সমরেশ বসু: এক অপ্রতিরোধ্য কথাকার
সত্তরের দশকে উপন্যাসিক সমরেশ বসুর নাম শোনে নি তেমন মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠক খুঁজে পাওয়া ভার। বিশেষতঃ তাঁর বিবর ও প্রজাপতি উপন্যাসদ্বয় যে ঝড় তুলেছিলো তার ধাক্কা কমবেশী সবার বুকেই লেগেছিলো। আজ এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসুর জন্মদিন। সমরেশ বসু (১১ ডিসেম্বর ১৯২৪ – ১২ মার্চ ১৯৮৮) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক। তার জন্মনাম সুরথনাথ বসু; কিন্তু সমরেশ বসু নামেই লেখক পরিচিতি সমধিক। তিনি কালকূট ও ভ্রমর ছদ্মনামে উল্লেখযযোগ্য সাহিত্য রচনা করেছেন। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে। তিনি ১৯৮০ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে ভারতের কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বাবার নাম মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবালিনী বসু। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। তিনি একসময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইছাপুর বন্দুক কারখানায় চাকরি করেছেন সমরেশ বসু। এই সময়পর্বের মধ্যেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তার মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, ‘জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক’ (প্রতিক্ষণ, ৫ম বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ২–১৬ এপ্রিল ১৯৮৮)। লিখেছিলেন, ‘তিনি আমাদের মতো অফিস-পালানো কেরানি লেখক ছিলেন না, যাঁদের সাহস নেই লেখাকে জীবিকা করার অথচ ষোল আনার ওপর আঠারো আনা শখ আছে লেখক হওয়ার।’
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের বন্দুক ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়। জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি ছিল তার ছদ্মনাম। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাব তারে’ সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধর্মী উপন্যাস। হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে তিনি অমৃতের সন্ধান করেছেন। তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ অমৃত বিষের পাত্রে, মন মেরামতের আশায়, হারায়ে সেই মানুষে, তুষার শৃঙ্গের পদতলে ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস।
ভ্রমর ছদ্মনামে লেখা তিনটে উপন্যাস ১৩৮৯, ১৩৯০ ও ১৩৯১ বঙ্গাব্দের শারদীয়া প্রসাদ-এ প্রকাশিত হয়:’যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’ , ‘প্রভু কার হাতে তোমার রক্ত’ , ‘প্রেম – কাব্য – রক্ত’।
ছদ্মনামে লেখা ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। তার নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। ‘চিরসখা’ নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে তার সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনি গোয়েন্দা গোগোল ও গোগোলের কীর্তি নামে চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে।
উপন্যাস
সমরেশ বসু প্রণীত উপন্যাসের সংখ্যা ১০০।
- উত্তরঙ্গ (১৯৫১)
- গঙ্গা (১৯৫৭)
- বিবর (১৯৬৫)
- প্রজাপতি
- দেখি নাই ফিরে
- সওদাগর
- কোথায় পাবো তারে (১৯৬৮) (কালকূট ছদ্মনামে)
- নয়নপুরের মাটি (১৯৫২)
- বাঘিনী (১৯৬০)
- চলো মন রুপনগরে
- পাতক
- মুক্তবেণীর উজানে
- টানাপোড়েন
- স্বীকারোক্তি
- অপদার্থ
- সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা
- যুগ যুগ জীয়ে (১৯৮১)
- মহাকালের রথের ঘোড়া (১৯৭৭)
- শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে (১৯৮৪)
- বাঘিনী
- বিপর্যস্ত
- শাম্ব
- বিটি রোডের ধারে (১৯৫২)
- শ্রীমতি কাফে (১৯৫৩)
- অবশেষে
- আম মাহাতো
- কামনা বাসনা
- কে নেবে মোরে
- খন্ডিতা
- গোগোল চিক্কুস নাগাল্যান্ড
- ছায়া ঢাকা মন
- জঙ্গল মহলের গোগোল
- জবাব
- তিন পুরুষ
- দাহ
- নাটের গুরু
- নিঠুর দরদী
- পথিক
- প্রাণ প্রতিমা
- বাঘিনী
- বিদেশী গাড়িতে বিপদ
- বিবেকবান/ভীরু
- ভানুমতী ও ভানুমতীর নবরঙ্গ
- মহাকালের রথের ঘোড়া
- রক্তিম বসন্ত
- শিমুলগড়ের খুনে ভূত
- শেখল ছেঁড়া হাতের খোঁজে
- সেই গাড়ির খোঁজে
- স্বর্ণচঞ্চু
- হৃদয়ের মুখ
- প্রচেতোষ
প্রকাশিত ছোটগল্পের সংখ্যা ২০০।
- মনোমুকুর
তিনি ১৯৫৯ ও ১৯৮২ সালে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন।
সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ মারা যান। মৃত্যুকালেও তার লেখার টেবিলে ছিল দশ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস দেখি নাই ফিরে। এই উপন্যাসের চিত্রাঙ্কন করেন প্রচ্ছদ শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।
আজ এই মহান কথাশিল্পীর জন্মদিনে মনমানচিত্রের পক্ষ থেকে জানাই অতল শ্রদ্ধা।
*******************************