You are currently viewing রাত্রিশেষ সম্পর্কে / চঞ্চল আশরাফ

রাত্রিশেষ সম্পর্কে / চঞ্চল আশরাফ

রাত্রিশেষ সম্পর্কে

চঞ্চল আশরাফ

আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ (১৯৪৭)’র কবিতাগুলোর রচনাকাল কবির ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৬ সাল। বাঙলা কবিতায় এর আগেই চেতনা (খণ্ডিত), ভাষা ও প্রকরণে একটা স্থিতি এসেছে। তখন এক দিকে জীবনানন্দ দাশের ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬) ও বনলতা সেন (১৯৪২)’র নতুন কাব্যভাষা, অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্ত্যপর্বে আধুনিক হয়ে ওঠার সাধনা এবং তাঁর মৃত্যুপরবর্তী সেই স্পন্দনসময়। একটা নতুন বোথ ও ভাষাপরিমণ্ডল গ’ড়ে উঠেছে বাঙলা সিিহত্যে, যেখানে নিরীক্ষাও খুব সাহস কিংবা ঝুঁকির কাজ নয়। প্রথাগত ছন্দের সীমানা ভেঙে তখন কথ্যভাষার এককরাশি ঢুকে পড়ছে কবিতায়। রাত্রিশেষ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা জরুরি। রাখলে, দেখা যায়, চারটি উপশিরোনাম ছাড়া এতে কৃতিত্বের কিছু নেই; ভাষায় নিজস্বতা সৃষ্টির সংগ্রামে, সমকালীন ও নিকট-পূর্বসূরিদের ব্যবহৃত এককগুলো মিশিয়ে আড়ষ্টতাদীর্ণ, অনির্দিষ্ট, অপরিণত ও অস্থির একটা ভাষাজগত তৈরি হয়েছে; অর্থ ও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে কবির ব্যর্থতা কিংবা এ-ব্যাপারে উদাসীনতা এবং সমকালীন বাস্তবতার চাপকে কবিতায় বেশি মাত্রায় প্রশ্রয় দেয়ার কারণে অধিকাংশ রচনাই হয়ে পড়েছে ব্যঞ্জনাহীন, সরল ও আতিশয্যপূর্ণ।

গ্রন্থটি চার ভাগে বিভক্ত এবং প্রতিটির রয়েছে উপশিরোনাম : প্রহর, প্রান্তিক (এই নামে রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৮ সালে), প্রতিভাস ও পদক্ষেপ। নামগুলোর আদ্যাক্ষরে মিল রাখার কারণ কী, সেই সময়ের কবিতার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, বলা মুশকিল। এটি কাব্যাংশগুলোর মধ্যে ভাবগত ঐক্যের প্রকাশের চেষ্টা হতে পারে। যা-ই হোক, প্রতিটি অংশে কবি এপিগ্রাফ জুড়ে দিয়েছেন এবং এগুলো তাঁর নিজের রচনা নয়, সবই অনুবাদ। তবে খুব লক্ষ করার বিষয় যে, এক উদ্বাস্তু-উন্মূলের যাত্রার বর্ণনা ও গন্তব্যের আকাক্সক্ষা আর ইশারা তাতে রয়েছে। পড়ে দেখা যাক :

মৃত্তিকা আমাদের শয়ন

আর আকাশ তার ছাউনি

অনন্ত পথের দিকে দৃষ্টি আমাদের প্রসারিত

আমরা অপেক্ষমাণ

সময়ের স্বর্ণ-ঈগল

কী আমাদের জন্য বহন করে আনবে

তারই অপেক্ষায়।

[প্রহর (ফিরদৌসী)]

আদিম প্রভাতের যাত্রী আমরা,

জানা নেই যাত্রাশেষের মঞ্জিল।

তবু জানা আছে

চলতে হবে অবিশ্রান্ত।

সময়ের পদধ্বনি আমাদের পুরোভাগে।

[প্রান্তিক (ভর্তৃহরি)]

 

মস্তিষ্কের কোষে কোষে যুদ্ধ আর নির্মম বিরোধ,

কামনার বন্যাবেগে এ যুদ্ধ নিমর্ম প্রতিরোধ।

যুদ্ধ আর যুদ্ধ শুধু ক্ষীণাশ্রয় নেই হৃদয়ের,

কোথাও আশ্রয় নেই পলায়নে মুক্তি নেই এর।

[প্রতিভাস (লরেন্স বিনিয়ন)]

শেষ হয়ে গেছে ঘুমের পাহারা স্বপ্ন দেখার রাত্রি

আমরা এখন রৌদ্রোজ্জ্বল নতুন দিনের যাত্রী।

[পদক্ষেপ (খলীল জিবরান)]

এই যাত্রীরা ইতিহাসের উন্মূল-উদ্বাস্তু পথিক এবং বেশ বোঝা যায়, তাদের আকাক্সক্ষা ও বাস্তবতার সংঘর্ষ এই কাব্যগ্রন্থে যে রয়েছে, সেটি মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে এই চারটি এপিগ্রাফ যুক্ত হয়েছে। সব কবিতায় অভিপ্রায়টি পূরণ হয়নি; তবে অধিকাংশ রচনার মর্মে এটি গৃহীত হয়েছে। উল্লেখ বাহুল্য নয়Ñ পথ, যাত্রা, গন্তব্য ইত্যাদি বিষয়আশয় বাঙলা কবিতায় শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে; যদিও এ-প্রসঙ্গে আমাদের সামনে জীবনানন্দ দাশের উপস্থিতি অবধারিত হয়ে আছে বহুদিন ধ’রে এবং যে-কবিতার বদৌলতে এমনটি ঘটেছে, সেটি ‘বনলতা সেন’। তারপর মনে পড়ে সমর সেনের ‘স্মৃতি’। কবিতাটির একটি অংশ :

রুদ্ধশ্বাস, কত পথ পার হয়ে এলাম,

পার হয়ে এলাম।

মন্থর কত মুহ’র্তের দীর্ঘ অবসর;

স্মৃতির দিগন্তে নেমে এল গভীর অন্ধকার,

আর এলোমেলো,

ডুবে যাওয়ার হাওয়া এল ধূসর পথ বেয়ে :

রুদ্ধশ্বাস, কত পথ পার হয়ে এলাম, কত মুহ’র্ত,

শ্রান্ত হয়ে এল অগণিত কত প্রহরের ক্রন্দন

(সমর সেনের কবিতা, পৃ. ২২)

 

পঁচিশটি বর্ষা ত পেরিয়ে এলাম

দেখে এলাম

কত অন্ধকার অরণ্যশীর্ষ

কালো মেঘের অন্ধকারে ছাওয়া,

দেখলাম

কত ঝরঝর বর্ষা

আর কত নিঃসঙ্গ জানালার

ইতিহাস পড়লাম

(রেণকোট, পৃ. ১৮)

এই ‘কত’ বাঙলা কবিতায়  এসেছে টি এস এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড (১৯২২)’র সেই বিখ্যাত পংক্তি ‘অ্যা ক্রাউড ফ্লৌড ওভার দ্য লন্ডন ব্রিজ, সো ম্যানি/ আই হ্যাড নট থট ডেথ হ্যাড আনডান সো ম্যানি’ থেকে।‘কত’ চাবিশব্দটি ‘সো ম্যানি’র খুব সুখকর অনুবাদ এবং এর প্রলোভন যেমন এড়াতে পারেননি সমর সেন, তেমনি আহসান হাবীবও পারেননি। উদাহরণ হিসেবে এ-দু’টি কবিতাংশ তুলে ধরার কারণ কেবল এটা নয়, সমর সেনের কবিতার প্রভাব আহসান হাবীবের রচনায় যে পড়েছে তা দেখানো; এটাও বোঝার চেষ্টাÑ ‘প্রহর’ পর্যায়ের ভাষাভঙ্গি ও ভাবপরিধির বাইরের কবিতাও এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে। এটা বাস্তবতা ও রোম্যান্টিকতার মধ্যেকার সংঘর্ষের ফল কি-না, তাও দেখার বিষয়। দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধে চারটি পর্যায়ে কবিতাগুলোকে চিহ্নিত করার কারণ বোঝাতে কবি লিখেছেন, ‘যে আবেগ থেকে এর ‘প্রহর’ পর্যায় উৎসারিত তাকে অতিক্রম করে, ইতিহাসের অগ্রগমন অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাসবিমুখ শ্রান্তি থেকে তাই ‘প্রান্তিক’ পর্যায়ের দ্বিধান্বিত স্বাক্ষর। কিন্তু সমাজ মানসে ইতিহাস-চেতনার ব্যপ্তিমানসে নতুন ইতিহাস যোজনায় অক্ষম নয়। আর ঐতিহাসিক অভিঘাত শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতায়ও নতুন আলোকসম্পাতে সক্ষম।’

এটা ঠিক, ‘প্রহরা’ পর্যায়ের কবিতাগুলো ব্যক্তিক অনুভব থেকে উৎসারিত। তাতে সমকালীনতার স্পন্দন খানিকটা আছে; তবে এর পরের পর্যায়েরগুলোয় ইতিহাসের ব্যক্তি ও সমষ্টি স্পষ্টভাবে মান্য হয়েছে; কিন্তু অতিক্রম করতে পারেনি। পেরিয়ে যেতে পারেনি নিকট-অতীত ও সমকালীন ভাষাকাঠামোকেও। সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। যে ইতিহাস ও সময়ের প্রকাশ এই গ্রন্থে ঘটেছে সেটি কাব্যিক বর্ণনায় নিঃশেষিত, কখনো-কখনো তাও নয়। সময়সত্যের সঙ্গে কবিতাসত্যের সমন্বয় না ঘটলে কিংবা কবিতার শিল্পকলায় সমকালীন বাস্তবতা নির্বিচারে ঢুকে পড়লে এমনটি হয়ে থাকে। একটি দৃষ্টান্ত :

এই ইতিহাস।

এই ইতিহাস লালন করছে পৃথিবীকে;

এই ইতিহাস আলো দিচ্ছে পৃথিবীকে;

এই ইতিহাসের ধারায়

পৃথিবীর বিস্তার তার বিকাশ।

(অস্তপারের আকাশ, পৃ. ২৭)

এই ধরনের রচনাকে গ্রন্থে স্থান দিয়ে কবিতা সম্পর্কে কবি নিজের ধারণাকে সন্দেহজনক ও হাস্যকর করে তুলেছেন এবং এর মন্দ প্রভাব পরবর্তীকালের বাঙলা কবিতায় খুব দেখা যায়। ‘রেণকোট’ কবিতাটিওসমর সেনের ‘স্মৃতি’ কবিতার ভঙ্গি ও ভাষার অনুকরণ মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। যা হোক, ‘প্রহর’ পর্যায়ের আবেগকে অতিক্রম করে ইতিহাসের অগ্রগমনে কবির অংশগ্রহণ ‘প্রান্তিক’ পর্যায়ে ‘দ্বিধান্বিত’, কিন্তু এর প্রকাশ কবিতার অর্থ ও সৌন্দর্যকে বহিষ্কার করেছে। অন্য পর্যায়ের কবিতাগুলোতেও যে ইতিহাসচেতনায় কবি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন ‘ঐতিহাসিক অভিঘাত শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতায়ও নতুন আলোকসম্পাতে সক্ষম’ ব’লে, সেটিও ইতিহাসের উল্লেখে ফুরিয়েছে; ‘নতুন’ তো দূরের কথা, কী ‘আলোকসম্পাত’ ঘটেছে, তা-ই বুঝতে পারা যায় না। ‘সেতু-শতক’ কবিতাটির অংশবিশেষ পড়ে দেখি :

দুই শতাব্দীর সেতু পার হয়ে এসেছি এখানে,

আমার অশান্ত আত্মা কেঁদে ফেরে এখনো যেখানে

ঘুম নেই নয়নে আমার,

এখনো নয়নে কাঁপে মীরণের তীক্ষè তলোয়ার!

 

দুই শতাব্দীর ঘুম কোন্ দস্যু করেছে হরণ!

কলঙ্কের কালিমায় কোন্ দস্যু হেনেছে মরণ!

সেই মৃত্যু দ্বারে দ্বারে হেনে যায় অশান্ত আঘাত,

আমার মৃত্যুরে দাও জীবনের তীক্ষè প্রতিঘাত!

 

নতুন সূর্য তীরে বিদ্ধ কর কুৎসিত মৃত্যুকে,

মহান মৃত্যুর ঘুম নামুক অশান্ত এই বুকে,

দাও ঘুম দাও সেই ঘুম

দুই শতাব্দীর পথে পথ চেয়ে রয়েছি নির্ঘুম।

(পৃ. ২৯)

এটা খুব বোঝা যায়, (এই ধরনের স্পষ্টতা কবিতার শিল্পকলায় গ্রহণযোগ্য নয়; এডগার অ্যালান পো বলেন, কবিতায় বক্তব্যের তিন-চতুর্থাংশ আড়াল করতে হবে Ñদ্র. আধুনিক কাব্যের পটভ’মি, জে. আইজ্যাক্স/ হুমায়ুন কবির অনুদিত) পলাশীর যুদ্ধের পর দু’শ বছরের পরাধীনতার কথা কবিতাটিতে বলা হয়েছে। পংক্তিগুলো শেষ পর্যন্ত অনিদ্র কথকের হেঁয়ালি এবং  এই হেঁয়ালির পর একটি প্রশ্ন হাজির করা হয়েছে, যা শোনাচ্ছে প্রত্যুত্তরের মতোই (জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এমনটি দেখা যায়) : ‘ছড়াবে না অগ্নিশিখা শীতল শিথিল তোমাদের/ ঘুমের কফিনে?’ অর্থাৎ কথক চাইছে ঘুমন্তরা জেগে উঠুক; কিন্তু সে চাইছে ঘুম, এত দীর্ঘকাল জেগে থাকতে তার ভালো লাগছে না। এই প্যারাডক্স বেশ উপভোগ্য; তবে এটি কোনো অর্থ হাজির করতে পারেনি কবিতার জন্য; হয়তো সে-সময় এর একটা অর্থ ছিল, আবেদনও ছিল, কিছুকালের মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটেছে। এটা খুব দোষের নয়, রবীন্দ্রনাথের বিপুল-অধিকাংশ কবিতার অর্থ ও সৌন্দর্য কোনোটিই এখন আর নেই। যা হোক, ‘সেতু-শতক’ কবিতাটি রাত্রিশেষ কাব্যে ধারণ-করা ইতিহাসচেতনার প্রতিনিধিত্ব করছে এবং এর মধ্যে সমকালীন বাস্তবতার স্পন্দনও টের পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু তা যেমন তখনকার পটভ’মির প্রতি বিশ্বস্ত নয়, তেমনি নয় শিল্পকলার প্রতিও। পলাশীর যুদ্ধের এক শ’ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে থেকেই বাঙালি ও ভারতবর্ষ জেগে উঠেছিল; কবিতাটি যখন লেখা হয়েছে, তখন খুব উত্তাল সময়, ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে গোটা ভারতবর্ষ অস্থির। উপভোগের বিষয় যে, কবিতাটিতে কথক একা জেগে আছে এবং বাকিরা ঘুমাচ্ছে! ব্যক্তি জেগে থাকলে সমষ্টি ঘুমিয়ে থাকেÑ ইতিহাসের এই থিসিসটি খুব নিরীহ ও গোলমেলে।

দুই.

রাত্রিশেষ কাব্যগ্রন্থের ভাষা কেমন? এতক্ষণ যে-আলোচনা হলো, তাতে এর জবাব কিছুটা নিশ্চয় পাওয়া গেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যÑ এঁদের কবিতাভাষার মিলিত পরাগায়নে গড়ে উঠেছে এই গ্রন্থের ভাষা। কিছু উদাহরণ :

দিনগুলি মোর বিকলপক্ষ পাখির মতো

বন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণ্যমান।

অন্ধ নয়নে দিনের কামনা আজিও ঊর্ধ্বায়িত

মনের অশ্ব হ্রস্ব চরণ বঞ্চনা-বিক্ষত।

(দিনগুলি মোর, পৃ. ৭)

 

বুঝেছি সেদিন মানুষ এমনি দীন,

এ-মাটির কাছে আছে আমাদের এমনি অশেষ ঋণ।

(এই মনÑ এ মৃত্তিকা, পৃ. ৯)

 

কোনো এক অরণ্যের মাঝখান থেকে

কোনো একদিন

এসেছিলো নাগরিক নিমন্ত্রণ;

নিমন্ত্রণ এসেছিলো ভর ক’রে স্বপ্নের ডানায়।

(বিয়ে, পৃ. ২৩)

 

হে নতুন সূর্য!

দিক দিগন্তে

তোমার জয়ধ্বনি কি শুনতে পাও?

(অস্তপারের আকাশকে, পৃ. ২৫)

 

এখানে সমুদ্র ছিলো

ছায়া ছিল দূর বনানীর।

কোনো এক আরণ্য রাত্রির

তীর ঘেঁষে কারা এসেছিলো,

বন্যার আবেগ নিয়ে কারা যেন ভালোবেসেছিলো।

(প্রদক্ষিণ, পৃ. ৪৪)

‘মোর’, ‘নয়ন’, ‘আজি’, ‘স্বপন’, ‘দ্বার’, ‘পানে’, ‘গগনতলে’, ‘বাতায়ন’ রবীন্দ্র-নজরুলের কাব্যভাষার ইত্যাদি একক যখন বাতিল হয়ে যাচ্ছে, তখনও তিনি ব্যবহার করেছেন এগুলো। তবে এ-কাব্যের মাঝামাঝি থেকে এই প্রবণতা শমিত হয়ে এসেছে এবং কথ্য ভাষার প্রয়োগে কবিতা সমকালীন ভাষারুচির অনুগামী হয়ে উঠেছে; কিন্তু অতিক্রম করতে পারেনি। সেই সামর্থ্যরে ইশারা কিঞ্চিৎ দেখা যায় দু’একটি জায়গায়, তবে তা কষ্ট করে খুঁজে নিতে হয়। এত সমস্যার মধ্যেও পূর্বসূরি ও সমকালীন কবিতাভাষার সংমিশ্রণে নতুন একটা ভাষাসৃষ্টির সংগ্রাম টের পাওয়া যায়। সৌন্দর্য সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা (দ্র. কবির শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কার ব্যবহারের ধরন) ও কবিতা সম্পর্কেঅস্বচ্ছ ধারণার চাপে সংগ্রামটি বিফল হয়েছে। যে-কোনো কবির প্রথম গ্রন্থে এমনটি হতেই পারে। এ-সান্ত্বনায় যে এর কবিতাগুলো নিঃশেষিত তা নয়, বাঙালি মুসলমান কবির মনোজগত তখন কেমন ছিল, তা বুঝতেও এটি সাহায্য করে।

০৬. ০২. ১২