শ্রীকান্ত
অনিরুদ্ধ রনি
মিনালি দেবীর আদুরের পুত্র শ্রীকান্ত। ঠাকুর ঘরে প্রনাম করে ছেলে জন্য পান্তা ভাত আর মরিচ নিয়ে এসেছেন। শ্রীকান্ত স্নান করে করে বাবু সেজে আছে স্কুলে যাবে বলে।
–মায়ের হাতের পান্তা ভাতও যেন তার কাছে অমৃত স্বাদের। বড় ছেলে বলে মিনালি দেবী একটু বেশিই ভালোবাসেন তাকে।
কাক কালো চুলে তাকে পুরাই কৃষ্ণ হরি লাগে। কালো গায়ে তার দুরন্তপনার চাপ।বাবা মতিলাল দাস এসব পছন্দ করেন না। তিনি সারাদিন মাছ ধরা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
শ্রীকান্তকে দেখে মতিলাল ক্ষেপে উঠলেন, বলি এ রকম আর কয়দিন আমি যে কেটে মরি কেউ দেখে?? মায়ের ইশারায় শ্রীকান্ত চলে গেল স্কুলে।
মিনালি দেবী ক্ষুদ্ধ চক্ষুতে অভিযোগের স্বরে বললেন কেন করেন এমন?? ছেলেটা একটু পড়তে চায় পড়ুক না।মতিলাল ভ্রু কুচকে ভাতের থালা হাত থেকে নিয়ে খেতে খেতে বলেন অন্ন কি আর এমনি এমনি জুটে?? একটু কাজ করলেই পারে আমার সাথে।
শ্রীকান্ত স্কুলের সেরা ছাত্র বার্ষিক পরীক্ষায় ১ম স্থান হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় তার গুঞ্জন পড়ে গেল।তার বোন চারু, পুস্প বেজায় খুশি দাদা তাদের আজ চকলেট খাওয়াবে। শ্রীকান্ত মায়ের কাছ থেকে নিয়ে এসেছে পাঁচ টাকা। সে সময় মালতিও এলো তাদের বাড়ি, মাছের ঝুলের তরকারি নিয়ে তার মা পাঠিয়েছে বলে।
শ্রীকান্তদা আমায় ও একটা চকলেট দিও বলে আবদার করল।চারু মালতির কান টেনে ধরে,আহ লাগছে তো চারু দি বলে উঠলো মালতি। শ্রীকান্ত ধমকে উঠলো দিব তো সকলেরে চলো।
তাদের ছোট ভাই নির্জন পুস্পের চকলেট খেতে চাইলে দেয় নি পুস্প। নির্জনের কান্নার বেগ আরো দ্রুত হয়ে উঠলো। মিনালি দেবী গলা ছেড়ে হাক দিয়ে পুস্পকে সাবধান করেলেন কিন্তু নির্জনের কান্না থামে নি।
রান্নার কাজ ফেলে মিনালি দেবী রাগে তেড়ে আসলেন পুস্পের দিকে,হাতের চটি দিয়ে দুই গা প্রহার করলেন মেয়ের গায়ে। পুস্প অশ্রুতে টুইটুম্বর আঁখিতে মাকে বলল আমি কিছু করি নি।
মিনালি দেবী চারুর দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ে বললেন রাখতে পার না ছোটকে। না কর ঘরের কাজ না বাহিরের কাজ সবি আমার কপাল বলে চলে গেলেন রান্না ঘরে।
শ্রীকান্ত সন্ধ্যায় গেছে ও পাড়ায় টিভি দেখতে এখানো আসার নাম নেই। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে চলল। মতিলাল শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোমার গুনধর বাবু কোথায় আজ।
ভদ্র ছেলের মত এ কয়দিন শ্রীকান্ত বাবার সাথে মাছ ধরতে গেছে। জেলে পাড়ায় তাদের ঘর হওয়ায়, বিল একটু পাশেই। শ্রীকান্ত এলো একটু পরেই।খাবার খেয়ে শুয়ে আছে ভাই বোন মিলে মাটিতে।
কাল স্কুলে যাবে নতুন বই হবে, কত শত স্বপ্ন তার এখনো বাকি। বাবার মন যোগাতেই শ্রীকান্তের কত কাজ। ঘুম থেকে উঠে চারুর হাতের রং চা খেয়ে গেল ঘাস আন্তে গেল। গোয়ালের গরু গুলো না খেয়ে থাকবে স্কুলে চলে গেলে।
মতিলাল বেজায় খুশি শ্রীকান্তের উপর ছেলে তার কাজ করছে। শ্রীকান্ত এবার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সরকারি বৃত্তিতেও অংশ নিবে পড়াশোনার চাপ তার বেড়ে গেছে। ছেলে যখন প্রাথমিকে ট্রেনেলফুল বৃত্তি ফেল অশ্রুতে সিক্ত আঁখি নিয়ে মতিলাল বাবু শ্রীকান্তের মাথায় হাত বুলালেন। উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হলো শ্রীকান্তের। হাই স্কুলের পৌছে শ্রীকান্ত আরো মনোযোগী পড়াশোনায়। সেই সাথে বাড়ে পরিবারের চাপ।নিত্য প্রয়োজনী দ্রব্যের মূল্য হাতের নাগালের বাহিরে যাচ্ছে দিনকে দিন।
সেদিন স্কুল থেকে এসে পরীক্ষার ফ্রী জমা দেওয়ার কথা বলতেই মতিলাল রেগে তেড়ে আসেন। পয়সা কি গাঙ্গে ভেসে আসে?? বই খাতা ছুড়ে মারলেন মাটিতে কি দরকার আর পড়াশোনার।এদিকে বোনের বিয়ে দিতে হবে শ্রীকান্তের বাবার উপর ঋণের বোঝা।
শ্রীকান্ত বেরিয়ে গেল ঘর হতে রাত্রে বাড়ি এলেও খাওয়া হলো না তার।এই যে স্বপ্নের বিনাশে তার অকারণে আয়েসি হওয়ার স্বাদ,বড়ই বিস্বাদময় এই পৃথিবীতে। সেই রাগ অভিমান সুপ্ত রইলো মনের গহীনে। শ্রীকান্ত আবারও চেষ্টায় রপ্ত হলো যদি ঘুচে দারিদ্র্যতার সীমারেখা। মিনালি দেবী জমানো টাকা লুকিয়ে বাড়িয়ে দিলেন ছেলের হাতে। শ্রীকান্ত স্কুলে গেল ঠিকি কিন্তু পরীক্ষার ফ্রী জমা করলো না। মায়ের শেষ ক’টা টাকা রেখে দিল বোনের বিয়েতে কাজে লাগবে বলে। স্যারেরা তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন পরীক্ষা গুলো ফ্রী করে দিলেন। পড়াশোনার কোনো কমতি নেই তার মাঝে। তবুও চিন্তা এসে ভীড় করে মনের মধ্যে। মালতি বসে আছে বিলের ধারে শাপলা নিয়ে, বিকেলে তীর্যক আলো পড়ছে বাঁকা হয়ে। শ্রীকান্ত,দাকে যে ভালো তার। নৌকা ভিড়তেই মালতি দৌড়ে গেল শ্রীকান্তের কাছে হাত বাড়াও বলে শাপলার মালা বেধে দিল হাতে লাজুক হেসে পালালো মালতি। পানি বেড়েই চলছে, রাস্তার মোড়ে এসে গেছে মাতিলাল বাবু চিন্তায় আছেন সব ফসল এবার যদি একেবারেই যায় তবে মাছ বেঁচে আর হবে না সংসার চালানো। ভয়াবহ বন্যায় ফসল ভেসে গেল। উঠোন জুড়ে হাটু পানি মালতি দাড়িয়ে আছে ঘরের পালা ধরে। সেই সাথে বাড়লো শ্রীকান্তের কাজের চাপ। উঠোনে নৌকা মালতি চলে যাচ্ছে মামার বাড়ি কবে আসবে কে জানে??
ক্লান্ত বিকেলে পুস্প বলল, দাদা আমাদের কি হবে??মালতি দিরা তো চলে গেল, গৌধুলি বেলায় নৌকা দূর প্রান্তে বিলিন হলো।
বারান্দার চৌকিতে শুয়ে আকাশে তাকিয়ে শ্রীকান্ত ভাবে আহা জীবন কত বৈচিত্রময়।স্বপ্নের তরী যায় গুড়িয়ে জলের আবরণে। কাল বাদ পরশু সেও পাড়ি দিবে কাজের সন্ধানে বহুদূর।
=======================