সব শব্দই উদ্বাস্তু
ঋতো আহমেদ
অদ্ভুত নৃশংসতা আর আশ্চর্য করুণার মধ্যেই বিস্তৃত রয়েছে জার্মান বংশদ্ভুত সুইডেনের কবি নেলি জাক্সের (Nelly Schas) রচনা সম্ভার। বিস্ময়কর প্রবলতার সেই ১৬ বছরের চিঠিপত্র-যোগাযোগের সময়টায়, পাউল সেলান আর নেলি জাক্স মাত্র হাতে গোনা কয়েকটিবারই দেখা করতে পেরেছিলেন। আর সেটি ছিল ১৯৬০ সালের একটাই মাস। প্রথমে জুরিখে, তারপর প্যারিসে। সেদিন খুব প্রসন্নভাবেই সেই উত্তরণ উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে তাঁরা ওই ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে জুরিখের সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করছিলেন। পরস্পর কথা বলে যাচ্ছিলেন অনেক বিষয়েই। পরে, সেলান তাঁর কবিতায় তাদের সেই প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখলেন—
আলাপ হয়েছিল বৃহৎ বিষয়ের, হয়েছিল
সামান্যেরও। তোমাকে নিয়ে
আর তোমার প্রতিরূপকে নিয়েও, কী-করে
পর্যবসিত হতে পারে স্বচ্ছতাও আন্ধকারে, হয়েছিল
ইহুদিত্ব নিয়ে, আর হয়েছিল
তোমার ঈশ্বর বিষয়ে।
যুদ্ধোত্তর জর্মন কবিতায় যদি জনপ্রিয় অ্যাংলোফোনের সমাদরকে প্রাধান্য দিয়ে দারুণ প্রভাব বিস্তার কেউ করে থাকেন, তবে তিনি সেলান। আর তাই হয়তো ব্যাপারটা বিশেষভাবে জাক্সের জন্য উদ্বেগজনকই। কারণ, তাঁদের দুজনেরই জীবন ও সাহিত্য সংক্রান্ত অনেক বিষয়েই মিল পাওয়া যায় আকর্ষণীয়ভাবে। মনে হয় যেন তাঁরা ভাই বোন। অবশ্য একে অপরকে তাঁরা ভাই/বোন বলেই সম্বোধন করতেন। কারণ, তাঁদের দুজনেরই জীবন শিল্পায়ত গণহত্যায় ভীষণরকম প্রভাবিত। দুজনেই নির্বাসিত হয়েছিলেন নাৎসি নির্যাতন ক্যাম্পে। যে’সব ঘটনাক্রম দুজনকেই পরবর্তীতে কবিতায় নিয়ে আসে। দুজনেই তাঁদের প্রথম দিককার গীতিকবিতার জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেলানের ক্ষেত্রে যেটা ছিল “ডেথ ফুগু”, জাক্সের ক্ষেত্রে সেটা “ও দ্য চিমনিস।”
হে চিমনি
মৃত্যুর চতুরতায় তৈরি গৃহের
ওপর দিয়ে
ইসরায়েলের কোনও দেহ, ধোঁয়ার মতো ভেসে যায় যখন
বাতাসে বাতাসে—
চিমনির নিঃসরণ আর ওই নক্ষত্রের অভিবাদনে স্বাগত সে,
ওই যে নক্ষত্র, কালো হয়ে গেছে ওটা,
নাকি সূর্যেরই কোনও রশ্মি?
দুজনেই পরবর্তীতে তাঁদের সুপরিচিত রচনাগুলো সম্পর্কে একইরকম সংবেদন প্রকাশ করেছিলেন। ওগুলোকে দেখিয়ে ছিলেন কিছু প্রামাণিক সাক্ষ্য হিসেবে। যেন সেই অপরাধীরা তাদের অপরাধের ইঙ্গিত পেয়ে যায় সুচারুভাবেই। জর্মন পাঠ্যক্রমে যেগুলো আরোপিত হয়ে আছে আজীবন। জীবনের শেষ দিকে তাঁরা দুজনেই তাদের রচনার ক্রমবর্ধমান জহুরি শৈলী থেকে সরে এসেছিলেন। কারণ, তাঁরা দুজনেই ভুগছিলেন গুরুতর ভ্রম-বাতুলতার মানসিক রোগে। তাঁদের সাক্ষাতের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জাক্স ইথারে যেন কারও আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন। তাই হয়তো চিঠিতে সেলানকে তিনি লিখলেন, “নাৎসি আধ্যাত্মবাদী এক দল রেডিও টেলিগ্রাফ ব্যাবহার করে ভয়ংকর এক কুতর্কে আমাকে ঘায়েল করতে চাইছে সেলান।” সেলানও ঠিক সেই সময়টায় সকালে তাঁর ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যেতে ভয় পেতেন। তাঁর মনে হতো, গেস্তাপোর (জার্মান গুপ্ত পুলিশ) এজেন্টরা তাঁদের অপহরণ করে নিয়ে যাবে। জাক্স আর সেলান তাঁদের কবিতায় মৌলিক একটি বিশ্বাসকে ভীষণ নেক্রোম্যান্টিক [যাদুবিদ্যাময়] প্রক্রিয়া হিসেবে বজায় রেখেছিলেন। তবে, মুক্তির ভান সর্বস্ব বিজাতীয় আভিজাত্যের কিছুই ছিল না সেখানে— ছিল কেবল বিনয়ী আর পরস্পর যোগাযোগের দুঃসাধ্য প্রয়াস। ছিল পণ, ভাষার বিচক্ষণ ব্যবহার আর বিস্মৃতির প্রবাহের রোধ। প্যারিসে, ১৯৭০ সালে সেলান যে’দিন তাঁর পরম বিস্মৃতিকে খুঁজে নিয়েছিলেন প্যঁ মিখাব্য থেকে লাফিয়ে পড়ে,— সেই মৃত্যুর ঠিক তিন সপ্তাহ পর তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিনই মারা যান নেলি জাক্স। এও এক অদ্ভুত মিলই বলা যায় দুজনের।
১৮৯১ সালে ধনাঢ্য এক শিল্পপতি পরিবারে জন্মেছিলেন নেলি জাক্স। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন তৎকালীন বার্লিনের ইহুদি সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জন। তারা সুচারুভাবে ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জোয়া সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলেন। ছুটির দিনও পালন করেন নি কিংবা যোগ দেন নি সিনেগগেও [ইহুদিদের মন্দির]। তাঁর বাবা গুটটা-পারচা উৎপাদনের মাধ্যমে ভালো ব্যবসা করছিলেন। গুটটা-পারচা হচ্ছে রাবারের মতো দেখতে একপ্রকার পলিমার। সে সময় খুব চাহিদা ছিল এর। পানির নিচের টেলিগ্রাফ তারের নিরোধক হিসেবে এর ব্যবহার ছিল পৃথিবী জুড়ে। জীবনের প্রথম তিন দশক জাক্স তাঁর বাবা-মা’র সাথে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিলেন। যা তাঁকে দাম্পত্য কিংবা পেশাগত উভয় জীবনেই সামনে এগিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত করেছিল। ক্রমাগত অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছে। তাই ক্রমশ আরোগ্য লাভের লম্বা প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তাঁর। নিজের প্রথম জীবনের অতিবাহিত বছরগুলোকে অভিহিত করতে গিয়ে বলেছেন, “জীবনের মরণ-কামড়ের ভয়ানক মুখোমুখি হতে সেই ছোট্ট মেয়ের সেটা ছিল দারুণ নিঃসঙ্গ এক নরক।” শুরুতে নাচের প্রতিভা নিয়ে আলোড়ন চলছিল কিছু। কিন্তু তাঁর স্বৈরাচারী বাবা সেটা নাকচ করে দিয়েছিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের অন্য যে কোনও আকাঙ্ক্ষার মতোই। তারপর থেকেই তাঁর অন্তর্নিহিত ছন্দময় অন্তর্দৃষ্টি অন্য কোনও মাধ্যম খুঁজতে থাকে। এবং পরবর্তীতে কবিতায় তাঁর কর্ণকুহর এক সতর্ক ধ্রুবক হিসেবেই প্রতিভাত হয়ে ওঠে। প্রথম দিককার ছন্দ-মাত্রাময় কবিতার চপলতা থেকে শুরু করে শেষ জীবনের থেমে থেমে চলার শৈলী পর্যন্ত, এমনকি তাঁর সবচেয়ে বিদ্ধস্ত অবস্থায়ও, তিনি শূন্যের ভেতর চলমান তাঁর দেহের রচিত সব সংকল্পই বজায় রাখেন।
নর্তকী
শ্রমসাধ্যে নেচে
তোমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে
একাকী
শরীরের লুকোনো তারে
প্রভুর দেয়া যুগল রত্ন
মৃত্যু এবং জন্মের।
তাঁর ১৫তম জন্মদিনে তিনি ইয়স্তা বারলিং সগা [১৮৯১] বইটি উপহার পান। বইটি ছিল সুইডেনের লেখক, সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম মহিলা, সেলমা ল্যগেল’র মন্ত্রমুগ্ধ উপকথা। নব্য-রোম্যান্টিক কবিতা আর রূপকথাময় নৈতিকতার চমৎকার মিশেল ওই বইটি ছিল তখনকার সময়ের দারুণ জনপ্রিয় এক পিকারেস্ক [রুক্ষ, অসৎ কিন্তু আবেদনময় নায়কের অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে পর্ব ভিত্তিক কথাসাহিত্য] সংকলন। বইটি ধীরে ধীরে জাক্সের জন্য সাহিত্যিক প্যারাগনে পরিণত হয়। ল্যগেল’র সাথে দীর্ঘদিনের গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র যোগাযোগ শুরু হয়। আর ১৯২১ সালে ল্যগেল’র প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই প্রকাশিত হয় জাক্সের প্রথম বই, ছোট গল্পের সংকলন লেজেন্ডস এন্ড টেলস। সেই সময়ে আরও একটি সম্পর্ক গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ছিল তাঁকে। সেই ১৭ বছর বয়স থেকে যে ছেলেটির প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। অবশ্য তেমন কিছুই জানা যায় না তার সম্পর্কে। এমনকি তাদের সম্পর্ক কতোটা গভীর ছিল—তাও না। বহু বছর পর যখন জাক্স তাঁর এক বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে এ বিষয়ে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বিবরণ দিয়ে চিঠি লেখেন, কেবল তখনই আমরা অবগত হতে পারি। তিনি লেখেন, “সে ছিল ভালো বংশের ভদ্র ও মার্জিত এক ছেলে। পরে, নাৎসি প্রতিরোধী যোদ্ধা হয়ে ওঠে। আর তাই নাৎসিরা শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করে।” এ জন্যই হয়তো জাক্স তাঁর বাকী জীবনে অনূঢ়া থেকে যান। তাঁদের ওই বিচ্ছেদ ছিল জাক্সের জন্য বিপর্যয়ের। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। প্রায় দুই বছর ধরে খাওয়া দাওয়ায় ভীষণরকম অরুচি ছিল। কিছুই খেতে পারতেন না। অনেকটাই জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলে ছিলেন যেন। জাগতিক বেঁচে থাকার সমস্ত প্রক্রিয়াকেই সজ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে, জীবনের এই পর্বটিকে তাঁর কবিতা রচনার প্রধান প্রেরণা হিসেবে অভিহিত করেন। আমরা দেখতে পাই, প্রেমিক নিজেই তাঁর কবিতায় মৃত বর হিসেবে পুনরুত্থিত হন। যেন এক ছায়া-শরীর তাঁর সমস্ত রচনায় সন্তর্পণ পদচারণায় বিস্তৃত। অনেকটা জর্জ ট্রাকলের অন্ধকারাচ্ছন্ন বোন কিংবা রিলকার সেই ফেরেশতাদের মতো, যারা তাঁকে ইশারা পাঠান নরকের প্রান্তদেশ থেকে।
সেই সময়টায় জাক্স যে কবিতাগুলো লিখেছিলেন সেগুলোর অনেকটাই ছিল অপরিণত। একই রোম্যান্টিক আবরণে চিত্রিত ছিল তাঁর কবিতা আর কথাসাহিত্য। প্রথম কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল ১৯২৯ সালে। এরপর ১৯৩৩ সালে স্কিফটলেইটারস গেসেটস [সম্পাদকের আইন] করার আগ পর্যন্ত আরও কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। এই আইনের মাধ্যমে সেই সময় বেশির ভাগ প্রকাশনা সংস্থা থেকে ইহুদি লেখকদের কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। তাই দেশ ত্যাগের আগে ওই সময়ের সমস্ত খসড়া পুড়িয়ে ফ্যালেন জাক্স। আধুনিকতার আন্দোলন থেকে শৈলীগত দূরত্বে অবস্থান করলেও, তিনি তাঁর তাৎক্ষণিক পরিবেশের নান্দনিক জোয়ার থেকে নিজেকে সামাজিকভাবে মোটেই বিচ্ছিন্ন রাখেননি। স্টেফান জর্জকে ঘিরে গড়ে ওঠা অভিব্যক্তিবাদ, নব্য বস্তুনিষ্ঠতা, আর প্রভাবশালী জর্জ-ক্রিস সাহিত্য গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। ওয়েমার বোহেমিয়ান কাউন্টারকালচারের কেন্দ্রস্থল, যেমন রোমানিসেস ক্যাফে বা ইউরোপহাউস, তাঁর বাড়ি থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পথ ছিল। তবু তাঁর ড্রয়িং রুমের নির্জনতার তুলনায় তা ছিল অনেকটাই কম আবেদনময়। তিনি, প্রথম দিকে, আন্তঃযুদ্ধের বছরগুলোর রাজনৈতিক উত্থান-পতনকে চরিত্রগত বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সচেষ্ট ছিলেন। যদিও সে যুগের প্রগতিশীল যৌথ মানসিকতা এবং গণ-অনুমোদিত বর্বরতা সম্পর্কে যথেষ্টই জ্ঞাত ছিলেন। অন্যদিকে, এই ক্রমবর্ধমান বাস্তবতার প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতা কেবলই নিজের মধ্যে আরও আবদ্ধ করে ফেলছিল তাঁকে। ক্রমশ নিরবতা প্রবণ হয়ে ওঠেন তিনি। নিজেই স্বীকার করেন, “নিজেকে উদ্ধারে নিজেই ছিলাম উদাসীন।”
যখন ভয়ানক ত্রাস ছেয়ে গেল সমস্ত দিক—
মরে যাওয়া নিথর মাছের মতোই
আমি নিরব হয়ে গেলাম, যার পেট উল্টে থাকে
ওপর দিকে […]
সব শব্দই উদ্বাস্তু
লুকানোর অমর জায়গায়।
জাক্সের কবিতাগুলো নৃশংসতা আর করুণার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কবিতা একই সঙ্গে ইতিহাস এবং ধর্মতত্ত্ব। একই সঙ্গে পরস্পর বিরোধীও। তিনি মৌলিকভাবে জ্ঞানবাদী মনোভাব লালন করতেন। যা তাঁর কাব্যের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কারণ, হয়তো সেই সময় তাঁর পাঠের আওতায় ছিল ইহুদি রহস্যবাদ; ছিলেন গ্যেশম শোলেম, ফ্রাঞ্জ হোজেন্সওয়াইগ এবং মার্টিন বুবারের মতো লেখকগণ। যাদের লেখায় ছিল দারুণ বুদ্ধিবৃত্তিক পুনর্জাগরণ। পরবর্তীতে টেল্স অব দ্য হাসিডিম [১৯৩৩] বিশেষভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। ওই মিথটির সেই উপরিভাগের ফাঁদ, গভীরভাবে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক মর্মের সঙ্গে ল্যগেল’র দিকে আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে। অন্যদিকে, দশক জুড়ে যেইসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল, সেইসব ক্রমান্বয়ে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল তাঁকে। হিটলারের নির্বাচন, নুরেমবার্গ আইন, ক্রিস্টাইনাখ্ট আর গণ নির্বাসন। এইসবই ঘটে যাচ্ছিল একের পর এক। তারপরও ১৯৪০এর মে মাসের আগ পর্যন্ত জার্মানি ছাড়েননি তিনি। এরই মধ্যে তাঁকে গেস্তাপোর হাতে জিজ্ঞাসাবাদে পড়তে হয়েছিল। মাকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। আইন করে সঞ্চয়, ধন-দৌলত, বাড়ি-গাড়ি সবকিছু থেকেই তাঁদের বেদখল করা হয়। থেরেইজিয়েনস্ট্যাড ক্যাম্পের বস্তি থেকে সমন পাওয়ার পর, যুদ্ধের মধ্যেই মাকে নিয়ে তিনি সুইডেনের শেষ ফ্লাইটে পালিয়ে যান। ওই ক্যাম্পে তৎকালীন বহু লেখক-শিল্পীকে এসে জীবন হারাতে দেখেছেন তিনি। কিন্তু তারা পালাতে পেরেছিলেন কারণ মৃত্যু পথযাত্রী ল্যগেল’র মধ্যস্ততায় সুইডেনের প্রিন্স ইউজেনের কাছে জরুরী ভিসার আবেদন করতে পেরেছিলেন। যা অন্যভাবে সম্ভব ছিল না। এ ব্যাপারে অবশ্য গেস্তাপো অফিসারের অকথ্য পরামর্শও ছিল। লোকটি তাঁকে নির্বাসনের নোটিশ দিয়েছিল। ভেবেছিল জাক্স সেটা উপেক্ষা করবেন। আর সেই নির্বাসন কেবল জরুরী অবস্থার নির্বাসন ছিল না। স্থায়ী শর্ত হিসেবেই ছিল সেই নির্বাসন। যে কারণে জীবনের ৪৮ বছর বয়সে তিনি জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হন। আর, বাকী জীবনে একটি রাতও সেখানে কাটান নি।
এর পরের তিনটি দশক তাঁর কাটে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায়। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক স্বতন্ত্র কাব্য-কায়া। সুইডেনের প্রথম সেই সময়টা বড়ো অসহায় কাটিয়ে ছিলেন তিনি। অন্যের আশ্রয় আর সাহায্যে দিন পার করতে হয়েছে। কিছু অনুবাদের কাজও করেছেন। তাতে অল্প যে আয় এসেছে, তাই দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। প্রায় এক দশক ধরে, মূলত সুইডেনের গুন্যার ইয়েক্যেলফ আর জোহানেস ইয়েডফেল্টের মতো কবিদের জর্মন ভাষায় অনুবাদ করেছেন। সুইডেনের সাহিত্য-মহলে প্রাথমিক পরিচিতিও পেয়েছিলেন ওভাবেই। তবে তাঁর মৌলিক রচনার কাজগুলো করতেন রাতে। খুন হওয়া বন্ধু আর তাঁর পরিবারের সংবাদ পুরো বাল্টিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গণহত্যার ভয়ানক বাস্তবতা আর তার অবর্ণনীয় অভিব্যক্তি অনিবার্যভাবেই প্রতিটি লেখায় স্পষ্ট কোনও স্রোতের ঢেউয়ের মতো ফুলে উঠতে থাকে। আর, তাঁর এই গতিময় লেখক-জীবনের পর্যায়টি ১৯৪৬ সালে আমাদের উপহার দেয় ইন দ্য হ্যাভিটেশানস অব ডেথ। এই রচনাটি লেখার তাড়না তাঁর জীবনের পূর্বের ৫৫ বছরের রচনা-অভিমুখের একেবারে বিপরীত। মনে হয়, তবে কি ৫৫ বছরের এই দূরত্ব, তাঁর কাব্যিক আত্মের সুপ্তাবস্থা ছিল? নাকি সেই আত্মকে তাঁর বিচ্ছিন্নতা হিসেবে আমূল আর অপ্রতিরোধ্যভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরার সময়োপযোগী আহ্বানের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি? সে’ক্ষেত্রে অবশ্য, প্রাচীন অর্থে তাঁকে স্বপ্নদর্শী বলেও অভিহিত করা যায়। সেই আহ্বান কোনও দেবতা বা ঈশ্বরের নির্দেশিত আহ্বান নয়। বরং বলা যায় তা, তাদেরই প্রস্থান-প্রেক্ষিতে ইতিহাসের আকস্মিকতায় প্রসূত।
জাক্সের এই সময়ের রচনাগুলোর বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে গেলে আমরা দেখতে পাই, ছন্দে ও মাত্রায় তা আক্ষরিক অর্থেই উত্তরবাচক জোয়ারে মন্ত্রমুগ্ধময় ধূপের দোলায় চালিত। দেখতে পাই সুচারু এক সাংগীতিক কাঠামোর আবরণ। শুনতে পাই অন্তমিল, ঐকতান আর নির্দিষ্ট কোনও শব্দের পুনরাবৃত্তি। কবিতাগুলো পর্যায়ক্রমে শোহের নাশ আর ঈশ্বরের মুক্তির কথাই বলতে থাকে। শুনতে পাওয়া যায় বিষাদ সংগীত কিংবা গাথার সুর। তবে জাক্সের সর্বাধিক খ্যাত কবিতাটি হচ্ছে, “ও দ্য চিমনিস।” তাঁর অন্য কবিতাগুলো একান্ত ব্যক্তিগত স্পার্ক থেকে উৎসারিত। যার কোনও কোনওটির মধ্যে দেখতে পাই পরিচিত কারও সম্বোধনে পুরো একটা সিরিজ রচিত। যা কেবল তাদের আদ্যাক্ষর দিয়েই চিহ্নিত। সমষ্টিগতভাবে, শেষের দিকে কোনও কোরাস বা ঐকতানে গিয়ে পৌঁছায়। কখনও কখনও মৃতের সাথেও কথা বলে তার স্বর—
আমরা ছায়া, হে আমরা ছায়া!
জল্লাদদের ছায়া
তোমার অপরাধের ধুলোয় আটকে গেছে—
শিকারের ছায়া
দেয়ালে তোমার রক্তের নাটক মসীবর্ণ ছায়া-পরিলেখ।
কোথাও আবার জাক্স তাঁর আপন বেঁচে যাওয়ার অপরাধ বোধ থেকেও কথা বলে ওঠেন—
আমরা উদ্ধারকৃতরা,
যাদের ফাঁপা হাড় থেকে মৃত্যু বাঁশি বাজাতে শুরু করেছিল,
যাদের স্নায়ু-পেশীতে ইতিমধ্যেই তার ধনুক আঘাত করছিল—
আমাদের শরীর বিলাপ করতে থাকে
তাদের ওই বিকৃত সঙ্গীতে।
হ্যাঁ, আত্মপ্রকাশের এইসব কবিতায় তাঁর প্রবর্তিত কণ্ঠস্বর, সম্পূর্ণরূপে তখনই গড়ে না উঠলেও, ইতিমধ্যেই তাঁর কবিতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের প্রধান দিকগুলো বীজাণু আকারে ছড়িয়ে ছিল। পরবর্তী জীবনের জাক্সের মহান বন্ধু, তাঁর সাহিত্যিক নির্বাহক, কবি হান্স মাগনুস এনসেন্সবেয়াগা বিশ্বাস করতেন, জাক্স প্রকৃতপক্ষে সব বই মিলে একটি বইই লিখেছেন জীবনে। আর এই বইটিতে শৈলীগত কোনও মোচড় যদি থেকে থাকে, তা আছে তার আকৃতির গঠনগত সংকোচন, বিষয়বস্তুর নির্বাচন আর তার তীব্রতায়। নক্ষত্র, বিদ্যুৎ, আঁখি, গোলাপ, বীজ আর প্রজাপতি থেকে শুরু করে তাঁর অধিকাংশ মেটাফোর আর শব্দই কাব্বালা, শোয়াহ আর কবিতার চিরায়ত অলংকারের সীমায় অভিধিত। তাই জাক্সের কবিতা ডায়াক্রনিকভাবে পড়ার মানে হলো, তাঁর ওই পৌরাণিক কাহিনীতে সক্রিয় নায়ক হিসেবে তাঁর উপস্থাপিত সমস্ত পরিসংখ্যানকে স্থিরভাবে উপলব্ধি করা এবং সমৃদ্ধ করাও। আমরা বুঝতে পারি, ধীরে ধীরে, পুনরাবৃত্তি আর ক্রমবর্ধমান ক্রস-রেফারেন্সের মাধ্যমে জুড়ে যাওয়া সঙ্গাভিলাষী এক ঢেউ যেন নিজেই সক্রিয় হয়ে ওঠে সেখানে। আর তাঁর আবরণীর বুনন এমনভাবে কাজ করে যে, যার পটভূমিতে যে কোনও কবিতা ব্যাপক তাৎপর্য অর্জন করতে পেরে যায়। তিনি আমাদের এমন একজন কবি, যাকে ইতিহাস আর মূল্যবোধে বিভাজিত ব্যবস্থা বিনাশের মোকাবিলায় রূপক হিসেবে আপাতবিরোধী অবস্থানেও পেয়ে যাই আমরা। যাকে বলা যায় একটি সংস্কৃতি বা একটি রূপক অবস্থা। তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কল্পনার চেয়ে কম নয়। তাঁর কাব্যদর্শন প্রকাশভঙ্গির বৈশিষ্ট্য, তাঁর একেবারে রহস্যোদ্ঘাটনের পাথর ও তলানি থেকে সম্পূর্ণ নতুন এক বিশ্বের সামগ্রিকতা, তাঁর অভিনব আঞ্চলিক ভাষা—এইসবের মাধ্যমেই পুনরুদয় হতে পারে আমাদের বোধের। যার চেয়ে শুদ্ধভাবে আর কেউই হয়তো জাক্স পড়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে পারেন নি, সেই লাইবনিজ, জাক্সের কবিতাকে “স্বতন্ত্র অস্পষ্টতা” বলে অভিহিত করেছেন। বলেছেন, মূলত তাঁর কবিতা যদি হারমেটিক [আবদ্ধ] হয়, সময় প্রবাহে তা হয়ে উঠবে আরও উজ্জ্বল ও সহজ পাঠ্য, —এক “প্রদীপ্ত রহস্য।”
ফ্লাইট এন্ড মেটামরফোসিস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। অ্যামেরিকার কবি জসুয়া ওয়েনার এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন নতুনভাবে। সঙ্গে দিয়েছেন অবশ্যপাঠ্য এক ভূমিকা। এটাই প্রথম জাক্সের বইগুলোর সম্পূর্ণ ইংরেজি অনুবাদ সংকলন। যেখানে কবির রচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। যা কবিকে জানার ও বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজিতে এই বইটিতেই আমরা দেখতে পাই তাঁর শৈলীর নির্দিষ্ট সংকোচন বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করে। ব্যাপারটা বইটির পৃষ্ঠায় পাঠক সরাসরি দেখতে পারেন, স্পষ্টভাবেই। কারণ, কবিতাগুলো এখানে শিরোনামহীন। যা পুরো একটা প্রার্থনাসঙ্গীতের চেয়ে ছোট একেকটা সিরিজ হিসেবে প্রতীয়মান এখানে :
তাই হয়তো বলা হয়—
সর্পিল রেখায় আঁকা
নিমজ্জন। […]
সূর্য গ্রহণে রোপিত
আপেলের মূল
আমাদের পতন
আমাদের পতন।
হ্যাঁ, এই রকম উল্লম্বতা জাক্সের অনেক কবিতায় নাটকীয় প্রেরণার অবতারণা করে। সাধারণত, শোভাময় মুক্তির [তোমার দুর্গ … কেবল আশীর্বাদে নির্মিত] কিংবা বিদারক যন্ত্রণার [সদমের/ অন্ধকার নিঃশ্বাস] চমকপ্রদ চিত্রকল্প দিয়ে শুরু হয় তাঁর অধিকাংশ কবিতা। আর, লাইন ভেঙে ভেঙে নীচের দিকে মাপা গতিতে এগিয়ে যায়। ছোট ছোট রুক্ষ প্রতিটি স্তবকে চিত্রকল্প ধীরে ধীরে আরও প্রতিভাত হতে থাকে। যা হয়তো পাঠকের প্রথম ভাবনাটিকেই আরও ভাবিয়ে তোলে অথবা নাকচ করে দেয় কিংবা জটিল করে তোলে খুব। যার ফলে কবিতাটিতে সৃষ্টি হয় এক ধরনের আধিভৌতিক মন্তাজ। কবিতা হয়ে যায় গূঢ় রহস্যময়। যা শেষ পর্যন্ত রিক্ততায় গিয়ে শেষ হতে পারে:
মৃত্যুচিৎকার-রত
মানুষের ভারে
শ্রম নিমজ্জিত ওরা—
কিংবা হয়তো ভোল্টার শেষ-খাদের সেই উৎরাইয়ের বিপরীতে, পরিত্রাণে গিয়ে শেষ হয়:
আর মানুষ
বলেছে আহ্
আর একটি মোম জ্বালিয়ে
উঠে গেছে
রাতের শরীরে।
কিংবা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য, কবিতাগুলো অস্পষ্টতার অভিযোগে সমাপ্ত হতে দেখা যায়:
দ্রুতই ওদের দেহ গিলে খায়
যন্ত্রণার লবণ।
চামড়াহীন
চক্ষুহীন
কাজ গঠন করেছেন ঈশ্বর।
প্রতিটি কবিতাই যেন করুণা আর গাম্ভীর্যের ভেতর এক অদ্ভুত হতবুদ্ধির নরকে হারিয়ে যাওয়া। পলায়নের জটিল ঝুঁকির উপর প্রতিটি পঙক্তিই যেন একেকটি বাজি। নিজস্ব শৈলীর উদ্ভাবনে আবদ্ধ। কোনও স্থানকে আয়ত্তে আনতে যেন সেই ‘প্রোফেটিক দূরত্ব দূর করার জুয়া।’— হয় তা সংযোগের দারুণ এক উত্তরণ অথবা মুহূর্তের অসীম পতন।
তাঁর প্রথম দিককার কবিতাগুলোর বেশির ভাগই গণহত্যার নিবন্ধন আর ধর্মীয় সীমায় দোদুল্যমান। কিন্তু পরের কবিতাগুলোয় এই ব্যাপারটা অনেকটাই অপস্রিয়মাণ হয়ে যায় তাঁর নিজস্ব ও একক ভাষাভঙ্গির আলোর ছটায়। আরও উদ্দীপনাময় উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ‘সময়ের কাঁটাতার’ কিংবা ‘শীত-নিহত রসায়ন’ এর মত রচনা, সেই পৌরাণিক সহিংসতা আর আচারিত রক্তপাতের দেশে, ব্যাতিক্রমী এক ধারা। অন্যদিকে, আগের কবিতাগুলোর ঈশ্বরের আবেদন যদি প্রচলিত ইব্রাহিমীয় ধর্মের মতোই হয়, তবে ঈশ্বর আর তাঁর অনুচর ফেরেশতাদের দল, আর তাঁর নবীগণ সেখানে, সেইসব কবিতায়, যে কোনও সনাতন ধর্ম থেকে বেরিয়ে রহস্যজনক প্রতীকে ঠিক যেন বিভক্ত হয়ে যান। আর তাঁর নতুন এই ভাষাভঙ্গি যদিও অস্পষ্ট, তবু তাকে বলা যায় দুর্বিপাকে পতন আর তার ঐশ্বরিক পরিত্রাণের মধ্যকার অনিবার্য এক সংযোগ। “তোমার উপর, স্বর্গীয় চর্চা / মানেই ধ্বংস /… / তোমার বাস, কৃপায়;” “ওরা নিক্ষেপ করে মন্ত্র / লবণ ছিটিয়ে নিরাময় করে ক্ষত।” — এইসব উচ্চারণের মাধ্যমে বিলাপ থেকে প্রশংসায় বদলে যাওয়া মেজাজ, মিলে যেতে থাকে অভূতপূর্ব কাব্যিক দৃষ্টির অগ্নিপরীক্ষায়।
কোন শিরাটি ফেটে যায়
আকুল আকাঙ্ক্ষার পবিত্র ভূমিকে দেবার প্রস্তাবে
তোমার কাছে যা তোমার স্বদেশ?
ক্ষতগুলো হয়ে ওঠে একেকটা চোষা মুখ। রক্তের ভেতর জেগে ওঠে স্মৃতি—সেই হিংস্রতার স্মৃতি,— [রোমান ক্যাথলিক ধর্ম মতে] রুটি ও মদের সেই মাংস আর রক্তে পরিণতির কথা। আর সেই ধোঁয়াময় অস্পষ্টতা, জাক্সের রচনায় নারকীয় ভয়াবহতার চূড়ান্ত সংকেত, ঠিক যেন দ্বিধাবিভক্ত ইশারায় চালিত এক স্বর।
কে জানে হয়তো
ভুলের ধোঁয়া-মেঘে
সৃষ্টি করেছি
আমরা এক বিচরণশীল মহাজগৎ
আমাদের জীবনের ভাষায়—
তাঁর কবিতার আরও একটি পরিবর্তন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। যা তাঁর কাব্যের মৌলিক পরিধির প্রসারকেই ইঙ্গিত করে। তাঁর প্রথম কবিতাগুলোর প্রায় সবকটাই প্রামাণিক সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করেই রচিত। আর পরের কবিতাগুলোয় দেখতে পাই কবি আর ভিকটিমের মধ্যবর্তী দূরত্ব একেবারেই নেই। যেন তারা একই ব্যক্তি। যেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাঁর ক্ষোভের কথাগুলো বলছিলেন তিনি আগে, এখন সেই অবস্থান থেকে আরও যৌক্তিক পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছেন অনেকটাই।
তোমরা দর্শকেরা,
তোমরা যারা হত্যার বিরুদ্ধে উঁচু করো নি তোমাদের হাত,
তবুও কে তোমাদের আকাঙ্ক্ষার ধুলো
উড়ায় নি বলো,
যারা নিবৃত ছিলে ওখানে তোমরা, যেখানে ধুলো
পাল্টে যায় আলোয়।
কবিতাটি শুধু কবিতার মতোই দেখায় না এখানে, দারুণ কাজও করে। যেটা কবিতার কাজ। ভাষা তার আপন উপস্থাপনা থেকে স্থানান্তরিত হয় অব্যবহারে। একসময় যা ছিল কেবল বাইরের জগতের প্রতিফলন, এখন তা আপন অসংখ্য ও নিবিড় অসীমতায় জড়িত। কবিতার অভ্যন্তরীণ এই বাঁক, আর যাই হোক, অন্ধ আত্মজ্ঞানবাদীতা নয়, বরং বলা যায় দারুণ এক আচ্ছন্নতা। প্রার্থনা হোক কিংবা যাদুকরী সমাবর্তন,—কবিতা তার নিজস্ব অব্যবহিত অভ্যাসেও এক অসহায় দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে আমাদেরই কবিতা হয়ে ওঠে।
তবুও অন্তরাত্মার নিঃশ্বাস
ভেদ করে বাতাসের হাহাকারী দেয়াল
যেন গোপনে মুক্ত স্বীকারোক্তির ফিসফাস,
আশ্রয়ে ডুবে যায়
বিশ্বের ক্ষত
এমনকি তার চরম পতনেও
আকস্মিক শুনে ফ্যালেন ঈশ্বর—
১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে জাক্স জোউহা পাঠ শেষ করেন। যাকে বলা হয় কাব্বালার ভিত্তি। যেখানে এর লেখক ওই ধর্মগ্রন্থটিকে ঈশ্বরের নাম আর সৃষ্টি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় টুকরো টুকরো বক্তব্যে অনেকটা সংকেত আকারেও লিখেছেন। ঈশ্বরের নিজের সম্পর্কে একক বক্তব্যের কৃতির মতো। এইরকম দৃষ্টিভঙ্গিতে চালিত হওয়ার আকর্ষণ মানেই ভাষাগত সর্বেশ্বরবাদে শব্দের তাৎক্ষণিক পবিত্রতা। এমনকি অবিচ্ছেদ্য রূপকধর্মী মনুষ্য ভাষার পরম মুক্তি।
হয়তো মানুষের পতনের পথ
উল্কার গোপন ত্যাগের মতো
রংধনুর পাশ বরাবর
ঝড়ের বর্ণমালায় চিহ্নিত—
এই যে অতীন্দ্রিয় আবেগ, ভাষা থেকে দূরের বাহ্যিক বাস্তবতার নিস্ক্রিয় প্রতিফলন, একই সাথে নিজস্ব গঠনগত শৈলী, এইসব নির্ভর করে তাঁর কাব্যিক চিত্রের স্বভাবের উপর। ইতিহাস বা ঈশ্বরত্বের অঙ্কিত প্রতিমূর্তি আর থাকে না সে। হয়ে ওঠে নিজস্ব আলোয় জীবন্ত— অবিচ্ছেদ্য এক উপস্থিতি। বলা যায় জাক্সের পরবর্তী রচনাগুলোর এমন প্রবাদধর্মী নির্মাণ, পরাবাস্তবতার বাহ্যিক দিকগুলোর অনেকটাই কাছের। অবশ্য, গতানুগতিক পথের বাইরে, একেবারে ভিন্ন উপায়েই, তাঁর কবিতা বিষয়ে এই অনুধাবনে পৌঁছানো গেছে। প্রকৃতপক্ষে, সেলান ছাড়াও, তিনি রবার্ট ডেসনোসের মতো কবির সঙ্গেও যতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, অন্য কারও সঙ্গে ততটা নন। স্বপ্নের মতো আধুনিক সাহিত্য পথের এক মোড়ে, ডেসনোসকেও আমরা দেখতে পাই তাঁর পাশে। তবে, ডেসনোস, ১৯৪৫ সালে, সেই নির্যাতন শিবিরেই মারা গিয়েছিলেন, যেখান থেকে জাক্স অল্পের জন্য পালাতে পেরেছিলেন।
যদি কেউ আসে
অনেক দূর থেকে
কুকুরের মতো
কিংবা
ইঁদুরের মতোই হয়তোবা
সেখানকার শীত
তারে গরম কাপড় পরায়
কে জানে কখন
পায়ে আগুন লেগে যেতে পারে […]
যে কোনও আগন্তুক সর্বদাই হাতে
স্বদেশ নিয়ে বেড়ায়
অনাথের মতো
যে কিনা খুঁজে বেড়ায় শুধুই
এক কবর।
ফ্লাইট কবিতাটি আশ্চর্য রকম তির্যক প্রেক্ষাপটে অবিচল। আর তা শুধুমাত্র তার প্রত্যক্ষ মানবিক আবেদনেই নয়, বরং স্পষ্টভাবে উদ্বাস্তুকে আমন্ত্রণ জানানোয়ও। জীবনী সংক্রান্ত জীবন আমদানির প্রকাশ্য চিত্র এই কবিতা। জাক্সের জন্য যা গভীর দার্শনিক নীতির মর্যাদায় উন্নীত। শিরোনাম থেকেই সে আহ্বান আমাদের কাছে পৌঁছয়,
ফ্লাইটে
এই পথ ধরে
কী যে মহান বরণ—
বাতাস-শালে
আবৃত হয়ে
বালির প্রার্থনায় এই পা
কখনও আমিন বলা যায় না
কারণ একে চলতে হবে
পাখনা থেকে ডানা পর্যন্ত
এবং আরও—[…]
যেখানে আমার বাড়ি
পুরো বিশ্বের রূপান্তর ধারণ করি—
এই কবিতাটি জাক্সের সবচেয়ে উর্বর কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাঁর উদ্বাস্তু অধিবিদ্যার কেন্দ্র বলা যেতে পারে একে। আপাত দৃষ্টিতে বিপর্যয় থেকে দ্রুত উত্তরণ মনে হলেও, এটি কোনও গন্তব্য নির্ধারণ করে না। কোনও টারমিনাসের পূর্বাভাসও দেয় না। শুধুমাত্র বয়ে চলার নিশ্চয়তা দেয়, আর দেয় শাশ্বত হওয়ার নিরঙ্কুশ সম্ভাবনা। হ্যাঁ, এই মোটিফ অবশ্য ইহুদি চিন্তন ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক নির্বাসন বা সেই ঐশ্বরিক পরিত্যাগ, জাক্সের জন্য নির্মাণ করে বিশেষ নৈতিক মূল্য। “বিশ্রাম/ শুধুমাত্র একটি মৃত মরূদ্যান-শব্দ—।” শরণার্থীর কথা বলা মানেই গতিশীল অন্তর্বর্তী প্রাধান্যকে জাহির করা। অবিলম্বে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা। এইসব নৈতিক দাবীর মাধ্যমেই হয় আত্মার প্রসেস ফিলসফি আর অতিক্রমের ম্যাগনা মোরালিয়া।
জাক্সের ক্ষেত্রে বলা যায় এটা একটা বিশেষ প্রোফেটিক ভঙ্গিমা। পুরনো প্রথার একজন দূরদর্শী কবি তিনি। অতিআধুনিকও। কারণ, তাঁর উৎপত্তির আর শেষের আমূল নোঙর-তোলাই হচ্ছে আধুনিকতার সুক্ষ্ম অভিজ্ঞতা। গেওরগে লুকাকস এবং অন্য একজন ইহুদি লোক “লোকোত্তর গৃহহীনতা” বলে অভিহিত করেছিলেন একে। নব্য স্বদেশের উপযুক্ত প্রতিস্থাপনের মতোই। জাক্স অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেননি এর। ইয়েটস এর স্বপ্নদর্শী শৈলীতে, বলা হয়, কেবল অন্য এক পৌরাণিক কাহিনীকেই তুলে ধরতে পারেন তিনি। কিংবা এলিয়ট, যার সব রকম ক্ষোভের প্রতিকার হয়েছিল সেই বিলাতী চার্চের সম্পদে। কিন্তু জাক্সের ক্ষেত্রে, তাঁর কবিতার বিশেষ আধুনিক ঘোর, কেবল বিলাপই নয়, কিংবা কোনও বিপর্যয়ও নয়, এর ভেতর দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এক ইতিবাচক অবস্থাতেই পৌঁছাতে পারেন পাঠক।
১৯৬০ সালে, জাক্সকে মর্যাদাপূর্ণ ড্রস্তে প্রাইজ ইন মেয়ারসবর্গ এ ভূষিত করা হয়। যে কারণে জার্মান ত্যাগের পর, প্রায় ২০ বছরের নির্বাসিত জীবনে প্রথম জার্মান যান। কিন্তু সেখানে রাত কাটাতে অস্বীকার করেন তিনি, আর কনস্ট্যান্স এর বোডেনজিতে অবস্থান করেন। তাঁর জীবনের এই ছোট পর্বটিও ছিল চরম দুঃখজনক। কারণ, এতো বেশী নেটিভ জর্মন-ভাষীর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন যে, সেখান থেকে সুইডেন ফিরে তাকে প্রায় তিন বছর মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। সেই সময় দারুণ সব প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তাঁর অভিনব সাহিত্যকর্মের জন্য। পরের বছর তিনিই প্রথম ডর্টমুণ্ড শহরে নেলি জাক্স পুরস্কার পান। আর, ১৯৬৬ সালে স্যামুয়েল অ্যাগননের সঙ্গে যৌথভাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
বাতাসে তাস খেলা
হাজারো স্বদেশ—এই
রহস্যের ভেতর এগিয়ে চলে শরণার্থী […]
ভাগ্য দুলছে
একটি হাতের রক্তক্ষরিত মধ্যহ্নে—
এই সবকিছুই অনিঃশেষ
একটু দূরের
সূর্য-রশ্মিতে ঝুলন্ত।
****************************
ঋতো আহমেদ
০১/১২/২০২২; উত্তরা, ঢাকা।
==================