শিমুল তলা
লতিফুল কবির
সাজু কবিরাজের নাতনিকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে আসার দিনটি বাদে গত চল্লিশ বছরের প্রতিটি দিন প্রায় একই রকম সেকেন্দার আলির কাছে। তার ধারণা, ওই একটা দিন গাঁয়ের মানুষ তার দিকে বেশ গভীর দৃষ্টিতে চেয়েছিল। গাঁয়ের মানুষের সেই দৃষ্টিতে ভালোবাসা বেশী ছিল কিনা, তা নিয়ে একটা ধন্দ তার মাথায় আটকে ছিল অনেক দিন। ঘোর কেটে গেলে নির্বান পাওয়া মানুষদের মতো সেকেন্দার আলিরও মনে হয়েছিল যে, জীবনে যেখানে বেঁচে থাকাটাই বড় কথা, সেখানে ভালোবাসার মতো বিষয়গুলি একধরণের বাহুল্য ছাড়া আর কিছু না। পাঁথারে কাজ করার সময় সানকিতে পান্তার সাথে আলু অথবা ডাল ভর্তা আর কাঁচা-মরিচের মাখামাখি অথবা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে ধোঁয়া ওঠা ভাতের মও-মও গন্ধ ক্ষণিকের জন্য একটা মায়ার জাল তৈরী করে বটে; কিন্তু, সারাদিনের কষ্ট আর বিশ্রামহীনতার তুলনায় গন্ধের সেই স্বাদটুকু এত কম যে, সেগুলো তার মনের মধ্যে তেমন করে যায়গা করে নিতে পারেনি। কবিরাজ বাড়ির উত্তর দিকের উঠোনে বাজ পড়ে পুড়তে পুড়তে টিকে যাওয়া একটা শিমুল গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা বছর। সেই গাছের সাথে নিজের জীবনের কোথাও একটা মিল খুঁজে পেয়েছিল সেকেন্দার আলি। ঘরের বউ ছাড়া আর কারও কাছে সেই কথা বলতে পারেনি সে। বৈচিত্র্যহীন সেই জীবনে শহরে বসবাসরত চাচা শ্বশুরের বাসায় যাতায়াতটা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পরের কথা। গাঁয়ের মানুষদের মতো সেকেন্দারের কাছেও সেটা ছিল গণ্ডগোলের তিন বছর পরের ঘটনা। শব্দটা মনে পড়লে সেকেন্দারের কেমন ভয় করে। চাচাশ্বশুরের কাছে একবার বলেছিল সে কথা; কিন্তু কী হয়েছিল কেন হয়েছিল সেটা সে মনে করতে পারে না, শ্বশুর মশাই এমন গালাগালি করেছিল যে, সেকেন্দার আলি আর কোনদিন গণ্ডগোল শব্দটা বলেনি। শহরের মানুষের মতো না হলেও সেও বলতে শিখেছিল মুক্তির বছর। গণ্ডগোল অথবা মুক্তি শব্দ দুইটিতে কী ছিল সেটা নিয়ে অনেক ভেবেও সে কোন উত্তর দাঁড় করাতে পারেনি। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক আয়েন উদ্দিনকে সাহস করে একবার সে জিজ্ঞেস করেছিল সেই কথা। শুনে চোখ বড় বড় করে আয়েন উদ্দিন বলেছিলেন, ‘ও সেকেন, মুক্তির সনকে তুমি গণ্ডগোল কবা ক্যানো?’
জবাবে সেকেন্দার বলেছিল, ‘ঘর-বাড়ি ছ্যারে লদীর ওপার ওপলালের গাওত গেছনু, পাঞ্জাবি অ্যাসে বাইত আগুন দিলো, দাদা শউরক ধরে লিয়ে গুলি করে মারলো, সেটা তো গণ্ডগোলই। মুক্তি ক্যাঙ্কা ছিল তাহলে?’
শিক্ষক আয়েন উদ্দনি তাকিয়েছিলেন সেকেন্দার আলির মুখের দিকে। মুক্তি বিষয়টি তিনি নিজেই ভালো করে বুঝতে পারেন না, আর এই বোকা-সোকা সেকেন্দার আলিকে সেটা তিনি কেমন করে বুঝাবেন? সহজ কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘অত বুজে কী হবে? মুক্তিক মুক্তিই কও, আর তোমার চা-শউর তো নিজেই মুক্তিবাহিনীর লোক।’
মুক্তিবাহিনী শব্দে চোখ গোল-গোল করে তাকিয়েছিল সেকেন্দার। জিজ্ঞাসু সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আয়েন উদ্দিন বলেছিলেন, ‘মুক্তি বোঝনি, সেডা তো বুঝাই পারিচ্চি, সে যাগাত মুক্তিবাহিনী বুঝবু ক্যাংকা করে। শোন সেকেন, যারা বন্দুক লিয়ে পাঞ্জাবি সেনাদের খ্যাদালো, তারাই মুক্তিবাহিনী। য্যাংকা তোমার চা-শউর।’
চাচা শ্বশুর বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেছিল! শুনতেই কেমন লেগেছিল সেকেন্দারের। বুকের মধ্যে একটা শীতল আনন্দ ভরা জোছনার চুইয়ে পড়া আলোর মতো চুইয়ে পড়েছিল সেদিন। ব্যাপারটা সে কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারেনি। বউকেও না। আরও অনেক বছর পরে মণ্ডলপাড়ার আজগর মণ্ডল নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে শুরু করলে শিক্ষক আয়েন উদ্দিনের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল, ‘আজগর মণ্ডল না আজকর ছিল, সে মুক্তি হল কেমন করে? সে-ই তো দাদা শউরক ধরে দিছিল পাঞ্জাবির কাছে!’
আয়েন উদ্দিন সেদিন অবাক হওয়ার ভান করে বলেছিলেন, ‘তুমি ঠিক বলিচ্চ তো যে আজগর আজকর ছিল?
’অ মাস্টর, দাদি আম্মা নিজে দেকিছে। বাইত তো আর কেউ ছিল না যে দেখপে।’
’শোন সেকেন, তোমার দাদির মাতা-টাথা কি আর ঠিক ছিল? কাক দেখপা যায়ে কাক দেখিছে। থোও তো এগলা প্যাচাল। আজগর মুক্তি হলেই কী আর আজকর হলেই কী?’
সেই থেকে মুক্তি আর রাজাকারের পার্থক্য ঘুঁচে গিয়েছিল সেকেন্দারের। সেটাও তিরিশ বছর আগের কথা। তার কয়েক বছর আগের যে ঘটনা সেটাই আগে বলা যাক। সেবার শহরে গিয়েছিল সে উঠেছিল চাচা শ্বশুরের বাসায়। দুই রুমের এক বাসায় বউ-বাচ্চাদের নিয়ে গাদাগাদি করে থাকেন, শহরের একটা স্কুলে পড়ান। যুদ্ধের আগেই এই চাকুরিতে ঢুকেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে বউ-বাচ্চাদের গ্রামে রেখে ভারতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেই গ্রাম থেকে আরও কয়েকজন যুবকও মুক্তির খাতায় নাম লিখিয়েছিল। যুদ্ধের সময় কালে-ভদ্রে আসতেন, তবে তা এতটা গোপনে যে, গাঁয়ের কাক-পক্ষীরও টের পাওয়ার উপায় ছিল না। পরদিন সকালে দাদী শ্বাশুড়ির কান্নার শব্দে গাঁয়ের মানুষ বুঝতে পারতো যে সাজু কবিরাজের ছেলে রাতে এসেছিল। ফিসফাস করলেও গাঁয়ের মানুষ এটা নিয়ে উচ্চ-বাচ্য করতো না। ওই গ্রাম থেকে প্রথম ম্যাট্রিক পাশ দেওয়া মানুষ তখন একজনই ছিল। সেজন্য আজগর মণ্ডল অনেক চেষ্টা করেও গাঁয়ের কয়েকজন যুবকের মুক্তি হওয়ার খবর সময়মতো জোগাড় করতে পারেনি।
শীতের সকাল। কয়েকদিনের কুয়াশা শেষে সেদিন চকচকে রোদ উঠেছিল। সেকেন্দারের চাচাশ্বশুর একটা টুলের মধ্যে বসে ক্ষুর দিয়ে নিজে-নিজেই শেভ করছিলেন। সামনে চেয়ারে একটা ছোট্ট আয়না। সেই আয়নায় নিজের মুখ ভালো করে দেখা যায় না, কিন্তু চাচা শ্বশুর তার ভেতর দিয়েই সেকেন্দার আলিকে দেখে ফেলেছিলেন। শেভ করা অসমাপ্ত রেখে সেকেন্দার আলির দিকে তাকিয়ে চাচা শ্বশুর বললেন, ‘কখন আলু? একাই আসিচু?’
মাটিতে গামছা বিছিয়ে সেখানে বসতে বসতে সেকেন্দার জবাব দিল, ‘কছিরেক কছনু। ভিয়েত বুলে কপি বুনিছে, অ্যাসপা প্যারবে না।’
‘খ্যাচু কিছু?’
আমতা আমতা করছিল সেকেন্দার। সেটা লক্ষ্য করেই চাচা শ্বশুর বললেন, ‘ভিতরে যাও। অস আর মুড়ি আছে। চাচিক কয়ে সেডা অ্যানা খায়ে এটি অ্যাসো।’ তারপর চেয়ারের উপর রাখা গ্লাস থেকে খেজুরের রস এক ঢোক খেয়ে আবার গ্লাসটি চেয়ারে নামিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
খেজুরের রস খেতে গেলেও সকালে রান্না করা ভুজনা খেয়ে বাইরে এলে সেকেন্দার আলির দিকে তাকিয়ে চাচা-শ্বশুর জানতে চাইলেন, ‘কী ক্যবা আসিছু?’
বড় করে একটা দম নিয়ে সেকেন্দার জবাব দিল, ‘ক্যালকা অ্যাতে বেটি হছে।’ বলতে বলতে শরমে মরে যাচ্ছিল সে।
‘আগে কবু না? ছ্যল ক্যাঙ্কা আছে? ছ্যলের মাও?’
‘ছ্যল ভালো। ছ্যলের মাও কোকাচ্ছিল, অইছ ডাক্তার অসুধ দিছে।’
‘নাম রাখিচু?’
‘সেডা কবাই তো আনু। কী নাম থোমো অ্যানা কলে ভাল হয়।’
‘বেটির নাম কী থুবু…’ বলে কিছু একটা ভাবলেন চাচা-শ্বশুর, তারপর আচমকা বললেন, ‘মুক্তি থো।’
‘মুক্তি!’ চমকে উঠে সেকেন্দার আলি। তারপর বলল, ‘ব্যাবাক মানুষ আপনিক মুক্তি ক্যয়ে ডাকে। বেটির নাম মুক্তি থুই ক্যাঙ্কা করে?’
‘হামাক মানুষ মুক্তি ক্যয়ে ডাকে? এডা তুই কী কলু?’
‘কয় তো। ক্যান আপনি জানিন না?’
সেকেন্দারের চাচা-শ্বশুর অনেকটা সময় চুপ করে থাকলেন। হয়তো যুদ্ধের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর। তারপর জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মানুষ ক্যক। তারপরও বেটির নাম মুক্তিই থো।’ শেভ করা শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাটির মধ্যে রাখা পানিতে ডুবিয়ে ফিটকারি মাখলেন গালে, তারপর জামার পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে বললেন, ‘এডা থোও। বাইত যাওয়ার সোময় কিছু লিয়ে যাবিন।’
দশ টাকার তখন অনেক দাম। কী করবে বুঝতে পারছিল না সেকেন্দার। চাচা-শ্বশুর স্কুলে মাস্টারি করে মাসে আড়াই শ’ টাকা বেতন পেতেন সেই সময়। আটআনা দিয়ে সিনেমা দেখা যেতো। বিকাল বেলা চাচা-শ্বশুরের ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে ম্যাটানি শো দেখেছিল সে। আশ্চর্যজনক ভাবে সিনেমা হলটির নামও ছিল ‘মুক্তি টকিজ’। জীবনে সেটাই ছিল তার প্রথম এবং শেষ সিনেমা দেখা। এত বড় পর্দার উপরে মানুষগুলো কী যে করছিল, আর তারা এত জোড়ে কথা বলছিল যে, সিনেমার পুরো সময়টা সে ভয়ে কুকড়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল। বউকে সেই কথা বললে বউ বলেছিল, ‘অ, তুমি ট্যাকা প্যায়ে ফুর্তি করে আলিন। ক্যা, হামার জন্যে একটা শাড়ি কিনবার পারছিলিন না? ছিঁড়া শাড়ি পরে আর কতদিন থাকমো?’
মুক্তির মায়ের শাড়ির দুঃখ কোনদিন ঘোচেনি। আর্থিক অবস্থা ভালো হবে, সেই আশায় বছর চলে গিয়েছে, কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। অথবা পরিবর্তন হয়েছিল, কিন্তু সেটা চোখে ধরা পড়েনি। বিয়ের সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে যে পরিমান জমি পেয়েছিল, সেটাতে ধান ছাড়া আর কিছু হতো না। তাও বছরে দু’বার; আর যদি বন্যা হয়, জমি লুকায় জলের তলে, তখন ডুবে যাওয়া ফসলের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকতো না। পূব পাড়ায় শ্বশুরের কিছু ভিটে-মাটি ছিল, সারাবছর ধরে সেটাতে পটল হতো, মরিচ হতো, আরও কত কিছু হতো। কিন্তু সেটাতে না মেয়ের না জামাইয়ের কথা বলার কিছু ছিল। বউ কতো অনুনয় করেছিল বাপের কাছে, মায়ের কাছে আর ভাইয়ের কাছে। কারও মন গলেনি। চাচা শ্বশুর এসেছিলেন একদিন। ততদিনে শেখ সাহেব মরে যাওয়ার কারণে চাচা-শ্বশুর নিজেই অর্ধেক হয়ে গিয়েছিলেন, এসব দুনিয়াদারী হিসাব-নিকাষে তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। তারপরও বড় ভাইয়ের হাত ধরে বলেছিলেন, ‘বেটিড্যাক পানিত ফেললু। নাতিন হছে, সেডাও দেখলু না। অরা কী খায়ে ব্যাঁচপে!’
ওই পর্যন্তই। ছোট ভাইয়ের কথা বড় ভাই শুনবেই এমন কোন বিধান কোরআন-হাদিসে তো ছিলনা, তাই সেকেন্দার আলির শ্বশুরও শোনেননি। কিন্তু চাচা শ্বশুরের কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল তার। বউয়ের কাছে বলেছিল সে কথা, ‘মুক্তির মাও, চাচা-আব্বার লাকান মানুষ হয় না।’ শুনে তার বউ ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। বাপের উপর তার জন্মের অভিমান, সেটাতে আরও কিছু যোগ হয়েছিল সেদিন। জামাই-বউ মিলে বুদ্ধি করে সকাল বেলা মুক্তির মা গিয়ে বসেচিল চাচার কাছে। বলেছিল, ‘অ চাচা, এগডা কথা কমো। রাখবিন?’
মাথায় সরিষার তেল দিয়ে রোদে পিঠ লাগিয়ে বসেছিলেন সেকেন্দারের চাচা-শ্বশুর। ভাতিজির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘কী কবু, ক।’
বড় করে দম নিয়ে আর বুকে সাহস সঞ্চয় করে মুক্তির মা বলেছিল, ‘একনা জমি দিয়ে কিছু হয়? আপনের জমিগুলা আদারক দিয়ে থুছেন, অটি থ্যাকে মিচ্চানা জমি হাংকেক দিলে…।’
কথা শেষ করতে পারেনি মুক্তির মা, চাচা তার রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সেকেনক জমি দিলে অটে আর ফসল হ্যবে না। অক অন্য কারও জমিত হালচাষ ক্যরবার ক।’
‘অ চাচা। আপনির জামাই কার জমিত হাল চাষ ক্যরবে? ক্যাউ দিবে?’
সেকেন্দার আলি দূরে বসে চাচা-ভাতিজির কথোপকথন শুনছিল। কিছু যে হবেনা, সেটার তার মন বলছিল, তবে মনের কথায় তার আস্থা ছিল না। এবার নিশ্চিত হওয়ার পরে মনে মনে ভেবেছিল, যা করার তাকেই করতে হবে। গাঁয়ের মানুষ দল বেঁধে পশ্চিমে যায় ধান কাটতে। খিয়ার অঞ্চলে যাওয়াটা যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি বিষাদের। পরপর কয়েক বছর সেই খিয়ারে গিয়েছিল সেকেন্দার। ফেরার পথে বউ বাচ্চার জন্য কিনে আনতো কতকিছু। একসময় গতরে শক্তি কমে এলে খিয়ারের জমিদাররা না করে দিয়েছিল। মুক্তি ততদিন বড় হয়ে গিয়েছে। গাঁয়ের স্কুলে পড়তে যায় সে। মাথার চুল বেণী করে তার আগায় লাল-ফিতার ফুল বানিয়ে সেই চুল কাঁধের উপর দিয়ে সামনে ঝুলিয়ে যখন সে হেঁটে যায়, তার চলার পথের দিকে নিষ্পলক থাকিয়ে থাকে সেকেন্দার আলি। ছোট করে দম নিতে নিতে বড় করে একটা দম বের হয়ে আসে।
খিয়ারের কাজ শেষ, কথাটা শোনার পর থেকে মুক্তির মা থম মেরে বসেছিল অনেকটা সময়। মেয়েটা উঠোনে কিত-কিত খেলছিল, সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও দৃষ্টিপথে তখন কেউ ছিল না। ধুসর একটা অন্ধকার মাথার মধ্যে দাঁনা বাঁধছিল। কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল মুক্তির মা। আজগর মণ্ডলের ছেলে আমজাদ মণ্ডল ইঁটের ভাঁটা দিয়েছে কিছুদিন আগে। আসেপাশের গাঁ থেকে অভুক্ত মানুষরা কাজ করতে আসে সেখানে, সেটা সে শুনেছিল। ভাঁটায় গিয়ে নিজের চোখে সেটা দেখে তো অবাক। এতকাজ থাকতে ভাতার কি-না দূর গাঁয়ে যায়? মুখে শাড়ির আঁচল গুজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেছিল সে। শহুরে মানুষদের মতো প্যাণ্ড-সার্ট পরা আমজাদ মণ্ডল তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘অ মুক্তির মাও। কী মনে করে?’
‘তোমার দুলাভাইয়ক খিয়ারের অরা না করে দিছে। এটে একটা কাম করব্যার দিলে তো…।’
‘অ, এডা কোন ব্যাপার হলো। অ্যাসপা কও।’ বলে আমজাদ মণ্ডল আর দাঁড়ায়নি। দম বন্ধ করে ছুটতে ছুটতে বাড়ি গিয়েছিল সেদিন মুক্তির মা। হাঁপাতে হাঁপাতে মুক্তির বাপকে বলেছিল, ‘আল্লাহ তাকাছে এবার। ও মুক্তির বাপ, ভাঁটাত তোমাক ডাকিছে।’
সেই থেকে ভাঁটায় কাজ করে সেকান্দার আলি। ট্রাকে করে মাটি আসে, খড়ি আসে। দল বেঁধে সেগুলোতে হাত লাগায় তারা। মেয়ে মানুষ, পুরুষ মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। গতর খাটায়। গায়ে যত ব্যথাই আসুক, পয়সা তো আসে। হাতে পয়সা এলে সব ব্যথা দূর হয়ে যায়। মুক্তি আরও বড় হয়। আসেপাশের গাঁও থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। তার মধ্য থেকে একটার সাথে বিয়ে হয়ে মেয়ে তার চলে যায়। মেয়ের বিয়েতে ধার-কর্জ হয়, জমি বন্ধক রাখতে হয়। ভেবেছিল, মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে কাজের চাপ কমিয়ে দেবে, জমি যা আছে দু’জন মানুষের জন্য তা যথেষ্ট। ধানের ফলন তো কম বাড়েনি! কিন্তু ঘটনা ঘটলো উল্টো। ধার-দেনা শোধ দিতে গিয়ে ভাঁটায় কাজ দিলো বাড়িয়ে।
আমজাদ মণ্ডলের ভাঁটায় খড়ি আসতো দূর-দূরান্ত থেকে। গায়ের সব বড় বড় গাছ সেই ভাঁটা খেয়ে ফেলেছিল। ছিল বাকী একটা শিমুল গাছ। সেকান্দার আলির চাচা-শ্বশুরের জমিতে একাই দাঁড়িয়ে ছিল সেটা। তিরিশ বছর আগে বাজ পড়ে সেটা মরে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও কেমন করে জানি গাছটি দাঁড়িয়ে ছিল। আমজাদ মণ্ডল কতবার শহরে গিয়ে সেকান্দার আলির চাচা-শ্বশুরের কাছে বলেছে, ‘অ চাচা। গাছটা তো মরাই। হামার কাছে বেঁচে দ্যাও। ভাঁটাত দিই। দাম কত নিবিন, কন?’
অজানা কারণে সেই গাছটি বেঁচতে চাইতেন না তিনি। গাছটিকে ঘিরে যুদ্ধের কোন ঘটনা আছে, সেটা অনেকে শুনেছে, তবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। অনেকে বলে শেখ সাহেব যেদিন নিহত হন, সেদিনই বাজ পড়েছিল গাছটিতে। কারণ যাই হোক, সেকেন্দারের চাচা শ্বশুর সেই গাছটিকে বেঁচে দিতে রাজি হননি। সেকেন্দার আলি ভাঁটায় কাজ শুরু করার পর থেকে নতুন করে বায়না শুরু করলো আমজাদ মণ্ডল। থাকতে না পেরে বউকে ধরলো যেন চাচাকে বুঝিয়ে গাছটি বিক্রি করার একটা বন্দোবস্ত করে। তাতে করে মেয়ের বিয়েতে করা ধার-দেনার একটা বিহিত করা যায়।
মুক্তির মা কোন বুদ্ধি বের করতে পারেনি। শেষে বলেছিল, ‘হামার কতা কি চাচা শুনবে? মুক্তিক লিয়ে যাই, অর কতা যদি শোনে।’
পরদিন সকাল সকালে মা-মেয়েতে গেল শহরে। শীতের সকাল ছিল। দোতলার বারান্দায় বসে মাছ কাটা দেখছিলেন চাচা। বাজার থেকে বড় একটা কাতল মাছ আনা হয়েছে, মটরশুটি দিয়ে সেটার রান্না হবে। ভাতিজিকে দেখে বললেন, ‘অ্যাসে ভালই করিছু। এত বড় মাছ, খাওয়ার লোক নাই।’
মুক্তির মা বলল, ‘অ চাচা-আব্বা। ব্যাটা-বেটিক মানুষ করে কী লাভ হল? সবতো বিদেশ থ্যাকে গ্যাল।’
চাচা তার উদাস নয়নে দূরে তাকিয়ে থাকেন। সত্যিই তো। ছেলে মেয়েরা সব বড় হয়ে কেমন করে বিদেশে স্থায়ী হয়ে গেল, সেটা তিনি বুঝেও উঠতে পারেন নি। ভাতিজির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ক্যবা আসিচু?’
‘আপনির জাঁয়ির শরিল তো চলেনা।’ তারপর মেয়ের দিকে ফিরে বলল, ‘অ মুক্তি। তুই ক।’
মাটির দিকে তাকিয়ে মুক্তি বলল, ‘দাদাজান। আব্বা কচ্চিল শিমুল গাছটা যদি…।’ আর বলতে পারেনা মুক্তি। কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার। চাচা বললেন, ‘তোক লিয়ে আসছে কবার জন্য?’
‘কী করমো। আব্বার শরীল চলেনা। অডা দিলে কিছু টাকা প্যাত।’
চাচা কিছু বলেন না। মনে হয় রাজি হয়েছে, সেটা মনে করে চাচার পায়ে সালাম করে কাঁদতে শুরু করে দিলো মুক্তির মা।
চাচা বললেন, ‘অ্যজগা এখনও ব্যাঁচে আছে। অর কাছে শুনিস অই গাছত কী আছে।’
বড় কিছু পাওয়ার তীব্র আনন্দে মুক্তি অথবা মুক্তির মা দু’জনেই ভুলে গেল আগজর মণ্ডলকে জিজ্ঞেস করার কথা। পরের দিন ভাঁটার লোক এসে গাছটি কেটে নিয়ে গেল।
গাছটি যখন ভাঁটার আগুনে পুড়ছিল সেই সময় বৃদ্ধ আজগর মণ্ডল এসে দাঁড়ালো ভাঁটায়। হঠাৎ করে তার বাপের আগমনে আমজাদ মণ্ডল অবাক হয়ে বলল, ‘আব্বা, এই শরীলে তোমাক কে অ্যাসপার কল?’
আজগর মণ্ডল জানতে চাইল, ‘শিমূল গাছটা কি পুড়ে গেছে বাবা?’
আমজাদ মণ্ডল ডাকলো সেকেন্দার আলিকে, ‘ও সেকেন। শিমুল গাছ কি পুড়ে শেষ?’
অস্তগামী সূর্যের আলোতে আকাশ লাল হয়ে আছে, সেকেন্দারের মনে ইর্ষা জাগে, ইটের ভাটার চেয়ে আকাশের রঙের লাল আলোকে ম্লান করে দিতেই শিমূল গাছের শেষ টুকরাগুলো ভাটার মধ্যে ফেলে দেয় সেকেন্দার আলি। নিমিষেই দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল কাঠগুলো। তখন চিমনির উপর দিয়ে একরাশ ধোঁয়া কুণ্ডুলি পাকিয়ে আকাশের উপর দিয়ে হারিয়ে যেতে থাকলে দিগন্তের ওপারে যতদূর চোখ যায় ততদূর দৃষ্টি ফেলে সেকেন্দার আলি বলে, ‘অ-অ-অ।’
আজগর মণ্ডল আকাশের দিকে তাকায়। তার কেন জানি মনে হল ধোঁয়ার মধ্যে সাজু কবিরাজের মুখ, আর তার ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি, একাত্তরে গুলি খেয়ে মরবার সময় এমন হাসিই সে দেখেছিল বুড়োর মুখে।