You are currently viewing লোনা পানির পিশভিটা || লুৎফর রহমান মন্ডল

লোনা পানির পিশভিটা || লুৎফর রহমান মন্ডল

লোনা পানির পিশভিটা

লুৎফর রহমান মন্ডল

শীতের দিনেও বর্ষা-বাদল দরদর করে নামে, প্রকৃতির সময় জ্ঞান বিমূর্ত হলে যা হয় আরকি! স্বাদু পানির পুকুরে লোনা পানির মাছ বাঁচে, মরুভূমিতে প্রাণ মিলছে সবুজে, নীল সমুদ্র তেল কলিজায় ছইছই করে। শত স্মারকের ধারক ভিন্ন। মাসুমার একটা টইটুৃম্বুর স্মারক তার স্বামী। ছয় ঋতুর বারো মাসে তেরোবার রংবদল হয়- হয়না শুধু বকর। মাসুমার রিক্সা-ভ্যান চালক স্বামী বক্কর। শ্যামনগরের গাবুরা থেকে আইলার তোড়ে শহরে ভেসে আসা বক্কর।
হিংসুটেরা নাক সিটকায়-
‘উহ-ঢং, মরদ মনে লয় আর কারও নাই। সাজ নাই-বিয়ান নাই, খালি কচলাকচলি। জ্বালায় ঘেন্না অয়। মুখকথা বাতাস মাখায় বিশ্রীতে।
‘খুন দরজায় কড়া নাড়ছে ঘ্রাণ
জাত নেড়ি কুকুরের নাক
গন্ধ খুজে দূর্গন্ধ উদ্ধার করে।’
মানুষও ঘেউ ঘেউ করে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। সুখ বা তৃপ্তি বুঝলে বা দেখলে।
মাসুমার নাকেও গন্ধ আসে-চ্যাপা সুটকির আষটে গন্ধ। এমন গন্ধ গাবুবার মাঝিপাড়ার শুটকি পট্টিতে আসে। তাহলে এমন চকচকে, ফিনফিনে শহরের আলিসানে গন্ধ আসে কোথা থেকে? চোখ বৃত্তাকারে ঘোরে নাকের ডগায়। কিন্তুু বক্কর তো এমন বাজার সদাই গত দুই সপ্তাহে করেছে বলে তার মনে হয় না। তাহলে এমন ছ্যানছ্যানা গন্ধ আসছে কোথা থেকে। চোখে ঠিকভাবে দেখতে পায় না সে। ছানির প্রলেপ বাড়ছে ঘন হয়ে। ঘরের উঠোনে বা দরজায় খট করে উঠলো বোধ হয়। ছোট পাতলা কিছু হাত থেকে পড়ে গেলে যেমন টুং করে শব্দ হয় সেরকম একটা শব্দ । সে স্থির করতে পারে না।
শুধু শুন্যে ভাসা আওয়াজ ছাড়ে-কেটায়, হুস, হুস’।
মাসুমার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর আগে। হোগলা পাতায় মোড়ানো ঘর, মেদমাটির পিড়ালি, সূর্যপোড়া কাইম শক্ত চিবুক উঠোন। পিড়ালি সনছে জুড়ে জুই, গন্ধরাজ জোড়া কতোক আর দোর উঠোনে হাসনেহেনার কয়েকটা পুষ্পটিত ষোড়শী ডানা। কলার গুড়ির সাজানো গেট, উঠোনের বুকে লম্বা বাশ ঠাঙিয়ে সেখান থেকে পুরো বাড়ি দড়ি আর লাল, নীল কাগজে মনের সাজ। পশুর থেকে হালকা মেজাজের হাওয়া আসে-দড়িতে সাঁটানো কাগজ ফুল দোল খায়-মাইকে বাজানো বিয়ে গানে গাবুরা ভাসে।
পুরো আয়োজনে কনে বাপের সামর্থ্যসীমায় ঘাটতি নেই। মা মরা বেটির বিয়ে সর্বোচ্চ সক্ষমতায় আয়োজন করে তাবের। ছেলে দক্ষিণ কাশদহের বক্কর। সামাজিক সমতার স্লাব মেপে বিয়ে। ছেলে গায়েগতরে জোয়ান। শক্তপুষ্ঠ দেহ-শীল বিলেতি আলুর মতো ফুলে উঠা মাংসপেশি। পশুরে টানা জালে মাছ ধরে। নৌকাও আছে একটা। বিয়ে ধুমধাম করেই হয়।
বিয়ের বছর আট না পেরুতেই শরীর ধরে বসে মাসুমাকে। চোখে সমস্যা, মেরুদন্ড ঠিকভাবে সোজা করতে পারে না। হাত পায়ে লবনের ঘা। ঘা তবু সারে-জরায়ু! সদ্য পচিশ পেরুনো মাসুমার জরায়ুটি কেটে ফেলতে হয়েছে। লবণ ঘুণ শরীর খেয়ে ফেলছে। ঘা-জরায়ুহীন এমন অকার্যকর স্ত্রীকে অনেকে বলেছে ছেড়ে দিতে। বক্কর তাতে কান দেয় কখনো। গাবুরার অনেক নারীর স্বামী থাকতেও নাই। কেউ কেউ ঘর করছে নতুন বউ নিয়ে। অনেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছে সমুদ্র ছুয়ে যাওয়া হাওয়ার মতো।
এই জনস্তরের নিম্নতম স্লাবেব কেউ কেউ কবিতা লিখে। ছোট গেওছা টং দোকান তার সাঁটারে আটাঁ দিয়ে সাঁটান। লাল, সবুজ কমবিনেশনের কালি দিয়ে চারুকার্যময় লেখনি।

‘নির্জনতা’
-কবি চা দোকানি গোলজার

আকাশ-বাতাস সবই আছে
যম এখানে পানি।
জীবন কাটে হাঁসফাসিয়ে
শরীর টানছে সময়ের ঘানি।
নারীর যোনী খাচ্ছে পানি
জীবণে ধরছে ঘুণ-
পশুর মতো যাচ্ছে জীবন
আলো কতদূর?
মাসুমার এই নগর শহরে ঘুম আসে না-ছানি পড়া চোখে এমনিতেই ঘুম কম থাকে। একাকীত্বের অন্ধকার ঘরকোণা মনে হয় সবকিছু। তারপরও লেদপেদা জনবস্তি। কাউকাউ, হাউমাউ, গ্যাজমেজ লেগেই আছে। মাসুমার কানে পশুর নদীর ঢেউয়ের শব্দ আসে। কেউ খিস্তিখেউড় করলে সে মনে করে পশুর নদীর জলধাক্কা তার পাতার ঘরের সহজ পিড়ালিতে আচড়ে পড়ছে। সে গোপনে নীরবে কান্দে- আহারে পশুর তোর সহজের উপর এতো ঘাই। কানের পাশ দিয়ে থাকা জনবস্তির চোরাবালির মানবমুখধুলো এঁটো হয়। বাশি, পচাঁ হয়ে ময়লার ড্রেনে জড়ো হয়ে থাকে- কখনো মহানগরের সুচিমানবের ধাক্কায় গতি পায়। কখনো ঘুমের মাঝে ফেলে আসা গাবুরার টেরা মইজ্জয়ার ছায়া কিলবিলিয়ে ঘেন্না পোকার মতো আসে। হোগলা পাতার দরজা ঠেলে আসে সে। গাবুরায় খুব জ¦ালিয়েছে ঘিনে মানুষ পোকা মইজ্জা। চোখ টেরার কারণে সবাই এলাকায় তাকে টেরা মইজ্জা বলে ডাকে। লুঙ্গি, হাতা কাটা সাদা গেঞ্জি আর হাতে থাকা বিড়ি তার দিনরাতের সঙ্গী। পশুর নদী পাড়ের গাবুরার পশু সে। নারী কেলেংকারীর শেষ নেই তার। শরীরজুড়ে গণপিটানির চিহ্ন। তারপরও এলাকায় তার দাপট বাড়ছে। শহরে মানুষের চিংড়ি ঘের, কাকড়া চাষ, লবণ মাঠ-আর এসবের দালালিতে মইজ্জা বাড়ছে-প্রবল ভাবে প্রকট আকারে বাড়ছে। সাথে বাড়ছে তার নারীতৃ া। সম্পদ আর সম্পদহীনতার সাথে নারীসম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে মাখামাখি- এই দুয়ের কমতি বা বাড়তি নারীবৃত্তিক জৈবিক খায়েশীয় মনোবাসনা জ্যামিতিক হারের সাথে মিলে যায়।

-‘ঘেরে কাম করবানি মাসু? দিন গুণনে মাইনে পাবি ছেমরি।’

একদিন ঘোর সন্ধ্যায় হোগলা পাতার বাড়িতে ঢুকে মইজ্জা প্রস্তাব দেয় মাসুমাকে। তখন মাসুমা সদ্য বিবাহিত। মোটামুটি গ্রামীন প্রাগৈতিহাসিক একটা সৌষ্টব তার। কিছু বোঝার আগেই মইজ্জা হামলে পড়ে মাসুর উপর। জোর করে মাটিতে শোয়াতে চায় মইজ্জা। মাসু দিকশুন্য হয়ে চিৎকার শুরু করলে টেরা মইজ্জা দ্রুত বাড়ি ত্যাগ করে। টেরা মইজ্জা তখন থেকে মাসুর কাছে এক আতঙ্কের নাম। সে ভাবে-শহরের এই ময়লার ভাগাড়ে আবার কোন টেরা মইজ্জা নাই তো। এখন আগের মতো সৌষ্টব নেই, নারী যোগীর পথটিও কাটা পড়েছে লোনা জলের মরিচা পড়ায়, পায়ের রানে দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি, হাত-মুখে ছোট ছোট ঘা আরও বাড়ছে বস্তির ময়লা যাপিত জীবনে। তাও তার ভয় হয়। নারীশরীর আপণা মাংসে হরিণা বৈরী। যদি কোন মইজ্জার চোখ পড়ে তার উপর। যদি হামলে পড়ে মৃত কামঘরে- আরও কায়দা নিয়ে। এমন ভাবনা থেকে সে বের হতে চায়। তার অমিমাংসিত চিন্তায় পশুর নদীর জলভৈরভী হুহু হাওয়ায় জোরে আচড়ে পড়ে। সে বোঝে সেই ছায়াটা আর নেই।

বক্করের ডাক আসে-
‘মাছু, নিদ গেছিস তুই, হুড়কোটা তো দিবিনি ঠেসে। নতুন শহর, এটা গাবুরা না, বুজলি। একটু কিরাম থাকিস তুই। সাবধানি থাকতি হবে রে মাছু।’

সাবধানের মাইর নাই। চোখের ছানি-শরীর তো খোলা। জরায়ুহীন শরীরেও ভয়। মাসুমা ভাবে-সে ভয় পাবে কেন? জল সাগরে ডুব সাতরে খেলা মাছ তার কীসের জলদানবের ভয়। সাগরবিরানে কমতি কী ছিল? শুধু পেটটা বাচাঁয় রাখতে এতোদূর। মাসুমা ভাবে না খেয়ে এর চাইতে গাবুরা বেশ। জল হেসেলে সকাল সন্ধ্যা জালের টান। কারি ভর্তি মাছ। টুনকা, কেরাল, চিংড়ি। মাছ বিনিময়ে চাল- মাছের ওজনে চাল। মাছ কিনবে কে এখানে। অথচ সেই মাছ শহরে বাজারে হাতের বাইরে। ছয় মাস হলো খুলনায় আসছে মাসু তাও একবারের জন্য সেই মাছ কেনার সাহস হয়নি। একবার সাহস করে মাছ দোকানীর কাছে গিয়েছিল।
এবা করে কী দেখ-কেনবার পারবা? পয়সা আছে নি এ্যা!
মাসু আর আগায়নি। ছানি ঝাপসা চোখ মাছ দেখার সাহস করেনি।
শহরে ঢোকার মুখে বাঘ, চিংড়ির রং কংক্রিট। সেখানে শহর যাত্রী, বাহন চক্কর দেয়। আশপাশে গৌরভবনগুলো আকাশ ছুঁতে চায়। মানুষের স্্েরাতে গিজগিজ করা ঢেউয়ে মানুষ ভাসে। পশুরের মাঝনদীতেও ঢেউ খেলা পানি পাক খায়। সমুদ্রমুখী পানির ধারা ঘুরতে ঘুরতে দুবলার চরমুখী হয়। ক্ষুদ্র নদীর জলধারা ভীষণ ক্ষ্যাপাটে-বর্ষাবাদলে সর্বগ্রাসী। অথচ সেই জলই সমুদ্রে নীল জোসনার ছটা, শান্ত, স্থির। বছরে মাঝে সাঝে বিকট আকার ধারণ করে। দিন রাত মানুষ ছোটে উপকূলীয় এলাকায়। মাইকিং, টিভি, টিনের মুড়ির এলান। সবাইকে ঘর ছেড়ে যেতে হবে। সমুদ্র উত্তাল, সব দুমড়ে মুছড়ে নিয়ে যাবে। মানুষ উড়ে নিয়ে যাবে।
মাসুমার মনে পড়ে কিছুটা। তখন ছোট। সমুদ্র, নদী, কিছুই তেমন বোঝে না। মহাবিপদসংকেত তখনই তার কানে প্রথম আসে। বাপ মায়ের হাত ধরে কিলোপাঁচেক দূরের এক শেল্টার সেন্টারে ঠাঁই নেয় তারা। মানুষ আর মানুষ, নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, শিশু-বৃদ্ধা, গরু-ছাগল, হাস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল একসাথে পাশাপাশি। গরু-মানুষের গুয়ে মুতে দুইটি মৃত্যুসমরাত পার হয়। দিনের বেলায় তারা যখন গ্রামের পথে হাটা ধরে ঠিকভাবে রাস্তা বের করতে পারে না। চেনা রাস্তাগুলো বিকৃত চেহারার হয়ে গেছে। গাছ-বাড়ি কোনঠিই আর ঠিক জায়গায় নেই। অনেকে বিপদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাড়িতেই অবস্থান করেছিল তাদের অনেকের খোঁজ নেই। পথের দু’ধারে মৃত মানুষের বিকৃত চেহারা-কোনভাবেই কাউকে চেনা যায় না। অনতিদূরে শুকনো একটা কী যেন নিয়ে ঠানাহেচড়া করছে-মানুষ না জন্তু-জনোয়ার বোঝা যাচ্ছে না। লাশের প্রতিও কারও তেমন মনোযোগ নেই। মাসুমারাও ছুটছে তাদের ভিটের খোঁজে। গাছের আগায় মানুষের লাশ, জমির ক্ষেতে লাশ। শুধু মানুষ নয়, পশু- পাখির লাশও মানুষের সাথে ।
দত্তবাড়ি বস্তি থেকে মুজগুন্নিপাড়া। শিকড়বিহীন বৃক্ষকে খুব সহজেই বাতাস নাড়াতে পারে। প্রকৃতিও মানুষের উপর করাত চাপায়। শিকড়হীনদের শাখের করাতে চাপায়। শহরে বস্তি ময়লার ভাগাড়। মানুষ সেখানে ছুঁড়ে ফেলা ময়লার মতোই। পানি নেই, ড্রেনেজ নেই, ঘর নেই, আলো নেই, অল্পতেই লবণ পানি বিছানায় উঠে। এ যেন আরেক গাবুরা, এ যেন আরেক পশুর। এরপর খালপট্টি হয়ে জামাল রাইস বস্তিতে ঠাঁই নিয়েছে তারা। বক্কর ভ্যান চালায়। বস্তির খোসায় বসে দিন বাড়ে তাদের।
গাবুরায় তাদের দিন ভালই কাটছিল। উনমানুষের দিন গেরস্থি যেভাবে কাটে। টানাটানি আর হা-হুতাশে। তাও ভালো বেশ ব্যস্ততাতে দিন রাত পার হতো। বাড়ির উঠোনের কোণে মরামাড্ডা একটা দেশি গাই- বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া সাদা ভেড়া। পশুর থেকে টানা জাল দিয়ে ধরে আনা মাছ। মবের তাফালিং মাছ ওজনে চাল দিত। দু‘পাল্লার একপাশে মাছ আরেকপাশে চাল। একদিন মাছ মারলে মোটামুটি দু’তিন দিনের হাড়ির চালের গতি হতো। আশপাশ থাকা নানান জাতের লতা পাতা হতো মাছের মিশেল। পেটে ভাতে চলতো বেশ। এখানকার জীবন জীবিকা পানি ভিত্তিক। বাঁধ ভাঙলে লোনা পানিতে চারদিক ছয়লাভ। চিংড়ি , কাকড়া চাষের জন্য স্থানীয় লেদপেদা লোকগুলো কোনকিছুর তোয়াক্কা করে না। তারা দেদারচ্ছে লোনা পানি ঢোকায় ঘের গুলোতে। সেই পানি আশপাশ ছড়িয়ে পড়ে। গাই আর ভেড়ার জন্য ঘাস জোগাড় করাও দুরুহ হয়ে পড়ে। কোথাও ঘাস, লতা-পাতা হয় না। লোনাপানিতে সব মরে যায়। পুরো গাবুরার একটি মাত্র পুকুর। সেখানেও লোনাপানি ঢুকে পড়েছে। খাবার জল আনতে তিন কিলোদুরে মেওতায় যেতে হয়। পুরো গ্রামের নারী-পুরুষ আর গবাদিপশুর এই পুকুরেই সাফসুতরো সারে।
কেউ পশুমানুষে একসাথে গোসলের ক্ষতির কথা বললে তারা খেয়াল অন্য দিকে নিয়ে যায়-
‘কী আর হবানি। কোন উপায় আছে নি এ্যা।’
কপাল ভাজের রেখা স্পষ্ট আকারে উঠে আসে। ফুলে উঠা রক্তরগ আশপাশের ঘাম নিয়ে রোদের কিরণে চিকচিক করে। সমগ্র উৎকণ্ঠা একবাক্যে ¤্রয়িমান হয়ে যায়-
‘আর ক্ষ্যাতি! ক্যা বা আছে আর। ক্ষ্যাতির ভ্যাতরেই তো আছি, ক্যাবা করে কম হয় সেটাই ভাবি।’
গাবুরার বেশিরভাগ মানুষই নানান পানিক্রিয়া সমস্যায় আক্রান্ত। খোশপাচড়া ঘরের কুটুম। নিদেন কুটুম এমন ভারী ঘরছাড়া হয় না। মেয়েলোকের জম হয়ে বাড়ছে লোনা পানির রোগ। কুড়ির ঘরও পার করতে পারছে না কেউ কেউ। ছোটখাটো চুলকানি দিয়ে শুরু। আমাশায়, ডায়রিয়া, রক্তস্বল্পতা, পুষ্টিহীনতা, সাদা স্রাব, লিউকোরিয়া কী নেই এখানে!
পৃথিবীর সব শূণ্যতা এখানে-অন্ধকারও সাথে। মেওতার গফুর বউরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। সকাল সন্ধ্যা কুরুক্ষেত্র তার বাড়িতে। নালিশ বসায় বউয়ের বাড়ির লোকজন-গফুরের এক আলাপ- ঘাউয়া বউরে নিয়ে সংসার করবে না সে। পেট, কোমর নাভিতে ঘা সারে না স্ত্রী হালিমার। কাপড় খুললে ঘেন্না হয় তার। শেষ পর্যন্ত আর ঘরই হলো না তাদের। এই সমস্যা আরো বাড়ছে। মইশবাড়ির আইজল, নৃপেন- চরিতাবাড়ীর কদম, ফরাস ওরাও একইভাবে একই কায়দায় বউ আলাদা করেছে। পুরান বউ যাওয়ার মাস না কাটতেই বিয়েও করেছে অনেকে। তাদের বিয়ে সাগরে করাত মাছের মুখে স্বাদু পানির চকচকা চাঁদনী মাছের মতো।
মানুষ নাক সিটকায়। ছোট খাটো জমায়েতে খই ফুটায় ঘরোয়া বিপ্লবের।
-‘পশু শালা সব-বউ নাই কী কারো এমন এ্যা-অসুখ ব্যামোয় কাইত হইলেই কী বউ ভাগানি অয়। মালেকে রাসুল -এগো ঘা পয়জন হবা নি গো। মায়-বোন তো প্রত্যেক ঘরে। ’
সমবেত মাথা ঝুলানো বাড়ে। বক্তা একটা ছোটখাটো সাবাস পায়।
মাসুমা এজন্য নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে। তামান কিছু সাগর জলে ভাসুক। স্বামীটা তো আছে। গভীর খুঁটির গেরো-জল বাইস্যায় ভাসপার ভয় নাই।
জামাল রাইস বস্তিতে ভালোই কাটে সময় তাদের। ভাত পানির তেমন কষ্ট নাই। মোড়ের ট্যাপ চাপলেই পরিস্কার পানি-হলহলিয়ে পড়ে। হীরার ঠিকরে পড়া আলোর মতো চকচকে পানি। মাসুমা বারবার সেই পানি ছোয়। আজলা করে নিয়ে আকাশপানে চোখ তুলে মুখে ঢালে সে।
-ও খোদা গে-া তোমার দুইনায় এতো ফারাক। গাবুরায় তুমি আছো ক্যাবা-আর এডানতে ক্যাবা।’
চোখের সামনে দিয়ে হাটাচলা করা নারীদের দেখে সে। জামাল রাইস বস্তিতে এক সোন্দরী স্বাথ্য আপা আসলে তাকেও অবাক হয়ে দেখে সে। ভয়ে ভয়ে জানতে চায়-
-আপামণি-জরায়ু না থাকলে নারীর কী থাকে গো।
টুপটুপ জলে চোখ ভেজে তার গাবুরার কথা ভেবে । চোখ খুললেই পানির আধার তাও গলা ভিজার পানি নাই। সোনার মতো খাওয়ার পানি। অথচ কালপুরাণে পানির তোপেই ভেসে যায় তাদের সবকিছু। গাবুরার মানুষ যদি এরকম টেপ কল পেতো। বাড়িতে না হোক গ্রাম জুড়ে থাকতো একটা-তাহলে তার ঘা পাচড়া হতো না, গরু গোয়ালের মতো জীবন থাকতো না, শত নারীকে তার মতো জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া লাগতো না। এমন শত বিমূর্ত ভাবনার দোলখাওয়া নোঙরহীন নৌকা দূর্গম চিন্তার নদীতে ভাসে- ধাক্কা খায়-পথহীন হয়ে পড়ে ।

—————————————