You are currently viewing রুদ্ধ সময়ের ওরা > ইসরাত জাহান

রুদ্ধ সময়ের ওরা > ইসরাত জাহান

রুদ্ধ সময়ের ওরা

ইসরাত জাহান

 

গভীর রাত হালকা কুয়াসার চাদর জড়িয়ে প্রকৃতি তখন নিমগ্নতায় ছিলো তখনই বালাতলী গ্রামের গুটিকয়েক মানুষের ঘুম ভাঙে দুই তিনটা গুলির শব্দে হয়তো তারা তাহাজ্জুদ নামাযের আদায়ের জন্য জেগে উঠেছিলেন তারা অনুমান করে, শব্দগুলো পাশের নলছড়া গ্রাম থেকে ভেসে আসছে একটু পরে শব্দগুলো তাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ে আরো একটু চাপের সৃষ্টি করে ঘুমন্ত কিছু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে জেগে ওঠে মায়ের স্তনবৃন্ত চুষতে থাকে অবুঝ বাচ্চাটাও খাবার ফেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ার্ত স্বরে কান্না শুরু করে পরবর্তী  আওয়াজটা আরো স্পষ্ট শোনা যায় কিছুসময় পরে বিকটশব্দে বিস্ফোরন তারপরে খানিকক্ষণের নিরবতা এরপরে শুরু হয় একটু পর পর থেমে থেমে গুলির আওয়াজ

আতঙ্কিত আকলিমা বাচ্চার কান্না বন্ধ করতে জোর করে  স্তনবৃন্ত ছেলের মুখে গুঁজে দিয়ে আয়তাল কুরসী আওড়াতে শুরু করেন জলিল কিছু সময় কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে ভেবে পায়না কি করবে হঠাৎ পাশের ঘরে সোবাহানের কাশির শব্দে উঠে বসে চৌকি থেকে মাটিতে পা রাখতেই মেয়েটা বলে ওঠে, ‘বাজান ভয় করে অন্ধকারে মেয়ের অস্পষ্ট মুখখানিতে হাত বুলিয়ে, দুয়ার খুলে উঠানে এসে দেখে পশ্চিমের আকাশটা মধ্যরাতে উষা আলো নিয়ে পূর্বের সূর্যে কিরণের প্রহর গুনছে

জলিল জানোয়ার গুলান মনে হইতাছে আইয়া পরছে?’

সোবাহান গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নিতে নিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে যেন বাতাসও টের না পায়

জলিল শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ঘরের চালার  পিছনেমাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী প্রকান্ড তেঁতুল গাছের দিকে এই গাছটি ওদের বাড়ির নিশানা এই বাড়িতে মোটে সাতটি ঘর সোবাহান জলিল সম্পর্কে চাচাতো ভাই বয়সে তিনমাসের ছোট বড়  হওয়ায় সম্পর্কটা দোস্তির ওদের দাদা তমিজ মিয়ার তিন ছেলে ছিলো সেই তিনঘর ভেঙে এখন সাতঘর হয়েছে সম্পত্তির স্বার্থের টানাপোড়েনে বাকি চারঘর থেকে আরো ছয়জন বেরিয়ে আসে নিরবে দাড়িয়ে নিজেদের ভেতরে চাপা স্বরে কথা বলে আটজন মানুষের ছোট স্বরের কথোপকথন, একটু পর পর থেমে গুলির আওয়াজ আতঙ্কিত করে তোলে নিঃসন্তান জমিলা বেগমকে তিনিডাকাত‘ ‘ডাকাতবলে চিৎকার করে ওঠেন আশি বছরের বৃদ্ধা নারী বয়সের ভারে কুজা হয়ে গেছেন হাঁটাচলা করেন কষ্টশিষ্টে সারাক্ষন দোচালা ঘরটায় শুইয়ে থাকেন, সম্পর্কে তিনি সোবাহান, জালিলের, কুদ্দুস, বাবরের ছোট চাচী সোবাহান চাচীকে শান্ত করতে দৌড়ে যায় বৃদ্ধার শয্যা পাশে একটু আগলে রাখে শান্ত করার জন্য এরই ভেতর নলছড়া গ্রামেরযতীনছুটতে ছুটতে সোবাহানদের উঠানে এসে লুটিয়ে পড়ে সবাই আতঙ্কিত যতীনকে ঘিরে ধরে উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চায় কি হয়েছে? ভয়ার্ত যতীন কিছুসময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে উৎকন্ঠিত  মুখগুলোর দিকে 

আমারে একটু পানি দ্যান দাদা

যতীনের কথা জড়িয়ে আসে, ধীর কন্ঠের কারনে বোঝা যায় না কিছু শব্দ তারপরও জলিল দৌড়ে গিয়ে পানি আনে চৈত্রের মাঠের মতো খরখরে গলাটায় একটু পানি দিয়ে যতীন জানায়,

গতকাল নলছড়া গ্রামের ধনাঢ্য ইদ্রিস হাজীকে  পাকবাহিনী ক্যাম্পে তলব করেছিলো গ্রামের হালচাল জানতে কোন মুক্তিযোদ্ধা লুকিয়ে আছে কিনা, জোয়ান কোন ছেলে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছি কিনা হাজী সাহেব কিছুকথা জানালেও নিজের দুই ছেলে নিরুদ্দেশের কথা চেপে যায় সেই তথ্য সন্ধ্যার আগেই আর্মির কমান্ডারকে জানিয়ে আসে সিঁধ কাটা চোর হারিস মিয়া হারিস একটা ছাগল চুরি করে আর্মির ক্যাম্পে দিয়ে আসে, সাথে উপরি কিছু খবর  সেই খবর পেয়ে হায়নাগুলো রাতে বের হয় বাড়ি বাড়ি তালাসি চালাতে  ইদ্রিস হাজীর দুই ছেলেকে না পেলেও মেয়ে আর বউকে তুলে নিয়ে যায় ওরা ফেরার পথে মাস্টারের বাড়িতে ক্ষানিকক্ষনের যাত্রা বিরতি করে মোচওয়ালা মেজর আধার রাতে জীপে আর্তনাত করা নারীদের কান্নায়, মাস্টারের ঘরে লুকিয়ে থাকা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র একসাথে গর্জে ওঠে যারা এসেছিলো খালের ওপারে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাল ডাল সংগ্রহের উদ্দ্যেশ্যে মুক্তিকামী যুবকের চোখের আগুন বন্দুকের গুলিতে জিপে থাকার তিনজন পাকিস্তানি মারা যায় বাকি দুজন পালিয়ে ক্যাম্পে চলে যায় তারপরে শুরু হয় গোলাগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের  সেই প্রতিরোধে কিছু মানুষ নলছড়া গ্রামে থেকে পালিয়ে আসার সুযোগ পায় যতীন তখন পালায় পরিবার পরিজন ছাড়াই 

যতীনের কথা শেষ হওয়ার আগে জামাল ছুটতে ছুটতে আসে চৌদ্দ বছরের জামাল এসে জানায় গ্রামের অনেক বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে ঘুমন্ত কিছু জীবন্ত মানুষ সেই আগুনে জ্বলছে কেউ সেই আগুন নেভাতে যায় না সবাই ছুটছে নিজ নিজ জীবন বাঁচাতে হায়নাগুলো অনেক যুবক, বৃদ্ধকে সারি বেঁধে দাড় করিয়ে রেখেছে খালের পাড়ে তবে আনন্দের সংবাদ হলো, বালাতলীনলছড়া গ্রামে দুটিকে সংযুক্ত করা কাঠের সেতুটি ভেঙে পড়েছে পাক আর্মির জিপের ভারে দুটো জীপ নিয়ে হানাদার বাহিনী এগিয়ে আসছিলো বালাতলী  গ্রামের দিকে প্রথম জিপটি পুরানো কাঠের সেতুটিতে ওঠার সাথে সাথে মরমর করে ওঠে সেতুটি রক্তচোষা গুলির ভার নিতে অপারগতা জানিয়ে জিপসহ খালের পানিতে নেমে আসে সেতুটি জিপটি নাকি তলিয়ে গেছে পিছনের জিপের হায়নাগুলো এরপরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বেড়ায় আর আগুন দেয় পুরানো দুই বাঁশে সাঁকো দিয়ে লোকজন বালাতলী গ্রামের দিকে ছুটে কাঠের সেতুটা ভেঙে পড়ায় কারনে এই গ্রামটা  যে এখন কিছু সময়ের জন্য নিরাপদ সেটা উঠানে দাড়ানো সবাই বুঝতে পারে সোবাহান উঠান থেকে বের হয়ে বাড়িতে ঢোকার মুখের রাস্তায় এসে দাঁড়ায় পিছনে জলিল, বাবর, যতীন, কুদ্দুস, সহ আরো কয়জন আজ কালকের ভেতরে যদি পাকআর্মি এই গ্রামের এসে পড়ে নিরস্ত্র ওরা তাহলে বাঁচবে কিভাবে? সেই চিন্তা সবার মাথায় ঘুরপাক খায় কিভাবে বউ বাচ্চাদের হায়নাগুলোর হিংস্র আঁচড় থেকে বাঁচাবে! এই ভাবনার মাঝে জলিল পুকুরপাড়ে শুকনো পাতার মড়মড়ে আওয়াজ শুনতে পেয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় হাতে প্রাথমিক হাতিয়ার হিসাবে একটা বাঁশ নেয় হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে বাচ্চার কান্না এসে কানে পৌঁছায় 

বুকে সাহস ফিরে পেয়ে জলিল উঁচু স্বরে বলে ওঠে

ক্যাডায় পুকুরপাড়ে?

ক্যাডায় ওইখানে, সামনে আইয়া খাড়াও

তারপরে কিছু সময়ে নিরবতা, জলিল এরপরে আবার ডাক দিলে বাচ্চাটা আবার কেঁদে ওঠে, ধীরে ধীরে দুটি ছায়ামূর্তি জলিলের সামনে এসে দাড়ায় উঁচু লম্বা একজন পুরুষের পিছনে গুটিসুটি হয়ে আড়ালে থাকা নারী, চাঁদনী পসর রাতের কারনে নারীর কোলে কাঁথা মুড়ানো শিশুটার দিকে জলিলের দৃষ্টি আটকে যায়৷ 

তুই নলছড়া গ্রামের পরিমল না?

হো কর্তা, মুই বালবাচ্চা লইয়া আইয়া পড়ছি আমগো বাঁচান কর্তা

তাইলে ওখানে লুকাইয়া আসোস ক্যান 

কর্তা হিন্দুগো কি তুমরা ঘরে তুলবা?

কথাটি কিছু সময়ের জন্য জলিলকে নির্বাক করে দেয় সত্যিই তো এই বাড়িতে কুকুর অন্য ধর্মের কেউ প্রবেশ করতে পারে না 

জলিলের দাদা ছিলেন একজন বড় মাওলানা তার জীবন দশায় এই বাড়িতে মুসলমান ব্যাতিত সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো এখনও সেই চর্চা বজায় রেখেছে ওরা তবে একটু আগে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা যতীনকে নিজের হাতেই পানি দিয়েছিলো জলিল তখন ওর সেই বোধ কোথায় গিয়েছিলো? নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করে জলিল নাকি এই রুদ্ধ সময় ওর ধর্মের লেবাসকে উড়িয়ে দিয়েছে মানবিকতার দমকা হাওয়ায় 

বউ বাচ্চা নিয়ে বাড়ি আয় পরিমল ওহন বাঁধবিচার করনের সময় না‘ 

এই কথা বলে জলিল বাড়ি ভেতরে প্রবেশ করে, পিছন পিছন পরিমল আর ওর বউ বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ায় উঠানের এককোনায়  হাটুতে মাথা গুজিয়ে বসে থাকা যতীন পরিমলকে দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন বাবর ছুটে এসে যতীনে মুখে হাত দিয়ে কন্ঠের আবেগকে রোধ করে আকাশ চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ওদের চোখে আনন্দ চকচক করে উঠে, জোছনার আলোয় ওদের চোখেরজল মুখের হাসিতে গুমোট চারপাশটা ঝলমল করে উঠে  জলিল পরিমলের বউকে ঘরের দুয়ার খুলে আকলিমার কাছে পৌঁছে দেয় কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পরিমলের বউ মালতি কোলের সন্তানকে নিয়ে আকলিমার পাশে গিয়ে বসে আকলিমা শোয়া থেকে উঠে বসে ঘুমন্ত ছেলে মেয়ের বুকে হাত বুলাতে থাকে ধীরে ধীরে মালতি আকলিমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিস্মিত হয়ে সর্বদা পর্দা করা আকলিমার চোখ ছাড়া আর কোন অঙ্গ দেখার সৌভাগ্য বাহিরের জগতের কারো কখনো হয়নি তাইতো মালতির চোখের ঘোর কাটেনা আকলিমার কথায় মালতির  হতচকিত রেশ কাটে

বইন পোলাডারে হোয়াইয়া দেও ঘুমাউক আলতুর পাশে 

আকলিমার ছেলের নাম আলতাফ, আদর করে আলতু ডাকে আটমাসের আলতু মায়ের ডাকে একটু আড়মোড়া ভেঙে সাড়া দেয় মালতি ছয়মাসের জয়ন্তকে আলতুর পাশে শুয়ে দিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে বিছানার এককোনে আকলিমা ধীরে স্বরে সূরা আওড়াতে থাকে,আর মালতি মনে মনে ভাগবানের নাম জপে চোখে ভাসে  বাটিতে রেখে আসা কাঁকড়া ভুনা রাতের জন্য  রান্না করে ছিলো  দুপুরে পরিমল খালে গিয়েছিলো মাছ ধরতে তখন মাছের সাথে কয়টা কাঁকড়াও ওঠে জালে সেইগুলো রাতের জন্য রান্না করতে বলেছিলো পরিমল বিকেলে হাটে মাছ বিক্রি করে রাতে বাড়িতে ফিরে খাবে মালতি চুলায় ভাত বসিয়ে ছিলো তখনই শুরু হয় তান্ডব পরিমল বড় রাস্তা দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসো জানায় পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঘরে যুবক ওদের তালাশ করছে এই কথা শুনে মালতি কপালের সিঁদুর তাড়াতাড়ি মুছে, ছেলেকে কোলে নিয়ে স্বামীর পিছু নেয় চুলায় পরে থাকে বলক উঠা ভাতঠাকুরঘরে রয়ে যায় বিয়ে সময় বাবার দেয়া একখানা সোনার বালা মালতি ভেতর থেকে একটি দীর্ঘ বের হয়ে আসে আকলিমা গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পরে ছেলের পাশে,আর মালতি অপেক্ষা করে ভোরের নতুন কিরণের জন্য  

রুদ্ধ সময় কিছু মানুষকে একজায়গায় এনে দাড় করায় জলিল, বাবর, যতীন, কুদ্দুস, পরিমল, জামালসহ আরো কিছু মানুষ নিজেদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য একসাথে বসে সলাপরামর্শ শুরু করে খালের উপরে কাঠের সেতু ভেঙে যাওয়ার কারনে আজকের এইসময়টুকু  কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওরা নলছড়া গ্রামের বাতাসে এখন রক্তের ঘ্রাণ কিছু মানুষ রক্তের ঘ্রাণের মায়া কাটিয়ে পালিয়ে আসে বালাতলী গ্রামে লুকিয়ে থাকা মানুষগুলোর রক্তের ঘ্রাণে যেকোন সময় হানাদার বাহিনী এসে হামলা চালাতে পারে এখানেও তাছাড়া তাদের অন্যপথ দিয়ে এই গ্রামে নিয়ে আসার জন্য আছে কিছু দালাল রাজাকার হারিস মিয়া তাদের একজন 

বাবর জলিল ঠিক করে বড় একটি গর্ত খুঁড়বে বড় রাস্তার উপরে সেই গর্তের উপরে বাঁশের পাতলা চালা দিয়ে উপরটা মাটি দিয়ে ঢেকে রাখবে নিরস্ত্র বাঙালী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য এর থেকে আর কোন ভালো বুদ্ধি খুঁজে পাননা ভোরের সূর্যের পরম স্নেহ, মৃদু হাওয়া ওরা এগিয়ে যায় মাটি খুঁড়তে নারীরা অপেক্ষা করে প্রিয়জনের শুভসংবাদের বুকে আশা, মুখে দোয়া নিয়ে

হেমন্তের স্নিগ্ধ সকাল,চারদিকে সুনসান নিরবতা গাছেট পাতা,ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলোতে সূর্যের আলো চিকচিক করে আকলিমা, মালতিসহ আশপাশের ঘরের নারীরা উঠানে এসে দাড়ায় মালতিকে দেখে প্রথমে চিৎকার করে ওঠে বাবরের বউ

মালতি? আল্লা কি করছে জলিললালালা এই মালাউনডারে ঘরে তুলছে ক্যা ওহন তো মিলিটারি আমগো মাইরা ফালাইবো… 

আল্লাহ গো, আমি ছাওয়ালগুলান লইয়া কই যামুু 

বাবরের বউয়ের বাজখাঁই চিৎকার উচ্চস্বরের কান্নায় বৃদ্ধা  জামিল চাচী ঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসেন  বৌ এতো কান্দিস না, একলা না বাঁইচা সবাই মিলাই বাঁইচা থাক ওহন মাথা ঠান্ডা কইরা ভাব ক্যামনে কি করবি

প্রবীণ নারীর কথায় বাবরের বৌ কিছুটা শান্ত হয়ে নিজের ঘরে চলে যায় সবাই সবার দৈনন্দিন কাজে লেগে পড়ে মালতিকে আকলিমা চোখের ইশারায় ঘরে যেতে বলেন মালতি মাথার ঘোমটাটা আরো একটু বাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায় 

ঢাকায় ২৫শে মার্চের শুরু হওয়া তান্ডব ধীরে ধীরে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেনগরে ছড়িয়ে পড়েছিলো গ্রামের নিরীহ মানুষগুলো এই হিংস্রতায় দিশা হারা হয়ে পড়ে ধর্ষনমর্দনে নারীরা হতমান হয়ে পড়ে বাঙালী তরুন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পাকিস্তানি জানোয়ারগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয় সাথে মদদ দেয় বেইমান কিছু বাঙালি এই রাজাকারগুলো যদি সাহায্য না করতে তাহলে পাকিস্তানিরা এতো হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারতো না নিরস্ত্র বাঙালি নিজেদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেবাবর জলিলরা বিশাল গর্ত খোঁড়া শুরু করে সেই গর্ত খোঁড়া শেষ হয় পড়ন্ত বিকেলে কান্ত মানুষগুলো ঘরে ফিরে আসে মায়ার টানে শিশুদের কোলাহলমুখর সেই বিকেলটা বিষন্ন ধূসর সন্ধ্যাটা এসে মিশে অন্ধকারে তলিয়ে যায় সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করে অপেক্ষা করে সেই ভয়ংকর  রক্তপিপাসুদের জন্য৷ যারা যখন তখন বাড়িঘরে হানা দিয়ে ছারখার করে দিচ্ছিলো সকল স্বপ্ন অনেকদিনে সাজানো সংসার আর মানুষজনের সামনে রেখে যায় অনিশ্চিত এক জীবন 

গভীর রাত, হয়তো অষ্টপ্রহর, খানাখন্দে ভরা মেটে রাস্তায় দিয়ে ছুটছে কিছু মানুষ অজানা গন্তব্যে রাস্তার বামপাশে হোগলা গাছের সারি ডানপাশ দিয়ে ছোট্ট একটি খাল বয়ে গেছে যেখানে ক্ষীন জলরেখা খালের ওপাড়ে গেলেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প  দলে দলে মানুষ যেখানে আশ্রয় নিচ্ছে 

শব্দহীন কান্নার স্রোত বারবার মালতির শরীরকে নাড়িয়ে দিচ্ছে কোলের ছেলেকে বুকে চেপে ছুটতে প্রান বাঁচাতে, সন্তানকে বাঁচাতে পিছনে ফেলে এসেছে স্বামী পরিমল, নিজের সাজানো সংসার চুলায় ফুটতে থাক ভাত কিছু সময় আগেও সব স্বাভাবিক ছিলো সবাই রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিলো বাড়ির সামনে সর্তক পাহাড়ায় ছিলো পরিমল, বাবর, কুদ্দুস বাকিরা ঘরে ছিলো হানাদার বাহিনীর প্রথম দলটি এসে সেই গর্তে পড়ে যায় পিছনে দলে ছিলো মেজর, সাথে আরো কিছু সৈনিক প্রথম দলের সবাই পরাভূত হওয়ার কারনে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী মেজর আদেশ করেন বেপরোয়া গোলাগুলির সে আক্রমনে প্রথমেই মরা যায় পরিমলসহ বেশ কয়জন মালতি তখন ছোট ঘরে গিয়েছিলো প্রকৃতি ডাকে সেটা বাড়ি থেকে একটু দূরে হওয়ায় মালতি সবার দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায় ফিরে এসে ঘরে পায় কাথায় প্যাচানো নাড়ী ছেঁড়া ধনকে আকলিমাসহ  আরো কয়জনের লাশ  উঠানে পরে থাকে এলোমেলোভাবে কোলের ছেলেটিকে বুকে নিয়ে দৌড়ে বের হবার সময় জলিল এসে মালতির হাত ধরে টান দেয় মালতি ছোটে জলিলের পিছনে 

খাল পাড় হয়ে মালতি  জলিল ভোর হবার একটু আগে এসে পৌঁছায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে বুকের সাথে লেপ্টে থাকা সন্তানের মুখ দেখে আঁতকে ওঠে মালতি ওর কোলে আলতু তাহলে জয়ন্ত কোথায়? জলিল দৌড়ে এসে নিজ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয় মালতি খালি কোল নিয়ে বসে থাকে, খোঁজে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে সবার কাছে জানতে চায়, জয়ন্ত কোথায়কোথায় জয়ন্ত

সেই উওর খুঁজে পায় না সেই রুদ্ধ সময়ের সাক্ষী  দেয়া বাংলাদেশ

=====================