশগ্রহণ করি। তার আগে ৯৩ তে কলকাতা থেকে একজন প্রকাশক আমাদের দেশে এসেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের বইমেলায় আমার বইগুলো কী আপনাদের স্টলে রাখতে পারবেন? ওই প্রকাশক বললেন, আপনাদের লেখকদের ওখানে কোনো পাঠক চেনে না। শুধু জসীমউদ্দীন আর শামসুর রাহমান ছাড়া কোনো লেখককে চেনে না। তখন এই বিষয়টা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল, খুব বেদনাদায়ক ছিল আমার কাছে ব্যাপারটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন চেনে না? প্রকাশক বললেন যে, আপনারা তো যান না। অথচ কলকাতার এমন কোন লেখক নাই যে লেখকের নাম বাংলাদেশের পাঠকরা চেনে না এবং তাদের বই পড়ে না। তখন আমি বললাম যে, আপনাদের সমস্ত লেখকদের নাম আমরা জানি। আপনাদের পাঠকরা কি খোঁজখবর নিয়েও লেখকদের বইয়ের নাম জানতে পারেনা? তিনি বললেন, বই না থাকলে কীভাবে লেখকদের নাম জানবে? তখন আমি কলকাতা বইমেলায় যাওয়া শুরু করি এবং আজকে যে পাঠক তৈরি হয়েছে তার গোড়াপত্তন আমি করেছি। এটা ছিল পেশাদারিত্বের বিষয়। আমি কি পেশা হিসেবে নিয়েছি, না অন্য হিসাবে নিয়েছি। ব্যবসা হিসেবে নিলে কলকাতা বইমেলায় যে খরচটা হয়েছে সে খরচটা আমি নিজের গাঁটের পয়সায় করেছি। আমার প্রকাশনার লাভ যা হয়েছে তা তো গেছেই আরও পুঁজি সহ গেছে। আমি চেয়েছি যে ওখানে আগে পাঠক ধরতে হবে পাঠক তৈরি করতে হবে। ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য আমাকেই প্রথমে নামতে হয়েছে। আমি না করে অন্যরাও করতে পারত। যেটা আমি পরেও দেখেছি। অন্যরা যেটা করতে পারত সেটা করে না তাদের প্রচুর টাকা পয়সা আছে। পেশা হিসেবে আমি প্রকাশনাকে নিয়েছি বটে কিন্তু এটাকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিস্তৃত করার জন্য কাজ করেছি।
নাহিদা আশরাফীঃ আমার প্রশ্ন কিন্তু এটা ছিল না মূলত পেশা হিসেবে তো আপনি অবশ্যই নিবেন। পেশার ব্যাপারটা একটা। কিন্তু যে পেশাদারিত্বের ভেতর শুধু বাণিজ্যই থাকে শিল্প থাকে না তাকে কী প্রকাশনা শিল্প বলা যায়? প্রকাশনা সম্পূর্ণ একটা শৈল্পিক বাণিজ্য। বাণিজ্য একেবারেই থাকবে না এটাও বলছি না কারণ বইটা যখন একটা বই আকারে বের হচ্ছে তখন সেটা অবশ্যই একটা প্রোডাক্ট। এবং সে প্রোডাক্ট সেলের ব্যবস্থা কিন্তু থাকতে হবে। মার্কেটিং পলিসি থাকতে হবে। এগুলো সব কিছুই পেশাদারিত্বের বিষয় হিসেবে পরে। কিন্তু আমি যে প্রশ্নটা করতে চেয়েছি সেটা আপনি বুঝতে পেরেছেন, বুঝতে পেরেই হয় তা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ এই সময়ে কতশত প্রকাশক একদম বাণিজ্য হিসেবেই পেশাটাকে নিচ্ছে। এবং এই বাণিজ্যটাকে ধরার জন্য তারা যেকোনো বই যেকোনো রকম ভাবে চাপিয়ে দিয়ে লেখক বানাচ্ছে এবং অলেখককে লেখক বানানোর প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। শুধুমাত্র এই জায়গাটাতে আসার জন্য আপনাকে ওই প্রশ্নটা করেছিলাম। আসলে ওটা মূল প্রশ্ন ছিল না। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
মজিবর রহমান খোকাঃ ওটাই বলেছি যে আজকে যে বিদ্যাপ্রকাশকে অনেকে মনে রেখেছে তার কারণ কী? বিদ্যাপ্রকাশ কে মনে রাখার কারণটাই হচ্ছে যে বিদ্যাপ্রকাশ বই বেছে এবং নান্দনিকভাবে প্রোডাকশন তৈরি করে বের করেছে । আগে কেউ এরকম ভাবে করে নি। খরচের বিষয়টা সবাই চিন্তা করে যে, এই কাজ করতে গেলে এত টাকা খরচ হবে কিন্তু আমি খরচ নিয়ে ভাবিনি। আমি চিন্তা করেছি যে, আমাকে সুন্দর ভাবে কাজ করতে হবে। নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে পাঠকের কাছে। বইয়ের বাঁধাই সুন্দর করতে হবে। আমি যদি সুন্দর করি তাহলে পাঠকের কাছে যখন আমি বই নিয়ে যাব তখন পাঠক গ্রহণ করবেন। আমার চিন্তাটা ছিল ওইখানে। বাণিজ্যিক চিন্তা আমি কম করেছি। যারা আমার সাথে ছিল তারা তো বাণিজ্যিক চিন্তা করেছে। শুধু বাণিজ্যিক চিন্তা না তার সাথে আরও অনেক অনেক অনৈতিক কাজ করেছে। আমি কোনদিন করতে পারিনি এবং এখনো করতে পারি না। যে কাজগুলো নতুন প্রকাশনাগুলো করছে আমি সেসব কাজ কোনদিনই করতে পারব না। যে কারণে আমি একজন সফল ব্যবসায়ী না হয়ে, অ্যামেচার পাবলিশার্স হয়ে আছি। যদি বলেন যে টাকা কোথা থেকে পান? হ্যাঁ আমি বিভিন্নভাবে লোন করে করে চলি। আমার কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স নাই , বাড়ি নাই, গাড়ি নাই, কিচ্ছু নাই। আমার ভেতরে কেবল রুচিবোধ আছে।
নাহিদা আশরাফীঃ আমাদের দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কোনো সম্পাদনা পরিষদ নেই। একজন প্রকাশক যখন বই প্রকাশ করেন প্রকাশের আগে তার সম্পাদনার দায়িত্বটা থেকেই যায়। আমাদের দেশের প্রকাশকরা সেই দায় কতটা নিচ্ছে? আর একজন প্রকাশককে এ ব্যাপারে কতটা যত্নবান হওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ প্রথমে হচ্ছে সম্পাদনার বিষয়টি। লেখক যখন পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিচ্ছেন প্রকাশককে। প্রকাশকের তখন এডিটোরিয়াল বোর্ডের কাছে পাণ্ডুলিপিটি পাঠানোর কথা। বাংলাদেশের একটা এডিটোরিয়াল বোর্ড ছিল আমি যতদূর জানি চিত্তদা যতদিন বেঁচেছিলেন মুক্তধারায় ছিলেন তিনি। ইউ পি এল এর মহিউদ্দিন সাহেবের ছিল। সাহিত্য প্রকাশের মফিদুল ভাই সবগুলো নিজেই দেখেন। আমার জানামতে সেই সময় আর কারোরই ছিল না। যদি আজ থেকে আরও দশ-পনেরো বছর আগেও যাই তাহলে এই এভাবেই সীমাবদ্ধ ছিল এডিটোরিয়াল বোর্ডের ব্যাপারটা। সম্প্রতি যারা এসেছে তাদের ভেতর দুই একজন বলেছে তাদের এডিটোরিয়াল বোর্ড আছে। তারা বলেছে কিন্তু আমি জানিনা তাদের এডিটোরিয়াল বোর্ড আছে কি না। অথচ বাংলাদেশে অসংখ্য প্রকাশক আছে। এরপরে তো আরো হয়েছে। আমি যদি মনে করি যে সম্পাদনা কারা করে? পেশাজীবী ভাবে সম্পাদনা করেন নাকি তারা যারা শিক্ষার সাথে জড়িত আছেন তাদেরকে দিয়ে করানো হয়? সম্পাদনা যে করবে তার কিন্তু একটা পেশাদারিত্ব থাকতে হবে। আমাকে একটা বই দিয়ে বলা হল,ভাই এই বইটা দেখে দেন। আমি দেখে দিলাম, এটা কিন্তু পেশাদারিত্ব না। এটাকে সম্পাদনা বলেনা। সম্পাদনা অনেকগুলো নিয়ম-নীতির ভেতর থেকে করতে হয়। আমাদের দেশে পেশা হিসেবে সম্পাদনা গড়ে উঠে নাই। সম্প্রতি সম্পাদক নামে একটা প্রতিষ্ঠান হয়েছে রাখাল রাহা নামে একজন আছেন তারা করছেন। তারা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি কিন্তু তারা কাজটি শুরু করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল কতটা শিক্ষিত হতে হয়? শিক্ষিত না হয়েও প্রকাশনায় এসেছে আমি দেখেছি। এমনও দেখেছি যে নিজের নাম সই করতে পারে নাই সেও প্রকাশনায় এসেছে। সে মন্ত্রীর পাশে বসে বক্তৃতা দিয়েছে আমি নিজের চোখে দেখেছি।
নাহিদা আশরাফীঃ এটা আমরা অহরহই দেখেছি এবং দেখছি বলেই আপনাকে প্রশ্নটা করা। আমাদের দেশে বইয়ের মান নামতে নামতে বেহাল অবস্থা! প্রতিটা মুহূর্তে আমরা দোষ দিচ্ছি পাঠকের ঘাড়ে পাঠক ভালো বই পড়ছে না। একজন প্রকাশক এবং সম্পাদক হিসেবে আমাদের তো দায় আছে একটা ভালো বই পাঠকের সামনে তুলে ধরার। যখন একটা নিম্ন মানের বই বের করব না, তখন তো সেই বইটা পাঠকের হাতে যাবে না। যখন প্রকাশ করছি তখন পাঠক বইটা নিবে এবং পাঠকের চাইতে আমার নিম্ন রুচি এবং চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বেশি হচ্ছে কারণ পাঠককে প্রকাশক হিসেবে আমি বিভ্রান্ত করছি। এ জন্য আমি এই প্রশ্নটা তুলেছি। আসলে পাঠক তৈরি হচ্ছে না, নাকি আমরা এক ধরনের নিম্নশ্রেণির পাঠক তৈরি করার জন্য দায়ী। কোনটা?
মজিবর রহমান খোকাঃ এ জন্য তো অবশ্যই আমরা প্রকাশকরাই দায়ী। কিন্তু আমি আমার প্রকাশনার সব কাজ গত দশ বছর থেকে হয়তো কিছুটা কম দেখছি কিন্তু তার আগে প্রত্যেকটা বইয়ের কম্পোজ থেকে শুরু করে ফাইনাল প্রিন্ট পর্যন্ত দেখতাম। আমি শুধু প্রুফ দেখতাম না। কপি হোল্ড করতাম। লাইন বাই লাইন প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে প্রুফ দেখতাম। কোথাও যদি একটু সন্দেহ লাগতো তাহলে আমি ওখানে ডট পেন দিয়ে দাগিয়ে রাখতাম। লেখকের সাথে সেই বিষয় নিয়ে পরে কথা হতো। লেখক কারা কারা ছিল আমার? ডঃ আহমেদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আহমেদ প্রমুখ। এই যে বড় বড় লেখকদের লেখাগুলি যেখানে আমার সন্দেহ হত, মনে হতো কেমন যেন লাগছে, সম্পূর্ণ হয়নি আমি ওভাবে আন্ডারলাইন করে করে তাদের সাথে কথা বলে সেই সব জায়গাগুলো ঠিক করেছি। এমনকি কবীর চৌধুরী স্যার পর্যন্ত। উনারা সবাই খুব বড় মাপের লেখক। উনারা কিন্তু বিরক্ত হননি বরং প্রশংসা করেছেন। একদিন ডঃ আহমেদ শরীফ স্যার বলেছেন, আপনার মতো এমন প্রকাশক আমি দেখিনি আজ অব্দি যিনি এভাবে দাগিয়ে দাগিয়ে আমার সামনে এসে বসে ঠিক করেন!
নুসরাত সুলতানাঃ একটা সময় আমরা জানতাম যে প্রকাশক লেখক তৈরি করে। মূল্যবোধ এরকমই ছিল এখন দেখছি লেখক আসলে প্রকাশক তৈরি করে। টাকা দিয়ে বই ছেপে লেখক প্রকাশক তৈরি করছে। এ ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমরা আসলে প্রকাশনাটা যে করি, কেন করি? প্রকাশক হতে হলে কী কী যোগ্যতা লাগে! আমি যখন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক ছিলাম এবং বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রয় সমিতির সৃজনশীল স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি ছিলাম, তখন আমি প্রকাশকদের বৈশিষ্ট্যের তালিকা করেছিলাম। কোন কোন বৈশিষ্ট্য অর্জন করলে সে প্রকাশক হতে পারবে। যদি সেই বৈশিষ্ট্য গুলো অর্জন করতে না পারে তাহলে আমি তাকে সৃজনশীল প্রকাশক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবো না। যদিও আমি চলে আসার পরে সেটা আর রাখা হয়নি। ওটা রাখতে গেলে অনেক অসুবিধা। কথায় বলেনা – কম্বলের লোম বাছতে গেলে কম্বল উজাড় হয়ে যায়!
নুসরাত সুলতানাঃ আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে ২০২২ সাল অব্দি রাষ্ট্রের ক্ষমতায়নের যে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন কখনো ধর্মান্ধতা জেঁকে বসেছে, আবার আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনা জয়জয়কার দেখেছি। সুদীর্ঘ সময় আপনি সব বড় লেখকদের সাথে কাজ করেছেন। এভাবে কাজ করতে গিয়ে আপনি কী কী সংকট মোকাবেলা করেছেন এবং সেগুলো কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ রাজনীতির সাথে প্রকাশনা জগতের দ্বন্দ্ব – সংঘর্ষ আমি অন্তত দেখিনি হুমায়ুন আজাদ মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এখনো যদি আগের বইগুলো দেখা যায় বইয়ের যে বিষয়গুলো সেগুলো এখন আর লেখা যাবে না। রাজাকারদের বিষয়ে লেখা যাবে না, গোলাম আযমের বিষয়ে লেখা যাবে না। স্বাধীনতাবিরোধীরা এতটাই শক্তি অর্জন করেছে! ভাবটা এমন যে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে লেখা মানে একজন মাওলানার বিরুদ্ধে লেখা। ভাবটা এমন যে, মাওলানার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। গোলাম আজম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীরা এত খারাপ হতে পারে না। মাওলানা তারা পরে হয়েছে কিন্তু তার আগে তো খারাপ কাজগুলো করে এসেছে। তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে যে, তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করেছে। সেই বিষয়গুলো এখন লেখালেখিতে উন্মুক্তভাবে বলা যাবে না। বললেই তার বিপদ হবে। যুদ্ধের পক্ষে সবাই বলে কিন্তু কে যে কতটুকু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলতেছে এটা বোঝা খুব মুশকিল। এখন যদি আমরা দেখি কোনো লেখক আর সাহস নিয়ে আগের মত লিখছন না। সেই সাহসটা তাদের নষ্ট হয়ে গেছে। রাষ্ট্র যেখানে বলেছে যে ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না। ধর্মানুভূতির বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না। এইযে অনুভূতির বিষয়টা, এই কারণে আমাদের ভালো উপন্যাস তৈরি হবে না। ভালো ঔপন্যাসিক তৈরি হবে না। কারণ লিখতে গেলে যদি এত বাধা থাকে সে তো মনের মত করে লিখতে পারবে না। কি লিখবে সেটা সে নিজেও জানে না তার কলম লিখবে কিন্তু সেটাকে যদি বলে যে আমার অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে? তাহলে কিন্তু সেই লেখকের বিপদ। রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে, সমাজ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তো ঐরকম লেখক তো আর পাওয়া যাবে না যেরকম লেখক আমরা আগে পেয়েছি। নজরুলকে পেয়েছি, হুমায়ুন আযাদকে পেয়েছি, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে পেয়েছি। এদের প্রত্যেকের উত্তীর্ণ লেখার ভেতরে আমরা যে বিষয়গুলো পাই সেভাবে কিন্তু এখন আর কেউ লিখতে পারবে না।
নুসরাত সুলতানাঃ আমাদের ছোটবেলায় আমরা যখন জোব্বা টুপি পরা, দাড়িওয়ালা কাউকে দেখতাম আমরা ভাবতাম এ হচ্ছে আলেম একজন সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু এখন এই পোষাকটা দেখলে আমাদের চোখে বলাৎকারের চিহ্ন ভাসে অথবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে ওয়াজ করছে,না, হলে তাবিজ দিচ্ছে,, মিলাদ পড়াচ্ছে এই চিত্রগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে । ইসলামকে তো তারাই বেশি নষ্ট করছে, ইসলামের ক্ষতি তারাই বেশি করছে। যত মিথ্যাচার এবং যত সংকীর্ণতা নিয়ে তারা আসছে সেটা যদি লেখায় ফুটিয়ে তোলা না যায় তাহলে লেখক লিখবেটা কী?
মজিবর রহমান খোকাঃ লেখককে তো রাষ্ট্রীয়, সামাজিক সব বিষয় নিয়ে লিখতে হবে। সব লিখতে পারছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটা বিষয়ে গিয়ে আটকে যাচ্ছেন তিনি। রাষ্ট্র যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রধর্ম আইন এবং ধর্মীয় অনুভূতি আইনগুলো উঠিয়ে না দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ স্বাধীনভাবে লিখতে পারবে না।
নুসরাত সুলতানাঃ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে প্রচুর লিটল ম্যাগ, ওয়েব ম্যাগ প্রচার-প্রসারের যুগ। লেখার চাইতেও প্রচারই গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিষয় দেখতে পাই যে, কেউ একজন লেখক হয়ে ওঠার আগেই স্টার হয়ে ওঠে। এই বিষয়টা কীভাবে আপনি দেখছেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ যারা স্টার হয় তাদের কাছে তোর আমি যাইনি। আমি তাদের লেখাই প্রকাশ করতে চাইবো যাদের লেখার ভিতর গভীরতা আছে। লেখার ভেতরে মৌলিক সাহিত্যবোধ আছে তাদেরকে নিয়েই আমি কাজ করতে চাই এবং করি।
নুসরাত সুলতানাঃ সেটা ঠিক আছে আমার প্রশ্নটা সেখানে না। আমার মনে হয় একজন লেখকের ম্যাচিউ হওয়ার যে বিষয়টা সেটা এমন, একটা নারকেলের শাঁস যেমন সবার অলক্ষ্যে জন্মে এবং পরিপক্ক হয় লেখক সত্তাটাও কী ঠিক সেভাবেই পরিপক্ক হয় না?
মজিবর রহমান খোকাঃ সেরকম তো অবশ্যই। সেরকম না হলে তো লেখক হয়ে উঠতে পারবে না কেউই । এইযে মেলাতে সাড়ে তিন হাজার বই বেরুচ্ছে এর মধ্যে তিন হাজার বই তো নির্ঘাত ওই ধরনের লেখকদের যারা জোর করে নিজেকে লেখক বলছেন। বই বের করলেই লেখক, এটাই তাদের ধারণা। বই লিখলেই তো লেখক হয়না, যেমন বই প্রকাশ করলেই প্রকাশক হয় না। বই যারাই প্রকাশ করছে তারাই কিন্তু প্রকাশক না। তারা চুক্তিতে যাচ্ছে এখন। লেখক বলছে যে ভাই তুমি আমার এই বইটা একটু বের করে দাও। একটু হেল্প করো আমাকে। হেল্প করার জন্য একটা চুক্তি হিসেবে সে টাকাটা নিচ্ছে। সুতরাং লেখক আর ওই চুক্তিভিত্তিক প্রকাশক এই দুজনই এক মানহীন।
নুসরাত সুলতানাঃ মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন যে বই লিখলেই সে লেখক না এবংবই প্রকাশ করলেই সে প্রকাশক না।
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ, একদম সেটাই।
নুসরাত সুলতানাঃ এইযে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত কাজ হচ্ছে প্রচুর বই বেরুচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে যারা জন্মেছে আমাদের প্রজন্মের যারা আমরাও লিখছি প্রকাশিত ইতিহাস পড়ে, দলিল দস্তাবেজ পড়ে রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা এসব কিছু নিয়ে আমরাও লিখছি। এসবের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা বা একজন সেই সময়কার মানুষ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা কতটা খুঁজে পান?
মজিবর রহমান খোকাঃ সবার লেখা আসলে আমি পড়তে পারিনি। কিছু বইগুলো আমি দেখেছি এবং পরিচিতদের লেখাগুলা পড়েছি। সেসব বই অবশ্যই ভালো। আরো কিছু আছে যে মুক্তিযুদ্ধের বই বের করলে প্রচুর বিক্রি হবে সরকার কিনবে সেই হিসেবে অনেক বই বের হচ্ছে, বের করছে অনেকে। আমি একটা বই লিখেছিলাম “একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকথা। ” সেসময় তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ যে করেছি তার সবটুকু আমি লেখার চেষ্টা করেছিলাম। যদিও পুরোটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটা পুরো সম্পূর্ণ না। আমার স্মরণশক্তির দুর্বলতার কারণে অনেককিছু বিস্মৃত হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে আমার কষ্ট আছে। যদি সবাই সততা নিয়ে লিখতো তাহলে খুব ভাল কাজ হতো। কিন্তু ওই যে বললাম মুক্তিযুদ্ধের বই লিখলে প্রচুর বিক্রি হবে তাই লিখে। বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অনেকেই তাড়াহুড়ো করে লিখেছে।
নুসরাত সুলতানাঃ বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। এই সুবর্ণজয়ন্তীতে একজন প্রকাশক এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির প্যারামিটার জানতে চাই।
মজিবুর রহমান খোকাঃ প্রকাশক হিসেবে আমি যে কাজটি করতে চেয়েছি সেটা করতে পেরেছি। নান্দনিক ভাবে বইকে উপস্থাপন করা এবং কলকাতার আনন্দবাজারের সাথে কম্পিট করা। এটা আমি করতে পেরেছি। এখানে আমি মনে করি, আমি সফল। আমি চেয়েছি কলকাতায় যেন বাংলাদেশের লেখকদের পাঠক তৈরি হয় সেটা আমি করতে পেরেছি। চেয়েছি যে সৃজনশীল প্রকাশকদের একটা আলাদা সংগঠন থাকা থাকা দরকার সেটাও আমি পেরেছি। আমি মনে করি আমি আরো অনেক কিছু করতে পারতাম কিন্তু সেটার জন্য যেভাবে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল, যাদের আমার সাথে থাকার প্রয়োজন ছিল, তারা আমার সাথে ছিল না বলে আমি পারিনি।
নাহিদ আশরাফীঃ আচ্ছা একটা প্রশ্ন আছে আমার। আজকাল পুরস্কার এর ছড়াছড়ি। এখন আর পুরস্কার লেখককে খোঁজে না, লেখক পুরস্কার খুঁজে বেড়ায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখেছি, যে কখনোই কোনো পুরস্কার পায়নি, কোন সম্মাননা পায়নি বা তার ধার সে ধরেনি কিন্তু তার টেক্সট আমরা পারলে মুখস্থ করে ফেলছি, আমাদের তাড়না থেকেই পড়তে বাধ্য হচ্ছি। আর এখন, যেকোনো মূল্যে পুরস্কার পেতে হবে, দরকার হলে কাটাবনে গিয়ে নিজে একটা বানিয়ে নিয়ে এসে দেখাতে হবে যে আমি পুরস্কার পেয়েছি। এই যে প্রবণতা এ ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ ও মতামত কী? সোস্যাল মিডিয়ায় দেখানোর প্রবণতা থেকে যে লেখক তৈরি হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যে আপনার বলার কী আছে?
মজিবর রহমান খোকাঃ (মৃদু হাসি)। পুরস্কার তো আসলে কোনো লেখার মানদন্ড হতে পারে না। যেভাবে আগে দেয়া হতো সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচার-বিশ্লেষণ করে তাকে দেয়া হতো। ছোটখাটো সংগঠন হোক আর বাংলা একাডেমি হোক। এখন যেটা করা হয়, যার যত প্রভাব আছে, লেখার মান যাই হোক না কেন যার যত যোগাযোগ আছে তারই জয়জয়কার। আমাকে কোথায় কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাবে, আমাকে কবে কবে কী খাওয়াবে, আর বাসায় দাওয়াত দিবে, কি পাওয়া যাবে এটা ভিত্তি করেই এখন পুরস্কার দেয়া হয়। লেনদেনের ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
নাহিদ আশরাফীঃ বিদ্যাপ্রকাশ লেখককে দেখছি বিভিন্ন লেখকের এর বাসায় দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছেন। সেক্ষেত্রে বিদ্যাপ্রকাশ কবে এরকম একটা পুরস্কার প্রবর্তন করবে? (হাসি)
মজিবর রহমান খোকাঃ (হাসি দিয়ে) বিদ্যাপ্রকাশ পুরষ্কার প্রবর্তন করবে কী! তার তো নিজেরই কপাল খারাপ, সে নিজেও এখন পর্যন্ত কোনো পুরস্কার পায়নি।
নাহিদা আশরাফীঃ এজন্যই আমি কথাটা তুললাম। বিদ্যাপ্রকাশ আজ অবধি যে দু-একটা পুরস্কার পেয়েছে তা ভালোভাবেই পেয়েছে অন্তত এটুকু আমরা জানি। আমার কিন্তু পুরস্কার নিয়ে কোনো আপত্তি নেই বা পুরস্কার নিয়ে আমি কোন নেগেটিভ মাইন্ড সেট নেই। বরং সবসময় বলি লেখার কারণে মানুষ ভালোবেসে গাছ তলায় ডেকে নিয়ে একটা ফুলও যদি দেয় সেটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। কিন্তু এই যে বাণিজ্য! শিল্পকে বাণিজ্যিকীকরণ, পুরস্কারকে বাণিজ্যিকীকরণ। আপনার আমার অথবা আমাদের অনেকের সৎ প্রাপ্তিটুকুও বাণিজ্যিকীকরণের যাতাকলে পড়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
মজিবুর রহমান খোকাঃ মূল কারণ তো পুঁজিবাদ। মানুষ এখন অর্থলিপ্সু। এমনভাবে ছুটছে যে, তার যা কিছুই ক্ষতি হয়ে যাক না কেন অর্থ ঠিক থাকলেই চলে। সবকিছুতে প্রাপ্তিযোগ হতে হবে।
নাহিদা আশরাফিঃ এটা যখন হবে তখন তো লেখার মান নিশ্চয়ই কমে যাবে। আপনি কী মনে করেন ?
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ তাতো কমে যাবে। যাচ্ছেও।
নাহিদ আশরাফীঃ তাহলে যা দাঁড়ালো, আমরা এখন আর লেখার মান নিয়ে চিন্তা করছি না আমরা পুঁজিবাদের ধান্দায় সবকিছুকেই একীভূত করছি।
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ। সেটাই হচ্ছে।
নুসরাত সুলতানাঃ একটা উত্তীর্ণ কবিতা গল্প বা উপন্যাস যতখানি অন্তর্গত বেদনা বা অন্তর্গত উপলব্ধি দিয়ে তৈরি হয়। আর একটা যেকোন ধরনের দায়সারা লেখা বা পড়ে পড়ে যেনতেন করে লেখা এই দুইটা লেখাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি যতদূর জানি- গল্প,কবিতা, উপন্যাস যাই হোক সেটা ঐশ্বরিক দান। সেটা একটা ধ্যানের মতো। অনেক লেখক আছেন ভোররাতে লিখেন। হয়তো সে উনি নিজেও জানেন না কী অসাধারণ সাহিত্য কর্ম তিনি করলেন সে সময়!
নুসরাত সুলতানাঃ একটা কবিতা আমি এখন লিখলাম কিন্তু তার পাঁচ মিনিট পরে আমি আর লিখতে পারবো না। আমাকে কোটি টাকা দিলেও পারবো না আমাকে গুলি করলেও পারবো না।
মজিবর রহমান খোকাঃ হ্যাঁ হয়তো তাকে ভেতর থেকে কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে। ওপর থেকে কেউ তার ওপর এই বিষয়গুলো হয়তো অনিবার্যভাবে লেখাচ্ছে। ওই লেখাগুলোই হচ্ছে আসল সাহিত্য, আসল কবিতা।
নুসরাত সুলতানাঃ এবার প্রবাস জীবন নিয়ে কিছু বলুন। বইমেলায় অংশগ্রহণ করেন, শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের সবার সাথে দেখা হয়, আড্ডা দেন এগুলো ছেড়ে যখন চলে যান তখন কেমন লাগে?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি যাই কিন্তু ওখানে আমি একটা সংগঠন তৈরি করেছি। আমি হচ্ছি অব্যবসায়ী একজন মানুষ। ওখানে আমি কোনো ব্যবসা করি না। কিন্তু ওখানে কোনো সংগঠন চালাতে গেলে উপার্জনের প্রয়োজন আছে। ওটা ওখানে যে ফেডারেল গভমেন্ট আছে সেই গভমেন্টের অনুমোদিত সংগঠন। এখানে যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে ওখানে ওরকম ফেডারেল গভমেন্টের অনুমোদন নিয়ে সংগঠনটা করা। ক্রান্তি সেন্টার ফর বাংলাদেশ ডায়লগ ইউএসএ। ঠিক এ রকমই শিল্প- সাহিত্য -সংস্কৃতি মূলক একটা সংগঠন। খুব পরিচ্ছন্ন একটা সংগঠন। সংগঠনটি ওখানে করেছি আমরা প্রায় পাঁচ বছর হল। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করেছি। যারা ওখানে বাঙালি অভিবাসী আছে তারা খুব প্রশংসা করে সংগঠনটির। এখানে মেলার শুরুতে আবার চলে আসি।
নুসরাত সুলতানাঃ বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ, অতি প্রযুক্তি এবং সভ্যতার পরতে পরতে যে গুমরে থাকা কান্না লেগে আছে এই সময়ে তার কতটা এই সময়ের সাহিত্যে ফুটে ওঠে? সোশ্যাল মিডিয়ায় আসার পরে যে লেখকরা লিখতে এসেছে তাদের লেখায় এই বিষয়গুলো আপনি কতটা দেখতে পান? সময়ের চিত্রকল্প তারা কতটা আঁকতে পারছেন বলে আপনি মনে করেন?
মজিবর রহমান খোকাঃ সবাই যে খারাপ লিখছে তা নয় কিন্তু। কষ্ট করে লেখালেখি সাথে যদি তারা যুক্ত থাকে, যদি কষ্ট করে তারা লেগে থাকতে পারেন তাহলে একসময় তারা অবশ্যই ভালো লেখক হয়ে উঠতে পারবেন আমার বিশ্বাস। আমি তো দেখছি, আমাদের তরুণ প্রজন্মের অনেকে ভালো লিখছেন। অনেকে আছেন, কী লিখছেন সেটা তিনি নিজেও জানে না। হুমায়ূন আহমেদের যখন খুব ক্রেজ ছিল কোনো কোনো তরুণ এসে আমাকে বলেছিলেন,আমার লেখাটা ছাপেন হুমায়ূন আহমেদের মতো চলবে। তার মানেই হচ্ছে তিনি হুমায়ুন আহমেদের চাইতে আরো উপরে উঠতে পারছে না। হুমায়ুন আহমেদকেই সর্বোচ্চ বিন্দু হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তিনি বলতে পারতেন আমি শওকত আলীর মতো লিখেছি, সৈয়দ শামসুল হকের মতো লিখেছি। শওকত ওসমানের মতো লিখেছি। কিন্তু তার দৌড়টা ছিল হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত। আমি তাদেরকে বিনয়ের সাথে রিফিউজ করেছি। একটা তরুণ মেয়েকে বলেছি যে তুমি আরো লেখাপড়া করো আরো ম্যাচিওর হও এবং তাকে পড়ার জন্য আমি প্রচুর বই দিয়েছি। পরবর্তীতে দেখেছি ওর লেখায় অনেক ম্যাচিউরিটি এসেছে। আমি তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছি।
নুসরাত সুলতানাঃ আজকের দিনে লেখকদের জন্য আপনার উপদেশ বা পরামর্শ কী?
মজিবর রহমান খোকাঃ আমি কোনো উপদেশ বা পরামর্শ দেয়ার সক্ষমতা রাখি না। শুধু বলবো, ভালো লেখক বা পাঠক-সমালোচক হতে প্রচুর পড়তে হবে। সবার জন্য শুভকামনা।
নুসরাত সুলতানাঃ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মজিবর রহমান খোকাঃ আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।