You are currently viewing শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধিপত্যবাদ ও বিবিধ প্রসঙ্গ || স্বপঞ্জয় চৌধুরী

শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধিপত্যবাদ ও বিবিধ প্রসঙ্গ || স্বপঞ্জয় চৌধুরী

শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধিপত্যবাদ ও বিবিধ প্রসঙ্গ

স্বপঞ্জয় চৌধুরী

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন পর্বটা ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। এতে প্রেম এসেছে বহু পরে। আদিগ্রন্থ চর্যাপদ লেখা হয়েছিল সান্ধ্র্যভাষা বা আলো আঁধারি ভাষায়। যা মিশ্রিত ছিল উচ্চপর্বের বৈদিক সংস্কৃত’র সাথে। তখন সাহিত্যের ভাষাকে ধর্ম চর্চার ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মৌখিক ও লিখিত রূপ ছিল ভিন্ন। চর্যাপদের পদ রচয়িতারাই মূলত প্রাচীন কবি। কাহ্নপা, লুইপা, ঢেডনপা, কুক্কুরীপা, শবরিপা প্রমুখ ছিলেন চর্যাপদের কবি। বহুকাল ধরে কবিতায় ঈশ্বর বন্দনা চলেছে। মধ্যযুগের শ্রী বড়ু চন্ডীদাশ, আব্দুল হাকিম, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (যুগসন্ধিক্ষনের কবি),আলাওল,কায়কোবাদ,কালীদাশ  প্রমুখের হাত ধরে সাহিত্যে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের সূচনা ঘটে। ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ গ্রন্থাগার থেকে প্রাচীন গ্রন্থ চর্যাপদ সংগ্রহ করেন। ১৯২৬ সালে ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তার রচিত The Origin and Development of Bengali Language (ODBL)বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ গ্রন্থে চর্যাপদকে আদি গ্রন্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আধুনিক সাহিত্যের প্রাক প্রথমিক পর্ব মূলত রচিত হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্যারিচাঁদ মিত্র, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত,কামিনী রায়, কুসুমকুমারী দাশ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব গুহ, জসিম উদ্দীন প্রমুখের হাত ধরে। এরপর সাহিত্য চলছে বহমান নদীর মতো। উপমহাদেশীয় স্বাধীনতা ও পাক বাংলাদেশ যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনতায় ও সাহিত্যে লেগেছে বাঁক বদলের খেলা। মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও চেতনা বিরোধী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গেল সাহিত্যিকেরা। আমি নাম বলবোনা। গুগলসার্চ দিলেই তাদের নাম পেয়ে যাবেন।

রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের সাথে সাথে শিল্প সংস্কৃতিতে জড়িত স্বার্থ সংশ্লিষ্টদেরও আধিপত্যবাদ তৈরি হয়। দলকানা কবি, সাহিত্যিক কিংবা সাংস্কৃতিক ছায়ায় বেড়ে ওঠা ব্যক্তিবর্গ নিজের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে নন্দিত হয়েছেন। সবাই না ব্যতিক্রমও আছে ঢের। লেখা ছাপানো থেকে শুরু করে জাতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে তারা একচেটিয়া দখলদারিত্ব কায়েম করে রেখেছে। যার ফলে সুসাহিত্যিক ও সত্যিকারের মেধাবীরা সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে। সাহিত্যের সাথে সংশ্লিষ্টতা নেই কেবল মাত্র ব্যবসায়ী কিংবা টাকার জোরে পত্রিকা প্রকাশ করা ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইসব পত্রিকাগুলোতে লেখার চেয়ে লেখককে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বেশি। নামফাটানো লেখক, মিডিয়া লেখক, মৌসুমি লেখক, চাইনিজ খাওয়ানো লেখক, সংখ্যালঘু লেখক, জেলা কোঠায় লেখক নানা প্রকারের লেখক চোখে পড়ে। একজন পাঠক হিসেবে আমার মূল্যায়ন সাহিত্যকে তার নিজের পথে চলতে দিতে হবে। সৃষ্টির পথে বাধা নয় তাকে মুক্ত করে দিতে হবে। লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে পরিচিত মুখ বিবেচনা না করে লেখার শিল্পমানকে প্রাধান্য দিতে হবে। নতুবা প্রকাশের অভাবে অনেক লেখকেই ঝরে পড়ে অসময়ে। আমি অনেক নতুন লেখকের লেখা পড়েছি যাদের লেখা অনেক বড় লেখকের চেয়েও শক্তিশালী। শুধু সৎ সম্পাদক ও সৎ প্রকাশকের অভাবে তারা বিকোশিত হতে পারছে না। সাহিত্য পত্রিকাগুলোর দায় এখানেই। তাদেরকে সম্মুখ সারিতে নিয়ে আসা। যে সম্পাদক ভালো লেখা জেনেও তা প্রকাশ করেনা। সেতো আজন্ম বিবেকহীন খুনীর সমান। নিজেকে কী সে কখনো ক্ষমা করতে পারবে? সাহিত্যের আধিপত্য হোক শিল্পগুনে। সাহিত্য পণ্য নয় এটি একটি চিন্তাশীল সেবা। এ সেবা গ্রহনে পাঠক তাড়িত হবে। কিন্তু আশংকার বিষয় এই যে সাহিত্যমান বিবেচনায় সুপাঠক কই? কালের প্ররোচনায় সস্তা,বস্তাপচা সাহিত্য হচ্ছে। এই শ্রেণির শখের ও বাজারী পাঠকদের তুষ্ট করতে অনেক লেখকই সস্তামানের সাহিত্য রচনায় বাধ্য হচ্ছেন। তাদের বাজারটা ধরার জন্য। কিন্তু এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলা সাহিত্য। অবশ্য পুঁজির অভাবেও অনেক সাহিত্য পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারকে শিল্প সাহিত্য বিকাশে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে( যদিও এখনেও লুটপাটের ভয় আছে) ভবিষ্যতে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপিত করার মতো কোন সাহিত্য খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এর জন্য অবশ্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও দায়ী। আমাদের প্রাক আধুনিক পর্বের সাহিত্যই এখানে আধিপত্য বিস্তার করবে। সাহিত্যের এখানেও একটা আধিপত্যবাদিতা আছে। গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য এবং কম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকে অবোদমিত করবে। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। সম্প্রতি ভারতের উত্তরবঙ্গে আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম তাদের পাঠ্য বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, শামীম রেজা, শহীদুল জহির, সেলিম আলদীন, হুমায়ুন আজাদ এর সাহিত্য কর্ম তারা পড়বে। এর চেয়ে গৌরবের আর কী হতে পারে। অনেকে বলবে তাদের নাম অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রেও ভারতীয় লেখক ও সংশ্লিষ্ট কমিটির সাথে সুসম্পর্ক ও লবিং এর ফলে নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি বলব তাদের সাহিত্য কর্মের কথা। সাহিত্য মান ও চিরন্তন আবেদনের কথা মাথায় রেখেই হয়তো তাদের সাহিত্য কর্মকে স্থান দেয়া হয়েছে। আমাদের বর্তমান সময়ের আলোচিত কবি ওবায়েদ আকাশ তার কবিতাও বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা থেকে ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। যশোরের একজন লেখক হোসেন উদ্দীন হোসেন তার লেখা গল্প ইন্দুর বিলাই খেলা ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। তাই সাহিত্যমান সম্পন্ন সাহিত্যই সত্যিকার অর্থে আধিপত্য বিস্তারের অধিকার রাখে।

এখানে আরো একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই না নয়। একটা সময় ছিল সাহিত্য পত্রিকা কিংবা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো সাহিত্যিকদের প্রমোট করতেন, তাদেরকে লেখা প্রকাশের বিনিময়ে সম্মানি দিতেন। যার ফলে তাদের জীবন যাত্রা থেমে থাকতো না। মৌলিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও চালিয়ে যেতে পেরেছেন। আজকের পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শিল্প-সাহিত্যকে লস প্রজেক্ট বিবেচনা করে। সরকার ও পুঁজিপতিগণ এখানে বিনিয়োগের পরিমান কমিয়ে দিয়েছে। পুঁজিপাতিরা বরং ধর্মশালায় টাকা ঢালবেন নিজেদের সামাজিক অবস্থান পাকাপোক্ত করতে। যাও দু-একটা পত্রিকা এই সম্মানির ব্যবস্থা রেখেছেন। সেখানেও চলে স্বজনপ্রীতি ও দলকানাদের প্রভাব। তাই লেখা বের হচ্ছে, টাকাও ঢালা হচ্ছে। আবার অনেক হঠাৎ লেখক, আমলা লেখক বা শখের লেখক টাকার বিনিময়ে সম্পাদকদের দিয়ে, প্রয়োজনে পত্রিকা মালিকের প্রভাব দেখিয়ে লেখা ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এতে পা-চাটা অর্থকষ্টে ভোগা সাহিত্য সম্পাদক নিজের আর্থিক উন্নতি করতে গিয়ে সাহিত্যের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। তাই যারা সত্যিকারের সাহিত্য চর্চা করছেন তারা দৈনিক পত্রিকা পাতা কিংবা কিছু কিছু সাহিত্য পত্রিকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এটা সাহিত্য বিকাশের জন্য বিরাট ক্ষতি।

আবার আরেক শ্রেণির কবিদল আছে। তারা একটি নির্দিষ্ট পত্রিকা বা গোষ্ঠিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। তবে এই গোষ্ঠীচর্চা কিংবা কবিদল গঠন নেতিবাচক কিছু নয়, যদি সেখান থেকে ভালো সাহিত্যকর্ম বেড়িয়ে আসে তবে অবশ্যই তা প্রশংসার দাবি রাখবে। কিন্তু তা যদি হয় শুধুই মাত্র দলকেন্দ্রিক-ই যেখানে বৃহৎ পাঠক সমাজের সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে তা কুয়োর ব্যঙের মতোই আজীবন কুয়োতেই জীবন পার করে দেবার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে এখানে। তারা শুধুমাত্র তাদের গ্রুপের কবিদেরকে প্রমোট করবে। একে অপরের প্রশংসা করবে। আহা! চমৎকার, কী দারুণ! লিখেছো ভায়া। অথচ তাতে সত্যিকার অর্থেই কোন শিল্পগুণ নেই। তাতে কোন দৃশ্য নেই, কল্পনা নেই, দর্শন নেই । আছে নিজেকে জাহির করার বালখিল্যতা। যার গোষ্ঠী যত বড় বইমেলায় বই বিক্রি তার ততো বেশি এবং বই বিক্রির সংখ্যার বিচারে সে-ই জনপ্রিয় এবং কালক্রমে কিছুকাল জননন্দিত লেখকেও পরিণত হবে। কিন্তু  প্রাণহীন জড়বস্তুসম্পন্ন সাহিত্য যা মানুষকে ভাবায় না, নাড়া দেয় না। তাকে প্রমোট করার জন্য এতো আয়োজন, এত দলাদলির কী প্রয়োজন? কালের ধূলোর মতো এইসব দলবাজ অলেখক বা অকবি ঝরে পড়বে। সাময়িক বাহ! কিংবা বাহবা! কিছুই থাকবে না। তারা নিজেরাও একসময় বুঝতে পারবে এইসব দলাদলি আসলে সাহিত্যের বিষয়বস্তু না তা সাহিত্যের বাইরের বিষয়। সাময়িক প্রতিষ্ঠার জন্যই এতো আয়োজন। তাই যারা সত্যিকারের সাহিত্য সাধনা করে, যারা অদলের কবি তাদেরকে খুঁজে বের করতে তাদের লেখার মাধ্যমে।  তাদের লেখাগুলোকে প্রকাশ করলে সাহিত্যেরই মঙ্গল। মিডিয়া, অর্থ ও ব্যক্তির নিকট নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে একজন সৎ সম্পাদকের দায়িত্ব সত্যিকারের কবি-লেখকগুলোকে খুঁজে বের করা। নাম নয় তারা লেখা ও শিল্পগুণকে প্রাধান্য দিয়ে লেখা প্রকাশ করা। তবেই সাহিত্যের জন্য হবে তা পরম পাওয়া। 

স্বপঞ্জয় চৌধুরী

কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

====================