You are currently viewing শহীদুল জহিরের অন্তরমহল / সৈয়দ কামরুল হাসান

শহীদুল জহিরের অন্তরমহল / সৈয়দ কামরুল হাসান

শহীদুল জহিরের অন্তরমহল

সৈয়দ কামরুল হাসান

১.

শহীদুল জহিরকে নিয়ে নতুন করে আর কিছু কি লিখবার আছে,বিশেষত: যখন তাঁর সৃষ্টিকর্ম ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত,স্বীকৃত ও নন্দিত ?

অকালপ্রয়াত ,অকৃতদার এই কথাশিল্পী অংশত পেশা আর খানিকটা নিজের স্বভাবের কারণেও হয়তো বা সাহিত্যের আড্ডা,গোষ্ঠীবৃত্তি ও দলবাজি থেকে দূরে থেকেছেন কিংবা বলা ভালো নিজেকে দুরে রাখতে পেরেছেন। এমনকি পেশাজীবনে একজন উর্ধতন আমলা হয়েও ,যেমনটা আমরা দেখে অভ্যস্ত , সাহিত্যের নানান আস্তানায় হানা দিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তারের নির্লজ্জ ক’টকৌশলে তাঁকে কস্মিনকালেও জড়াতে দেখা যায়নি। উল্টো তিনি ছিলেন যেন খানিকটা বিব্রত ও বিহবল ,‘কঠিন’ লেখা লিখছেন বলে কিছুটা কুণ্ঠিতও যেন বা ! লেখক হিসাবে নিজের নৈতিক অবস্থান ও বাস্তব পরিস্থিতিতে একলা কিছু করতে না পারার দ্বন্ধে বিপর্যস্তও যেন খানিকটা। এর মাশুল গুনতে হয়েছে তাঁকে,যদিও আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে তাই ছিলো স্বাভাবিক। সত্তুরের মাঝামাঝি থেকে লিখতে শুরু করলেও (সে সময় তিনি শহীদুল হক নামে লিখতেন) শহীদুল জহির তাঁর জীবদ্দশায় অনেকটা সময় জুড়ে ছিলেন এক কম-চেনা,অনাদৃত ,অপরিচিত লেখক। দৈনিক পত্রিকার দিগগজ সম্পাদক ও তাদের ঘনিষ্ঠ প্রকাশকরা মিলে যে ‘বাধার বিন্ধ্যাচল’ খাড়া করে রেখেছিল তার মুখে সত্তুর , আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়ে সক্রিয় আরো কতিপয় লেখকের মত তিনিও ছিলেন প্রত্যাখ্যানের আতংকে অধীর। ২/১টি ছোট কাগজ , আধা-চেনা ম্যাগাজিন (এমনকি সিনে ম্যাগাজিন) ও কতিপয় অপেশাদার প্রকাশনী তাঁকে পাঠকের সামনে তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছে। সেদিনের অভিজ্ঞতা শহীদুল জহির তাঁর ডায়রির পাতায় লিখেছেন: “আমার ছোট গল্পের পান্ডুলিপিটি আজকে বিকেলে মুক্তধারা প্রকাশনীতে দিয়ে এসেছি । যাব যাচ্ছি এমন ভাবনা অনেকদিন থেকেই চলছিল ,যাওয়া হচ্ছিল না এক ধরণের আশ্চর্যজনক সংকোচ মিশ্রিত ভীতির জন্য । ব্যাপারটা বোধ হয় আমার অস্তিত্বের সার্থকতার প্রশ্নের সংগে জড়িত। আমি লিখতে চাই। আর লিখে কী লাভ যদি তা প্রকাশিত না হয়। আর লেখা যদি কঠিন হয় তবে তার প্রকাশনা কঠিনতম। সেই কঠিনতম কর্মটির প্রক্রিয়া শুরু করায় যা আমার জন্য খুবই অসুবিধাজনক ছিল সেটা হচ্ছে ধরনা দেওয়া-যা আমি একদম পারি না। মুক্তধারা অবশ্য খুব সহজেই পান্ডুলিপিটি রাখল-সাহস করে গিয়েছিলাম তাই না! এরপর বসে থাকতে হবে ভাগ্যে কী নির্ধারিত হয় সেটা দেখার জন্য । ওদের যদি পছন্দ হয় আমার লেখা,যদি ভালো লাগে,মন গলে ,তাহলে প্রকাশ ও মূদ্রণের সিদ্ধান্ত নেবে তারা । ভালো না লাগলে সব আশা ভরসা শেষ। ওরা শুধু বিবেচনা করে দেখার জন্য পান্ডুলিপিটি গ্রহণ করেছে তাতেই কী খুশী আমি। তবুওতো একটা সুযোগ দিয়েছে ; অন্যেরা তো কথাই বলেনি । সময় আমার জন্য কী বয়ে আনবে জানি না ,আশা না হতাশা ,তবে আমি ততদিন আশা বয়ে বেড়াবই সকল সংকোচ ও দ্বিধা সত্তে¦ও যতদিন না আমি নি:সংশয়ে বুঝব এবার দাঁড়িয়ে পড়া দরকার আর ছুটে লাভ নেই। ” [ ২৮ এপ্রিল ১৯৮০,সোমবার/ ১৫  বৈশাখ ১৩৮৭ ] দেশের মূল ধারার প্রকাশনা সংস্থা – মুক্তধারাই তাঁর প্রথম বই বাজারে আনার কৃতিত্বের দাবীদার। পান্ডুলিপি জমা দেয়ার পাঁচ বছর পর ১৯৮৫ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম বই ‘পারাপার’ (গল্পগ্রন্থ) । হাল ছেড়ে দেন নি তিনি,সাধনা চালিয়ে গেছেন  – ইতোমধ্যে প্রকাশের একটা স্বতন্ত্র ভংগী আয়ত্তে এনেছেন , সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব এক ভাষারীতি ও প্রকাশভংগী,আর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে কী তিনি বলতে চান ,হতে চান কাদের জীবনের কথাকার তা স্পষ্ট করেছেন। সিকি শতাব্দীর সাধনায় তাঁর সৃষ্টি পরিমাণে বিপুল নয়, কিন্তু গুনে ও মানে তা বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে। হীরার মত ঝকঝকে, ধারালো ও দ্যুতিময় তাঁর রচনা,তাতে ধরা পড়েছে বহুমাত্রিক বিছ্ছুরণ। ২০০৮ সালের ২৩ মার্চ মাত্র ৫৫ বছর বয়সে তাঁর চির অন্তর্ধান এই সাধনায় যবনিকা টেনে দিয়েছিলো।

শূণ্য দশকের শুরু থেকে শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানকার লেখক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ – উদ্দীপনা লক্ষ করা যায় । বেশ কটি জনপ্রিয় দৈনিক ও পাঠক-নন্দিত ছোট কাগজ তাঁর গল্প ও উপন্যাসের আলোচনা ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। প্রথিতযশা কথাশিল্পীরা তাঁর রচনার নানা বৈশিষ্ট্য ও মাত্রা নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। তাঁর গ্রন্থ প্রকাশে এগিয়ে আসে মাওলা ব্রাদার্স ও পাঠক সমাবেশের মত নামী প্রতিষ্ঠান। কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কারও (বাংলা একাডেমী নয়) জোটে। তাঁকে নিয়ে মনোযোগের এই ধারাবহিকতা ২০০৮ সালে তাঁর হঠাৎ মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেন আরো বেগবান হয়ে ওঠে। অনতিবিলম্বে তাঁর ছাত্র ও পেশাজীবনের কয়েকজন করিৎকর্মা বন্ধুর উদ্যোগে গঠিত হয় শহীদুল জহির স্মৃতি পরিষদ। তাঁরা শহীদুল জহির স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এগিয়ে আসেন পাঠক সমাবেশের সাহিদুল ইসলাম বিজু সহায়তার হাত বাড়িয়ে। শহীদুল জহিরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু মোহাম্মদ আবদুর রশিদের  নেতৃত্বে স্মারক গ্রন্থের সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি মনোনীত হন সর্বজনমান্য গুনীজন প্রফেসর আনিসুজ্জামান। পরিষদে সদস্য হিসেবে যুক্ত হন আমাদের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক , হায়াৎ মামুদ ,সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও মহীবুল আজিজ সহ আরো বেশ কয়েকজন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত হয় শহীদুল জহির সমগ্র। সহস্রাধিক পৃষ্ঠার এই সমগ্রে জহিরের গ্রন্থিত ,অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা, চিঠিপত্র,ডায়েরি,সাক্ষাৎকার, মূল্যায়ন,জীবনপঞ্জী ও জীবনের নানা পর্বের আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। তাঁর মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণায় অংশ নেন তাঁর অগ্রজ , সমসাময়িক ও অনুজ দেশের প্রায় সকল প্রধান লেখক ।  ওপার বাংলার গুনী লেখকরাও বাদ পড়েন না । আমন্ত্রিত কিংবা স্বত:প্রণোদিত হয়ে লিখেন তাঁর বন্ধু, সহকর্মী, সতীর্থ ও পরিবারের সদস্যরা। এই সব আলোচনায় ব্যক্তি শহীদুল জহির,তাঁর শিক্ষা,পেশা, তাঁর রচনার মান ,বৈচিত্র ,স্বাতন্ত্র – ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

প্রসংগ বদলানোর আগে এর কুড়ি বছর আগের (১৯৮৬) একটা ছবি আবার আমাদের চোখের সামনে দিয়ে গড়িয়ে যায় । ঠিক ছবি নয়,একটা চিঠি। বুলগেরিয়ায় পিএইচডি করতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক অন্তরংগ বন্ধু আবদুর রশিদকে লিখছেন শহীদুল জহির : “তুই থাকতে যে লেখাটা আমি লিখছিলাম সেটা দীর্ঘ দিন পর শেষ করতে পেরেছি । আজকেই একটা পত্রিকায় দিয়ে এলাম পান্ডুলিপি। আসছে ঈদ সংখ্যায় ছাপা হলেও হতে পারে। আর একটি প্রকাশিত লেখা বই আকারে ছাপানো যায় কি না সে-বিষয়ে চেষ্টা করছি। তিনজন প্রকাশকের সংগে যোগাযোগ করেছি । —— তিনজনের ভেতর দুজন কোন কথাই বলে নি। একজন বলেছে ফেব্রæয়ারির পরে যেতে । হয়তো হবে না ,হয়তো কিছু হবে । আমি আশাবাদী। এ দুটো বই উপন্যাস। প্রথমটির নাম আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু এবং দ্বিতীয়টির নাম উড়াল। ” তথ্য ঘেঁটে দেখছি, ‘আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় নিপুণ-এ ১৯৯১ সালের জুনে।  এর ১৮ বছর পর মাওলা ব্রাদার্স বইটি প্রকাশ করেছিলো ২০০৯ -এর ফেব্রুয়ারিতে তাঁর মৃত্যুর পর ; বইটি প্রথম-আলো বর্ষসেরা পুরস্কার পায় ,তাও মরণোত্তর। সমসাময়িককালে ইলিয়াসের পর আমাদের কথাসাহিত্যের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী লেখকের জীবনের এও বুঝি ছিলো এক ‘নিয়তির লিখন’। তাঁর মৃত্যুর পর অন্যত্র এক সাক্ষাৎকারে একজন বর্ষীয়ান কথাসাহিত্যিক আফসোসে ভেঙে পড়েছিলেন : কেন শহীদুল জহিরকে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষকার দেওয়া হলো না । তাঁর আফসোসের একটা সংগত কারণ বোধ করি এটুকু যে এতে তাঁরও কিছু করণীয় ছিলো, কিন্তু তার আগেই পুরষকার প্রাপক বিদায় নিয়েছেন।এই সব ঘটনার তিন কুড়ি বছর আগের আরেকটা ছবি । বনগাঁ থেকে কিছু পথ ট্রেনে চেপে,কিছু ট্রামে আর কিছু রাস্তা পায়ে হেঁটে ধূলিধূসর চপ্পল জোড়ায় ক্লান্ত ঘামে ভেজা এক স্কুল শিক্ষক রোজ কোলকাতার কলেজ স্ট্রীটে এসে ধর্না দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তাঁর উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে বিচিত্রায় প্রকাশ পেয়েছে , কিন্তু কোন  প্রকাশকই বই হিসেবে ছাপতে রাজি হচ্ছে না। লেখককে দেখেই খেঁকিয়ে উঠছে- কি লিখেছেন মশাই , এতে কি কোন গল্প আছে ! সব দেখি অই গৈঁ -গাঁয়ের কথাবার্তা ! পাঠক এ-জিনিস পড়বে কেন ? শেষে ১৯২৯ সালে রঞ্জন প্রকাশনালয় নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা ক্ল্যাসিক বিভ’তিভ’ষণের ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম প্রকাশ করে। আশীর দশকের গোড়ার দিকে এক বিকেলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কে এম দাশ লেনের বাসায় বসে তাঁর প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতাও শুনছিলাম। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুক ও সারল্যে তিনি বর্ণনা করছিলেন কিভাবে তাঁর কজন বন্ধু (আসাদ চৌধুরী, মুহম্মদ মুজাক্কির প্রমুখ) চাঁদা তুলে ‘কল্পিত’ এক প্রকাশনীর নামে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ -‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ প্রকাশ করেছিলো । প্রকাশনীই নেই ,সে-বই বাজারজাত হয় কি করে ? আরো খানিকটা হেসে নিয়ে ‘ওই যে দ্যাখো, আমার বইয়ের স্তূপ’ বলে তিনি আঙুল উঁচিয়ে ড্রয়িংরুমের এক কোণে মুখ-গুঁজে পড়ে-থাকা ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’-এর বান্ডিলগুলি আমাকে দেখালেন।

শহীদুল জহিরের উপন্যাস প্রকাশের অভিজ্ঞতার সাথে এইসব ঘটনার কোন মিলই নেই হয়তো বা, আবার থাকতেও পারে!

২.

চাকুরীজীবনে একজন পেশাদার আমলা হিসেবে তাঁকে সফলই বলা যায়, ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে ক্যাডার সার্ভিসের শিখর তিনি স্পর্শ করেছিলেন । কিন্তু এ-ব্যাপারে লেখক শহীদুল জহিরের নিরুচ্ছাস ও নির্লিপ্তি লক্ষণীয়। বিদেশে গবেষণারত বন্ধুকে ১৯৮৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখছেন : “ তোকে দীর্ঘ করে লেখার আমার প্রচুর ইচ্ছা আছে এবং পর্যাপ্ত সময়ও আছে হাতে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে – একটাই সমস্যা ,কী লিখব তোকে ? আমলা হয়ে একটা ব্যাপার ক্রমে আমার উপলব্ধিতে স্পষ্ট হচ্ছে । এখান থেকে আমরা যখন চারদিকে তাকাই,ঘটনা অবলোকন করি তখন এর ভেতর নিজেকে খুঁজে পাই না । কোনো তাড়না মেটার সঙ্গে দেয়ালের বাইরের জীবনের যোগ আছে সেটা আমাদের তাড়িত করে না। অনেক কিছু হয়তো বুঝি বুদ্ধিমানের মতো,কিন্তু যে বোধ তাড়নার জন্ম দেয় না সে বোধ শুধু নিস্ফলা নয়,সেটা অতি জড়। আমাদের প্রকাশ অনেক কম। বলার কথা থাকে না । যে বলে অনেক,করে না কিছুই, সে প্রতারক। কিন্তু যারা বলে না কিছুই,করেও না কিছু তারা ?” স্পষ্টত যে, ভেতরে ভেতরে তিনি অনবরত নিজেকে প্রশ্ন করে গেছেন- চারদেয়ালের ঘেরটোপের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী থেকেই নিজেকে বাইরের জীবনপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট রেখে আত্মাকে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেছেন ,হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে লেখার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতে চেয়েছেন তাঁর উদ্দীপনা ও উপলব্ধির ধারাভাষ্য। দেশ ও দেশের মানুষকে তিনি বসিয়েছেন হৃদয়ের মর্মমূলে, সেদিন কেউই দেখেনি মানুষের ব্যথায় কাতর নিভৃতচারী এক লেখকের রক্তাক্ত হৃদয়। কিন্তু এক অর্থে এভাবে নিজের ভেতরে তৈরি হয়ে উঠছিলেন লেখক শহীদুল জহির। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তাঁর লেখায় স্থান-পাওয়া অসংখ্য ছিন্নমূল , ছিন্নভিন্ন মানুষের দু:সহ দিনযাপনের ছবি ও ইতিহাসের স্বপ্নভংগের বেদনা যে গভীর মানবিক ব্যঞ্জনায় প্রতিফলিত হয়েছে তা আসলে মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ও আত্মার উৎসারণ মাত্র, যেখানে কোন দেয়ালই বাধা হয়ে ওঠেনি। বন্ধুর কাছে লেখা অই একই চিঠিতে দেশের মানুষের জন্য তাঁর উদ্বেগ ও হাহাকার যে-ভাবে ভাষা পেয়েছে :“এই জনগোষ্ঠীর কী যে অবস্থা দাঁড়াবে সেটা আমার চিন্তায় আসে না । প্রত্যেকটি গতকাল এদের জন্য আজকের তুলনায় ভালোয় দাঁড়াচ্ছে। এভাবে আর কতদিন টিকবে । এদের জন্য দু:খবোধটাও এখন সত্যিকার অর্থে কুমিরের অশ্রুর সংগে তুলনীয় হতে পারে । তবু কেমন যেন খারাপ লাগে আমার। আমার জীবনের বিষাদের কারণসমূহের মধ্যে এটাও একটা। বিশ্বাস করতে পারিস। এই মানুষগুলোকে আমরা বাঁচতে দিচ্ছিনা । ঢাকা শহর ঘরছাড়া,গৃহহারা মেয়েতে ঠাসা। এরা অতি সস্তায় আমাদের শ্রম দেয় এবং একদম বিনে পয়সায় সম্ভোগের জন্য দেহ দেয় । এর মধ্যে ঈদ গেল। ঈদের সময় তৎপর জনগোষ্ঠীকে দেখলে আগে মনে হতো না দেশটা এমন গরীব।” গোটা আশীর দশক জুড়ে প্রশাসনের অভ্যন্তরে থেকে  স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে দেশটার যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই – মৃত্যুর দুয়ারে এসে ধুঁকছে কেবল, তা সঠিকভাবে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। দেশ জুড়ে তখন ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠছে ‘স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন”। প্রত্যক্ষে তাঁর যে কিছু করার নেই সে-কথা সত্য , কিন্তু লেখক হিসেবে তিনি যে সামিল হয়ে আছেন একেবারে সামনের কাতারে তা ৮৭ সনে বন্ধুকে লেখা আরেক চিঠিতে আমরা জানতে পারি: “– দেশের অবস্থা ভালো না। রাজনৈতিক অবস্থাও ভালো না , এর বস্তুগত অবস্থাও খুবই খারাপ। এ মূহুর্তে ভয়াবহ বন্যা চলছে।  আসলে এই জনগোষ্ঠীটা বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে । একটা নিশ্চিত ভয়াবহ ভবিষ্যৎ রয়েছে সামনে যদি মৌলিক পরিবর্তন না হয় এই মূহুর্তে ।’ তবে কি তিনি আগাম দেখতে পেয়েছিলেন – স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন ! ভাগ্যিস সেকালের আড়ি-পাতা বাহিনী একজন উর্ধতন আমলার পিছু নিয়ে তার মনোজগতের পাতালে হানা দেয়ার খোঁজে নামে নি। এখনকার মত ডিজিটাল যুগ হলে কি হতো কে জানে।

এ-সময়টায় অনেকটা সবার অগোচরে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন পরিস্থিতি, ভাবছেন আর লিখছেন। গল্প তো লিখছেনই ফাঁকে ফাঁকে, এ-সময়টায় তিনি রচনা করেছেন উপন্যাস আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু আর তাঁর সবচেয়ে আলোচিত কাজ – “জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা”। প্রয়াত কবি আবিদ আজাদের মালিকানাধীন শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে ১৯৯৪ সালে “জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা” উপন্যাসটি  প্রকাশ পেলেও, আরেক সূত্রে জানতে পারি , বইটি প্রথম ১৯৮৮ সালে তিনি নিজেই খরচা দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন হাক্কানী পাবলিশার্স থেকে। বইয়ের নামটাই ছিল প্রথম চমক !  তাঁর পাঠকপরিধি তখনও ততটা বিস্তৃত নয় – জানাশোনা যাঁরা ছিলেন,তাঁরা কৃশকায় বইটি (টেনেটুনে দু-ফরমার কিছু বেশি) হাতে নিয়ে ভাবলেন – হবে হয়তো কোন প্রবন্ধের বই-টই ! কিন্তু সেই বই পাঠকরা যখন পড়তে শুরু করলেন তাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ; অনন্তর  তাদের সকলের একযোগে মনে পড়লো মুক্তিযুদ্ধে উত্তাল সেই দিনগুলির কথা , মনে পড়লো একদিন যে যুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছিলো তাদের কথা। আরো মনে পড়লো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশেী দোসর দালালদের নৃশংসতার কথা। জহীর লিখছেন: “লক্ষীবাজারের লোকদের মনে পড়ে , একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে । এক থালা মাংস নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা । মহল্লায় তখনো যারা ছিল,তারা বলেছিলো ,বদু মওলানা প্রত্যেক দিন যে মাংসের টুকরোগুলো আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিত ,সেগুলো ছিল মানুষের মাংস। ” তখন লক্ষীবাজার আর একটিমাত্র মহল্লা নয়,তা হয়ে উঠল সেদিনের স্মৃতির আগুনে পোড়া পুরো বাংলাদেশ। সেই কষ্টলব্ধ স্বাধীনতা অর্জনের পরও যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে না। কেননা শত্রুর বিনাশ হয়না -‘গোক’লে’ বাড়ে সে। উপন্যাসের কোথাও ঘূণাক্ষরেও শহীদুল জহির রাজনৈতিক হত্যাকান্ড , মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণে রাজনৈতিক নেতাদের পরবতীকালের ব্যর্থতা – ইত্যাদি প্রসংগ টেনে আনেন না। এইভাবে সেই কৃশকায় উপন্যাসটিকে তিনি আরো দশটা দশাসই চেহারার বাজারকাটতি স্স্তা রাজনৈতিক উপন্যাস হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন। তাঁর সম্বল বলতে লক্ষীবাজারের কিছু বিত্তহীন মানুষ আর তাদের সম্মিলিত স্মৃতি। একক কোন চরিত্র নয়,বলতে গেলে লক্ষীবাজারের অধিবাসীরা একযোগে এ-উপন্যাসের মূল চরিত্র । তবু গল্পের প্রোটাগোনিষ্ট হিসেবে যদি আবদুল মজিদকে ধরা হয় ,তাহলে বলতে হয় মুক্তিযুদ্ধে স্বজন পরিজন হারিয়ে অন্যান্যদের মতো সেও এক ঢাল-তলোয়ারহীন ‘চিলেকোঠার সেপাই’ মাত্র,যার বুকের মধ্যে নিবু নিবু আগুনের সামান্য আঁচে কেবল জ্বলছে ঘৃণাটুকু। ফলে যুদ্ধের দেড় দশক পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুবাদে একাত্তরের ঘাতক দালাল বদু মওলানার মুখে সেই নরম হাসি ফিরে এলে আবদুল মজিদ (ও অন্যান্যদের) মনে হয় – “বদু মওলানা একাত্তর সনের সেই একই রাজনীতির চর্চা করে এবং সে এখনো জানে আবদুল মজিদ এবং তার পরিবার মোমেনার মৃত্যুর পর এখনো তাকে ঘৃণা করে।তার মনে হয় এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় বদু মওলানা এবং তার দল সুবিধে করতে পারলে তারা আবদুল মজিদকে ছেড়ে দেবে না এই ঘৃণার জন্য। তবে আবদুল মজিদ এটাও বুঝতে পারে যে ,বদু মওলানার সে সুযোগ ঘটলে মহল্লার প্রায় সব লোকই আবার তার সেই পুরনো চেহারাটা দেখতে পাবে;কিন্তু এই ভয়ে একটি মহল্লার সব অধিবাসী বাড়িঘর বিক্রি করে পালাতে পারে না । তা সত্বেও আবদুল মজিদ ঠিক করে যে,মহল্লার সব লোকের কী হবে,তা নিয়ে চিন্তা করে তার লাভ হবে না ,সে প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে চায় এবং কোনো সমষ্টিগত প্রচেষ্টার অবর্তমানে সে তা করতে পারে ;এখনই মহল্লা ত্যাগ করে। তার এই চিন্তা এবং সিদ্ধান্তের পরিণতিতে ছিয়াশি সনের সাতই জানুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকে আবদুল মজিদের বাড়ি বিক্রির একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এবং ধরে নেয়া যায় যে,তাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকলে লক্ষীবাজারে তাদের নাম অবলুপ্ত হয়েছে। মহল্লার লোকেরা তাদের এই আচরণে প্রথমে হয়তো বিস্মিত হয়,তবে একসময় তারা হয়তো বুঝতে পারে ,কেন আবদুল মজিদ মহল্লা ছেড়ে চলে যায় ;—— ” এইভাবে গল্পের প্রোটাগনিষ্টকে প্রতিবাদী নায়ক হয়ে উঠার বহুচর্চিত,সস্তা সুযোগ থেকে রেহাই দিয়ে লেখক প্রকৃত সত্যের আরো কাছাকাছি পৌঁছান। কেননা তখন পাঠকের  মনে আপনাতেই প্রশ্ন জাগে: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ কি হলো তবে ? এই প্রশ্নের অবকাশ আরো দৃঢ়ভাবে তৈরি হয় ঠিক তখুনি যখন লেখক এই বাক্যের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি টানেন: “অথবা এমনও হতে পারে যে,আবদুল মজিদের এই সংকটের বিষয়টি মহল্লায় এবং দেশে হয়তো কেউ-ই বুঝতে পারে নাই ।” সেই উপন্যাস প্রকাশের তিন দশক পার হয়ে এসে আজো এ-প্রশ্ন জারী থাকে- আবদুল মজিদদের চাপা ঘৃণা এতদিনেও কি সম্মিলিত ক্রোধে পরিণত হতে পেরেছে ? তবে বদু মওলানারা ঝাড়ে-বংশে যে বেড়েছে এ-কথা একরকম নিশ্চিত করেই বলা যায় ।

একজন লেখক এভাবে অবলীলায় অতীত – বর্তমান -ভবিষ্যৎকে একীভ’ত করে দেখেন আর দেখান এর নির্যাসটুকু , ভবিষ্যতে নিহিত এর সম্ভাব্য সত্যটুকু।

৩.

নিজেকে সব দিক থেকে আলাদা করতে চেয়েছেন শহীদুল জহীর, এবং তা চেয়েছেন সচেতনভাবে । নিজের নাম পরিবর্তন করা থেকে শুরু হয়েছিলো (শহীদুল হক থেকে শহীদুল জহির) এই সচেতন প্রয়াস। উপন্যাসের নাম -‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ কিংবা গল্পের নাম -‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ দেখে পাঠক ভেবেছিল এগুলো বুঝি প্রবন্ধ-নিবন্ধ ! খুব যে ভেবে দিয়েছেন নাম তা বলা যায় না,বরং এর পেছনেও ছিল নিজেকে তাঁর আলাদা করার প্রয়াস। তারপর ভাষারীতি , বাক্যে আ লিক শব্দ এমনকি যতি চিহের ব্যবহার, ব্যক্তির স্থলে সমষ্টিকে চরিত্র হিসেবে দাঁড় করানো ,এক এক একটি রচনায় বিপুল ঘটনা ও চরিত্রের সমাবেশ ও সেগুলোতে ভারসাম্য আনয়নের অসাধারন দক্ষতা, ,জাদুবাস্তবতা প্রয়োগের নিজস্ব কৌশল (যা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা ইলিয়াসের তুলনায় ভিন্ন ধরণের) সর্বোপরি ঘটনা বা আখ্যানের সময়কালের ক্ষেত্রে নিত্যবৃত্ত বর্তমানের ব্যাপক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বলা যায় সমসাময়িককালে (ইলিয়াসের পর) তিনিই সবচেয়ে পৃথক ও ব্যতিক্রমী ঘরাণার কথাশিল্পী । আমার মতে তাঁর অনন্যতার আরো একটা ভিন্ন দিক আছে। আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধ ,যুদ্ধ- পরবর্তী প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্রে রেখে এবং কয়েকজন শক্তিশালী কথাশিল্পীর সযতœ অনুশীলন ও অভিভাবকত্বে যখন জীবনমুখী ও প্রতিবাদী সাহিত্যের একটা পরিচিত ধাঁচ/কাঠামো/ঘরাণা গড়ে উঠেছিলো (যাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম), শহীদুল জহির তাতে খুব নি:শব্দে কিন্তু সচেতনভাবে আঘাত করেছিলেন । এদিক থেকে মাহমুদুল হকের সাহিত্য প্রসংগে তিনি যা বলেছেন তা হুবহু তাঁর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায় বলে আমার ধারণা। প্রয়াত সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন :“মাহমুদুল হক খুবই ভিন্ন ধরণের একজন কথাশিল্পী । তাঁর ভাষা শুধু নয়, দেখার বিষয়টাও আলাদা। মাহমুদুল হক এক অর্থে সাহসী লেখক ছিলেন, কারণ পৃথিবীর এমন একটা সময়ে যখন সাহিত্যের প্রগতিশীল দায়িত্ব পালনের পক্ষে শক্তিশালী অভিমত কার্যকর ছিল, মাহমুদুল হক সাহিত্যকে সাহিত্যের ভিতরে রেখে দিয়েছিলেন ,দায়িত্ব পালন করেন নাই ,জীবন আমার বোনেও একই কাজ করেছেন, মানে কোন লোকপ্রিয় দায়িত্ব পালনের দিকে যান নাই,তাঁর সাহিত্যের প্রসঙ্গ মানুষের মানবিকতা ।” বলা যায় শহীদুল জহিরও সচেতনভাবে এই কাজটিই করতে চেয়েছেন আমাদের সাহিত্যে ।

নিজের শ্রেণীগত অবস্থানকে তিনি সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং এ-ব্যাপারে নিজের পক্ষাবলম্বণের জন্য তাঁর কোন বাড়তি আবেগ কিংবা অনুকম্পা ছিল না । বরং একধরণের স্বভাবগত নৈতিক সততা, আত্মিক শুদ্ধতা ও শ্রেয়োবোধে তাড়িত ছিলেন বলে নিজের বাস্তব অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে গ্লানিবোধ ছিলো তাঁর,ছিলেন কিছুটা বিব্রত এমনকি বিষাদাচ্ছন্নও । নিজের ডায়রির পাতায় দৈনন্দিন দিনযাপনের টুকরো টুকরো ছবিতে ছাপ আছে এসবের । ১৯ এপ্রিল ১৯৮০ সালে লেখা ডায়রির একটি পাতা : “গতকাল এক পশলা হঠাৎ বৃষ্টির পর গরম আবার চড়েছে । গরমে গরীব নাগরিক জীবনের দুর্দশা চরমে উঠে যাচ্ছে। কালকের বৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি অবশ্য এনেছে। এটা ছিল মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি ।  ফসলের জন্য বৃষ্টিটা উপকারী হবে অবশ্য পাটের ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে,কারণ শিল পড়েছে খুব। এটা আশ্চর্যজনক হলেও আশ্চর্যজনক নয় – এই নিছক নাগরিক জীবনযাপন করেও ফসলের ক্ষেতে প্রথম বর্ষার প্রভাব নিয়ে ভাবনা করা । এটা তো কবেই জানা হয়ে গেছে অন্ধকারচ্ছন্ন গ্রামগুলোতে ভালো ফসল হলে মোটামুটি আরামপ্রদ শহরগুলোতে আমরা কিছুটা ভালো থাকতে পারি। গ্রামের মঙ্গলামঙ্গলের ব্যাপারে তাই ভাবনা হয়। গ্রামেই শুধু জাতীয় সম্পদ তৈরি হয় এবং তার ভোগের অধিকার চলে আসে মূলত: শহরবাসীদের কাছে। মধ্যবিত্তের ভোগের পিঠা আয়তনে ছোট ,অনেক ব্যাপারে খুবই ছোট ,তবুও যেটুকু পায় তার জন্যই তার ভাবনা । ভাবতে খারাপ লাগলেও , এটা সত্যি যে, আমিও তেমনি একজন মধ্যবিত্ত। ”

তাঁর ডায়রি পড়তে গিয়ে যে কেউ বিস্মিত হবেন । ২৭ বছরের এক টগবগে তরুণ আমলা ১৩ এপ্রিল ১৯৮০ /৩০ চৈত্র ১৩৮৬ তাঁর ডায়রির পাতায় লিখছেন : “ চৈত্রের শেষ দিনটি চলে যাচ্ছে । কালকে পহেলা বৈশাখ। একটি বছর শেষ হয়ে নতুন একটি বছর শুরু হচ্ছে। ব্যাপারটা বিরাট কিছু মনে করতে ইচ্ছে করলেও জানি ব্যাপারটার তেমন কিছুই বিশেষত্ব নেই অন্তত আমার মতো অগণিত লোকের জীবনে। আজকে রোববার ছিল । সারাটা দিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি । কিছু করার ছিল না ,আর ক্লান্তি লাগছিল । এখন একটা বড়ি খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেই হয়। বছর শেষ হবে এভাবেই,বছরের পর বছর।” এমন একজনের পক্ষেই আবু ইব্রাহীমের মত এমন একটি চরিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিলো । যে চরিত্রটি কিনা পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী ,পেশাক্ষেত্রের সহকর্মী সকলের মধ্যে থেকেও ‘নিজেরই মূদ্রাদোষে’ ছিল যেন পৃথক,বহিরাগত,আগন্তক বা আউটসাইডার ।

৪.

শহীদুল জহিরের যাবতীয় সৃষ্টি, স্মৃতি ও রচনাকর্মের মূল্যায়ন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই পাঠক সমাবেশ কর্তৃক প্রকাশিত – ‘শহীদুল জহির সমগ্র’। নি:সন্দেহে এটি একটি দুর্লভ সংকলন, শহীদুল জহিরের উপর একটি আকর গ্রন্থ। এতে তাঁর প্রতিটি উপন্যাস , এমনকি প্রায় প্রতিটি গল্প ধরে ধরে আলোচনা করা হয়েছে – এইসব রচনার ভেতর-বাহির নিয়ে রীতিমত চুলচেরা আলোচনা করেছেন ষাটের দশক থেকে শুরু করে শূন্য দশকের -এমনকি বর্তমান পযন্ত দেশের প্রসিদ্ধ ও সুবিজ্ঞ সব কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক। পাশের দেশের দেবেশ রায় , অভিজিৎ সেন, কিন্নর রায় প্রমুখও আছেন লেখক তালিকায়। বরং প্রশ্ন করা যায় -কে লিখেন নি শহীদুল জহিরের উপর দু’কলম? সমকালের কয়েকজন লেখক ও সম্পাদকের সাথে কয়েকটি দীর্ঘ ও বিস্তারিত সাক্ষাৎকারে শহীদুল জহির নিজের সাহিত্য বোধ, লেখার কৌশল, ভাষারীতি, লেখায় জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ, অগ্রজ , সমসাময়িক ,অনুজ লেখক এবং বিশ্বসাহিত্যের লেখকদের সম্পর্কে তাঁর মতামত খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং , তাঁর রচনা সম্পর্কে আপাতত কিছু বলার নেই বলে আমার ধারণা ; তাতে পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাই বেশি। তবে তাঁর রচনার কোন কোন দিক বেছে নিয়ে যেমন- ভাষারীতি, জাদু বাস্তবতার প্রয়োগ, মানবিকতা, অন্য শিল্পীদের সাথে তাঁর রচনার মিল-অমিল বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর অবদান ইত্যাদি নিয়ে বিদ্যায়তনিক পরিসরে গবেষণা হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই বাংলা সাহিত্যের উচ্চতর পাঠক্রমে শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্য অন্তর্ভূক্ত হয়েছে কি না। সে যাই হোক না কেন ,আমরা বরং ইত্যবসরে সুহাসিনী গ্রামটি ঘুরে আসতে পারি। গ্রামটিকে ঘুরে ফিরে দেখি। মফিজউদ্দিন, মোল্লা নাসিরউদ্দিন, দুলালির কবরের কাছে একদন্ড দাঁড়াই। আমাদের তখন দেখা হতে পারে তোরাপ আলীর সাথে ; হয়তো তোরাপ বিড়বিড় করবে: “চাঁদের আলো যহন ফেরেশতারা পিরথিবীতে ঢাইল্যা দেয়, তহন বিরিক্ষ আর পশুপাখির পরাণ নিঝঝুম হয়্যা আসে, তহন চাঁদের রাজত্বে যে যায় , সে কইতে পারে না ,সে জাইগা না ঘুমায়া আছে, সে য্যান খালি এক নেশার ভিতর দিয়্যা হাঁইট্যা যায় । ” ( সে রাতে পূণিমা ছিল)। চন্দ্রাহত তোরাপ আলীর কাছে আমরা শুনবো সুহাসিনী গাঁয়ে পুর্ণিমা রাতের সেই রোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা। সেই গল্প শুনতে শুনতে গ্রামের বাড়িঘর এবং গাছপালার ওপর অঝোর ধারায় জ্যেৎস্না ঝরে পড়বে আর তারপর “গ্রামের মাথার ওপর দিয়ে ,নরম এবং স্মিতমুখী এক বালিকার ভরা মুখের মতো” গড়িয়ে নামবে চাঁদ।

সেই গল্প হারাবেনা, দিনের আলোর তিমিরে লুকোবে শুধু, কিন্তু আবার ঠিক ফিরে আসবে রাতের জোছনায়। সুহাসিনী গ্রামের জোছনা মাখা গল্প বেঁচে থাকবে চিরকাল।

[ কৃতজ্ঞতা : শহীদুল জহির সমগ্র – পাঠক সমাবেশ ]