You are currently viewing যুদ্ধশিশু রুহি/ রুখসানা কাজল

যুদ্ধশিশু রুহি/ রুখসানা কাজল

 

 

যুদ্ধশিশু রুহি

রুখসানা কাজল    

দ্রুত খাতা কাটছিল রুহি। যত শিঘ্রি সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে।

আম্মুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না কদিন ধরে। অতবড় ফাঁকাবাড়িতে আম্মু প্রায় একাই পড়ে থাকে। নিম্নবিত্ত দুএকজন ভাড়াটে বসাতে চেয়েছিল রুহি।  লোকজন থাকলে খানিক দেখাশুনা করতে পারবে। বিপদে আপদে দেখাশুনা করতে পারবে। কিন্তু আম্মু রাজি হয়নি। রুহির উদ্বেগ দেখে ম্লান হেসে আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, এই তো ভালো আছি রে। কী হবে মানুষজন দিয়ে ! আমার আর মানুষজন ভালো লাগে না রে রাহি। আই হেট মানুষজন !

বড়  দুই  বোন ঢাকায় আর ভাইয়া থাকে বিদেশে । স্থানীয় গার্লস ইশকুলে শিক্ষকতা করে রুহি। এই  ইশকুলের ছায়ার সাথে পা  মিলিয়ে হাঁটতে ওর খুব ভালো লাগে। একাত্তরের কোন এক দুপুরে এ ইশকুলে ধর্ষিতা হয়েছিল ওর আম্মু। সেদিন একটি অনিচ্ছুক জরায়ু কিছুতেই চায়নি একটি ঘৃনার ভ্রুণকে  ঠাঁই দিতে। তবু জন্মেছিল সেই শিশু।

কখনও কখনও ইশকুলটাকে তাই ওর আসল মা বলে মনে হয়।

ভাইয়া খুব চেয়েছিল ওকে বিদেশ নিয়ে যেতে। কিন্তু এই শহর ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না রুহির। তাছাড়া ওর কত কাজ রয়েছে। কয়েক দিন না দেখলে সান্ধ্য ক্লাশের ছিন্নমূল শিশুরা দল বেঁধে ওর বাড়িতে চলে আসে।  তাদের কত রকমের জিজ্ঞাসা, উৎকণ্ঠা, অনুযোগ ভালোবাসা ! ওদের দেখলে আম্মু বেশ হাসিখুশি থাকে। এটা সেটা খেতে দেয়। পড়তে বলে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার উপদেশ দেয়। কাউকে কাউকে তো সাথে সাথে সাবান শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে তবে ছাড়ে। আম্মুকে তখন কি যে মিষ্টি লাগে দেখতে। ভাইয়া আপুরা গল্প করেছে উনসত্তুরে আম্মু নাকি মিছিলের প্রথম সারির মুখ ছিল। গান গাইত উত্তাল দেশপ্রেমের।

রুহির আব্বু নামের লোকটা মারা গেছে সে অনেক বছর আগে। মাঝে  মাঝে বোনেরা বেড়াতে  আসে। সে দিনগুলোতে বাসা ভরে ওঠে খুশি ও আনন্দে। বোনদের কাছে পেলেই আম্মু কাঁদতে শুরু করে। কেঁদে কেঁদে ওর নামে নালিশ করে। রুহি হাসে। বোনেরাও মুখ লুকিয়ে হাসি কন্ট্রোল করে। আম্মু বুঝতে পেরে রেগে যায়। কয়েক ঘণ্টা খাওয়া আর কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সে এক বিরাট ছেলেমানুষি অবস্থার সৃষ্টি হয় বাসায়। জোলেখা খালা তখন বকেঝকে ওদের তিন বোনকে শুধু মারতে বাকি রাখে। আবার চুপিচুপি খালা  ভাইয়াকে জানিয়ে দেয় আম্মুর অভিমানের কথা।

সন্ধ্যায় আম্মুর সাথে কথা বলে ভাইয়া। আম্মু তখন শর্ত দেয়, রুহিকে বিয়ে করতে রাজী হতে হবে তবে সে খাবে। রুহি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে শর্ত মেনে নেয়। ওর আম্মুকে শুনিয়ে প্রতিজ্ঞা করে বিয়ে সে করবে। তবে তোমার বাড়িতে আর থাকবো না কিন্তু আম্মু !

সে সব সন্ধ্যায় চায়ের গন্ধ আর গানের সুরে বাড়িটা গমগম করে ওঠে। রুস্তমদা তার উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর বন্ধুদের নিয়ে চলে আসে।  রুহির  ছিন্নমূল  ইশকুলের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে দেশের গান শোনে। মাথা নেড়ে তাল দেয়। গলা মেলায়। রুহির তখন মনে হয় বেশ আছে সে। কি দরকার  এই প্রায় চল্লিশে বিয়েশাদি করে সংসার করার !

যাওয়ার সময় নরম হেসে বোনেরা রুহিকে বলে, আচ্ছা তুই কী সত্যি বিয়ে করবি না ? অমন ভালোবাসার মানুষ তোর ! আরেকবার ভেবে দেখ না সোনাবোন আমাদের !

রুহি অন্যকিছু ভাবে। ভেবে মনে করার চেষ্টা করে আব্বু নামের লোকটির   চেহারা। ঠিক মনে পড়ে না। তবে ভাইয়াকে দেখলে কেমন যেনো আব্বু  আব্বু মনে হয়।  ভাইয়ার মন যেনো মহাসাগর। কি ভালো যে বাসে রুহিকে ! চেহারায় যত মিল থাকুক আব্বু নামের লোকটা ভাইয়ার মত স্নেহময় ছিল  না। আব্বু ওকে কখনো কাছে ডেকে নেয়নি। আদর করেনি। এমনকি কোনোদিন কোন কথাও বলেনি ওর সাথে। রুহি কাছে গেলে নিজেই কাজের অজুহাতে নীরবে সরে গেছে।

ছোট বেলায় আব্বুর কাছে ছুটে ছুটে গেলে ভাইয়া আর তনু আপু ওকে  সরিয়ে নিয়ে যেত। এটা সেটা দিয়ে ভুলিয়ে দিতে চাইত। মেজপা বনি ছিল খুব মুখরা। আব্বুকে শুনিয়ে রুহিকে আচ্ছা করে কান মলে দিয়ে সাংঘাতিক বকে দিত, রুহি খবরদার। তুই আব্বুর কাছে যাবি না। কখনো যাবি না। এই আব্বুটা ভালো না। পচা আব্বু। আর রাক্ষসও। মানুষ খেয়ে ফেলে। তুই কাছে গেলেই হালুম করে গিলে ফেলবে বুঝেছিস সোনাই।

একটু বড় হতে রুহি দেখেছে আব্বু আর ভেতর বাড়িতে আসে না, খায় না , থাকে না। সারা দিন সামনের অফিস ঘরে মক্কেল সামলে রাতে ঘুমোয়  অফিস ঘরের ছাদের ছোট্ট রুমে।

আস্তে আস্তে সবার থেকে দূরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল আব্বু নামের নির্লিপ্ত অথচ নিষ্ঠুর রাজাকার লোকটা।

কোনো কোনো দিন ইশকুলে যাওয়ার পথে রুহি দেখতে পেতো, আব্বু লোকটা কালো মাফলারে মাথা ঢেকে অফিসের চেয়ারে বসে দোকান থেকে আনা নাস্তা খাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে আমানত চাচা।  আমানত মুন্সি বাবার মুহুরি। বহুদিনের পুরনো মানুষ। বাবার খুব কাছের লোক। গ্রাম সম্পর্কে কেমন আত্মীয়। আমানত মুহুরিকে রুহি দুচোখে দেখতে পারত না। ওর  মনে হত, আব্বুর চাইতেও খারাপ এই লোকটা। আব্বু যে তাকে ভালোবাসে না তার কারণ এই আমানত মুন্সির কুবুদ্ধি। শকুনের মত সারাক্ষণ গলা বাড়িয়ে থাকে। এমন বিশ্রি চোখ রুহি আর কোথাও কারও দেখেনি।

ক্লাশ সেভেনে নতুন ক্লাশে ভর্তি হয়ে বাসায় ফিরছে রুহি। অফিস ঘরের দরোজায় দাঁড়িয়ে আমানত মুহুরি ডাক দেয়, অ রুইই, রুইই ভরতির কাগজখান দেও ত দেখিন।

ভর্তির কাগজ, বেতনের রশিদ হাতে নিয়ে সেকি হাসি শয়তানটার। রুহির ইচ্ছা করছিল লাত্থি মারতে। এমনিতে রাস্তা ঘাটে কোথাও দেখা হলেই রুই রুই মাছ করে ডাকে। লোকটাকে অসহ্য লাগে রুহির। এই লোকটা যে কি করে মনসুরের মত ভালোমানুষের আব্বু হতে পারে ভেবেই পায় না সে।

কাগজগুলো ফেরত দিয়ে পচা চোখে রুহিকে দেখে সেদিন আমানত মুহুরি  বলেছিল, ইস্যিরে ! আবার বাপের নাম লেখা হইছে নাহিদ  মির্যা !

দু’ সিঁড়ি নীচে নেমে হিসহিস করে ওঠেছিল, গরীবের ছাওয়াল বলে  সংসার ছাড়ি যাতি পারতিছে না । তাই তোর মত মিলিটারির মাইয়ের বাপ হতি হচ্ছে নাহিদ মির্যাকে। থুঃ থুক তোরে—

পান খাওয়া লাল থুথু দেখে শিরশিরিয়ে ওঠেছিল ওর মন। আচমকা কেঁপে গেছিল শরীর। ফণা উদ্যত সাপের সামনে অসহায় রুহি আমানত মুন্সিকে ঘৃণায় জারিয়ে দিতে গিয়ে কেঁপে ওঠেছিল, সে কে ? কে সে, কার মেয়ে রুহি ? তবে তার আব্বু কে ?

কথাটা তখনো ভাল করে বোঝেনি রুহি। কিন্তু ক্লাশ নাইনে ওঠে বুঝে গেছিল, সে একজন যুদ্ধশিশু।

শ্বশুরের দানে বড়লোক উকিল নাহিদ মির্যা তার জন্মদাতা পিতা নয়। কোন  এক পাকিস্তানী সৈন্যর সন্তান সে । সেই থেকে রুহি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। পড়াশুনা, ইশকুল, বাসা আর বই।

ছোটবেলায় দেখেছে আব্বু তার নিজের তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে গ্রামে বেড়াতে যেত। আর রুহিকে নিয়ে ওর আম্মু চলে আসত ওদের মামাবাড়ি।  তনুবনু আপুরা ইশকুল পাশ করে কলেজে যেতেই আব্বুর সাথে আর দাদাবাড়ি যেতে চাইত না। ভাইয়াও বলে দিয়েছিল, সে আম্মুর সাথে  মামাবাড়ি যাবে। আরও বড় হয়ে রুহি নানুবুজির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল একাত্তরের সেই ঘটনাকে।

একাত্তুরের কোনো এক গরমের দুপুরে যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখাতে  ইশকুল খোলা রেখেছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। ওদের বাসা থেকে দু পা হেঁটে গেলেই গার্লস ইশকুল। সেদিন ইশকুল ছুটির পর তনু আর বনি আপুদের বাসায় পাঠিয়ে বান্ধবি ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস আর অন্য একজন শিক্ষিকার সাথে গল্প করছিল আম্মু।

এমন সময়  মিলিটারি জীপে করে চারজন সৈন্য এসে ইশকুলের হেডমিস্ট্রেসের সাথে দেখা করতে চায়। চারজন সৈন্যই ছিল অল্প বয়সি। টগবগ ফুটছে। হেডমিস্ট্রেসের সাথে কথা বলে কি একটা কাগজ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল। এসময় চোখ পড়ে রুহির আম্মুর উপর।

বান্ধবীদের ভেতর সব চে সুন্দরী, প্রায় মোমরঙের শরীর ছিল ওর আম্মু নার্গিস আক্তারের। খুবই  সরল সহজ নিস্পাপ কিছুটা কমবুদ্ধির শিশুর মত ছিল। তিন ছেলেমেয়ের সাথে গাইড বুক দেখে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করত, তানু ডোন্ট টাচ বালি। রেইন নামছে, ওয়েট হয়ো না। কিপ ড্রাই।

ভুল  ইংরেজি বলা স্মার্ট, সুন্দরী আর সুখি মহিলা ছিল নার্গিস আক্তার। বিত্তশালী বাবা ভাইরা গরীব ঘরের শিক্ষিত ছেলের সাথে নার্গিসকে বিয়ে দিয়ে নিজেদের আওতায় রেখে দিয়েছিল।

কালো মত সৈন্যটা যে ছিল চারজনের ভেতর সবচে বড় আর সিনিয়র সে নার্গিস আক্তারকে দেখে থমকে যায়। তারপর রাইফেল উচিয়ে ফায়ারের ভাব দেখাতেই দারোয়ান জলিল ছুটে পালিয়ে যায়  ইশকুলের বাগানের ভেতর। হেডমিস্ট্রেস বাঁধা দিতে গিয়ে নিজেও ধর্ষিত হয়। ধর্ষিত হয় সেই শিক্ষিকা বান্ধবীও।

রুহি বোঝে অই কালো সৈন্যটাই হচ্ছে ওর জন্মদাতা। ওকে দেখলে আম্মু কেমন ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। যেদিন মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে থাকে রুহি কাছে যায় না। হাতের  কাছে যা পায় তাই ছুঁড়ে মারে রুহির দিকে আর চেঁচায়, মেরে ফেলো মেরে ফেলো। সি ইজ নট মাই ডটার। দ্য বাস্টার্ড। জোলেখা জোলেখা!  নুন ঢেলে দে ওর মুখে। কিল হার। নাউ এন্ড জাস্ট নাউ।

জোলেখা খালা আম্মুর বাপের বাড়ি থেকে সেই কবে আম্মুর বিয়ের সময় সাথে এসেছে। মায়ার শরীর। বড় স্নেহবতী মানুষ। গার্লস ইশকুলে আয়ার চাকরি করে। এতগুলো বছর আম্মুকে খালাই সামলে রাখছে। আর রুহিকে কিছুতেই মরতে দেয়নি। হাত আঁকড়ে ধরেছিল, যখন নুন খাইয়ে রুহিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল নানুবুজি। সেই যে আঁতুড়ঘর থেকে বুকে তুলে নিয়েছে রুহিকে এখনো বুকে তুলে রেখেছে।

একটা বয়স পর্যন্ত রুহির খুব ইচ্ছা করত পাকিস্তান গিয়ে লোকটাকে খুঁজে বের করে খুন করে  আসতে।

কিন্তু কি করে চিনবে ? আম্মু তো কিছুই বলতে পারে না। তাছাড়া আম্মুর মাথাও ঠিক নেই অই ঘটনার পর থেকে। স্বামীকে দেখলেই চেঁচিয়ে মারতে  আসত। চেঁচিয়ে বলত, দালাল দালাল। ইউ রাজাকার ! তুমি বলেছিলে পাকিস্তানীরা মোর গুড দ্যান বাঙ্গালী। নাউ কি ঘটলো ? রুস্তম, রুস্তম ফায়ার হিম। হি  ইজ দ্যা গ্রেট রাজাকার। কিল হিম। আগুনে পুড়িয়ে দে শয়তান রাজাকারটাকে।

রুস্তমদা আম্মুর ভাইয়ের ছেলে। যুদ্ধের পর একমাত্র ফুপির এমন অবস্থা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে উকিল ফুপাকে বলেছিলো, আমি মুক্তিযোদ্ধা হলে সে সময় আপনাকে গুলি করে মারতাম।পাকিস্তানচাটা রাজাকারের বাচ্চাকে আমি কিছুতেই বাঁচতে দিতাম না। সুযোগ পেলে আপনাকে আমি কঠিন শাস্তি দেব।

কিন্তু আব্বুটা বেশিদিন বাঁচেনি। গ্রামের বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় ফেরার সময় ট্রলার থেকে পড়ে গেছিল নদীতে। খেয়াল করেনি অন্যেরা। কিম্বা খেয়াল করলেও ঘৃণায় তুলে আনেনি। একাত্তরে যেভাবে অগণিত লাশ ভেসে যেত  সেভাবেই ভেসে যাচ্ছিল। এক মাঝি টেনে তুলে হাত ঝাড়া দিয়ে বলেছিল, আল্লাহপাক ঠিক শাস্তিই দিয়েছে। কত মানুষের যে ক্ষতি করিছে এই রাজাকার লোকটা !

থানা পুলিশ হয়নি। রুস্তমদা শুনেই চলে এসেছিল বাসায়। শক্ত করে  গেট লাগিয়ে দিয়ে ভাইবোনদের বলেছিল, এ লোকটার জন্যে হাজার বছর ধরে আমাদের গঞ্জনা সইতে হবে। আয় আজ থেকে আমাদের প্রায়শ্চিত্ত শুরু হোক।

খাতা দেখা শেষ করে টেবিল গোছাচ্ছে রুহি। ফাঁকা ইশকুল। আয়া দারোয়ান ছাড়া সবাই চলে গেছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ জোলেখা খালা এক কাপ চা এনে সামনে দাঁড়ায়। খুশি হয়ে যায় রুহি, খালা চা দিলা যে। কিছু বলবা ?

খালার মুখ বেজার, মনসুর আইছে। দেখা করতি চায়।

তরঙ্গ বয়ে যায় রুহির মনে। এতক্ষণ যে তাড়া ছিল বাসায় যাওয়ার তার বদলে মনসুরের সাথে দেখা করার ইচ্ছাটা তীব্র হয়ে ওঠে, পাঠায় দেও। আরেক কাপ চা দিও খালা প্লিজ !

ইতস্তত করে জোলেখা। কিছু বলতে চায় রুহিকে। সামান্য আয়া সে। কিন্তু রুহির আম্মুর অনেক কাছের মানুষ । রুহিকে সে কোলে পিঠে করে বড় করেছে। জন্মের পর রুহিকে মেরে ফেলবে নাকি বাঁচিয়ে রাখবে তাই ভাবতে ভাবতে ওর মা কেমন পাগল হয়ে গেলো। সেই সময় রুহিকে সেই তুলে নিয়েছিল বুকে। বড় ভালো মেয়ে রুহি। এই মনসুরের পাল্লায় পড়ে জীবনটা গেছে মেয়েটার। আজও  দুজনের কেউ বিয়ে করেনি। সমাজসেবা করে করে মনসুর হইছে এক পাগল ছাগল মানুষ। বছর বছর কতগুলো মেডেল এনে ঘরে  জমা করছে আর রাস্তার ছেলেপেলে কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তার সাথে রুহিও পাগল হয়ে গেছে। মনসুরের কথায় মরণ বাঁচন।

গজগজ করে জোলেখা, তোমরা কি বিয়ে করবা না ? আর কতদিন !

রুহি এবার জোরে হেসে ফেলে, খালা বিয়েটাই কি সব খালা?

তয় ? মাইয়া মানুষ না তুমি !

মাইয়া মানুষ হইলেই বিয়ে করতে হবে কে বলেছে তুমারে? এইই  ভাল আছি খালা। অন্তত কিছুটা ত মানুষের উপকারে লাগছি।

মনসুর ঢুকে পড়েছে টিচার্স রুমে। আমানত মুহুরির এই ছেলেটা অন্যরকম। বড় সুন্দর দেখতে। মায়াভরা দুটি চোখ। লোকে  বলে পাজির ঘরের হাজি। রুহির সাথে বিয়েতে আপত্তি করায় আমানত মুহুরিকে ছেড়ে উঠে গেছে  অন্য খানে। রাস্তার শিশুদের নিয়ে দিনরাত এক করে দিচ্ছে দুজনে। তাদের লেখাপড়া করানোর সাথে সাথে দেশ, মানুষ আর এই বুড়ো পৃথিবীর সঠিক ইতিহাসটাও নাকি জানাতে হবে। বিয়েশাদি ঘর সংসার সবকিছু ছেড়ে এটাই নাকি ওদের একমাত্র কর্তব্য। জোলেখা মনে মনে প্রচুর রাগ হয়।

প্রতিবারের মত লাল সবুজ শাড়ি হাতে মনসুর রুহির সামনে বসে গপ্‌ করে চা টা খেয়ে ফেলে। আন্তরিক রাগে মনসুরের জন্যে আনা চা  ঠক করে রেখে চলে যেতেই জড়িয়ে ধরে মনসুর, খালা ও খালা আমার সোনা খালা তুমিই তো আমার মা সত্যি কিনা বল খালা! আচ্ছা আজকেই আমরা বিয়ে করব তুমি খুশি ?

জোলেখার রাগ গলে চোখ ভেসে যায়। রাগতে গিয়েও কেঁদে ফেলে জোলেখা। জলে মেশা   স্বপ্নগুলো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে গাল বেয়ে।  কত বছর ধরে সে একটা সোনার চেন আর আংটি লুকিয়ে রেখেছে। মনসুর হোক আমানত মুহুরির ছেলে। সে তো রুহিকে ভালবাসে। আহা সোনা বাচ্চারা আমার! আন্তরিক মায়ায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

রুহি অবাক হয়, এই মনসুরা, তোর মাথামুথো ঠিক আছে ত ?

একদম ফিট। টেবিলের উপর ঝুঁকে মনসুর নরম হয়ে বলে, চল রুহি বিজয় দিবসকে আমরা গেঁথে নিই আমাদের জীবনের সাথে!

রুহির বুক কেঁপে উঠে, ক্লাশ নাইন, ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের  অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে রুহিকে ফিরিয়ে দিয়েছিল গেম মিস। ভূগোল মিস কেমন হেসে ফিসফিসিয়ে পাশের মিসকে বলেছিল, মিলিটারির মেয়ের সখ কত ! জাতীয় সঙ্গীত গাইতে চায় !

মনসুরের কথা শুনে ওর বুকের ভেতর সুরে সুরে উড়ে আসে ভ্রমর। পাখনার ভাঁজ খুলে তারা দুলে  দুলে ওঠে । আর রুহির মন গেয়ে ওঠে, অনেক অনেক দিনের অনেক আবেগে জমিয়ে রাখা সেই পূণ্য সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি—

জোলেখা খালা জড়িয়ে ধরে রুহিকে। মনসুর উঠে আসে। দীর্ঘ দুহাতে  দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলে, চল্‌ রুহি, খালা চলো আমরা আম্মুর কাছে আগে যাই।

—————————————-

রুখসানা কাজলঃ গল্পকার