যেভাবে পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ
আলী সিদ্দিকী
আমার একলাপনার যৌবনে সাগর সেনের ভরাট গলার রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে বিপুল শূন্যতার প্রহর পূর্ণ করার এক নেশায় মেতেছিলাম। নিকটতম সহস্রোতা ছিলো বন্ধু অরুণ। মূল বাড়ি থেকে দূরে পুকুরপাড়ে পথের ধারে আমাদের বাংলাঘর। ইতিহাসের অনেক ঘটনার সাক্ষী বাংলাঘরটিতে শেষবারের মতো আমার রাজত্ব কায়েম হয়। হল্লা করে আড্ডা দিয়ে, ক্যারম, দাবা খেলে আমরা মেতেছিলাম। কেউ কেউ প্রেম করছে, কেউ কেউ দাগা খাওয়া প্রাণে মান্না দে’র প্রলেপ দিচ্ছে। আর ডি বর্মনে মগ্ন থাকছে। এই চরম যৌবনোত্তাল সময়ে আমার ভালো লাগার বিমুগ্ধতা নিয়ে আগমন ঘটে রবিবাবুর। তখন ইন্টার শেষ করেছি। হাইস্কুলে শুকতারাকে ভালো লেগেছিলো। এসএসসি শেষে বিয়ে করে চলে গেছে সিলেটে। তখন একে ওকে ভালো লাগে কিন্তু কোথাও দাঁড়ানোর তাড়া নেই। তবে শরৎ পড়ে, মানিক পড়ে, রমাপদ চৌধুরীর “বাড়ি বদলে যায়” আর .”খারিজ” পড়ে আমার ভেতর যে ভাঙচুর শুরু হয় রবীন্দ্রসংগীত তাতে কোমল পরশ বুলিয়ে দেয়। আমি যেন নিজেকে নতুন করে চিনি। সকল দস্যিপনা ছেড়ে গোগ্রাসে বইপড়া আর রবীন্দ্রসংগীত শোনায় আমার অবসর ভরে উঠে। শুরু হয় ক্যাসেট সংগ্রহ করা। অরুণও নিয়ে আসতো। দেবব্রত বিশ্বাস,বন্যা, হেমন্ত থেকে শুরু করে কিশোর কুমার চলে আসেন আমার মনোজগতে। ট্রানজিস্টারে উচ্চস্বরে গান শোনা আর ঠোঁট মেলানোতেই আমার আনন্দ।
আমার পাড়াপড়শি সমবয়সী বন্ধুরা, বড় ভাইয়েরা টিটকারি করে, কিরে হোমোপ্যাথি গানে তুই কি মজা পাস?
আমি মৃদু হেসে সরে যেতাম। ওদের বোঝাতে যাওয়ার কোনো অর্থই হয়না। ওরা চটুল বাংলা নইলে হিন্দি শুনবে। এটাই ওদের বিনোদন।
রবীন্দ্র সুরের আবহে আমার অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজে পায় রবীন্দ্র সাহিত্যের অপরিসীম রত্নভাণ্ডার। রবীন্দ্রনাথের বিপুল সাহিত্যভান্ডারে আমি ডুবে যাই। গীতিকার রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে আমি তাঁর কবিতা গল্প উপন্যাসে মুগ্ধ হয়ে যাই। বাঙালী জাতীয়তার চেতনাবোধ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার প্রাক্কালে। তবে সিটি কলেজে থাকতেই একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ধর্মীয় রাজনীতি যারা করে তারা রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করে না। আমার বন্ধু আশীষ দত্ত ভাষা আন্দোলনের উপর কিছু বই পড়তে দেয়। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে পাঠ্যক্রমের বাইরে তেমন পড়াশোনা আমার ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদররা বাঙালী নিধন করেছে চরম আক্রোশে এবং এদের পূর্বসূরিরাই উর্দু হরফে বাংলা লিখতে চেয়েছে এবং তৎকালীন পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছিলো। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি কৌতূহলী মন রবীন্দ্র পাঠে যতো নিবিড় হয়েছে ততোই নিজেকে বাঙালী জাতিসত্তার অংশভাগী হিসেবে আবিষ্কার করেছি। জাতিসত্তার উপর যতোবার বিজাতীয় অপসংস্কৃতি হামলে পড়েছে ততোবারই রবীন্দ্রনাথকে অপরিহার্য উজ্জীবক হয়ে উঠতে দেখেছি।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেখেছি এলাকায় এলাকায় তুমুল ধর্মীয় মাতামাতি শুরু হয় এবং বাঙালির সংস্কৃতি, লোকাচার, লোকজ সংস্কৃতিকে চরম অবহেলার শিকার হতে হয়। স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে এই অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। জিয়ার জাতীয়তাবাদী মাস্তান ছাত্রদল, এরশাদের খুনী ছাত্রসমাজ আর স্বাধীনতাবিরোধী হিংস্র ছাত্রশিবির দেশব্যাপী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র-শিক্ষকরা কোনোরকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে না। রগকাটা আর গলাকাটার মহোৎসব চলছে দেশব্যাপী। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো ক্ষুদ্রাকারে প্রয়াস চালাতে গিয়ে সর্বত্রই আক্রান্ত হচ্ছে। তখন আওয়ামী ছাত্রলীগও ত্রিমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বামপ্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি আন্দোলন সংগ্রামে নিজেদের সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় হয়। এসব আন্দোলন সংগ্রামে ভূপেন হাজারিকা, গণসংগীত যেমন উদ্দীপকের কাজ করেছে তেমনি ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রনাথের গান কবিতা জংধরা জাতীয় চেতনাকে উজ্জীবিত করেছিলো।
কিন্তু আজো রবীন্দ্রনাথ বাংলায় নিরাপদ নন। যে আওয়ামীলীগ গণতন্ত্রের লড়াই সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় নিয়েছিলো সেই আওয়ামীলীগ ধর্মীয় মৌলবাদের সাথে আঁতাত করে জিয়া এরশাদ এবং তাদের পূর্বসূরি তমুদ্দুনওয়ালাদের মতো বাংলাকে আরবিকীকরণে তৎপর হয়ে উঠেছে। শিক্ষা পাঠ্যক্রম থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দিয়ে শিক্ষাকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হচ্ছে। বাঙালী জাতিসত্তার অস্তিত্ব মরুভূমির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বিপন্ন হয়ে উঠছে। এই বিপন্ন জনপদে ত্রাতা রবীন্দ্রনাথ এখনো তীব্রভাবে অপরিহার্য- লড়াইয়ে, উৎকর্ষে, স্বকীয়তায় এবং মননশীলতায়।