সময়টা থেমে যাক
রাজিয়া নাজমী
নাইমা, ওরা টেক্সট করেছে। থার্টি মিনিটের মধ্যে এসে যাবে। তোমার কাজ শেষ হলো ?
নাইমার উত্তর না পেয়ে জামিল আবার বলে, নাইমা, ইমাকে দুধ খাইয়ে দিয়েছি। তুমি নিচে এসো তাড়াতাড়ি।
-আচ্ছা, আসছি।
এর বেশি আর কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না নাইমার । আজ যে আসছে তার জন্য হাতের কাজ কোনদিনই শেষ হবে না। কেবল মনে হচ্ছে কিছু যেন বাদ রয়ে গেছে । সবগুলো রুম কতবার ঝেড়েছে । তবু মনে হয়েছে ধুলো রয়ে যায়নি তো! শুনেছে, ইদানীং নাকি ধুলোয় ওর অ্যালার্জি হয় । গত সাতদিন ধরে সারা বাড়ির আনাচে কানাচে স্প্রে করে, পরিষ্কার করে চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে । এই কিছুক্ষণ আগে চাদর তুলে জামিল আবার স্প্রে করেছে । নাইমাকে বলতেও হয়নি করার জন্য । জামিলের নার্ভাসনেসটা যে কারো চোখে পড়ার মত । এই প্রথম জামিল ওকে দেখবে । কাল সারাদিন প্র্যাকটিস করেছে; কী বলবে দরজা খুলে, হাত ধরবে না জড়িয়ে ধরবে!
বাথরুমের আয়নায় দাঁড়িয়ে তলপেটে আলতো করে হাত বুলিয়ে জোরে শ্বাস নেয় নাইমা। আজ যদিও মন খারাপের নিঃশ্বাস না। কেমন অস্থির অস্থির ভাব। তবে বুকের ভিতরে কোন ব্যথার চাপ দিচ্ছে না। কেমন অন্য রকমের খুশি আবার কেমন ভয়ও লাগছে।
বারবার নিজেকেই বলছে, ঠিক আছে অল্প সময়ের জন্যে আসছে। তবু আসছে তো !
কালরাতেও জামিলকে একই কথা বলেছে, এটা কী কম পাওয়া বল? কত বছর পরে দেখবো ওকে। এই প্রথম একা দিনরাত আমাদের বাড়িতে, আমাদের কাছে পাচ্ছি। এই বাড়িতে হাঁটবে, ঘুমাবে।
একি কম পাওয়া !
জামিল অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো- কিন্তু তারপর!
দুজনেই চুপ হয়ে হয়তো একই কথাই ভাবছে – অল্পবয়সের খেয়ালের মাসুল দিতে হবে সারাজীবন।
পনেরো বছর বয়সের নাইমার আর দুই বছরের বড় জামিল । স্কুল ফাঁকি দেওয়া থেকে সমস্ত বাজে অভ্যাস রপ্ত করেছিলো ওরা দুজনেই। অবাধ্য নাইমাকে শাসন করার তেমন কেউ ছিল না। বাবা বরাবরই বোহেমিয়ান টাইপের। সংসারের প্রতি কোন খেয়াল ছিল না।
মা ক্যানসার সারভাইবার । শরীর খারাপ থাকতো অনেক। তারপরেও মায়ের কাঁধেই সংসারের সব দায়িত্ব। নাইমার পিছে লেগে থাকার সময় হতো না মায়ের।
ক্যান্সার থেকে মা সেরে উঠেছিলো ঠিকই কিন্তু এক সকালে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হলো।
মায়ের অবর্তমানে বাবা আর বেশি বেহিসেবী হয়ে গেলো । দিনের পর দিন শরীরের প্রতি অবহেলার কারণে শেষ পর্যন্ত রিহ্যাবেই যেতে হল বাবাকে।
মা হার্ট অ্যাটাকের কয়েক দিন আগে নাইমাকে কাছে টেনে বলেছিল, তুমি অনেক ছোট তবু বলছি তোমার নিজের ভালো তোমাকেই বুঝতে হবে । এখনো সময় আছে, শুধরে নাও নিজেকে । পড়াশুনায় মন দেও।
জামিলকে ভালোবাসো ঠিক আছে। কিন্তু পড়াশুনা করে যে ভালো চাকরী করতে হবে দুজনকেই।
আমি যতদিন আছি নিজেকে গুছিয়ে নে নাইমা।
শুধুমাত্র শোনার জন্যই সেদিন শুনেছিলো মায়ের কথা । নাইমা মায়ের কথার গুরুত্ব কখনই দেয়নি । মাকে তেমন করে বুঝতেও পারত না । শুধু মনে হত যে কোন কারণেই হোক মা কে খুব অসুখী মনে হতো। ভালো লাগতো না মায়ের জীবনকে । নাইমা মায়ের মত হতে চায়নি । মা শিক্ষিত, ভাল চাকরী করে, তবু একেবারেই সাদামাটা যান্ত্রিক একটা জীবন। নাইমা যে জীবন সে বেছে নিয়েছিল তার সাথে মায়ের আদেশের সাথে কোন মিলই ছিল না। নাইমার সেই ছন্নছাড়া লাগামহীন জীবনে একটাই সত্য ছিল, ‘জামিল’ ! জামিল ছাড়া আর কোনকিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নিয়ে নাইমা ভাবে, কত কথা বলার আছে, এত বছরে কত কথা জমে আছে বলার জন। পারবে তো বোঝাতে কেন অমন সিদ্ধান্ত নিতে সে বাধ্য হয়েছিলো!
মা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পরেই নাইমা বুঝতে পারলো শরীরের ভিতর আরেকটি শরীর বেড়ে উঠছে। এই প্রথম সে ভয় পেলো। এই প্রথম মনে হলো ও ভীষণ একা। বাবার বোঝা না বোঝায় তেমন কিছু আসে যায় না । বাবা থেকেও না থাকার মতই ছিল। এই প্রথম মা’কে ভীষণ দরকার মনে হলো । জামিল ততদিনে বাবা মায়ের সাথে ফিরে গেছে দেশে।
সতেরো বছরের নাইমা অনেক ভেবেছে। এবর্ট করার সময়ও পার হয়ে গেছে । থাকলেও নাইমা করতে পারত না । মায়ের সাথে একাএকা কথা বলত । জানতে চাইতো কি করবে। কেন মনে হত মা ঠিক শুনতে পেতো । মা যেন বলতো, যা হবার হয়ে গেছে । এখন যা ঠিক তাই কর। ওকে পৃথিবীর আলো দেখাও।
নাইমা জানতো ধর্মে বিশ্বাসী তার মা এটাই বলবে।আবার মনে হত তার মন যা চায় তাই হয়ত মা বলছে । কিন্তু জন্ম দিলেই কি পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবে সে ? সে যে হাইস্কুলও পাস করতে পারেনি। চাকরি করার মত কোন যোগ্যতা নেই । নিজের ভবিষ্যৎই যে আপাতত অন্ধকারে !
পেটের ভিতর বাচ্চাটা নড়াচড়া করলেই মায়ের মত মা হতে ইচ্ছে করতো । নাইমার মত এমন ডিফিকাল্ট মেয়ের জন্যও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো মা। যদিও শেষরক্ষা করতে পারেনি নিজের অসুস্থতার জন্য । নাইমা ফিরেও তাকাত না মার দিকে ।তবু মা যতদিন পেরেছে নাইমার পছন্দের সব রান্না করে রেখে দিত । এলোমেলো করে রাখা রুম পরিষ্কার করে রাখতো ।
মা’ কী এখন দেখে নাইমা মায়ের মত করেই সবকিছু গুছিয়ে রাখে এখন! বাবার দেখাশুনাও করে।
পেটের ভিতর নড়াচড়া বাড়তেই নাইমা কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়লো । একটু একটু করে তার ভিতর যে বেড়ে উঠছে ,তাকে পৃথিবীর আলো দেখাবার জন্য যা কিছু করার তাকে করতে হবে। বাচ্চা এডাপ্টশন এজেন্সির নাম খুঁজে খুঁজে ফোন করতে শুরু করলো সে। দুই সপ্তাহের মধ্যেই ডাক এলো দেখা করার জন্য । নাইমার বয়স যেন তখন আর সতেরোতে নেই । এই কয় মাসে সে অনেক বেশি বড় হয়ে গেছে । খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েই সে তার সন্তানের হবু বাবা মায়েদের সাথে দেখা করতে যেতো । বাড়ি ফিরে আবার সব প্রশ্ন উত্তর লিখে রাখতো নোটবুকে ।
এজেন্সির মহিলাটি নাইমার কাঁধে হাত রেখে বলতো, হতাশ হয়ো না । তোমার পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করবো ।
নাইমা পেটে হাত রেখে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইতো, কিন্তু তার আগেই যদি …।
আট মাসের শুরুতেই এজেন্সির ডাক এলো আবার । নাইমাকে দেখা করতে যেতে হবে দত্তক নিতে চাওয়া স্বামী স্ত্রীর সাথে ।
মায়ের ছবির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বের হয়ে গেলো নাইমা এজেন্টের অফিসে । সংগে নতুন করে লেখা প্রশ্নের খাতা ।
নাইমার আগেই ওরা চলে এসেছিলে । নাইমা রুমে ঢুকতেই ভদ্রমহিলা কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো, আমি সামিয়া জাহান, আমার হাজব্যান্ড করিম জাহান । আমরা ভারতীয় ।
ভদ্রলোক সোফা থেকে উঠে এসে বলল, আমি আপনাকে সাহায্য করবো বসার জন্য ? বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো । নাইমা আপত্তি করেনি । ইদানীং সোফায় বসতে উঠতে বেশ অসুবিধা হয় । এই প্রথম কেউ তাকে এত আদর করে বসতে সাহায্য করল। জামিল থাকলে এমনই করেই হয়ত হাত বাড়িয়ে দিত !
আপনি কত বছর আমেরিকাতে? করিমের প্রশ্নে জামিলের স্মৃতি থেকে বের হয়ে এলো নাইমা।
আমার যখন এক বছর বয়সে আমার বাবা মা নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন । নাইমা সোফায় একটু হেলান দিয়ে বলে।
আমরা জন্ম থেকেই এদেশে তবে চাকরি সূত্রে অন্য দেশে যেতে হয় । একথা আপনার জানা দরকার । তবে আমরা প্রতি বছর ছুটিতে আসি ।
নাইমা মাথা নেড়ে বলে, আপনাদের যা কিছু জানার আছে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন ।
বাচ্চার নাম কী রাখবেন ঠিক করেছেন?
নাইমা ভীষণ অবাক হয়ে গেলো । এর আগে কেউ তাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করেনি । নাইমার লম্বা লিস্টেও এ প্রশ্ন লেখা নেই ।
না করিনি। কারণ …
করিম ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমরা আসতে আসতে ভাবছিলাম আপনাকে বলবো ওর নাম নাইম রাখবো। অবশ্য আপনি যদি চান।
গত সাতমাসে নাইমা কাঁদেনি । আজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না । সামিয়া ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, ওকে আমাদের সবটুকু দিয়ে ভালো রাখার চেষ্টা করবো । বাকি উপরওয়ালা জানে ।
নাইমা খুব ভালো করে ওদেরকে দেখে। মনে হলো তার নাইমকে ওদের কোলেই মানাবে ।
সেই রাতে নাইমা পেটের নড়াচড়া দেখতে দেখতে ইচ্ছে করছিলো পেটের উপর ঝুঁকে আদর করতে । যতবার হাত পা দিয়ে গুঁতো মারছিল, নাইমা ফুলে ফুলে ওঠা পেটের উপর হাত রেখে আদর করে ডাকছিল, নাইম… নাইম – ভালো থেকো সোনা । মা’কে ভুল বুঝো না ।
সামিয়া আর করিম দুজনেই ডেলিভারির দিন ওর সাথে ছিলো । আগেরদিন থেকেই নাইমার ভালো লাগছিলো না । সপ্তাহ আগে বাবাকে রিহ্যাবে রেখে এসেছিলো। সেদিন আরেকবার গিয়ে দেখা করে এলো । বাবা এখন কাউকেই চিনতে পারেন না । নাইমাকেও না । তবু তার দূর দূরান্তের বাবার কপালে চুমু খেলো। বাবা তাকাতেই, অনেককিছু বলতেই চাইলেও অনেক কষ্টে, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও বলেই বের হয়ে এলো।
রাত থেকেই ব্যথা শুরু হলেও সহ্য করার মত ছিল । নার্স ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল কখন হসপিটালে যেতে হবে । ভোররাত থেকে আর পারছিলো না। অত সকালে সামিয়াকে ফোন করতে খারাপ লাগলেও শেষ পর্যন্ত যখন করতেই হল তখনো মাত্র ভোর পাঁচটা।
সামিয়া শেষের কদিন ওদের সাথে থাকতে বলেছিলো, নাইমা চায়নি । কেন যেন ইচ্ছে করছিলো নাইমকে নিয়ে ওর নিজের বিছানায় যে কদিন পারে ঘুমায় ।
উনিশ ঘণ্টা ব্যথার সাথে যুদ্ধ করে নাইমকে পৃথিবীর আলো দেখালো নাইমা। একবারই কেঁদেছিল নাইম। তারপর এক মাথা ঘন কালো চুল আর ফোলা ফোলা চোখে চারদিকে তাকিয়ে যেন সবাইকে দেখে ছোট্ট হাত মুখের কাছে এনে চুপ হয়ে গেলো । মাথায় একটা টুপি পরিয়ে নার্স নাইমার বুকের উপর শুইয়ে দিলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দামি কাউকে । নাইমা ফিসফিস করে নাইমের কানে কানে বলল, আমি তোর মা, এই কথাটি কখন ভুলিস না ।
নাইমা হসপিটালে ছেলেকে নিয়ে দুইদিন ছিল। সামিয়ারা একদিনই দেখে গেছে। বাকী সময়টা ওদেরকে একা কাটাতে দেবার জন্য আর আসে নাই। সেই দুইদিন – রাত নাইমা যত গান জানে নাইমকে শুনিয়েছে । বলেছে কেন সে পারলো না ওকে কাছে রাখতে – বলেছে অক্ষমতার কথা । ক্ষমা চেয়েছে বারবার । কতটা ভালবাসে আর সারাজীবনই যে ভালোবেসে যাবে,তাও বলেছে। ছোট্ট পায়ে,হাতে আর মাথায় আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছে । বুকের দুধ যতটা খেতে পেরেছে খাইয়েছে। একটু সময়ের জন্যেও নাইমকে নার্সারিতে পাঠায়নি । নার্স এসে বলেছে, তোমার ঘুম দরকার এখন । নাইমা হেসে বলেছে, অনেক ঘুমিয়েছি । আবার পরশু থেকে ঘুমাবো ।
যে নাইমা মায়ের মত হতে চায়নি । মা হবে ভাবেনি। জীবনকে শুধু উপভোগ করতেই চেয়েছিল । এখন সে সুধুই মা হতে চায় , শুধু মা!
তার বেপরোয়া জীবনে সব এলোমেলোর মধ্যেও তার নিখাদ ভালোবাসা – জামিল হারিয়ে গেছে ! আজ সেই ভালোবাসার সন্তানও জামিলের মত হারিয়ে যাবে!
নাইমের ফর্সা গায়ের রঙ জামিলের কাছ থেকে পাওয়া । নাইমের চোখ, নাক, ঠোঁট, কপাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জামিলের সাথে আর কী মিল আছে দেখতে দেখতে চোখ ভিজে গেলো । জামিলকে আজ যে তার বড় দরকার ছিল । তাকে এত সুন্দর উপহার দিয়ে কেন চলে গেল জামিল !
দুদিন কেটে গেলো নাইমা বোঝার আগেই। সামিয়া আর করিম এলো সময়মত!
নাইমা জানে ওঁরা খুশী; তবু সেই খুশী নাইমার সামনে ছড়িয়ে দিল না । সামিয়া কাছে এসে দাঁড়িয়েও অযথা সহানুভূতি দেখালো না । অত খুশীর ভিতরে যেন এক ধরনের অপরাধী ভাব।
নাইমা তার জীবনের সব কিছু হারানোর আবেগ, কান্না গিলে ফেলে সামিয়ার হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ তুলে দিয়ে বলে,সামিয়া, এতে আমার একটা চেইন আছে, আর দুটো ছবি । একটি আমার, অন্যটি আমার বাবা মায়ের । যদি কখনো তোমরা নাইমকে …।
নাইমা, কথা দিলাম নাইম তোমার কথা জানবে। এসব ওকে সময় মত দেবো
নাইমার মনে হল সামিয়া যেন চোখের জল আড়াল করলো । কেন ? মা না হতে পারার কষ্ট ? নাকি একজন মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের সন্তানকে নিজের করে নেওয়ার জন্য খারাপ লাগছে ?
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েও নাইমার পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছিল নাইমকে নিয়ে ওদের গাড়ি অবধি যেতে । করিম গাড়ির দরজা খুলে দিলো । নাইমা কোল থেকে ঘুমন্ত নাইমকে কার সিটে শুইয়ে দিলো । ঘুমের মধ্যেই নাইম একটু কেঁদে ওঠে । নাইম কী বুঝতে পারছে মায়ের কাছ থেকে সে চলে যাচ্ছে চিরদিনের জন্য ?
নাইমের বুকে হাত দিতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
সামিয়া গাড়ির আরেক পাশে বসে খুব অভিজ্ঞ হাতে নাইমের সিট বেল্ট বেঁধে দিলো।
নাইমা শেষবারের মত ছেলের কপালে চুমু দিয়ে নিঃশব্দে বলে, আবার দেখা হবে আমাদের – ঠিক দেখা হবে । তবে ততদিনে আমাকে তোমার যোগ্য হতে হবে !
সবকিছু কত দ্রতু কত সহজে শেষ হয়ে গেলো।
দামী গাড়িটা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে নাইমা ফিরে এলো রুমে । পেটের দাগগুলো তখন সতেজ, সদ্য প্রসূতির ব্যথা তখন তলপেটে, দুধের ভারে বুক টনটন করছে । শুধু যার জন্য এতসব কেবল সেই নেই । মা হওয়ার সমস্ত চিহ্ন রেখে দিয়ে চলে গেলো কোল খালি করে অন্য কারো কোল আলো করে ।
নিজের গর্ভে ধারণ করার ক্ষমতা থাকলেও কোলে রাখার ক্ষমতা নেই। এই কঠিন সত্য মেনে নিতে নাইমার মন মানছে না।
নাইমার গায়ে, বিছানায় বালিশে এখনো ছেলের গায়ের গন্ধ মিশে আছে । বিছানায় পড়ে আছে গায়ে জড়ানোর জন্য হাসপাতালের দেওয়া সাদা নীল কাঁথা । নাইমা উপুড় হয়ে পেটের দাগের উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে রইলো।
একটু যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতো , কারো কোলে মাথা রেখে , কারো কাঁধে মাথা রেখে যদি কাঁদতে পারতো । চলেই যাবে সে তো জানা ছিল । তবু এত কষ্ট এত হাহাকার কেনো বুকের ভিতরে।
ডেলিভারি ওয়ার্ডে – সবসময় নতুন আগমনের আনন্দ, বেলুন আর ফুল হাতে এত লোকের এত খুশি, তবু নাইমার মনে হলো কী থমথমে ভাব চারপাশে।
মাথায় কারো আলতো হাতের ছোঁয়ায় চমকে উঠে না তাকিয়ে বলতে থাকে, সামিয়া ! নিয়ে এসেছো ! কাঁদছিল বুঝি ?
চোখ তুলতেই দাঁড়িয়ে থাকা নার্স ভীষণ মমতা মাখা চোখে বলে, সময় তোমাকে সয়ে নিতে সাহায্য করবে।
নাইমার ইচ্ছে হল বলতে, কেন এমন হল ! কেন ভালবাসার মানুষগুলোকে সে ধরে রাখতে পারে না ! কেন সবাই তাকে ছেড়ে চলে যায় । সে জানে তার কান্নার, তার কোন প্রশ্নের উত্তর নেই । তার সন্তানের দাবী সে হারিয়েছে চিরদিনের মত।
উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ গুছাতেই নার্স বিছানায় পড়ে থাকা ছোট্ট কাঁথা আর গা থেকে খুলে রাখা সাদা জামা হাতে দেয়।
নাইমা তাকাতেই, কাঁধে হাত দিয়ে বলে, নিয়ে যাও, রেখে দিও স্মৃতি হিসাবে। গড হয়ত একদিন আবার তোমার সন্তানকে তোমার কাছে এনে দিবে।
কথা বলার মত গলায় কোন আওয়াজ ছিল না নাইমার। মাথা ঝুঁকিয়ে বিদায় নিয়ে এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে নাইমের ফেলে রেখে যাওয়া জামা আর কাঁথা বুকের সাথে আটকে ধরে রুম থেকে বের হয়ে এলো। নিজেকে এত ছোট এত অক্ষম কখনো তার লাগেনি। শরীরের ভিতরে একজনের উপস্থিতির জন্য অর্থপূর্ণ জীবন নিয়ে এসেছিল দুদিন আগে । সে চলে যাওয়ায় আজ এক অর্থহীন জীবন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে ।
একরাশ শূন্যতা নিয়ে লম্বা করিডোরে পার হয়ে , এলিভেটর দিয়ে নিচে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বললো, দিয়ে এলাম মা !
নাইমার প্রথম মাস কেটে গেছে শুধু সামিয়াদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরেঘুরে । সকাল বিকেল গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকত যদি একবার দেখা যায় । তারপর একদিন মনে হল, না তার এমন করার কথা নয় ।
নাইমের সামনে দাঁড়াবার জন্য যেদিন সে নিজেকে যোগ্য করতে পারবে সেদিন যে ওর কাছে যাবে।
নিজেকে এক কঠিন পরীক্ষার ভিতর ফেললেও মাঝেমাঝে আবার যেতে ইচ্ছে করতো । ইচ্ছেটাকে আটকাতে না পারলে সে যেতো, কিন্তু মাঝ পথ থেকে ফিরে আসতো ।
এই ইচ্ছেকে বাড়তে না দেওয়ার জন্য এত কালের চেনা শহর ছেড়ে চলে গেলে বহুদূরে অন্য আরেক প্রান্তে । ছোট বেলার এক বন্ধুর সাহায্যে নতুন করে বাঁচার যুদ্ধে নেমে গেলো সে । লোকের বাড়িতে কাজ করা থেকে জীবনের মোর ঘুরাবার জন্য যা কিছু করার সবকিছু করেছে । রাতের স্কুল থেকে হাইস্কুল , কলেজ শেষ করে ভালো চাকরি। । আর ঠিক তারপরই অদ্ভুত ভাবে জামিল আবার এলো নাইমার জীবনে। এক বিকেলে কাজ থেকে ঘরে ফিরে চমকে গেলো নাইমা । জামিল বসে আছে বাড়ির সিঁড়িতে। তার মতই জামিলও অনেক বদলে গেছে। একবছর হল জামিল ফিরে এসেছে অ্যামেরিকায় । আসার পর থেকে নাইমাকে খুঁজে পেতে এত সময় লেগে যায়।
এতগুলো বছর ধরে যে কষ্টকে বুকের ভিতর চেপে রেখেছিল জামিলকে কাছে পেয়ে চেপে রাখা কষ্ট চোখের জলে ভেসে এলো।জামিলের বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিল কোন অবিশ্বাস আর অভিযোগ ছাড়াই। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ জামিলকে দেখাবার জন্য তাদের সন্তান ছিলো না । ছিলো শুধু নাইমার তলপেট জুড়ে ছেলের আগমনের প্রসারিত চিহ্ন। মাতৃত্বের চিহ্ন।
দুই বছর পর নাইমা আবার গেলো হাসপাতালে। মেয়েকে জন্ম দিতে। এবার আর সে একা নয়। হাসপাতালে এসেছে কত কাছের লোক । জামিল লেবার রুমে সারাক্ষণ । মেয়ে জন্ম নিয়েই বাবার কোল পেলো । আগের বারের সাথে এবারের কোন মিল নেই । মেয়েটি জন্ম নিতেও বেশি সময় নেয়নি ।
মেয়েকে বুকে নিয়েও কেবল মনে পড়ছিল সেই দিনের কথা । নাইমকে এমন করেই বুকের উপর নিয়েছিল । তবু তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি, আদর দিয়ে বড় করতে পারেনি। প্রথম সন্তানের ‘মা‘ ডাক শোনেনি !
মেয়েকে বুকে নিয়ে মেয়ের কানে কানে, মা ডাকবি তুই আমায় বলতেই চোখ ভিজে গেলো নাইমার । কেমন আছে নাইম! কত বড় হয়েছে এখন!
আবার প্রেগন্যান্ট হবার পরেই ডাক্তারকে নাইমা বোকার মতই বলেছিল, আমার পেটের এই দাগগুলো যেন মুছে না যায়, মিশে না যায় নতুন দাগের সাথে ।
ডাক্তার অবাক হয়ে বলেছিল, সবাই মুছে ফেলতে চায় আর তুমি …।
ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেছিল , এ আমার প্রথম সন্তানের স্মৃতি।
এতগুলো বছর শুধু পেটের দাগ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করেছে নাইমকে। আজ কাছে পেয়ে কতটুকু আদর নাইমকে দিতে পারবে ! ও যে অন্য কারো আদরের হয়ে আছে ।
সামিয়ারা আমেরিকা থেকে ইন্ডিয়াতে চলে গিয়েছিল নাইমের একবছর না হতেই । জানিয়েছিল সে কথা নাইমাকে । নিজেকে অনেক কষ্টে সামাল দিয়েছিল নাইমা । শূন্য হাতে ভিখিরীর মত নাইমের সামনে সে যাবে না, সেই প্রতিজ্ঞাই যেতে দেয়নি তাকে।
গাড়ীর আওয়াজ এলো – জামিলের আরেকবার চাপা গলায় ডাক – নাইমা এসো ! এসে গেছে !
বেল বাজাবার আগেই দরজা খোলার আওয়াজ এলো – নাইমা কান পেতে রইলো গলার আওয়াজ শোনার জন্য !
জামিল কেন বলছে , প্লিজ কাম ! কেনো ! কেনো বলছে না – বাবা এসো।
সামিয়ার হাসি শুনতে পেলো । জিজ্ঞাসা করছে নাইমা কোথায় !
কী করছে জামিল , ওদেরকে আবার জুতো খুলতে বলছে না তো ? নাহ , অনেকগুলো জুতোর শব্দ এলো ঘরের ভিতর অবধি ।
নাইমার হাত পা কাঁপছিল এই কিছুক্ষণ আগেও। হঠাৎ মনে হলো পেটের দাগগুলো যেন সেই প্রথম দিনের মত সতেজ, বড় বেশি তাজা হয়ে ফুলে উঠেছে । পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামলো নাইমা । লিভিং-রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে নাইম । কোলে দুইবছরের ইমা । নাকে নাক ঘষে আদর করছে বোনকে আর বোন হেসে ভাইয়ের কাঁধে গড়িয়ে পড়ছে । পাশে দাঁড়িয়ে আছে জামিল । কি অবাক করা মিল জামিলের সাথে নাইমের । করিম কি তাই দেখছে পাশে দাঁড়িয়ে ?
সামিয়ার হাতে হাত রেখে চেষ্টা করলো বলতে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাইলেও পারলো না । গায়ের স্কার্ফ দিয়ে মুখ চাপা দিতে হল । পায়ে পায়ে নাইমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । একটু ছুঁতে ইচ্ছে করছে । বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে । তবু পারছে না । কোথায় যেন একটা হাল্কা দেয়াল! নাইমা জানে সে এই দেয়াল সরাতে পারবে না । এই দেয়াল বানাবার অধিকার যে তারই দেওয়া ।
সামিয়া নাইমার কাঁধে হাত রেখে বলল, তোমাদের কাছে নাইম দুইদিন থাকবে । আমরা পরশু এসে ওকে নিয়ে যাব ।
কী ভীষণ কানে লাগলো সামিয়ার কথা – নিয়ে যাব!
আবারও সেই দুইদিনের জন্যই কাছে পাওয়া । অথচ এতগুলো বছর ধরে যোগ্য মা হওয়ার জন্য সব করেছে সে তবু দাবী করার অধিকার নেই তার ।
জামিলের কানেও কি গেলো কথাটা ? চমকে তাকালো কেনো ওর দিকে? এত অসহায় চোখে কেন তাকিয়ে আছে জামিল ?
নাইমা নিঃশব্দে জামিলকে বলে, নিয়ে যাবে, চলে যাবে ! নাইম আবার চলে যাবে …। নাইমকে আবার নিয়ে যাবে । নাইম যে যাবে বলেই এসেছে ।
আলতো করে নাইমের মাথায় হাত ছোঁয়ালো নাইমা । বারো বছরের নাইম বোনকে নিয়ে ব্যস্ত, তবুও যেন আড়চোখে একবার নাইমাকে দেখলো ।
নাইমার এক হাত ধরে অন্য হাতে নাইমকে কাছে টেনে নিলো জামিল । ভাইয়ের কোলে ইমা । নাইমার অশ্রুভরা চোখ জ্বলছে ।
মন চাইছে একটি মিরাকল – এই মুহূর্ত থেকে সময়টা থেমে যাক !