You are currently viewing লোকটি সত্যি অদ্ভুত ছিল || মনিজা রহমান

লোকটি সত্যি অদ্ভুত ছিল || মনিজা রহমান

লোকটি সত্যি অদ্ভুত ছিল

মনিজা রহমান

-ওই দিন ঝড়ের রাইতে আপনার কাছে একজন লোক আইছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প একরাত্রি’র নামটা তৎক্ষনাৎ টিক করে উঠল মাথার মধ্যে।
ঝড় ও জলের রাতের সেই সুরবালার মতো মনে হল নিজেকে। অথচ কি আশ্চর্য্য লোকটা যখন আসল, আমি তখন বাসায় ছিলাম না। হাওয়া বদল করতে গিয়েছিলাম রোড আইল্যান্ডের উপকূলবর্তী শহর নিউপোর্টে।
রোড আইল্যান্ড থেকে ফেরার পরে বাসার চাবি চাইতে গেলে পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ প্রতিবেশী রীতিমত চমকে দিয়ে খবরটা জানালেন। আগের রাতের ঝড়ের তীব্রতা আর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনার জন্য তখন মনে মনে আগ্রহী ছিলাম। অনেকে বলাবলি করছিল, নিউইয়র্ক শহরের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ দুরযোগ কখনও দেখা যায়নি! পরিচিত অনেককে দেখলাম নিজেদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে জানিয়েছে। কারো রাস্তায় গাড়ি অচল হয়ে গেছে, কারো কারো বাসায় পানি ঢুকে গেছে, ইস্ট এলমহারস্টের এক বাড়ির বেসমেন্টে পানিতে আটকে সলিল সমাধির ঘটনাও ঘটেছে।
ইস্ট এলমহারস্টের এত কাছে থেকেও এস্টোরিয়া এলাকাবাসী সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়াকে- ঈশ্বরের আশির্বাদ হিসেবে ভাবছিলাম। এমন সময় বৃদ্ধ প্রতিবেশী, যাকে আমরা ‘মুকুলের বাবা’ ডাকি, আচমকা বলে বসলেন ঝড়ের রাতের আগন্তুকের কথা।
-আমার কাছে এতো রাতে কে আসবে? ঝড়ের পরে এসেছিল?
– না না, ঝড় শুরু হবার কিছুক্ষণ আগে।
– ঝড় শুরুর আগে হলে তো আশ্রয় নিতে এসেছিল বলে মনে হয় না! আপনি কি ওনার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
– নাম জিগাইছিলাম। কিন্তু কিছু তো কইল না। শুধু কইল, আপনি ওনাকে ভালো ভাবেই চেনেন। আরেকদিন আসবেন কইছেন। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কইল, কুমিল্লার শাহরাস্তিতে।
গ্রামের আলপথ থেকে উঠে আসা মানুষ মুকুলের বাবা। গরমকালে লুঙি কোচা মেরে, খালি গায়ে গামছা পরে ঘুরে বেড়ান বাড়ির সামনে লনে। ওনার পক্ষে অপরিচিত কাউকে পেলে প্রথমেই বাংলাদেশের কোন জেলায় বাড়ি সেটাই জানতে চাওয়ার কথা!
‘শাহরাস্তি’ ‘কুমিল্লা’… কই সেখানকার কাউকে তো চিনিনা! মনের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে হঠাৎ করে আব্বার কথা মনে পড়ল। আব্বা পাড়া প্রতিবেশীদের কাউকে কাউকে তার এলাকার নাম ধরে ডাকতেন। প্রতিবেশী গণি মিয়া চাচাকে যেমন ডাকতেন ‘সুরেশ্বর’ বলে। গণি মিয়া চাচা ছিলেন সুরেশ্বর পীরের মুরিদ। আমাদের বাসায় এলে নেচে গেয়ে শোনাতেন-
‘সুরেশ্বরের ভাইরা কয়
নাইচা গাইয়া করমু জিকির
যেমনে খোদা রাজী হয়।’

দুই দিন পরে রাস্তার ওপাশে আবদুল লতিফকে দেখে বিদ্যুৎ চমকের মতো বুঝে গেলাম-ওইদিন ঝড়ের রাতে কে এসেছিল বাসায়!

চেরি ভ্যালি থেকে গ্রোসারি করে মাত্র বের হয়েছি। রাস্তার এপাশ থেকে দেখছিলাম- আবদুল লতিফ হন্তদন্ত হয়ে কোথাও যাচ্ছেন। সব সময় ওনার মধ্যে কিসের যেন তাড়া থাকে। চোখের দৃষ্টি থেকে পুরো অবয়বে এক ধরনের খ্যাপাটে ভাব। ঝড়ের রাতে আসার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা শুধু উনিই ঘটাতে পারেন।

আগেও তিনি একদিন দুপুর বেলা হঠাৎ করে আমার বাসায় এসে হাজির হন। উনি আমাকে কিছু বলতে চান! কিন্তু, মনে মনে গুছিয়ে উঠতে পারছেন না কিভাবে বলবেন! ওইদিন দুপুরে বাসায় বেশ কয়েকজন মেহমান থাকাতে আলাদা করে ওনার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। নানা রকম খাবারের পদ দিয়েছিলাম সামনে। কিন্তু উনি জানালেন, দুপুরের খাবারের পর্ব শেষ করেই এখানে এসেছেন।

ওই দিন ঘুরে ফিরে বলছিলেন মেয়ের কথা। ডাক্তার মেয়ে কিভাবে বাবাকে স্পন্সর করে এই দেশে এনেছে, কত যত্ন করে, খেয়াল রাখে বাবার…ইত্যাদি ইত্যাদি! কর্মজীবি হওয়ার পরে কিভাবে এত পদ রান্না করি সেটা খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চাইছিলেন আমার কাছে। ডাক্তার মেয়েকে ঘরে বাইরে কাজ সামাল দিতে খুব হিমশিম খেতে হয় বললেন বার বার।

-চাচা কোথায় চললেন?
দ্রুত রাস্তা পার হয়ে আবদুল লতিফকে পাকড়াও করলাম। বরাবরের মতো একটা ঘোরের মধ্যে চলছেন তিনি। তার তাকানো দেখে মনে হল শুরুতে তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না।
• নাতনিকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি।

• আচ্ছা আঙ্কেল, আপনি কি দুই দিন আগে ঝড়ের রাতে আমার বাসায় এসেছিলেন?

আবদুল লতিফ কিছু না বলে থেমে গেলেন। ওনাকে কিছুটা লজ্জ্বিত মনে হল।

• আমার কন্যার ওই দিন জন্মদিন ছিল। এস্টোরিয়ার থার্টি ফাইভ এভিনিউতে আলাউদ্দীন নামে একটা রেস্টুরেন্ট আছে না, ওখানে সবাই মিলে খেতে গিয়েছিলাম। বাসায় ফেরার সময় ভাবলাম আপনাকে মেয়ের জন্মদিনের কেক দিয়ে যাই। পরে এভাবে ঝড় বৃষ্টি শুরু হবে বুঝতে পারি নাই।

• আহা! বাসায় না থাকায় আপনার মেয়ের জন্মদিনের কেক খাওয়া হল না!

• জি আমার কন্যাও বারবার বলছিল আপনার কথা। ওইদিন আপনার বাসার মেহমানদারীর কথা ওকে বলেছি।

হাঁটতে হাঁটতে কথা বলার কারণে হাফাতে লাগলেন আব্দুল লতিফ। মধ্যবয়সী মানুষটির কথাবার্তা ঠিক স্বাভাবিক নয়। হয়ত এক সময় নিয়মিত সাহিত্য পাঠ করতেন, কথাবার্তায় সেটা প্রয়োগের চেষ্টা থাকে। যেমন হঠাৎ করে বলতে আরম্ভ করলেন-
–জানেন, ,মা জননী, পৃথিবীর সবকিছু চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এই যে জীবন দেখছেন, এটাও একটি চক্র। শিশু ছিলাম, তারপর বড় হলাম, বিয়ে করে সন্তানাদি হল। তাদের বিয়ে হল। আবার তাদের সন্তানাদি হল। এই যে আমাকে ছুটতে দেখছেন, সেটা নাতনির জন্য। ওর কয়েক মিনিটের মধ্যে স্কুল ছুটি হবে। আমাকে ওকে স্কুল থেকে বাসায় আনতে হবে।

আমরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেলাম। আমি থামলাম লাল বাতি জ্বলে ওঠায়। আবদুল লতিফ আড়াআড়িভাবে রাস্তা পার হলেন নাতনির স্কুলের উদ্দেশ্যে।

চলমান আবদুল লতিফের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কি যেন বলতে চান তিনি, কিন্তু ছিড়ে কুটি কুটি হয়ে যাওয়া কাগজে মতো ঘটনাগুলোকে এখনও যেন জোড়া লাগাতে পারছেন না।

পাওয়ার দেয়া সানগ্লাসের ভিতর দিয়ে চারপাশে রঙীন প্রকৃতির দিকে তাকালাম। মধ্য দুপুরে হেমন্তের ঝরাপাতারা ‘স্লো মোশনে’ নেমে আসছে গাছ থেকে। হাঁটতে হাঁটতে শুকনো হলুদ পাতার ওপর বীরত্ব ফলাতে লাগলাম পা দিয়ে চুরচুর করে গুড়ো করে ফেলে।

আবদুল লতিফের সঙ্গে আমার পরিচয় এস্টোরিয়া পার্কের কাছে ইস্ট রিভারের তীরে। ছোট ছেলে সেদিন স্কুলে যায়নি বলে ওকে নিয়ে নদীর ধারে হাঁটতে গিয়েছিলাম। হালকা শীত পরে যাবার কারণে এখন প্রতিদিন পার্কে কিংবা নদীর ধারে যাওযা হয়না। গ্রীষ্মকালে আমাদের পাড়া প্রতিবেশীদের দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটে নদীর ধারে। লোকজন নানা ভঙ্গীতে রোদ পোহায়। কেউ বই পড়ে চাদর বিছিয়ে, কেউ যোগ ব্যায়াম করে, কেউ বা আবার তেল মেখে তাঁবু বানিয়ে সেখানে সুখে নিদ্রা যায়। আহারে কি সুখ! আহা! সারা বছরের জন্য ভিটামিন ডি সংগ্রহ করে নেয় উদোম শরীরে।
নদীর ধার ঘেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেঞ্চগুলোতে আবার জাতিভেদ আছে। বাঙালিরা অর্থনীতির সূত্র মেনে একই ঘনত্বের মধ্যে বসে। একটু দূরে গ্রীক প্রতিবেশীদের দেখা যায় ওদের ভাষায় বাতচিত করতে। ইউরোপিয়ান হলেও গ্রীকরা আদতে খুব অলস জাতি। জ্যাকসন হাইটসের সেভেন্টি থ্রি স্ট্রিটের মতো এস্টোরিয়া ডিটমারসের আশেপাশে জটলা পাকিয়ে দিনে দুপুরে গ্রীকদের আড্ডা দিতে দেখা যায়। পুরো এলাকার একমাত্র বাঙালি ডেলি গ্রোসারিতে বাংলা পত্রিকা চোখে না পড়লেও, গ্রীক বর্ণমালা জ্বলজ্বল করে।
আবদুল লতিফ সেদিন চেক শার্টটা ইন করে পরেছিলেন প্যান্টের সঙ্গে। নাকের নীচে কাঁচা পাকা গোফ শোভা পেলেও দাড়ি রাখেননি। ওনার বয়সী লোকদের জন্যে যেটা বেশ ব্যাতিক্রম। ওনাকে দেখে কেন যেন সেদিন আব্বার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল । চেক শার্ট প্যান্টে ইন করা, আর কাঁচাপাকা গোফ ছিল আব্বার।

পার্কের বেঞ্চিতে বসতে বসতে দেখলাম উনি একা সেখানে বসে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ঠিক যেন আমাকে নয়, দূরে বহু দূরে অতীতের কোন কাহিনী অবলোকন করছেন। একা একজন বৃদ্ধকে নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখে আচমকা আমি বলে উঠলাম
–চাচা, ভালো আছেন?
উনি বিষ্ময়ভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। সুদূরের ধ্যান ভেঙ্গে হঠাৎ বাস্তবে ফিরতে যেন সময় লাগছিল তার।
–ভালো আছি মা জননী। আপনি কেমন আছেন?
–আমিও ভালো আছি আঙ্কেল। আপনি কি এখানে থাকেন?
— জি এখানেই থাকি। নাইনটিন স্ট্রিটে বাসা আমার। আপনার?
–ক্রিসেন্ট স্ট্রিটে।
আমার নাম জানতে চাইবার সময় লোকটার চেহারায় রীতিমতো আকুল জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। তারপর আমার নাম ও পরিচয় জানার পরে মনে হল উনি যেন লটোতে মিলিয়ন ডলার জিতেছেন।
–বিশ্বাস করবেন কিনা মা জননী, আমি মনে মনে আপনার মতো কাউকে খুঁজছিলাম। আপনাকে দেখেই আমার পরিচিত মনে হচ্ছিল। এখানকার সাপ্তাহিক পত্রিকায় আপনার ছবিসহ লেখা পড়েছি।
–জি পড়তে পারেন। আর এখানকার বাংলা পত্রিকাগুলিতো আপনাদের মতো বয়স্ক মানুষরাই বেশী পড়েন!

জীবনে প্রথমবার প্রথম পরিচয়ে কাউকে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলাম। লোকটার মধ্যে কিরকম যেন একটা রহস্য আছে। মনের মধ্যে এক ধরনের আকুপাকু বোধ হচ্ছিল সেই রহস্য জানার জন্য।

খ্যাপাটে লোকটি আমার বাসায় এল কিনা এক ঝড়ের রাতে! নিউইয়র্ক শহরে ঝড়-বৃষ্টি এমন নয় যে হরহামেশা হয়। তবে প্রায়ই আকাশ মেঘলা থাকে। সারা দিনে সূর্য্যর দেখা নাই, বিষণ্ণ চারধার। হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসগুলি হলুদরঙা পাতা হয়ে উড়তে থাকে চারপাশে। সেই পাতা ঝরা রাস্তায় দেখি মুকুলের বাবাকে আরেক প্রতিবেশী, অরুণ, বরুণ কিংবা কিরণের বাবার কাঁধে হাতে রেখে হাঁটতে। গ্রাম বাংলার দুই সরল সিঁধে মানুষ হেঁটে বেড়ান গ্রামের আলপথে হাঁটার মতো করে! মুকুলের বাবার পরনে লম্বা জোব্বার মতো পাঞ্জাবী, অরুণের বাবা খাটো ফতুয়ার ওপরে জ্যাকেট পরে মাঝেমধ্যে বসে থাকেন এস্টোরিয়া ডিটমারসের প্রাণকেন্দ্রে। ফুটপাতের বেঞ্চে বসে দুজন রোদ পোহান প্রতিবেশী গ্রীকদের সঙ্গে।
আবদুল লতিফের কোন হাঁটার সঙ্গী কিংবা বন্ধু নেই এই শহরে, যার কাছে অন্তরের কথা মেলে ধরবেন। কুয়াশায় আচ্ছন্ন ইস্ট রিভারের দুই তীর। দূরের ম্যানহাটন জাহাজ ঘাট শৈশবের ফেলে আসা দিনের মধুর ভ্রম সৃষ্টি করে। দুই নদীপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশিত দেখা হয়ে যায় পথিকের জন্য রেখে দেয়া বেঞ্চিতে। বেঞ্চির সামনে জমে থাকা হলুদ পাতার গালিচায় পা দিয়ে বসে অবশেষে আবদুল লতিফের জমিয়ে রাখা গল্প শুনি। অনেক দ্বিধার পথ পেরিয়ে উনি শেষ পর্যন্ত বলেন সেই কাহিনী।

-জানেন মা জননী, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বছর ফেব্রুয়ারিতে এমন হালকা শীতের দিনে আমার বিবাহ হয়। নৌবাহিনীর চাকরী থেকে ছুটি নিয়ে কুমিল্লায় এসেছিলাম বিয়ে করতে। যুদ্ধ শুরু হওয়ায় আর ফেরত যাওয়া হয়নি করাচীতে কাজের জায়গায়। নব পরিনীতা স্ত্রীকে রেখে যুদ্ধে যোগ দেব কিনা ভাবছিলাম, তখন আমাদের গ্রামে একটা ঘটনা ঘটে। আমার গ্রামের প্রতিবেশী এক শিশুকে পথের মধ্যে কুঁড়িয়ে পায়। শিশুটি সদ্য জন্ম হয়েছে। নাড়ি কাটা হলেও ঠিকমতো শুকায়নি। আমাদের গ্রামের ওপর দিয়ে ভারতে যাবার সময় এক শরণার্থী পরিবারের সঙ্গে ছিল শিশুটি। যাবার সমযে মায়ের কোল থেকে বেখেয়ালে শিশুটি পড়ে যায়। সন্তান নিখোঁজ হয়েছে বোঝার পরে তারা আর ফিরে আসার সাহস পায়নি, কাঁদতে কাঁদতেই ভারতে পাড়ি দেয়। আমাদের পরের গ্রামের অনেকেই সন্তানহারা মাকে আকুল হয়ে কাঁদতে দেখেছিল।

-কি ভয়ংকর ঘটনা! মনে হল আমার বুকের মধ্যে শেল ফেলল কেউ।

প্রচন্ড ব্যথা বোধ করছিলাম অজানা অচেনা মায়ের জন্য। আহারে! কি কষ্ট! সদ্যজাত সন্তান হারানো মায়ের কান্না যেন শুনতে পেলাম! মা তো জানতে পারল না তার সন্তানের ভাগ্যে কি হল! তাকে কি কেউ খুঁজে পেল! নাকি কুকুরে-শিয়ালে খেয়ে নিয়ে গেল!

দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর আগের একটি ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আবদুল লতিফ নিজেও যেন বিপর্যস্ত।

-তারপর কি হল? আপনার সেই গ্রামের প্রতিবেশী শিশুটির পরিবারের সন্ধান করেনি!
-তখন তো যুদ্ধের সময় কিভাবে খোঁজ করবে? তবে যুদ্ধের পরপরই উনি গেছিলেন কলকাতায় আর তার আশে পাশের এলাকায়। পুরা দুই মাস ঘুরছে রিফিউজি ক্যাম্পে। কেউ যদি সন্তান হারানো এক পরিবারের সন্ধান দিতে পারে! কিন্তু কেউ পারেনি।
আবদুল লতিফ আর আমি দুজনে পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে থাকি। হলুদ পাতা ঝরতে ঝরতে ক্রমে গাছগুলো ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দৃষ্টি চলে যায় সময়কে ছাড়িয়ে অনেক দূরে। মৃদ্যু স্বরে নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠি-
-তারপর?
-সদ্যজাত সন্তানটি ছিল এক কন্যা। সে তার নতুন বাবা-মায়ের পরিবারে বড় হয়ে ওঠে। তারা নিশ্চিত করে জানতো না কন্যাটির জন্মদাত্রী আর জন্মদাতা কোন ধর্মের! তবে তারা ধারণা করেছিল। এজন্য কন্যাটিকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মপালনের জন্য জোর করেনি তারা। তবে সে যেন মানবিক মানুষ হয়ে ওঠে এই চেষ্টা করেছে তারা। শৈশব থেকে মেধার পরিচয় দিয়ে স্কুল-কলেজে খুব ভালো ফল করে মেয়েটি মেডিকেল কলেজে সুযোগ পায়। তারপর বিয়ে করে ও সন্তান হয়। এক সময়ে আটিলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আসে।
এবার আমার সোজা হয়ে বসার পালা। ফেইরিহুইলের মতো চক্রাকারে ঘুরে এসে কাহিনীর স্পটলাইট আবদুল লতিফের ওপর থেমে যায়। আমি চমকে তার দিকে তাকাই। পূর্ণদৃষ্টি মেলে দেখি তাকে। তার চোখের কোনে জমে থাকা ময়লায় অব্যক্ত বেদনার কষ্ট দেখতে পাই।
-মা জননী, মেয়ে বাবাকে ভালোবেসে আমেরিকায় স্পন্সর করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেতো এর যোগ্য নয়। তার তো কোন অধিকার নেই এত উন্নত দেশে আরাম আয়েশে থাকার! যারা সত্যিকারের যোগ্য তারা কোথায় কিভাবে আছে কোনদিনই জানা হল না!

সন্ধ্যাবেলা দূরে ম্যানহাটানের জাহাজ ঘাটের আলো এসে পড়েছে নদীর বুকে। শেষ বিকেলের রক্তিমাভা পুরো প্রকৃতি জুড়ে। আবদুল লতিফের গাঢ় গভীর দীর্ঘশ্বাসে আরো বিষন্ন হয় প্রকৃতি। আমরা দুজন কোন কথা না বলে দৃষ্টিগম্য আকাশের তীরে তাকিয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ।