You are currently viewing রক্তের বিভাজন || পিওনা আফরোজ

রক্তের বিভাজন || পিওনা আফরোজ

রক্তের বিভাজন
পিওনা আফরোজ

অফিস শেষে সুনীল রওনা হয়েছে বাসার উদ্দেশ্যে। তখন দিনের আলো ক্রমেই মলিন হয়ে আসছে। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘও জমেছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে একটার পর একটা বজ্রপাত শুরু হয়। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে সুনীলের মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা। জীবনের কথা। যে ভাবনাগুলো তাকে বেদনার্ত করে তোলে। একটা নীরব বিষন্নতা চেপে বসে বুকের ওপর। সে ভাবে- প্রচলিত নিয়মের বিপক্ষে সংগ্রাম করা কতই না কঠিন। আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে বোধের এই বোঝাটিই আজকাল সময়ে অসময়ে খুব বেশি আঁকড়ে ধরে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সুনীলের ফোন বেজে উঠলে সে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে তানিয়া। গাড়ির সিটের উপরে রাখা ফোনটি হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে তানিয়া বলল, সুনীল, তুমি কই?
অফিস থেকে বেরিয়েছি, গাড়িতে।
তানিয়া কিছু একটা বলছিল, কিন্তু তখনই বিকট শব্দে আরেকটা বজ্রপাত হওয়াতে কিছু শুনতে পায় না সুনীল।
কী বলছ, শুনতে পাই নি। সুনীল বলে।
মায়ের শরীরটা খুব খারাপ। তুমি তাড়াতাড়ি আসো।
কি হয়েছে? বিচলিত হয়ে জানতে চাইল সুনীল।
উঁফ…। ব্যথার গোঙানির আওয়াজ এলো তানিয়ার কানে। কথা না বাড়িয়ে শুধু বলল, সরাসরি হাসপাতালে চলে আসো, আমি রাখছি।
এ সময় ঝুম বৃষ্টি নামে। অঝোরধারার বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসে চারিদিক। আশেপাশের গাছগুলো তখন বাতাসে এলোমেলো দুলছে। রাস্তায় গাড়ির গতি কমে আসে। গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে আশপাশটা দেখে নিয়ে সুনীল ভাবে, মা’র হঠাৎ কী হলো? খারাপ কিছু নয়তো? তানিয়ার গলা শুনে মনে হলো ও বেশ উদ্বিগ্ন। কী জানি কী হয়েছে, ভগবান জানেন!
উত্তেজনায় বুক কাঁপে থরথর। এই মুহুর্তে তার কাছে জগৎ সংসারের যাবতীয় কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তানিয়ার পাশে থাকা। তানিয়ার ভাবনায় গভীর উদ্বিগ্নতায় পেয়ে বসে সুনীলকেও।
একসময় সুনীলের শাশুড়ি-মাকে খুব অসহ্য লাগত। মনে হতো তাঁর যন্ত্রণায় জীবনটা দূর্বিষহ হয়ে উঠছে। কিন্তু অসহ্য লাগলেও কিইবা করার ছিল! আর যাই হোক, উনি তো তানিয়ারই মা। মেয়েটাই তো তার সবকিছু। তাই, ভালো না লাগলেও সপ্তাহ শেষে তার বাসায় বাজার বয়ে নেওয়া, অসুস্থতায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া- সবই সে করতো। তবে এসবের জন্য সুনীলের কখনো কোনো টাকা খরচ করতে হতো না। তানিয়া চাকরিজীবী মেয়ে। তার টাকা থেকেই মায়ের জন্য সে খরচ করেছে।
চলতে চলতে হঠাৎ সুনীলের গাড়ি থেমে যায়। কানে বাজে টাপুরটুপুর বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টির শব্দের সাথে সাথে পাশেই একটা গাড়ির প্লেয়ারে মৃদৃস্বরে বাজছে- আজি বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে/আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে।
গান শুনতে শুনতে সুনীলের মনে পড়ে, ছোটবেলায় তানিয়া পাশের বাসায় এক বৌদির কাছে গান শিখত, সে ছিল হিন্দু। মা মাঝে মাঝে তানিয়াকে গানের ক্লাস শেষে আনতে যেতেন কিন্তু বৌদির ঘরে ঢুকতে চাইতেন না। যদিও বৌদি মায়ের কোনো আপত্তিই শুনতো না। জোরপূর্বক তাকে ঘরে নিয়ে আসত। ঘরে যাই থাকত খেতে দিত। কেননা বৌদি অতিথি আপ্যায়ন করতে ভীষণ ভালোবাসত। কিন্তু হিন্দুর ঘরে খেলে তো জাত যাবে। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘরে ঢুকলেও খাবারের সাথে কখনই আপোষ করেননি মা। এমনিতেই তিনি খুব ধর্মভীরু মানুষ- পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন, প্রতিদিন নিয়ম করে কোরআন তেলওয়াত করেন, পর্দা করা ছাড়া চলাফেরা করেন না। মায়ের সম্পর্কে এ সব কিছুই, সুনীল জেনেছে তানিয়ার কাছ থেকেই।
তানিয়ার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয়, তখন সুনীল ক্লাস টেনে। একই এলাকায় পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতো। তানিয়ার কথা বলা, হাঁটাচলার মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ছিল যা অন্যদের চেয়ে ঈর্ষণীয়ভাবে স্বতন্ত্র। তার মুখটা দেখলেই অদ্ভুত এক ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে যেত মনের গভীরে। তাকে একবার দেখার অপেক্ষায় থেকে থেকে সারাবেলা কেটে যেত। এমনকি রাতে যদি ইলেকট্রিসিটি চলে যেতো, সেই সুযোগে সুনীল ছাদে গিয়ে বন্ধুদের সাথে গল্প করার ছলে তানিয়াকে দেখতো। বিকেলে যখন তানিয়া গোলাপ গাছগুলোয় জল দিতে ছাদে আসত, তখন গোলাপ গাছের সাথে সাথে সুনীলের পিপাসার্ত হৃদয়ও যেন প্রাণ ফিরে পেত। কিন্তু এসব কথা তাকে বলার সাহস কই? বললে যদি তানিয়া ওর বাসায় জানিয়ে দেয়, তাহলে তো এলাকাটাই ছাড়তে হবে তাকে। এমন অনেক ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায় সুনীলের।
তবে কোনো ভাবনাই সুনীলকে বেশিদিন দমিয়ে রাখতে পারেনি। এক জ্যোৎস্না ভেজা রাতে আকাশে সোনালী চাঁদ উঠেছিলো। চারিদিকের গাছপালা, বাড়ি-ঘর সবকিছু যেন ভেসে যাচ্ছিল জ্যোৎস্নার আলোয়। ফুলের হালকা ম-ম গন্ধ মৃদুমন্দ বাতাসে ভাসছিল। ঠিক তখনি ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে সকল দ্বিধা সরিয়ে তানিয়াকে ভালোলাগার কথা বলেছিল সুনীল। কী আশ্চর্য! তানিয়াও তার প্রস্তাবকে গ্রহণ করেছিল লাজুক হেসে।
সেই থেকে শুরু। যাকে বলে প্রেম। প্রেম মানেই চিঠির আদান প্রদান। সময়ে অসময়ে সুযোগ পেলেই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা। দিনে দিনে বেড়ে যায় নিয়ম ভাঙার অনিয়ম। এমনি করেই সময়ের স্রােতে অনেকগুলো দিন কেটে যায়।
সুনীল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে তানিয়া তখন কলেজের শেষ ধাপে। সেই সময়ের এক সকালে সুনীলের রুমমেট আনিস এসে সুনীলকে জানাল, তানিয়ার বাবা আর নেই। আকস্মিক এ মৃত্যুসংবাদে সুনীল হতবাক হয়েছিল। বিশ্বাস করতে তার কিছুটা সময় লেগেছে। যদিও দুঃসংবাদ সবসময়ই নির্মমভাবে আকস্মিকই হয়।

এ সময় আবার বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতের শব্দে সুনীলের তন্ময়তা কেটে গেলে সে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নদ্দা থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত পুরো রাস্তা জুড়ে দীর্ঘ জ্যাম। ভাবে-কবে যে এই জ্যাম ছাড়বে, কে জানে! সাথে বৃষ্টিও একনাগারে ঝরেই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তানিয়ার কাছে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সুনীলের আরও দুশ্চিন্তা হয় এই ভেবে যে – তানিয়া সবকিছু কী করে একা সামলে নিচ্ছে! অবশ্য জীবনে কত কিছুইতো মানুষকে একাই সামলে নিতে হয়! যা একেবারে খুব কাছের মানুষটিও হয়তো কখনোই জানতে পারে না।

তানিয়ার বাবার মৃত্যুর কয়েকদিন পর ওরা চলে যায় অন্য এলাকায়। ওর বড় মামার বাসায়। মূল সড়কটির শেষ মাথায় একটি টিনশেডের একতলা বাড়ি। পাশেই চারকোণা একটি খোলা মাঠ। প্রতিবেশীদের বাড়িগুলো এ বাড়ি থেকে একটু দূরেই বলা চলে। অচেনা এলাকা, অপরিচিত সব মানুষ। পাড়ার ছেলেগুলো তানিয়াকে দেখলেই পিছু নিতো। রিকশায় চড়ে কলেজে যাওয়া আসার পথে রিকশার হুড ফেলে দিতো। শুধু তাই নয়, তানিয়ার বাসার জানালা দিয়ে রাতে ঢিল ছুড়ে মারতো।
এরকম পরিস্থিতিতে তানিয়ার মামা স্বিদ্ধান্ত নিলেন, তানিয়াকে বিয়ে দিয়ে দিবেন। বাবা নেই। মা একা মানুষ, তারও বয়স হয়েছে, হায়াৎ মওত আল্লার হাতে। কখন কী হয়, বলা তো যায় না। তাই ভালো একজন পাত্র দেখে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।
তারপরই বাড়িতে একের পর এক সম্বন্ধ আসে। কিন্তু তানিয়া এ ব্যাপারে কোনও আগ্রহ প্রকাশ করে না। এক সন্ধ্যায় পাত্র এসে দেখে যাবার পর পাত্র পছন্দ হয়েছে কি না এ বিষয়ে মা এবং মামা তানিয়ার কাছে জানতে চাইলে, তানিয়া কোনো কথা বলে না। অকেক্ষণ চেষ্টা করেও তানিয়ার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তিনি রেগে গিয়ে বলেন, ওর কি আর এইসব ছেলেরে পছন্দ হইব, ও তো পছন্দ করে ওই মালাউনরে। সুনীল না কি যেন নাম ! কত কইরা ওরে বুঝাইলাম, তোর এই সম্পর্ক সমাজ কোনোদিন মাইনা নিব না। কে শোনে কার কথা! কোন পাপে যে আজ আমার এই শাস্তি পাইতে হইতেছে, জানি না। অশ্রু ছলছল চোখে দু-হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে- হে আল্লাহ তুমি আমারে এই বিপদ থেইকা উদ্ধার কর। নাইলে দুনিয়া থেইকা ওঠাইয়া নিয়া যাও। ধর্মের সাথে এমন বেঈমানি…। সহ্য করতে পারুম না।

তানিয়ার বাসার এমন পরিস্থিতিতে সুনীল কি করবে বা তার কি করা উচিত, ভেবে কোনো স্বিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না সে। এমনিতেই তার জীবনে তেমন কোনো চমকপ্রদ ঘটনা নেই। বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে পড়াশোনা শেষ করে শহরে একটা চাকরি নিয়েছে। সেই চাকরি থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে সাহায্য করে বৃদ্ধ বাবা-মাকে। এই পৌনঃপুনিক চক্রে চলেছে তার জীবন। মাঝে শুধু তানিয়াই তার জীবনে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করেছে।
এরই মধ্যে সারাক্ষণ কী এক অসম্ভব, নির্বোধ তাড়না সুনীলের ঘুম ও জাগরণের সমস্ত ভাবনাগুলো কেড়ে নিল। কোনো কাজ করতেই ভালো লাগত না তার। রাতে শোবার ঘরে কিংবা দিনে অফিসে যখনই একটু কাজ করতে চাইত, কেবলই তানিয়ার ছায়া ভেসে উঠত চোখের সামনে। তার স্বপ্ন, আশা ও আকাক্সক্ষার মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হতো, সবকিছু কেমন ছেলেখেলা, ধর্মের দোহাই দিয়ে বিচ্ছিরি, একঘেয়ে একটা ছেলেখেলা।
অবশেষে ওরা স্বিদ্ধান্ত নিলো, বিয়ে করবে। নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়বে। তাই ভালোবাসার মানুষকে আপন করে কাছে পেতে সুনীলকে ধর্মান্তরিত হতে হলো।
সুনীল আর তানিয়ার বিয়ের কথা জানার পর মা অনেক বছর তানিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। তানিয়া চাইলেও তিনি সেই সুযোগ দেননি।
বড় মামা মারা যান বিয়ের বছর দুয়েকের মাথায়। মা তখন একেবারে একা হয়ে গেলেন। বড় মামা বেঁচে থাকাকালীন মাঝে মাঝে তানিয়ার সাথে যোগাযোগ করতেন। মাকেও বুঝাতেন । বলতেন – অনেক তো রাগ করে ছিলি! ছেলে-মেয়ে দুটাকে এবার মাফ করে দে। তাছাড়া ছেলেটাতো মুসলিম রীতি মেনেই বিয়ে করেছে। ও তো এখন আমাদেরই গোত্রীয়।
মা তখন মৃদু হেসে বলেছিলেন, ভাইজান, মুসলিম রীতি মাইনা বিয়া করলেই কি মুসলমান হইয়া যায়? আচ্ছা কন তো, আপনি তারে কোনোদিন আমাগো কোনো আচার- অনুষ্ঠান, কোনো নিয়ম কানুন পালন করতে দেখছিলেন ? এমনকি দুই ঈদের নামাজটাও তো কোনোদিন সে পড়ে নাই।
মায়ের কথায় মামা তখন চুপ করে ছিলেন। মামাকে নিরুত্তর দেখে মা বলেন, জানি এর কোনো উত্তর আপনার কছে নাই। শুনেন ভাইজান, ওগো লগে আমার কোনো যোগাযোগ না থাকলেও আমি সব খোঁজ রাখি।
বড় মামার মৃত্যুর পর মাকে কাছে রাখার চেষ্টা করে তানিয়া। তাকে অনেক করে বুঝালেও মা একসাথে থাকতে রাজি হন না। একা একা অসুখে ভোগেন, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না। সারাদিন কান্নাকাটি করেন। তবুও মেয়ের কাছে আসেন নি। তিনি যেহেতু আসতে রাজি ছিলেন না তাই তার কাছাকাছি থাকার জন্যে তানিয়াই মায়ের বাসার কাছে একটা বাসা ভাড়া নেয়। আর সুযোগ পেলেই মাকে যেয়ে দেখে আসত।
কিন্তু আলাদা থেকে আসা যাওয়া করে কতটুকুই বা খেয়াল রাখা যায়! এ না পারাটা কতটা কষ্টের, কতটা গ্লানির তা তানিয়া না বললেও সুনীল বুঝতে পারে। তানিয়া যখন মায়ের আচরণে দুঃখ পেতো, তখন সুনীলের কাছে তার জীবনটাও দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। মা এবং সন্তানের এই দূরত্ব সুনীলের ভিতরে অপরাধবোধ জাগ্রত হয়। সেই অপরাধবোধ থেকে তখন তার ইচ্ছে হতো কোনও না কোনও ভাবে অন্য কোথাও চলে যেতে। যেখানে কোনও বৈষম্য থাকবে না। যেখানে এইসব সমস্যা তাকে আর যন্ত্রণা দিবে না, পীড়িত করবে না।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর সুনীলের যন্ত্রণা কমেছিলো। হয়তো সময়ের সাথে সাথে সব ব্যথাই একদিন মুছে যায়। দূরত্ব ও ঘুচে যায় কখনও কখনও। যেভাবে ফেলে আসা পথে অতীতের পায়ের চিহ্ন মুছে যায় বর্তমানের পদচারণায়, তেমনি সুনীল আর তানিয়ারও দূরত্ব ঘুচেছিল মায়ের সঙ্গে। তাদের কোল জুড়ে ফুটফুটে একটি ছেলে আসে। নাম রাখে আরাফ। আরাফের জন্মের পর থেকেই মাঝে মাঝে মা মেয়ের বাড়ি আসেন। যদিও তারা বুঝে এই আসা যাওয়া সুনীল বা তানিয়ার জন্য নয়। ছোট্ট আরাফের জন্যই এই ছুটে আসা।
সে যার জন্যই আসুক, তানিয়ার সাথে মায়ের দূরত্বটা তো ঘুচলো। এই ভেবে সুনীলও নিজের অপরাধবোধ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেল। কিন্তু এখন মায়ের শরীরের যে অবস্থা, তাতে কে জানে,কী হবে! এর আগেও একবার স্ট্রোক হয়েছে। স্ট্রোকের পর মায়ের বাসায় গেলেই বলতো, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। কথাটিকে সুনীল খুব একটা গুরুত্ব দিত না। কিন্তু এই কথাটি এখন সুনীলের মনে ভয় জাগায়। হারানোর ভয়। আর কোনো দুঃখদায়ী ঘটনায় তানিয়া কষ্ট পাক, সুনীল তা চায় না।
এ সময় সশব্দে ব্রেক কষে গাড়ি থেমে গেলে সুনীলের তন্ময়তা কেটে যায়। বাইরে তাকিয়ে দেখে সে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু তখনও গুড়িগুড়ি বৃৃষ্টি পড়ছিল। সুনীল গাড়ি থেকে নেমে দৌঁড়ে রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতালে পৌঁছায়। একটা অনিশ্চিত সংবাদের আশঙ্কায় সুনীলের মনটা অস্থির হয়ে আছে। হাসপাতালের লিফটে উঠে তিন তলায় করিডোর পেরিয়ে ৩০৪ নং কেবিনে গিয়ে দেখে, মা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন। বুকে প্রচন্ড ব্যথা। ব্যথায় মায়ের মুখটাও বিকৃত হয়ে আছে। আর পাশে দাঁড়িয়ে তানিয়া মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
মাকে দেখে সুনীলের চোখে-মুখে ঠিকরে পড়ছে আশঙ্কা। সে ক্ষীণ গলায় তানিয়ার কাছে জানতে চাইল, ডাক্তার কি বলেছে?
দু-একদিন অবজারভেশনে রাখবেন। কিছু টেস্ট করাতে হবে। তারপরই নিশ্চিত হয়ে বলা যাবে।

দু’দিন পর ডাক্তার সব রিপোর্ট হাতে পেয়ে জানালেন, রোগীর ব্লাড প্রেশার গত কয়েকদিন ধরে বারবার ফ্লেকচুয়েট করছিল। এখন স্টেবল আছে। কিন্তু আলটাসনোগ্রাফিতে দেখা গেছে ইউটেরাসে বেশ বড় সাইজের ফাইভরয়েড রয়েছে। এ্যাজ আর্লি এ্যাজ পসিবল সার্জারি করে ফাইভরয়েড রিমুভ করতে হবে।
সার্জারীতে কত খরচ হতে পারে? তানিয়া জানতে চাইল ডাক্তারের কাছে।
তা প্রায় দুই লাখ। আর আপনাদের দিক থেকে সাপোর্ট পেলে আমরা আগামীকালই সার্জারী করতে চাই।
ঠিক আছে। আপনারা তাহলে সার্জারির জন্য প্রিপারেশন নিন। সুনীল ডাক্তারকে বলে।

কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়ে যাবার পর বেডের পাশে রাখা চেয়ারে বসে সুনীল। তার কথায় অবাক হয়ে জানতে চায় তানিয়া, হঠাৎ করেই এতোগুলা টাকা তুমি কই পাবা?
সুনীল ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, আরে অত ভেবো না । ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বুঝলাম তো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু কোথ্থেকে। সেটা বলবা তো।
হ্যাঁ সুনীল, তুমি এতা টাকা কই পাইবা ? ধীরে শোয়া থেকে উঠে বেডের মাথার দিকে বালিশে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করছেন আর দূর্বল গলায় মা জানতে চাইলেন।
মা, আমার একটা ডি. পি. এস আছে। অনেকদিন ধরে প্রতি মাসে অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমাচ্ছিলাম। ওইটা ভাঙলেই হবে, আশা করি।
কিন্তু ওই ডি. পি. এস টা ছাড়া তো আমাদের আর কোনো স য় নাই। তাছাড়া ডাক্তারের কাছ থেকে আরও কয়েকটাদিন সময় নিলে আমিও না হয় চেষ্টা করে দেখতাম, অফিস থেকে কিছু টাকা লোন করা যায় কি না! তানিয়া বলে সুনীলকে।
হ্যাঁ সুনীল। তানিয়াতো ঠিকই কইছে। তাছাড়া তোমার জমানো টাকা আমার লাইগা …
মায়ের কথা শেষ হবার আগেই সুনীল বলে, মা আপনি এগুলো নিয়ে চিন্তা করবেন না। ভাগ্যে থাকলে টাকা আবার হবে। আগে আপনি সুস্থ হয়ে নিন। কথা শেষ করেই সুনীল বসা থেকে উঠে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
মা তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। বলে তানিয়াও কেবিন থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমের চেয়ার যেয়ে বসে। হাসপাতালের মেঝের দিকে তাকিয়ে আনমনে পায়ের আঙুলগুলো নাড়াতে থাকে আর ভাবে, শেষ পর্যন্ত সুনীল নিজের এতো কষ্টের জমানো টাকাগুলো মায়ের জন্য দিয়ে দিবে? তাছাড়া আর তো কোনো উপায়ও নেই! আমার অফিসের লোনের অপেক্ষায় থেকে থেকে যদি মায়ের কিছু হয়ে যায়! এ কথা ভাবতেই মুহূর্তেই একটা ভয়ানক ভয় তাকে আঁকড়ে ধরে। তার গলা শুকিয়ে আসে। মাকে ছাড়া নিজেকে বড় অবলম্বনহীন মনে হয়। মায়ের মুখটা তার স্মৃতিতে ভাসতে থাকে।
ওয়েটিং রুমে তানিয়াকে বিষন্ন, একাকী বসে থাকতে দেখে সুনীল তার পাশে এসে বসে। কাঁধে হাত রাখে। মলিন মুখখানি দেখে বলে, অত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তানিয়া মুখ তুলে সুনীলের চোখের দিকে তাকায়। সুনীল যেন ওর বুকের কাঁপন টের পায়।
সুনীলের কথায় তানিয়ার নিজেকে খানিকটা নির্ভার মনে হয়। সে ওড়না দিয়ে চোখ মোছে। হাতের আঙুলগুলোর সাহায্যে চুলগুলো ঠিক করে নেয়। এখন তার মুখে আর কোনো দুঃসহ চিন্তার চিহ্ন নেই।
পরদিন অপারেশনের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে ডাক্তার জানান, পেশেন্টের জন্য ‘ও পজেটিভ’ ব্লাড লাগবে। আপনারা ডোনার রেডি রাখুন। যাতে প্রয়োজন হলেই আমরা ব্লাড কালেক্ট করতে পারি।
ডক্টর, ব্লাড নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আমার ব্লাড গ্রুপ ‘ও পজেটিভ’। সুনীল বলে।
ঠিক আছে। আপনি তাহলে আসুন আমাদের সঙ্গে।
তানিয়াও সুনীলের পিছু নিয়ে যেতে চাইলে তানিয়ার মা তার ডান হাতটা ধরে মৃদু টান দেন। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলেন, দাঁড়া। তোরে একটা কথা কওনের আছিল।
তানিয়া বিব্রত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- কি কথা? বল।
আমি জানি, তুই চাইলেই সুনীলের টাকা ফেরত দিতে পারবি। তার জন্য হয়তো কিছুটা সময় লাগব। সেইজন্যই তখন ওর কাছ থেইকা টাকা নেয়ার ব্যাপারে আর কোনো কথা আমি বাড়াই নাই। তাই বইলা কোনো হিন্দুর রক্ত আমার শরীরে থাকব, সেইটা তো হইতে পারে না। আমি মইরা গেলেও সুনীলের রক্ত আমার শরীরে দিবি না। দরকার হইলে রক্তের ব্যবস্থা তুই অন্য কোথাও থেইকা কর।
মায়ের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তানিয়া। চোখ দুটো স্থির, নিস্পলক চেয়ে থাকে মায়ের উদ্ধত চাহনির দিকে। একটা গাঢ় নিস্পৃহতা পেয়ে বসে তাকে। অসীম এক শূন্যতা উপহাস করে। অসম্ভব অর্ন্তজালার উত্তাপে চোখ দুটো থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ে।

*********************************