You are currently viewing সমকালীন ভারত ২০২৩: একটি পর্যবেক্ষণ || ফাল্গুনী ঘোষ

সমকালীন ভারত ২০২৩: একটি পর্যবেক্ষণ || ফাল্গুনী ঘোষ

সমকালীন ভারত ২০২৩: একটি পর্যবেক্ষণ
ফাল্গুনী ঘোষ

এই কলম আমার বিদ্রোহী ঘোড়া বিষাদ আগুন
প্রতিবাদে হরকরা ভারতের বুক চিরে ওঠে উপরে চন্দ্রযান
মণিপুর জ্বলে পিশাচ আগুনে নিত্য যুযুধান।

স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অতিক্রান্ত সূর্য ধীরে ধীরে মুখ লুকায় দিগন্তের লজ্জানীল আসমানে | দিকে দিকে জেগে ওঠে নরকের শয়তান | পিশাচের পদভারে পৃথিবী আজ রাশিয়া পুতিন | যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সময়ের দাবানলে | মৌন মোদী মুখ খুললেন ৮৪ দিন পর | উপজাতি দাঙ্গায় মণিপুর ক্ষত বিক্ষত | বেসরকারি হিসেবে ৩০০ মানুষ মৃত | ধর্ষিত বোন | বিভৎস বলাৎকার | মণিপুরে বিজেপি শাসন ২০০৩ এর রক্তাক্ত গুজরাট কে মনে করিয়ে দেয় | যদিও প্রেক্ষাপট আলাদা | গত পঞ্চাশ বছরে আমরা দেখেছি মানুষের রক্ত কতোটা ঝরেছে হাড় হিম বিভীষিকায় | প্রতিটি রাজনৈতিক দলের হাত রক্তরঞ্জিত | সে বাম বা ডান যেইহোক | এরা শুধু একে অপরের দিকে বুলেট ছোঁড়ে |

আলো আর আঁধারের এই পৃথিবীতে, এই দেশে, এই রাজ্যে মানুষ শান্তি চায় | শান্তির পায়রা আজ আর্ত, রক্তাক্ত | বিপন্ন স্বদেশ | বিষন্ন মন | অবারিত হিংসার দ্বন্দ্বভূমি | সরকার তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেনা | তিনমাস ধরে চলতে থাকা মণিপুরের দাঙ্গা এড়ানো যেতো | যদি দাঙ্গার প্রথমেই কঠোর ব্যবস্হা নিতো| মণিপুরের বিজেপি পরিচালিত সরকার , কেন্দ্রের বিজেপি পরিচালিত সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ | কেন্দ্র তখন কর্নাটকের ভোটের প্রচারে ব্যস্ত | স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহের প্রচেষ্টা সীমিত |

বিরোধী নেতা কংগ্রেস কোম্পানীর রাহুল গান্ধীদের কথা ও প্রতিবাদ কে সংসদে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি | আজ সুপ্রীম কোর্ট নড়ে বসায় সরকার দায়িত্ব দেখাচ্ছে | মনিপুরে তৃণমূল সুপ্রিমোর ভালোবাসার উপজাতি ভাইবোনেরা গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত | তিনি এতোদিন পর প্রায় তিন মাসের মাথায় কেন নমো নমো করে প্রতিনিধি টিম পাঠালেন | ভোট বড়ো বালাই | দাদার চোখ দাক্ষিনাত্যে, দিদির চোখ বাংলায়। দূরের উত্তর পুব ব্রাত্য কেন? উপজাতিদের জীবন যৌবন ধনের মূল্য বুঝি খুব কম? এর হিসেব শাসককে একদিন চোকাতে হবে | সে দিন খুব দূরে নয়।

চাঁদে রকেট পাঠানো যেমন সরকারের কাছে গৌরবের ,ঠিক তেমনই মণিপুরের দুজন ধর্ষিতা মহিলাকে দিনের রাস্তায় জনতার মাঝে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া কতোটা পৈশাচিক ও বর্বরতার তার হিসেব ও কলংকের ভাগ সরকারকেই নিতে হবে | সাতাত্তরে পা দিতে যাওয়া অভিনেত্রী ও সিনেমাকার অপর্না সেনকে দেখলাম ১২বছর পর তীব্রভাবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখতে | অপর্না দেবীর হাইবারনেশান কাটাতে এতগুলো বছর লেগে গেল | তবুও আশা জাগে| বুদ্ধিজীবীদের মৃত পৃথিবীতে তিনি আলো জ্বাললেন| হয়তো এবার ওনাকে দেখে কেউ কেউ ওনার হাত ধরে পথে নামবে| আমার এই লেখা আর কতোদূর পৌঁছাবে|

“তবে কি নতুন সব হিটলার মৃত্যুর কুটিল কারবারে
কাটায় প্রহর কালান্তক ঘাতকের মতো!
একদিকে মানুষের শান্তির বিড়ম্বিত হাহাকার
অন্যদিকে জল্লাদের ডাকে তীব্র হুংকার”।……..
(মহাকবিতা “সন্ত্রস্ত সময়”, ২০১৮ /ফাল্গুনী ঘোষ)

বাংলার সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোটের সময়কে ঘিরে গত ৩৮ দিনে ৫৫ জন মানুষের খুন হয়ে যাওয়া এক নিদারুণ যন্ত্রণার বিষয় | গরিব, নিম্নবিত্ত শিক্ষাহীন প্রান্তিক মানুষগুলি সামনের পাঁচবছর টাকা পয়সা করে কিছুটা খেয়ে পরে বাঁচবে বলে নিজেদের মধ্যে এই মারপিট ও খুনোখুনি করে| প্রসাদ খায় গাঁয়ের বড়ো নেতা আর রাজভোগ খায় রাজধানীর ধড়িবাজ কোরাপটেড নেতারা | যতোদিন না মানুষ এই সত্যটি মনের ভিতর চৈতন্যে না আনতে পারবে ততোদিন এই খুনের রাজনীতি চলবে |

১৯৯০ এর দশকে বিহারে লালুপ্রসাদের জমানায় এসব হতো | এখন নীতিশের জমানায় এসব আর হয়না | তিনি বিহারে কঠোর আইন এনে এতো এতো রেভেনিউ এর লাভজনক টাকাকে দূরে সরিয়ে বিহারকে নীতিগতভাবে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন | বিহারের মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের তরুণ ছেলে মেয়েরা জেগে উঠেছে | তারা পড়াশুনা করে সর্বভারতীয় চাকুরিতে বসছে | গুন্ডাগর্দি বন্ধের জন্য দরকার বেকার মানুষের হাতে কাজ | যে কাজে সে নিয়োজিত হলে তার ডেভিল ব্রেনটা নিষ্ক্রিয় হবে| টাকা রোজগারের সাথে সাথে সে চাইবে শান্তি ও সুন্দর জীবন |

গৌরবের বাংলা পাশাপাশি কোটি কোটি গ্যালন মদ বিক্রী করে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করছে | পথে বসছে নতুন জেনেরেশন | রাস্তায় যোগ চাকুরীপ্রার্থী | নেতাদের পকেট মোটা হচ্ছে | সরকারী কর্মচারিদের অধিকার ডি এ র টাকা না দিয়ে মহা অন্যায় করছে রাজ্যসরকার | ৫০০ টাকা , ১০০০ টাকা ভাতা দিয়ে গরিব মানুষের উপকার হচ্ছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই | কিন্তু পাইয়ে দেওয়া ডোল পলিটিক্স একদিন উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী ও তামিলনাডুর জয়ললিতাকে পথে বসিয়েছিল | সুতরাং এভাবে আর কতোদিন? চাকুরির পরীক্ষাগুলো আর হয়না | তার পরিবর্তে চালু হয়েছে কম পয়সার সিভিক পুলিশ, অতিথি অধ্যাপক, পারা টিচার | সব ক্ষেত্রে অল্প টাকার কনটাকচুয়াল পদ।

“আজ আর নেই কোনো স্বাধীন নাগরিক সমাজ
রঙিন পতাকার তলে দলে দলে প্রাপ্তির আশায়
ভিড় করে পিপাসু মানুষ ….খাদ্য বস্ত্র বাসস্হান
পদ ও সম্মানের আশায় ….
আকাঙ্ক্ষা তার অতিশয় অতিকায় দানবের মতো
বাড়তে থাকে দিনদিন …..প্রশ্নাতীত দাসত্বের জপমালায়” |

(মহাকবিতা “সন্ত্রস্ত সময়” , ২০১৮ / ফাল্গুনী ঘোষ)

অতি রাজনীতির করাল ছায়া প্রলম্বিত হতে হতে ঢুকে পড়ে আমাদের ভাতের হাঁড়ির ভিতর| আমাদের মানবিক ও শিক্ষিত বোধের যাপন আজ একা হতে হতে মুখ লুকায় বিষাদ আস্তিনে | গ্রামে ,পাড়ায়,গঞ্জে, শহরে, নগরে এমনকি স্কুলেও স্বাধীন মানবিক ও নিরপেক্ষ সংস্কৃতি আজ বিপন্ন | কোথায় গিয়ে দাঁড়বো আমরা | রাজা ও রানীর , মন্ত্রী ও সান্ত্রীর চেলা চামুন্ডারা পদসেবা করে কিছু পাবার আশায় আজ ক্ষমতার পতাকা তলে | অতি রাজনীতির এই ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল বাম আমলে | ১৯৯০ এর দশক থেকেই এর চলন শুরু।

তবুও তখন মানুষের বোধে ছিল আদর্শের সফেদ কবুতর | ন্যায় অন্যায় বোধে অধিক মানুষ পীড়িত হতো | টাকা পয়সা দিয়ে নয় , বরং মানুষকে বিচার করা হতো তার ভালো কাজ দিয়ে | গুণের সম্মান ছিলো, গুণীর কদর ছিলো | মানুষে মানুষে একটা প্রীতি ছিলো, ভালোবাসার নির্মলতা ছিলো| মানুষের কথার অধিকতর মূল্য ছিলো | আজ সেইসব গুণগুলি , আদর্শগুলি সামান্য টাকার পাওনা গন্ডায় হাইজাক হয়ে যাচ্ছে | কারণ কি | সময়ের গতিতে চলতে চলতে আমরা লক্ষ করছি যে টাকা আজ ভগবানের মতো নিয়ন্ত্রন করছে সবকিছু | সামাজিক সুযোগ সুবিধাগুলি অনেকদিন ধরে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত | শিক্ষার জাগতিক মূল্য কমতে কমতে তলানিতে |

আজ একজন তরুণ বা তরুণী, নতুন প্রজন্ম শিক্ষক গুরুর কাছে না গিয়ে রাজনৈতিক নেতার কাছে যায় | কারণ চাকুরি থেকে পদ , মঞ্চ থেকে মব সবকিছুই আজ ঠিক করে দেয় নেতা | সরকারি প্রকল্পগুলি গরিব ও সাধারণ নিম্নবিত্ত , এমনকি মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরাও মহানন্দে গ্রহণ করছে | অধিক সংখ্যক মানুষ প্রশ্ন করে না শিক্ষার মান ক্রমে ক্রমে অপসৃয়মান কেন! প্রশ্ন করলেই দলীয় বুলডগ গুলিকে লেলিয়ে দিয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয় | মাসল পাওয়ারের দাম বেড়ে গেল | মস্তানদের মূল্য আজ বেশি | শিক্ষিত মার্জিতদের মূল্য কমে গেছে অনেকদিন আগেই |

প্রশাসনের কৃপাপ্রার্থী আজ সিনেমা নায়ক থেকে গায়ক, শিল্পী থেকে শিক্ষাবিদ , কবি থেকে অধ্যাপক, নাটককার থেকে আইনজীবী | অযোগ্য মানুষ অথচ প্রশাসনের দলের লোক, তারাই আজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে | লাখ লাখ টাকা দিয়ে উপাচার্য পদ কিনে নিচ্ছে অধ্যাপক | আতান্তরে উপাচার্যরা দলদাস হয়ে পড়ছে | দলের সুপ্রীমোর অংগুলি হেলনে তার পথচলা | মেডিক্যাল থেকে বিদ্যালয়, খেলাধূলা থেকে পুজো পার্বণ সর্বত্র এই রাজনীতির অতি সক্রিয়তা সুস্হ ও সুন্দর সমাজ গঠনের এক প্রধান অন্তরায়|

যারা বিবেকের দংশনে দংশিত, যারা জীবনবোধের আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারলো না তারা ব্রাত্য। একটা ভীষণ অধঃপতিত সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ছি আমরা | সহজ সরল স্ট্রেট ফরওয়ার্ড মানবিক মানুষগুলি ডোডোপাখির মতো বিলীয়মান হতে হতে প্রায় নিঃশেষ | এখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কে কতো ডিপ্লোমাটিকালি নিজেকে প্রেজেন্ট করতে পারছে তার উপরেই দাঁড়িয়ে থাকছে তার ভাগ্য……..

“আজ কে কতো অপচিৎকারে মঞ্চ মাতাতে পারে
কে কতো জিরাফের মতো গলা তুলে জিতে নেবে পুরস্কার
কে কতো নগ্ন হয়ে লুটে নেবে অলীক অহংকার
তারই দুর্বিপাকে ভাঙছে আজ জীবননদীর পাড়”।

(“সিসিফাসের স্বপ্ন” মহাকবিতা সংগ্রহ ফাল্গুনী ঘোষ)

নতুন শতক কিংবা নতুন সহস্রাব্দ ২০০০ শুরুর আগে থেকেই আমাদের বিজ্ঞান শাখার বন্ধু বান্ধবদের দেখেছি ডাক্তার কিংবা এঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন। আমরা যারা আর্টস তারা মাস্টার হতে চাইতাম। আমি চাকুরির জন্য পড়াশুনা করিনি | জীবনকে সিরিয়াসলি নিইনি। যা হোক কিছু করে , কোথাও একটা পড়িয়ে পেট ভরাতে চেয়েছি | আর্টসের ছাত্র হিসেবে সবসময়ই ক্যারিসমাটিক | পড়াশুনা করতাম প্রচুর এবং এখনো সেই একই অভ্যাসে বাঁচি। গোটা পৃথিবীর ইতিহাস বিশেষ করে গত ১০০ বছর ও সমকালের রাজনীতি সম্পর্কে পড়াশুনা ও পর্যবেক্ষণ দরকার। নিজের রাজ্য দেশ ও পৃথিবীর সংস্কৃতি যতোটা সম্ভব জানতে হবে। তার জন্য খাওয়া দাওয়া, জামা কাপড়, ফ্যাসনের সুখগুলোকে ত্যাগ করতে হবে। এখন যে কথাটা বলতে চাইছি সেটা হল Brain drain. খুব বুদ্ধিমান ছাত্র ছাত্রীরা বাংলা ও ভারত ছেড়ে ইউরোপ আমেরিকা তে পড়াশুনা ও চাকরি করতে যায়। তারা অনেকসময় বিদেশি সুখে মত্ত হয়ে নিজের মাতৃভূমিকে ভুলে যায়। সারাজীবন বিদেশে কাটিয়ে কেউ কেউ আবার অবসর কাটাতে নিজের দেশে ফেরে। অবশ্যই সারাজীবনে প্রচুর ডলার ইউরো ইনকাম করে নিয়ে আসে। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই বেইন ড্রেইন আজ অনেক বেড়েছে। কর্মহীন বাংলার ছাত্রছাত্রী পাস করে পেটের তাগিদে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিক থেকে কর্পোরেট চাকরিজীবীরা সবাই। ২০০৩ পরবর্তী বাংলায় বাম সরকার চেয়েছিলো শিল্প। খুব ভালো কথা। ৬০ পারসেন্ট কাজ এগিয়ে যাওয়া সিঙ্গুরে টাটার ছোট গাড়ি কারখানা ন্যানোর কাজ বন্ধ হল। বিরোধী পার্টির উত্তুঙ্গ ও উন্মাদ আন্দোলনে শিল্প তল্পিতল্পা গুটিয়ে গুজরাট। সেসব দিনে বাম বিরোধী আন্দোলনে বাংলার বড়ো মিডিয়া গোষ্ঠির মানুষকে বিরোধীদের পক্ষে মুভ করানোতে নিদারুণ ভূমিকা ছিলো । বাংলাতে তারপর থেকে কোনো ভারী শিল্পের নিয়োগ আসেনি। টাটার মতো পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পগোষ্ঠিকে তাড়িয়ে দেওয়া মানে গোটা বিশ্বে বার্তা গেলো বাংলার মানুষ শিল্পবান্ধব নয়। তারা কৃষিতেই সুখী। বড়ো শিল্পকে কেন্দ্র করে যে ছোট অনুসারী শিল্পগুলি হুগলির সিঙ্গুরের বুকে গড়ে উঠতে চলেছিল তা প্রশাসক বাম এর বিরোধী জোটের আন্দোলনে অংকুরে বিনষ্ট হলো |

বাংলার তরুণ তরুণীদের মাথায় বজ্রপাত | দশ হাজার মানুষের নিশ্চিত কর্মসংস্হান ভানডালিজমের গর্ভে শুকিয়ে গেলো | যদিও বামেরা হলদিয়া পেট্রোকেমিকালস ও বক্রেশ্বরের তাপবিদ্যুৎ ছাড়া ভারী শিল্পে আর কিছু করতে পারেনি | দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে অনেক সুযোগ ছিলো| বরং তাদের অনৈতিক শিল্পবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপ ফেলে অনেক শিল্পপতিরা পালিয়েছে | তবুও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধ বাবু শেষ চেষ্টা করেছিলেন | ২০১১ তে ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন। মে মাসের ১৩, ২০১১ তে শপথ বাক্য পাঠ করলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। আমি সেইদিন ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে ভীড়ে ভীড়াক্কার জনতার মাঝে উৎসুক চিত্তে জায়ান্ট স্ক্রীনের সামনে ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম | বিপুল জনতার হর্ষধ্বনি নতুন দিনের নতুন স্বপ্নের আশায়। ২০১১ থেকে আজ এই ২০২৩, গংগার জল বয়ে গেছে ধীরে | ভারতের ভাগ্যাকাশে ঘটেছে ক্ষমতার বিভিন্ন হাতবদল | আজ স্বাধীনতার ৭৬ বছরে দাঁড়িয়ে এই বোধ প্রকটতর হতে থাকে যে এ শুধু শাসনের হাতবদল | বিদেশি শাসকের হাত থেকে দেশি শাসকের হাতে | গণতন্ত্রের মোড়কে এ এক অভিনব লুট | আমাদের সুভাষ বোসেরা এ স্বদেশ কি চেয়েছিলেন? বণিক প্রভুর অংগুলি হেলনে বন্দি রাজনীতির কুশিলব | ক্ষমতার দর্পিত দর্পনে প্রতিদিন আমাদের মুখ দেখা | কোরাপশনের কুৎসিৎ বীভৎস মুখ বারবার আমাদের উদ্বাস্তু করে | ধনী আরও সম্পদশালী হয়, গরিবের ধন লুট করে ধনীর হাত | কিনে নেয় অল্পদামে জীবনের খিদে | শ্রমের নিষ্পেষিত ঘামে দেশের গুলবাগিচায় ফোটে গৌরব গোলাপ | রাজনীতির হাড়িকাঠে বন্দি আমরা সবাই | আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে দেয় অদৃশ্য সেলফিস জায়ান্ট | ধর্ম থেকে কর্ম, শিক্ষা থেকে সংস্কার, খাদ্য থেকে বস্ত্র সবজায়গায় অতিরাজনীতির আগ্নেয় লাভা নির্গত হতে হতে আমরা ক্লান্ত | গত বারো বছরে আমাদের বংগে উন্নয়ন হয়নি তা নয় | রাস্তাঘাট , বিদুৎ , জল , বড়ো বড়ো বিল্ডিং , শহরের সৌন্দর্যায়ন , হসপিটাল বিল্ডিং, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকগুলি জনহিতকর প্রকল্প | আমরা এসব চোখে দেখতে পাচ্ছি| এনজয় করছি প্রতিদিন |

কিন্তু যা চোখে দেখতে পাই না , যেটাকে অনুভব করতে হয় তা হল আমাদের শিক্ষা পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেছে | ২০ বছর ধরে শিক্ষার জগতে বিচরণ করে এ বিষয়ে আমি খুব পরিষ্কার | এই শিক্ষাই কিন্তু জাতির মেরুদন্ড | পরিকল্পিত ভাবে শিক্ষার নির্মিত সুরভিত অট্টালিকা থেকে প্রতিদিন একটি একটি করে ইঁট খুলে ফেলা হয়েছে | অশিক্ষিত পেশী শক্তিতে বলীয়ান লোকেদের সমাজের প্রতি স্তরে আজ বিচরণ | রাজনীতির নেতারা নেত্রীরা তাদের প্রমোট করে বিভিন্ন কাজে | অতি সম্প্রতি পঞ্চায়েত ভোট যার প্রকৃষ্ট প্রমান | শিক্ষার পবিত্র সময়কে নষ্ট করে বিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন প্রকল্পের অনুদান দেওয়া হয় | আজকের দিনটা পেটে খেয়ে বেঁচে থেকে সরকারকে ভোটটা দাও |

আগামী দিন অন্ধকার | কারণ আগামীর জন্য প্রস্তুতির যে সময় ও শিক্ষা নষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন তার খেসারৎ কে দেবে, সরকার? না। আবার আসবে নতুন সরকার নতুন জামা গায়ে। তারাও তাদের মত পরিচালনা করবে সে আগামী। সাধারণ মানুষ এইভাবে হয়ে ওঠে ভোট পাবলিক | গণতন্ত্রে ইহাই সত্য | মধবিত্ত শিক্ষিত সমাজ আজ আর সরকারি স্কুলগুলিকে বিশ্বাস করে না | তারা তাদের সাধ্যমত টাকায় ছেলেমেয়েদের বেসরকারি ইংরাজী মিডিয়ামে পড়ায় | এমনকি সরকারি শিক্ষকরা তাঁদের বাচ্চাকাচ্চাদের নিজেদের স্কুলে পড়ান না | কারন তাঁদের মাথার উপর সরকার সত্য তাহার উপর নাই | বাংলা আজ মরুভূমি | শিক্ষা আর সংস্কৃতির একদা পীঠস্হান বাংলা আজ মৃতপ্রায় | অপসংস্কৃতির কারবারিদের হাতে বন্দি | কবে আসবে আবার রেঁনেসাঁস? এই বিষয়ের শেষ পর্বের লেখাতে ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে কিছু ভাবনার উদ্রেক হোল তা নিয়ে আলোকপাত করছি। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় ক্ষেত্রেই শাসক সরকারের প্রবণতা হল বিরোধীহীন আধিপত্য কায়েম করা। গণতন্ত্রে বিরোধীপক্ষের বিসর্জন এর অর্থ হোল সরকারের ক্রমশ ডিকটেটরের ভূমিকীয় অবতীর্ন হয়ে ওঠা | একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট অর্থাৎ জনকল্যাণকামী শাসনব্যবস্হা চালু রাখতে হলে জনগণের আশুসমস্যাগুলি নিরসন করার মধ্য দিয়ে ভাবতে হবে তার সুদূরপ্রসারী উন্নতি | দেশ বলতে মানুষ | দেশ বলতে প্রকৃতি | দেশ বলতে লিভিং থিংগ্স |

৭৬ বছর স্বাধীনতার প্রাক্কালে আজ এই বিষয় খুব বেশি করে বলতে হয় যে দেশের সম্পদ লুট করেছে কিছু বণিক ও রাজনীতির কারবারি | কিন্তু কিভাবে ? খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে রাজনীতির কারবারিরা ভোট হান্টার্স | ভোট বিজ্ঞাপন এর টাকা তাদের চোজেন রাজনৈতিক দলকে অনুদান হিসেবে দেয় দেশের বড় বড় শিল্পপতি ও বিজনেস টাইকুনরা | ভোট মিটলে দল জিতলে সেই টাকা সুদে আসলে ১৪১ কোটি জনগণের পকেট কেটে তুলে নেওয়া হয় | তারজন্য ওইসব বড় বড় ব্যবসাদারদের উৎপাদিত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে আকাশ ছুঁতে থাকে ঠিক ভোটের পর | এক অর্থে রাজনীতির কারবারি ও বিজনেস টাইকুন একে অপরের মুখপাত্র | জনগণ হোল খেলার গুটি | মাস মুভ করে রাজনীতির নেতা | শিক্ষিত মানুষকে মুভ করা কষ্টের | অশিক্ষিত মানুষ হোল ঝাঁকের কই | এরা আবেগে চলে | এদের মষ্তিষ্ক কম | সুদূর প্রসারী ভাবনা ভাবতে পারে শিক্ষিত মানুষ | সে মানুষের সংখ্যা এখনও কম | বেশ কম | স্বল্পশিক্ষিত মানুষটি রাজনৈতিক পদলোভে এবং কিছু মাসোয়ারার লোভে এলাকায় নেতা হয়ে ওঠে | তার দায়িত্ব লোকাল মাস মুভ করা | কোন সরকার চায়না মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠুক | বাম আমলে প্রাইমারিতে ইংরেজি বন্ধ করে কয়েকটা জেনেরেশনকে পথে বসানো হয়েছে | স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই হয়েছে | সেগুলির বেশিরভাগ টিমটিম করছে | নামকরা প্রাইভেট স্কুল কলেজগুলি , রামকৃষ্ণ মিশনের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের মান ধরে রেখেছে | কিন্তু তাতো খুব সীমিত | তামাম জনতার জন্য যে ব্যবস্হা তা খুব অরুচিকর। ভারতে শেষবারে শিক্ষার জন্য বাজেট কমেছে , মোট বাজেটের মাত্র ৩ শতাংশ | প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে অনেক | ৭ দশক ধরে অর্জন করা সরকারি সম্পত্তি রেল এয়ারযান বিক্রি করছে কেন্দ্র সরকার | রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ বি এস এন এল কে রুগ্ন সংস্হায় পরিণত করা বর্তমান কেন্দ্র সরকারের ” মহান অবদান” | আম্বানি আদানি নামক শিল্পপতিদের প্রচুর পাইয়ে দিয়ে রাষ্ট্রকে ফকির করাও জাতীয়তাবাদের অংগ | শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে বিদেশে ভারতের নাম ও দাম বেড়েছে | জিডিপি নাকি বেড়েছে | পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেকারত্ব | কিছু মানুষ হয়েছে সর্বশ্রান্ত | জল জমি জংগল দখল করে নিতে চায় ধনী লোক জংগলের অদিবাসীদের উৎখাত করে | শিল্প হবে, দেশ আধুনিক হবে, ইউরোপ আমেরিকা চিন জাপানকে টেক্কা দেবে |

কিন্তু দেখা যাচ্ছে এক বিরাট সংখ্যক জনগন নিরক্ষর, খবরের কাগজ টাও তারা পড়তে পারে না, নাম সইও না | রবিঠাকুরের বাণী মনে পড়ে| উন্নয়নের সমস্ত কিছু ভোগ করে ২০ ভাগ মানুষ আর বাকি ৮০ ভাগ এর অবস্হা রিকেট রুগীর মতো | একটি সত্যিকারের সুষম সম্পদশালী দেশ তৈরী করতে গেলে proper and more or less equal distribution of wealth দরকার। ভারতের দরকার কিছু নির্লোভ নেতার | যে নেতাদের জীবনের যাপন হবে খুব সাধারণ | যাদের দেখে জনগণ ও নতুন প্রজন্ম সামনে থেকে শিখবে | যেমন আমরা নেতাজি সুভাষকে দেখে শিখি | যেমন আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেখে শিখি | ভারতের দরকার কিছু দেশসেবক বিজ্ঞানীকে | ভারতের দরকার আরো কিছু ভালো শিক্ষক মহাশয়ের যারা হবে নতুন প্রজন্মের রোল মডেল | ভারতের দরকার কিছু সৎ ব্যবসাদারের। দরকার কিছু মানবদরদি চিকিৎসকের | কিছু সৎ আইনজীবীর| দরকার কিছু কলার তোলা দাসত্ব না করা নির্ভীক সাংবাদিকের | আর দরকার কিছু খাড়া মেরুদন্ডী লেখকের | পুরস্কার নাম খ্যাতি যাদের ছোঁবে না | যাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে সময়ের গান | যাদের ভাষা তে গলা মেলাবে তরুণ তরুণী , তামাম জনগণ | আমি অপেক্ষায়, আমরা অপেক্ষায় |

=============================
ফাল্গুনী ঘোষ
কবি, সম্পাদক ও মুক্তচিন্তক
=============================