You are currently viewing সত্তাজুড়ে একাত্তর || শিল্পী নাজনীন

সত্তাজুড়ে একাত্তর || শিল্পী নাজনীন

সত্তাজুড়ে একাত্তর
শিল্পী নাজনীন

ক দিন থেকেই ভয়ে সিঁটিয়ে আছি আমরা। সময়টা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে হঠাৎ। হঠাৎই স্থবির, স্থির হয়ে গেছে জীবন। দমবন্ধ করা এক গুমোট হাওয়া ক্রমশ বিকল করে তুলছে মন। আমি, মিঠুন, অরিন্দম আর অরিত্র প্রায় নিঃশব্দে চলাফেরা করছি আজকাল। অরিন্দমকে গত সন্ধ্যায় সেজদা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন দূরে কোথাও। অরিন্দম সবে ক্লাস এইটে উঠেছে এবার। সবে তার ঠোঁটের ওপর কিঞ্চিৎ আভাস মিলছে গোঁফরেখার, যেন সফেদ নদীর বুকে একফালি কালচে বাঁকা চর জাগছে ঈষৎ। কিন্তু তার বাড়ন্ত শরীর দেখে তাকে বড় মনে হয় আরো, সে কলেজে পড়ে বলে ভ্রম জাগে। সময়টা বড্ড খারাপ। ওকে নিয়ে কাল থেকে চিন্তায় অস্থির সময় কাটছে আমাদের, বিশেষত আমার। এমনিতেই মাথার ভেতর হাজারো চিন্তা, নানান শঙ্কা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে প্রতিদিন। চারদিকে শকুনেরা ওঁৎ পেতে আছে। যে কোনো মুহূর্তে বিপদ নেমে আসতে পারে। গতকাল সকালেও পাশের মহল্লার বরকত মোল্লা চোখে সুরমা, দাড়িতে মেহেদি আর নাকে-মুখে আতর মেখে এসে ঘুরে গেছে এ বাড়ি থেকে। যাওয়ার সময় অর্থপূর্ণ দেঁতো হাসি হেসে অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বলে গেছে, সাবধানে থাইকেন আপনারা। সময় খারাপ। ঘরে জোয়ান পোলা। মিলিটারিদের নজর পড়তে পারে আপনাগোর দিকে। আপনারা তো আবার হিন্দু! হিন্দুদের ওপর মিলিটারিগো খুব রাগ। হেরা তো দ্যাশেত্থন ইসলাম মুইছা যাইতে দিত না, বুঝেন নাই?
লোকটার কথায় শঙ্কায় কেঁপে উঠেছে বুক। আমাদের জীবন থেকে স্বস্তির বাতিটা যেন এক লহমায় ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে কেউ। আমাদের এই মহল্লাটায় এতদিন শান্তি ছিল। ছিল স্বস্তির সুবাতাস। হিন্দু-মুসলিম বলে কেউ কাউকে আলাদা ভেবে বিচারের চল ছিল না কোনোদিন। কিন্তু কী যে হল হঠাৎ দেশটার। শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই দেশের মানুষ যেমন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গোপনে অনেকেই আবার হাত মিলিয়েছে পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে, তেমনি মহল্লার কেউ কেউও রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের ধরিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানী মিলিটারিদের হাতে। যুবতী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসছে মিলিটারি ক্যাম্পে। নিরীহ হরিণশাবককে যেমন ছিঁড়ে খায় হিংস্র জন্তু, তেমনি করে মিলিটারিরাও ছিঁড়ে খাচ্ছে তাদের। আর আমরা ক্রমশ যেন নিজেরাই শত্রু হয়ে উঠছি নিজেদের। জোয়ান ছেলেদের কেউই প্রায় নাই এখন মহল্লায়। বেশিরভাগই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, কেউ কেউ ধরা পড়েছে, ধরা পড়ছে মিলিটারীদের হাতে। এতদিন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা খানিকটা শঙ্কিত ছিলাম সত্যি, তবু আলাদা করে অরিন্দমকে নিয়ে ভাবিনি একদম। সবে চৌদ্দয় পড়েছে সে, বাচ্চা ছেলে। কিন্তু বরকত মোল্লার কথায় অজান্তেই বুকটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটায় একঝলক তপ্ত হাওয়া এসে পুড়িয়ে দিতে চাইল আমার মাতৃহৃদয়। এত ছোট ছেলেটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাব এখন? কোথায় লুকোব ওকে? আর এই বয়সের ছোট্ট একটা ছেলের প্রতি ওদের রাগটাই বা কীসের! কীসের আক্রোশ এত অরিন্দমের প্রতি ওদের?
আমি আর মিঠুন ভেবে হয়রান হলাম সারা সকাল। ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে এল তবু কূলকিনারা পেলাম না কিছুই। অরিত্র সবে পাঁচে পড়েছে। ওকে নিয়ে ভয় নেই তেমন। কিন্তু গা-গতরে বেড়ে ওঠা অরিন্দম! আমার কলিজা ছেঁড়া যক্ষের ধন অরিন্দম! ওকে নিয়ে কী করব আমি? কোথায় লুকিয়ে রাখব আমি ওকে? কীভাবে?
সেই মার্চ থেকে অফিস আদালত বন্ধ। মিঠুনদের অফিস গুটিয়ে নিয়ে মালিক চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। জমানো টাকা খরচ করে আমরা চলছি কোনোমতে। সাগর সেঁচে মুক্তো কুড়ানোর মতো দুহাতে জড়ো করতে চাইছি সুসময়। কিন্তু মিলছে কই। কৃপণের মতো খরচ করছি জমানো টাকা, একেকটা দিন মনে হচ্ছে বছরের মতো দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর। এতদিন এই জায়গাটাকে নিরাপদ ভেবেছিলাম। কারণ এটা ঢাকা শহর থেকে অনেকটা দূরে। দুর্গম গ্রাম এলাকা। ভেবেছিলাম বিপদ আসবে না হুট করে। কিন্তু বরকত মোল্লা আজ সব হিসেব উলটপালোট করে দিয়ে গেল। জীবন মাঝে মাঝে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় মানুষকে, কে জানত! কে জানত নিজের একান্ত নিরাপদ আশ্রয়টুকুও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে একসময়, বাধ্য হয়ে ছেড়ে যেতে হবে সেই শান্তির নীড়!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দুপুরের দিকে আবার কড়া নড়ে উঠল দরজায়। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল আমার। কী যেন এক অজানা শঙ্কা আমাকে অস্থির, অশান্ত করে তুলল ভীষণ। বাচ্চাদুটোর জন্য যদি নিরাপদ কোনো স্থানের খোঁজ পেতাম এখন! হায়! অরিন্দম আর অরিত্রকে জড়িয়ে আমি ঘরের কোণায় আলমারির পেছনে লুকিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকলাম থরথর। ঠাকুরকে ডাকতে থাকলাম একমনে। মিঠুন দরজার ফাঁকে চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করল আগন্তুককে। মাথা চাদরে পুরোপুরি ঢাকা। কে, দেখে সেটা একদম বোঝার উপায় নাই, ফিসফিস করে মিঠুন এসে কথাটা বলল ভয়ে ভয়ে। আবার নড়ে উঠল দরজার কড়া, আবার, আবার।
দরজা খুলো না! যদি কোনো বিপদ হয়! ভয়ার্ত কণ্ঠে মিঠুনকে কথাটা বলে আমি কনুই খামচে ধরলাম তার। ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে তখনো। তখনই দরজার ওপাশ থেকে সেজদার কণ্ঠ ভেসে এল, রিণি! মিঠু! দরজা খোল! আমি রঞ্জিত!
বুক থেকে পাথর সরে গেল সহসা। মিঠু গিয়ে দরজা খুলতেই সেজদা ভেতরে এসে তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলেন দরজা।
উদ্বিগ্ন, জরুরি গলায় বললেন, তোরা সবাই ভালো আছিস তো?
আছি দাদা। তোমাদের কী খবর?
আর খবর। পিয়াস যুদ্ধে গেছে। আমিও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তোরাও সীমান্তের ওপারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখ। দেশের অবস্থা ভালো না। সামনে অবস্থা আরো খারাপ হবে। যে কোনো মূল্যে দেশ স্বাধীন করতে হবে আমাদের। ততদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দাদা!
কী রে?
দাদার কণ্ঠে উদ্বেগ। আজ দুপুরের ঘটনাটা দাদাকে আদ্যোপান্ত বলতেই দাদা গম্ভীর হয়ে উঠলেন ভীষণ। বললেন, এক কাজ কর। অরিন্দমকে এখানে রাখা আর নিরাপদ না। ওকে আমার সঙ্গে দিয়ে দে। আমি ওকে নিয়ে যাই।
কিন্তু দাদা! ঢাকার অবস্থা তো আরো খারাপ! সেখানে অরিন্দম কি নিরাপদে থাকবে?
অন্তত আজকের রাতটা নিরাপদে থাকবে। আমি প্রয়োজনে ঢাকায় ফিরব না আজ। ওকে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে তারপর অন্য কাজে মন দেব। আর তোরাও দুয়েকদিনের মধ্যে সব গুছিয়ে নে। ভারতে চলে যা সবাই। দেশ স্বাধীন হলে তখন ফিরবি।
কিন্তু দাদা, অরিন্দম? ও তোমার সঙ্গে গেলে আমরা ওকে ছেড়ে কীভাবে যাব? ও কোথায় থাকবে তখন? বলতে বলতে বুক ভেঙে যায় আমার, গলা বুজে আসে। মিঠুনের চোখেও হাজার প্রশ্ন। অরিন্দম চুপ। অরিত্র ভয়ে বুকের মধ্যে সেই যে মুখ লুকিয়েছে আর তার কোনো সাড়া নেই।
ভাবিস না। তোরা যাওয়ার আগে আমি অরিন্দমকে তোদের কাছে দিয়ে যাব। আর কোনো কারণে যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে তোর বৌদিদের সঙ্গে সীমান্তের ওপারে যাওয়ার ব্যবস্থা করব, ওখানে গিয়ে ওরা তোদের খুঁজে বের করে নেবে। এখন জরুরি অবস্থা চলছে দেশে। নিজেকে শক্ত করতে হবে রিণি, বাস্তবতা বুঝতে হবে। আজ রাতটা এখানে থাকা অরিন্দমের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। সাবধানে পথ চলতে হবে এখন।
দাদা অরিন্দমকে নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় ছেলেটার মুখটা এত করুণ দেখাল! এত মলিন! ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠল আমার। মনে হলো আমার হৃৎপিণ্ডটাকে কেউ ছিঁড়ে নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে। অরিত্র শিশু। সে বোঝে না জীবনের জটিলতা, কঠিন হিসাব। সে-ও দাদার সঙ্গে যাবে বলে বায়না জুড়ল তারস্বরে। দাদা! দাদা! বলে কাঁদল হাত-পা ছুড়ে। তাকে থামাতে জীবন জেরবার হল আমার। মিঠুন গুম হয়ে বসে রইল চুপচাপ। কেন যে এমন দুর্দিন এল দেশে! কেন যে এত কষ্ট এল জীবনে! আমার, আমাদের মতো লাখ লাখ মানুষের সাজানো, গোছানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল মুহূর্তেই। এদেশের মানুষকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে, মশা-মাছির মতো পিষে ফেলতে যেন পণ করেছে পাকিস্তানী হায়েনারা। রক্তের হোলিখেলায় মেতেছে নরপিশাচের দল।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই দাদা অরিন্দমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আমরাও আলো নিভিয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে রইলাম যে যার মতো। দুঃস্বপ্নের মতো মনে হল সব। মনে হল কিছুই সত্যি নয়। স্বপ্ন দেখছি আমরা। ঘুম ভাঙলেই সব স্বাভাবিক দেখতে পাব, দেখতে পাব দারুণ সুন্দর একটি জীবন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। সে জীবনে পাকিস্তানী মিলিটারীর আতঙ্ক নেই, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের ভয় নেই, দমবন্ধ করা পরিবেশ নেই, সর্বোপরি আত্মজকে হারিয়ে ফেলার দুঃসহ অভিজ্ঞতা নেই। হঠাৎই কেন যেন গুমোট মনে হল পরিবেশ। কেমন থম ধরা, গম্ভীর একটা হাওয়া বইতে শুরু করল যেন। সবকিছু অতিরিক্ত নীরব মনে হল, বড় বেশি শান্ত। অতিরিক্ত সেই নীরবতাকে খুন করতেই যেন দরজায় দুমদাম আওয়াজ শুরু হল হুট করে। কী হল? দাদা কী কোনো কারণে অরিন্দিমকে নিয়ে ফিরে এলেন? পথে কি তাদের বিপদ হল কোনো? ভয়ে কাঠ হয়ে বসে রইলাম আমি। মিঠুন গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল বিষয়টা।
ক্ষণপরেই পাশের হারান কাকা, গফুর কাকা আর তার ছেলে মালেক ঘরে ঢুকল মিঠুনের আগে আগে। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের সোনালী অলোয় তাদের স্পষ্ট চেনা যায়। কিন্তু এই রাতে তারা আমাদের বাড়িতে কেন? কেনই বা এত জোরে দরজায় শব্দ? এতে তো চারপাশের মানুষ সজাগ, সতর্ক হয়ে উঠছে আরো। উনাদের সঙ্গে একটা ভারী বস্তা। বস্তা ভর্তি হ্যান্ডগ্রেনেড। বস্তাটা আজ রাতে এখানে লুকিয়ে রেখে কাল সন্ধ্যায় নিয়ে যাবে আবার। গফুর কাকা সহসা হাউমাউ কাঁদে। কাকী আর মালতিকে সন্ধ্যায় ধরে নিয়ে গেছে রাজাকারেরা কাকা আর মালেককে না পেয়ে। কাকারা মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়েছে সেটা জেনে গেছে তারা, তাই কাকাদের ধরতে না পেরে কাকী আর মেয়ে মালতিকে ধরে নিয়ে গিয়ে শোধ তুলেছে আপাতত। হারান কাকা তার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলে, কাঁদিস না গফুর। ঠাকুরকে ডাক। একদিন সব কান্নার শেষ হবে, দেখিস।
মালেক কিছু বলে না। পাথরের মতো শক্ত শরীর নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার চোখদুটো শুধু ভাটার মতো জ্বলে। সব অন্যায়, অবিচার, জুলুম পুড়িয়ে বুঝি ছাই করে দেবে সে চোখ। ঘরের মেঝেয় গর্ত করে বস্তাটা সেখানে লুকিয়ে রেখে চলে যায় সবাই। আবার চুপচাপ সব, আবার ঝিমিয়ে পড়ে চারপাশ। কতক্ষণ যায়? কত সময়? কে জানে! সহসাই আবার জেগে ওঠে সব। আবার চারদিকে শুরু হয়ে যায় আর্তনাদ, হাহাকার, গুলির শব্দ। চারপাশে দাউদাউ জ্বলে ওঠে আগুন। জানালার পাল্লা সামান্য ফাঁকা করে দেখি পাশের মহল্লা দাউদাউ আগুনে পুড়ছে। আমাদের তিনবাড়ি পরের ঘোষেদের বাড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। তার পাশের জহির মিস্ত্রি আর গফুর কাকাদের বাড়ি থেকে লকলকে আগুনের শিখা ছিটকে উঠছে আকাশ বরাবর। হিন্দুপ্রধান এ পাড়ায় এতদিন মিলিটারি হামলা হয়নি। রাজাকারেরা এসে হুমকি দিয়ে গেছে, ধরে নিয়ে গেছে অনেককে, অনেক হিন্দু চলে গেছে ওপারে, তাদের বাড়ি লুট করে দখলে নিয়েছে রাজাকারেরা। অনেক মুসলমানও পালিয়েছে মহল্লা ছেড়ে। সোমত্ত মেয়ে আর জোয়ান ছেলেদের নিয়ে তারা চলে গেছে নিরাপদ আশ্রয়ে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে যারা, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তাদের বেশিরভাগেরই পরিবার চলে গেছে ঘর-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ কোনো আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু এখন আদতে এদেশের কোনো এলাকাই আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ নয়। এখন আশলে নিরাপত্তা নয়, স্বাধীনতা খোঁজার সময়, শান্তির সন্ধানে না ছুটে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। ভিটেবাড়িটুকুও হাতছাড়া, বেদখল হওয়ার ভয়ে এতদিন মাটি কামড়ে পড়ে ছিলাম তবু এখানেই। কেন যে ছিলাম! কেন যে চলে যাইনি এতদিনও!
আমি অরিত্র আর অরিন্দমকে নিয়ে ওপারে, ভারতে চলে যাব, মিঠুন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে, একসঙ্গে ওপারে গিয়ে আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে ট্রেনিংয়ে চলে যাবে মিঠুন, ট্রেনিং শেষে যোগ দেবে যুদ্ধে। অন্ধকার ঘরে বসে জানালার বাইরে জ্বলতে থাকা প্রিয় জন্মভূমিকে দেখতে দেখতে ফিসফিস করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঠিক করতে থাকি আমরা। পরমুহূর্তেই একটি ব্যথা তীক্ষ্ণ ছুরির ফলা হয়ে গেঁথে যায় আমাদের বুকের ভেতর। অরিন্দম! কোথায় আমাদের অরিন্দম! কেন তাকে আজ দাদার সঙ্গে যেতে দিলাম আমরা! কেন তাকে আমাদের সঙ্গেই রেখে দিলাম না আজকের রাতটাও! সকাল হলেই আমরা তাহলে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম ভারতের সীমান্ত লক্ষ্য করে। কেন এমন ভুল করলাম আমরা! অনুতাপে, শোকে আমার বুকটা পুড়ে যায় একদম। হঠাৎ এক ছড়ড়া গুলি এসে আমাদের জানালায় লাগে। ঝনঝন শব্দে কাচ ভেঙে পড়ে, গুলিগুলো সোজা গিয়ে লাগে ঘরের দেয়ালে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারি না কোথায়, কতটা ক্ষতি হল। অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে জানালা থেকে সরে আসি সবাই। খাটের নিচে আশ্রয় নিই। অবিরাম গুলি আর চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। মনে হয় মহাপ্রলয় শুরু হয়েছে বাইরে। আমি অন্ধকারে অরিত্রকে বুকের মধ্যে আগলে ধরে ঠাকুরকে ডাকি। আমার অরিন্দমকে ভালো রাখ ঠাকুর! তাকে নিরাপদে রাখ! সে এখন কোথায়, কেমন আছে ভেবে বুকটা মুচড়ে ওঠে ব্যথায়। তার চলে যাওয়ার সময়ের করুণ, মলিন মুখটা মনে পড়ে গুমড়ে ওঠে মন। হঠাৎ সব শব্দ থেমে যায়। ভীষণ চুপচাপ হয়ে যায় সব। ভয়াবহ নৈঃশব্দ্য নামে চারপাশে। অসহ্য লাগে। মনে হয় এতক্ষণের চিৎকার, হাহাকার আর গুলির শব্দ বরং ভালো ছিল এর চেয়ে। দরজায় দড়াম দড়াম শব্দ সব নিস্তব্ধতাকে গুড়িয়ে দেয় সহসা। কে একজন দরজায় শব্দ করে চিৎকার করে ডাকে, মিঠুনদা! মিঠুনদা!
আমি মিঠুনের কনুই শক্ত করে ধরে রাখি। ফিসফিসিয়ে ওকে বলি, যেয়ো না! যদি বিপদ হয়!
দরজায় আবার শব্দ হয়। বলে, মিঠুনদা! ভয় নেই! আমি রুদ্র! দরজা খোল।
অগত্যা মিঠুন যায়। দরজা সামান্য খুলে ভয়ে ভয়ে বলে, কী হয়েছে রুদ্র? এত রাতে তুই কেন এসেছিস?
শিগগির পালাতে হবে মিঠুনদা! ওরা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে। সবাইকে মেরে ফেলবে। হারান কাকা আর গফুর কাকাকে ওরা মেরে ফেলেছে, মালেক পালিয়ে গেছে, মালেককে ওরা ধরতে পারেনি। ওরা এখন কিছুক্ষণের বিরতি দিয়েছে। চলো এই সুযোগে আমরা পালাই! দেরি কোরো না!
মিঠুন ফিরে এসে চুপিচুপি বলে, শুনলে তো সব! চলো বেরিয়ে পড়ি!
কিন্তু আমার অরিন্দম! ওকে রেখে কোথায় যাব আমি!
বেঁচে থাকলে ওর সঙ্গে দেখা হবে রিণি! এখন চলো! শিগগির!
তোমরা যাও! আমি আমার অরিন্দমকে রেখে কোথাও যাব না, কোত্থাও না! ও যখন ফিরে এসে দেখবে ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেছি আমরা, কতটা কষ্ট হবে ওর তখন, বলো তো! ও একা একা কোথায় যাবে তখন? কার কাছে যাবে আমার ছোট্ট ছেলেটা? এই নরকে ওকে রেখে আমি কোথাও যাব না।
বলতে বলতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে আমার। বুক ফেটে যায় ভীষণ কষ্টে। আমার গলা শুকিয়ে আসে। দম বন্ধ হয়ে আসে। আহা! কেন আমি যেতে দিলাম ছেলেটাকে! ও থাকলে তো এখন কিছু না ভেবেই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারতাম পথে! নিশ্চিন্তে পা বাড়াতে পারতাম নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে! কেন দাদার কথা শুনলাম তখন! কেন যেতে দিলাম আমার হৃৎপিণ্ডের টুকরোটাকে! কেন!
প্রবল হাহাকারে ছেয়ে যায় মন। তীব্র অনুশোচনা আমাকে পাগল করে দেয়। তখনই দরজায় দড়াম দড়াম শব্দ হয় আবার। রুদ্র ভীষণস্বরে বলে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো দাদা! সময় নাই কিন্তু! একদম সময় নাই!
হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে দেখি প্রচণ্ড ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত আমার শরীর। ভীষণ দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখি একাত্তরের সেই ভয়ঙ্কর সময় পেছনে ফেলে এসেছি আমার জন্মেরও ঢের আগে। এটা দু হাজার তেইশ। পাশে মিঠুন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে, যেন কুম্ভকর্ণ। তার পাশে অরিত্রও ঘুমে কাদা। তার কচি মুখে কী যেন এক স্বপ্ন দোল খাচ্ছে দারুণ সুখে। তবু কী এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক। উঠে পাশের রুমে যাই। অরিন্দম হাত-পা ছড়িয়ে দারুণ আরামে ঘুমুচ্ছে। তার সদ্য জাগা গোঁফের রেখার আভাস আড়াল করে জেগে আছে একটুকরো হাসি, আগামীর বাংলাদেশ।

**********************************