You are currently viewing শহীদ ডক্টর শামসুজ্জোহা/  দলিলুর রহমান

শহীদ ডক্টর শামসুজ্জোহা/ দলিলুর রহমান

শহীদ ডক্টর শামসুজ্জোহা

দলিলুর রহমান

নিউইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানে ডক্টর শামসুজ্জোহার বোন আক্তার জাহান আনার এর সাথে আমার আলাপ হয়। এর আগে আমরা একে অপরকে জানতাম না। ওই দিনই তিনি জানতে পারেন যে আমি তার মামা জনাব রবিউল করিম ও তার বাবা জনাব আব্দুর রশিদ এর ছাত্র। তার ছোটভাই আমার সহপাঠী ছিলেন। একবার আনার আমাকে ও আমার স্ত্রীকে তার বাসায় দাওয়াত করেছিলেন। তখন ডঃ জোহা সম্পর্কে অনেক আলাপ আলোচনা হয় এবং আমি অনেক কিছু নতুন ভাবে জানতে পারি। শহীদ শামসুজ্জোহা র পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল বর্ধমানের সেমা ডাঙ্গা গ্রামে। তারা ছিলেন সেখানকার জমিদার। তাদের নানা ছিলেন বাঁকুড়ার দারোগা। বাবা আব্দুর রশিদ বাঁকুড়া জেলায় চাকরি করতেন। তার নানীরাও বাঁকুড়ায় থাকতেন। নানার পরিবার ছিল শিক্ষা সংগীত ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে অগ্রগামী আর সংস্কৃতিমনা পরিবার। সবাই রাজনীতি করতেন। তার মামা এবং মামাতো ভাই ছিলেন গান্ধীজীর শিষ্য। বাবা চাচারাও কংগ্রেস করতেন। চাচা চরকায়া সুতা কাটতেন। তার বড় খালা ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।নানার বাড়িতে মেয়েদের একটি স্কুল ছিল যার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার বড় খালা।মায়ের পরিবারের সবাই আদর্শবাদী প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক। ডক্টর শামসুজ্জোহা ওতার ভাইবোনরা ওই পরিবেশে মানুষ। যার ফলে শিক্ষা সংগীত ও ক্রীড়া এই তিনটি ক্ষেত্রে তাদের সমান পারদর্শী হতে দেখা যায়।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর একটি লেখা থেকে পাই বাঁকুড়ার ২৯৩৯-৪০ ডঃ জোহা জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাঁকুড়ায় মুসলমানেরা ছিল ভয়ানক ভাবে সংখ্যালঘু সেখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে অবশ্য যাওয়া-আসা ছিল সামাজিকতা অন্তরঙ্গতার কথা জানা যায়। বাঁকুড়া শুধু হিন্দু প্রধান নয় বর্ণহিন্দু প্রধান জেলা ও শহর ছিল। বর্ণের হিন্দুরা কিভাবে তাদের প্রাধান্য ও দূরত্ব রক্ষা করত তার কিছু স্মৃতি এখনো যারা সেখানে বাস করেছিলেন তাদের মনে গেঁথে আছে।


পঞ্চাশের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শহীদ জোহার পরিবার বলতে গেলে পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যায়। তার মামা জনাব রবিউলকরিম প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট এবং গোল্ড মেডেল পান। ওই দাঙ্গায় তার সার্টিফিকেট ও গোল্ড মেডেল ভষ্মিভূত হয়
। পরিবারের সবাই ছিলেন আদর্শবাদী প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক। ওই দাঙ্গার পর পরই গোটা পরিবার পূর্ব বাংলায় চলে আসে। তার বাবা কিছুদিন বাঁকুড়ায় থাকলেও মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পূর্ব বাংলায় থাকতে শুরু করেন। প্রথমে তিন বছর তিনি পাবনায় থাকার পর ঢাকায় চলে আসেন এবং গেণ্ডারিয়ায় একটা ভাড়া করা বাসায় থাকতেন। ১৯৬৫ সালে জনাব রবিউল করিম আমাকে গেন্ডারিয়ায় নিয়ে তার বোনের সাথে আলাপ করিয়ে দেন। রিক্ত হাতে গোটা পরিবার নিয়ে আব্দুর রশিদ সাহেব মুষরে পড়েন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ধামরাইর ভালুম আতাউর রহমান খান হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তখন জনাব রবিউল করিম সাহেব ওই হাই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। ডক্টর শামসুজ্জোহার ডাক নাম ছিল মন্টু। তিনি দেখতে ভীষণ সুন্দর ছিলেন তাই অনেকে তাকে দিলীপ কুমার ডাকতেন। তিনি সব সময় হাসি খুশি এবং প্রফুল্ল আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ সদাই তার চোখে মুখে ছিল।অবসর পেলেই পাড়ায় ছোট ছোট ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন। এমনকি পিএইচডি করে এসেও একেবারে কিশোর বয়সি ছেলেদের সাথে তাকে ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে। তিনি আতাউর রহমান হাই স্কুলের মাঠে আমাদের সাথে ভলিবল খেলেছেন। তার মামা জনাব রবিউল করিম সাহেব সব সময় মন্টুকে নিয়ে গল্প করতেন। মন্টুকে নিয়ে তার গর্বের শেষ ছিলনা। মন্টুর হত্যার পর তিনি পাগলপ্রায় হয়ে গেছিলেন।

শহীদ শামসুজ্জোহা কে বাংলাদেশ ভুলেনি। তার মৃত্যু দিবস ১৮ই ফেব্রুয়ারি তাকে ফিরিয়ে আনে আমাদের মাঝে। ফিরিয়ে আনে তার স্মৃতি সারাদেশে। শত সহস শহীদের মাঝে তিনি একজন অন্যতম ব্যক্তি প্রতীক। তিনি স্বাক্ষর রেখে গেছেন ত্যাগের সাহসের ও মহত্বের। তার আত্মাহুতির সম্মানে আমাদের উচিত ১৮ই ফেব্রুয়ারি সারাদেশে যথাযথভাবে উদযাপন করা এবং শহীদ শামসুজ্জোহার ত্যাগের মহিমাকে শিক্ষক দিবস স্বীকৃতি দেয়া।