যৌবন ওড়ে ছেঁড়াদ্বীপে
ইসহাক তুহিন
১.
প্রতিদিন বসে বসে এভাবে আমার মৃত্যুর প্রহর না গুনে এক শিশির বিষ এনে দাও। খেয়ে তোমাকে চিরতরে মুক্তি দিই।
নিরমিন, সকাল সকাল কি শুরু করলে তুমি! এখন তো তুষি এসে গেছে। তোমার আর কষ্ট হবে না।
চুপ হয়ে গেল নিরমিন। হাঁটা-চলা করতে পারে না, একবছর যাবত অবশ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে সে। তার মনটা কখনো কখনো বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে, বিশেষ করে যখন প্রাকৃতিক কাজ-কর্ম সারতে তুষি কিংবা স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হতে হয়!
সেদিন তার বার্থডে ছিল। সে সচরাচর স্বামীর কাছে কোনোকিছুই আবদার করে না। সেদিন কি মনে করে তমোহরকে বলেছিল, আমার প্যারাসেলিং করতে খুব ইচ্ছে করছে। আমাকে একটু কক্সবাজার নিয়ে চলো।
তার আবদারে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল স্বামী তমোহর।
কক্সবাজার মূল বীচ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেরিন ড্রাইভের সাথে লাগোয়া লাল কাঁকড়া বীচ। এ বীচে ট্যুরিস্টের তেমন ভিড় থাকে না। যাঁরা একটু নির্ঝুম প্রকৃতি ভালোবাসেন, মূলত তাঁরাই এখানে আসেন।
এ বীচেই প্যারাসেলিংয়ের জন্য এসেছিল তমোহর আর নিরমিন। বেলাভূমি থেকে কয়েকশো ফুট ওপরে ভেসে ভেসে পাখির চোখে কক্সবাজার শহরকে দেখেছিল তারা। ফেসবুক লাইভ চালু করে প্যারাসেলিংয়ের দৃশ্য ফেসবুক ফ্রেন্ডদের সাথে শেয়ারও করেছিল। ওই লাইভ ভিডিওটা এখনও নিরমিনের ফেসবুক আইডির টাইমলাইনে রেকর্ড আছে।
সারাদিন সমুদ্র চষে বেড়িয়ে টমটম নিয়ে কক্সবাজার ফিরছিল দুজন। খুব ক্লান্ত ছিল তারা। ভ্রমণ ক্লান্তি! ওই ক্লান্তিবোধের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ লুকিয়ে ছিল।
তমোহর, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তোমার কাঁধে একটু মাথা রাখি?
অনুমতি নেয়ার কি আছে! হেসে বলল তমোহর।
তার কাঁধে মাথা রাখতেই ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে এলো নিরমিনের।
টমটম হলিডে মোড় পার হওয়ার পরপরই একটা বিকট শব্দ হলো। আশেপাশের লোকজন ক্ষিপ্রগতিতে দৌড়ে ছুটে এলো। নিরমিনের শরীরের নিম্নাংশ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছিল। যেন রক্তের উদ্দাম ঝর্ণাধারা! টমটমের চাকার সাথে পেঁচিয়ে গিয়েছিল তার বোরকা। লোকজন তাকে টমটমের নিচ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
তারপর থেকেই তো পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছে সে।
২.
আরাম করে চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে তমোহর। প্রথম চুমুক দিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে ফেলল। চায়ে চিনি বেশি হয়েছে। ডাক্তার চিনি কম খেতে বলেছেন তাকে।
তুষি, চায়ে এতো চিনি দিছো কেন?
একটু চিনি খেলে কি হবে?
শরীরের ভীষণ ক্ষতি হবে।
আচ্ছা, বুঝেছি। কাপটা দাও। আমি আরেকটু লিকার দিয়ে আনি।
তুষি কাপে আরেকটু লিকার দিয়ে আনল।
এখন ঠিক আছে?
হু।
তুষির ডান হাতটি বুকের ওপর নিয়ে আঙ্গুল টেনে টেনে আদর করছে নিরমিন। অনেকদিন পর তুষিকে কাছে পেয়ে বেজায় খুশি সে।
তমোহরের ফুপাতো বোন তুষি। বাড়ি টেকনাফ পৌরসভায়। এ বছর কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেছে সে। পড়াশোনায় খুবই ভালো। মা তাকে প্রায় সময় ছেঁড়াদ্বীপ পাঠান তমোহরের অনুরোধে। ছেঁড়াদ্বীপে এসে নিরমিন ভাবির একটু সেবা-যত্ন করতে পারলে তুষির নিজেরও ভালোই লাগে।
শোনো নিরমিন, গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি। এটাকে স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না।
স্বপ্নের কথা বলায় তুষির হাতের আঙ্গুল টানা বন্ধ করে তমোহরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিরমিন জিজ্ঞেস করল, কি স্বপ্ন?
বলব?
হু।
না, থাক। বলতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।
সেটা আবার কি ধরনের কথা!
আপনারা কথা বলেন, আমি যাই। বলে হনহন করে অন্যরুমে চলে গেল তুষি। সে বুঝতে পারল, তার সামনে স্বপ্নের কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে তমোহর।
তুষি চলে গেছে। এবার বলো কি স্বপ্ন দেখেছো? নিরমিন বলল।
স্বপ্নে তোমাকে একটা লোকের সাথে শুতে দেখেছি আমি।
আসতাগফিরুল্লাহ। কি বাজে স্বপ্ন দেখেছো তুমি!
হু।
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিরমিন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা তমোহর, শেষ কবে আমরা ইনটিমেট হয়েছি তোমার মনে পড়ে?
না, মনে করতে পারছি না।
আমারও মনে নেই। তবে দেড় বছরের কম হবে না। ওই একটা এক্সিডেন্ট আমাদের জীবনের সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে।
কথাগুলো বলতে বলতে নিরমিনের চোখ দিয়ে রাতের শিশিরের মতো টুপটুপ করে পানি পড়ছে।
বাইরে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। তমোহরের অসহ্য লাগছে। আজকাল সবকিছুতেই তার চেহারায় বিরক্তি ফুটে ওঠে।
মাথাটা ঠকঠক করছে। তুষি, অ তুষি, বাইরে গিয়ে একটু দেখে এসো তো!
তুষি তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে বের হয়ে দেখল, নজু পাগলা উঠোনে শুয়ে আছে। পাগলার ঠোঁটে দুটি সিগারেট জ্বলজ্বল করছে। চার-পাঁচটি কুকুর ঘিরে ধরেছে তাকে। তার উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া এ কুকুরগুলোর সাথে। সবসময়ই পাগলার ভাবসাব এ রকম, যেন সে ছেঁড়াদ্বীপের রাজা, আর কুকুরগুলো তার প্রজা! সারাদিন ছেঁড়াদ্বীপে রাজত্ব করে রাতে হয় গোরস্তানে, নয়তো তমোহরের বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকে সে। ইদানিং তার চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে, বয়স কিন্তু খুব বেশি হয়নি। মাত্র ত্রিশ ছুঁইছুঁই।
একসাথে দুটি সিগারেট ধরিয়েছিস কেন তুই?
ওই খানকি, তুই চুপ থাক। আর একটা কথাও বলবি না, বললে তোর গায়ে হিসু করে দিব!
তুই আমাকে শুধু শুধু গালি দিলি কেন?
তুই আবারও কথা বলিস! বলে নজু পাগলা শোয়া থেকে ওঠে দাঁড়াল। তারপর লুঙ্গিটা তুলে তুষির দিকে মুখ করে শকশকিয়ে প্রস্রাব করে দিল।
ধুর ধুর, বেহায়া। বলে কয়েক কদম পিছিয়ে দাঁড়াল তুষি।
৩.
রাত গভীর। দরজায় ঠকঠক করে টোকা পড়ল। চিরচেনা টোকা। এখনও সজাগ নারীটি। ঘুমায়নি। বোধহয় এ টোকার অপেক্ষা করছিল। শোয়া থেকে নিঃশব্দে ওঠে আস্তে করে দরজাটা খুলে দিল সে। পুরুষটি রুমে ঢোকার সাথে সাথে দরজাটা লাগিয়ে দিল। পুরুষটি তার মুখোমুখি দাঁড়াল, তার গালে হাত দিল।
আমাকে যদি তোমার এতোই প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাকে বিয়ে করে ফেলছো না কেন? হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল নারীটি।
করবো, করবো। আমাকে একটু টাইম দাও, প্লিজ।
আমি খুব ভালো করেই জানি, তুমি আমাকে কখনোই বিয়ে করবে না।
বাজে কথা বলিও না তো।
মোটেও বাজে কথা বলছি না। তোমার স্ত্রী অক্ষম, তাই আমাকে তোমার প্রয়োজন। সহজ ভাষায়, আমি শুধুই ভোগের বস্তু তোমার ।
শেষের কথাটি শোনার সাথে সাথে মেজাজ হারাল পুরুষটি। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে নারীটির নাকে একটা ঘুসি মেরে দিল। নাক ফেটে ধরধরিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। তীব্র ব্যথার সত্ত্বেও আর্তনাদ করে ওঠেনি নারীটি। দু’হাত দিয়ে নাকটি চেপে ধরল শুধু।
সকালে পুরো বাড়ি হলুদ ফিতা ঘিরে দিয়েছে পুলিশ। ফিতায় বড় বড় হরফে লেখা- CRIME SCENE DON’T CROSS
তুষি খুন হয়েছে। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। খুনের দায়ে তমোহরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, ঠান্ডা মাথায় কীভাবে তুষিকে খুন করেছে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছে সাংবাদিকরা। কিন্তু খুনের বিষয়ে কিছুতেই মুখ খুলছে না তমোহর। এ বিষয়ে কথা বলতে একেবারেই অনিচ্ছুক সে। মুখ না খোলায় পুলিশ তাকে বারবার ধমকাচ্ছে। ওসি সাহেব তো রাগের মাথায় বলেই ফেলেছেন, এখন বলছিস না ঠিক আছে। দুইদিন পর যখন কোর্ট থেকে চৌদ্দ দিনের রিমান্ডে আনবো, তখন ঠিকই ঘড়ঘড় করে বলে দিবি!
৪.
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় নিরমিনের। বুকের ওপর পাথরের মতো ভারি কিছু একটা অনুভব করল সে। বুকটা ধুকপুক করে উঠল। চিৎকার দিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসতে চাইল সে। কিন্তু পারল না।
নজু তুই?
হ, আমি। নজু পাগলা!
নিরমিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। পঙ্গু শরীরটা কিছুতেই নজু পাগলার সাথে পেরে উঠল না। চিৎকার দিতে চাইল সে, কিন্তু দিল না। চিৎকার দিয়ে কোনো লাভ নাই। কারণ আশেপাশে কোনো বসতি নেই। ছেঁড়াদ্বীপে এ মুহূর্তে তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই!
তুষি মাগিরে একদম ঘাড়ে এককোপ দিছি। বলে খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে উঠল নজু পাগলা।
তার কথা শুনে আকাশ থেকে দুম করে যেন মাটিতে পড়ল নিরমিন।
ওই হারামজাদা, বলিস কি!
ঠিকই বলছি।
তুষিকে তুই খুন করেছিস?
হ, আমি খুন করেছি।
মেয়েটারে খুন করলি কেন? ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল নিরমিন।
এই মেয়ে তো একটা বেশ্যা। তোর স্বামীর সাথে রাতে ঢলাঢলি করতো। আমি নিজ চোখে অনেকবার দেখেছি। আর তোর স্বামী তো একটা প্রতারক, ভণ্ড। সে দিনের পর দিন তোকে ঠকিয়েছে অথচ তুই টেরও পেলি না।
কথাগুলো বলে আবারো খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে উঠল নজু পাগলা।
====================