সভ্য না অসভ্য?
অতীশ চক্রবর্তী
আগে “শ্লীল” বলতে বুঝতাম -রুচিসম্মত বা শিষ্ট এবং ভদ্র। অভিধান বলছে ‘শিষ্ট’ শব্দটির অর্থ শান্ত, ভদ্র, সুশীল, সুবোধ, নীতিমান, শিক্ষিত, মার্জিত; আর শিষ্টাচার শব্দের মধ্যে যে ‘আচার’ আছে সেই শব্দের মানে হল, শিষ্টজনদের অনুমোদিত পদ্ধতি বা নিয়ম। যিনি তাঁর কথায় ও কাজে এই দুই গুণকে নিয়ত প্রকাশ করে থাকেন তাদেরকে আমরা শিষ্টাচারী বলে থাকি। আর এই সব গুণাবলীর বিপরীতে যদি কিছু থেকে থাকে তাকেই বলা হত “অশ্লীল”।
আমাদের ছোটবেলায় কিছু কিছু শব্দ ছিল যা তথাকথিত অশিক্ষিত বা নিম্নমানের রুচি সম্পন্ন লোকেরা যত সহজে যত্রতত্র বলত, তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের লোকেরা তা বলত না, অন্তত লোকসমক্ষে বলত না। সেগুলোকে অশ্লীল শব্দ বলে গণ্য করা হত। সেই সময়ে একজন লোকের শিক্ষাগত মান, সামাজিক মান থাকলে তিনি সর্বসমক্ষে গালাগালি বা অশ্লীল শব্দাদি উচ্চারণ করতেন না। কিছু কিছু কাজকম্ম লোকসমক্ষে করা বা না করার মধ্য দিয়ে সভ্য ও অসভ্যের মধ্যে একটা বিভেদ রেখা টানা হত। ভদ্র-সভ্য পোশাক পড়তে দেখলে মানুষটি আচার ব্যাবহারে ভদ্র-সভ্য হবেন এরকমটাই সাধারণত হত। পাড়ার মোড়ে গুলতানি করা রিকশাওয়ালাদের মধ্যে, সাট্টার আসরে বা বাস কন্ডাক্টর থেকে শুরু করে পাড়ার মস্তানরা যে শব্দ ব্যবহার করে গালাগাল দিত তা লোকসমক্ষে তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোকরা ব্যবহার করতেন না। কোনও পেশাই ছোট নয়, চুরি না করে যে কোনও পেশা নিয়ে রোজগার করার মধ্যে কোনও লজ্জার ব্যাপার নেই। কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ দরিদ্র এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ন্যুনতম প্রথাগত চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষার বাইরে তাই এই শ্রেণীর মধ্যে শিষ্টাচারের অভাব হত। মায়েরা তক্কে তক্কে থাকত, এই বুঝি আমার ছেলেটা ওই বখাটে ছেলেটার পাল্লায় পরে বখে গেল। ওই রাস্তাতে যারা সারাদিন গুলি খেলে তাদের মত মুখ খারাপ করে যেন বাড়ী না ফেরে। তখন কি আমরা কোনও অশ্লীল শব্দ শুনি নি বা জানি নি? অবশ্যই শুনেছি কিন্তু তার খুল্লা-মুখুল্লা ব্যবহার করতে আমরা রীতিমত বিরত থাকতাম। স্কুলে ভালো ছাত্র, বরাবর প্রথম তিনের মধ্যে থাকি, বাবা অধ্যক্ষ, সমাজে মান ও স্বীকৃতি আছে এসব বিবেকের ধমকে মাথা নত করত। আজকের প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না, যে একটা সময় ছিল যখন একজন স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখ থেকে গালাগাল বেরোবে একথা একপ্রকার ভাবাই যেত না। বা অন্যরকম করে বললে, যদি কেউ দিয়েও থাকেন, তাঁকে সর্বসমক্ষে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হত না, সকলে ঘৃণা করত। আগে গুরুজন ভেবে যাদের প্রণাম করতাম তাদের ক্ষেত্রে এরকমটাই আশা করা হত, তাঁরা নিজেরাও এব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এখনকার প্রজন্মের কাছে তাঁরা মিউজিয়ামে রাখার মত বস্তু বটে।
যখন থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে তখন থেকেই খিস্তি খেউর সমাজে বরাবরই ছিল। যারা সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা করত তারা এগুলো থেকে আপাতভাবে বিরত থাকত। কিন্তু কখন এবং কিভাবে ধীরে ধীরে তার পরিবর্তন হল সেটাই এখানে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার বিষয়। অশ্লীলতার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়ালো নগ্নতা এবং যৌনতা। শ্লীল কি আর অশ্লীল-ই বা কি, দেশ, কাল ব্যতিরিকে তার সঠিক এবং সর্বগ্রাহ্য কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। আজও কেউ দিতে পারবে না। ভবিষ্যতেও কেউ দিতে পারবে না। এটাই শ্লীল ও অশ্লীল – এই দুইয়ের ফ্যালাসি বা বিভ্রান্তি।
একজনের কাছে যাহা শ্লীল অন্যের কাছে তা অশ্লীল বলে পরিগণিত হতে পারে। এক দেশে যাহা শ্লীল অন্য দেশে তা অশ্লীল হতেই পারে। এক ধর্মে যাহা পরিশীলিত, অন্য ধর্মে তা অশ্লীল হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সবটাই আপেক্ষিক। এক একটি সভ্যতা ও সমাজ, বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলি তাদের সৃষ্টির শুরু থেকেই নিজ নিজ বিচার বুদ্ধিতে আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করত। অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয়বিধান শ্লীল ও অশ্লীলতার সংজ্ঞার একটা ধাঁচা বেঁধে দিত। সেই নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে যুক্তি যত না থাকত, ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষমতার দম্ভ থাকত বেশী, নারী-বিরোধী পুরুষতন্ত্রের হুঙ্কার থাকত বেশী। অথচ আমরা আজ যেভাবে শ্লীল ও অশ্লীলতার ব্যাপারে অত্যন্ত সংবেদনশীল কিছুদিন আগেও তা ছিল না।
অতীতে শ্লীল ও অশ্লীলতা নিয়ে কি ভাবা হত সেটা যদি আলোচনা করতে হয় তাহলে আমাদের এক এক করে ফিরে যেতে হবে হাজার হাজার বছর আগের পুরানো সভ্যতাগুলোর দিকে। গ্রীক ও রোমান সভ্যতা খুব পুরানো এবং সভ্যতার বিবর্তনে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই সভ্যতাটি প্রভাব বিস্তারকারী ও দিক নির্দেশনাকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় নগ্নতা ও যৌনতাকে সাধারণত প্রাকৃতিক এবং ইতিবাচক হিসাবেই ভাবা হত। পাপ, লজ্জা ও ধর্ম বিনাশকারী কোনও রূপে নগ্নতা ও যৌনতাকে দেখা হয় নি। অনেকে মনে করেন যে “অশ্লীলতা” নামে কোনও ধ্যান ধারণা তাদের ছিল না। সভ্যতার সময় সারণী ধরে পিছোতে থাকলে দেখা যাবে যে ইংরাজি obscene শব্দটি ফ্রেঞ্চ বা ল্যাটিন থেকে এসেছে। ১৫৯০ সাল নাগাদ এই শব্দটির উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। Latin obscenus মানে “offensive,” especially to modesty বা বিনয়ী না হওয়া। আবার ob মানে “in front of” + caenum “filth মানে নোংরা, ময়লা – এই দুইয়ে মিলে obscene শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। খৃষ্টপূর্ব ২৭ সাল থেকে ১৪৫৩ খৃষ্টাব্দ – এই বিশাল সময় ব্যাপী রোমান রাজত্বে এই শব্দটির কোনও ধারণা বা অস্তিত্ব ছিল না বলে মনে করা হয়। যেমনটা আগে বলেছি, পাপ, লজ্জা ও ধর্ম বিনাশকারী কোনও রূপে নগ্নতাকে ও যৌনতাকে সেই সময়ে দেখা হয় নি। গ্রীক সভ্যতার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। আমরা সকলেই জানি যে গ্রীক এবং রোমান সাহিত্য এবং চিত্রকল্পে নিয়মিতভাবে যৌনতাকে বেশ স্পষ্টভাবেই চিত্রিত করা হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে যে কোনও ধরণের আইন হস্তক্ষেপ করাকে অবজ্ঞার সাথে দেখা হত। যদিও রাষ্ট্রদ্রোহীতা, ধর্মবিরোধীতা করার শাস্তি ছিল, কিন্তু কাউকে যৌন অভিব্যক্তির কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এমনটি দেখা যেত না কারণ তাদের অভিধানে “অশ্লীল,” ধারনাটির অস্তিত্ব তখন ছিল না। বৈদিক যুগে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এগুলিকে পাপ হিসাবে ধরা হলেও যৌনতাকে সেভাবে দেখানো হয় নি। লালসা, ক্রোধ এবং লোভ এই তিনটি প্রবৃত্তিকে নরকের দিকে যাওয়ার তিনটি দরজা বলে মনে করা হয়েছে। প্রতিটি বিবেকবান মানুষের উচিত এগুলো ত্যাগ করা, কারণ এগুলো আত্মার অবনতির দিকে নিয়ে যায় বলে মনে করা হত। তার বিপরীতে নগ্নতা ও যৌনতাকে প্রাকৃতিক সহজাত ব্যাপার হিসাবেই বরাবর ধরা হয়ে এসেছে। যতগুলি পুরানো সভ্যতা আছে, প্রায় সবগুলিতেই নগ্নতা ও যৌনতার সদর্থক উল্লেখ আছে। পাহাড়ের গায়ে, গুহার গায়ে, নানা রকমের চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কাব্যগ্রন্থ, নানা নাটকীয় শিল্পকলা, সঙ্গীত ও রচনাতে নগ্নতা ও যৌনতার স্বাভাবিক উপস্থিতি রয়েছে। আদি প্রাকৃতিক সংস্কৃতিগুলিতে যৌনতাকে অতিপ্রাকৃত শক্তির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মধ্যে এর সহজ গ্রহণযোগ্যতা ঘটেছে। তার কিছু অবশিষ্ট এখনও যে নেই তা নয়। আফ্রিকা মহাদেশে লেসোথো রাষ্ট্র এবং ভারতে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে জারোয়া উপজাতিদের দেখলেই বোঝা যায়। তাদের মধ্যে এখনও যেভাবে নগ্নতা ও যৌনতা প্রাকৃতিক সহজাত গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আছে তাকে আমরা তথাকথিত সভ্য মানুষ অনুধাবন করতে পারব না। আমরা তাদের নগ্নতা দেখে তাদের অসভ্য বলি বটে কিন্তু নিজেদেরকে কি তারা নিজেরাও অসভ্য বলে মনে করে? মনে তো হয় না। যৌন অভিব্যক্তির যে বহিঃপ্রকাশের কারণে আজ এত শ্লীল ও অশ্লীল – এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের ঘূর্ণাবর্তে পাক খাচ্ছি তা আমাদের মানসিক বিকারের ফল।
মনে করা হয় যে খৃস্ট-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই ব্যাপারে চিন্তা ধারার ব্যাপক পরিবর্তন আসে, নগ্নতা ও যৌনতা, শ্লীল ও অশ্লীল এই দুই ধারায় ফেলে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ধর্মের ব্যাপক কড়াকড়ি শুরু হয়। এই কড়াকড়ির ফলে পুরুষতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করার নামে, মহিলাদের সম্মান রক্ষার নামে তাদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, বস্তুত তাদের গৃহবন্দী করে রাখা শুরু হয়। তবে শিল্প বিপ্লবোত্তর আধুনিককালে মুক্ত চিন্তার ধ্যান ধারণা, নারী মুক্তি আন্দোলন, ইত্যাদির ফলে এই বিতর্কের একটা আলাদা সদর্থক মাত্রা এসেছে ঠিকই কিন্তু শ্লীল ও অশ্লীল এই দুই পরিপ্রেক্ষিতের সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা এখনও দিতে পারে নি। বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী আইনকানুনের মাপকাঠিতে যে সংজ্ঞা তৈরি করা হয়েছে তাকেই আমরা কিছুটা সর্বজনগ্রাহ্য একটা কাঠামো হিসাবে মেনে নিলেও তা আক্ষরিক অর্থে একটা জোড়াতালি দেওয়া সমাধান। তাই মাঝেমাঝে আমি ভাবি আমরা কি আসলেই সভ্য না অসভ্য!!
অতীশ চক্রবর্তী: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক
ফিলাডেলফিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
*****************************