You are currently viewing যাপন ও উদযাপনে রবীন্দ্রনাথ > বদরুজ্জামান আলমগীর

যাপন ও উদযাপনে রবীন্দ্রনাথ > বদরুজ্জামান আলমগীর

যাপন ও উদযাপনে রবীন্দ্রনাথ

বদরুজ্জামান আলমগীর

রবীন্দ্রনাথের দ্বিধা বিবেকানন্দের চাঁদমারি

ভারতের বাইরে এসে বার দুনিয়ায় বহুবার কথা বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, একইভাবে অনেকবার বক্তৃতা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দুজনই ভারতের বাতি, হিমালয়ের উচ্চতা; কিন্তু তাঁদের দুজনের ভার ও ক্ষিপ্রতা অনেকটাই দুরকম।

রবীন্দ্রনাথ প্রধানত বলতেন পশ্চিমের জাতীয়তাবাদের বিপদের কথা, স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন তাঁদের ধর্মের প্রাণহীনতার কথা, এবং তিনি পূর্ব-পশ্চিমের খণ্ডবিখণ্ডতার জায়গায় এক ইউনিভার্সাল গহন ব্যক্তির প্রকল্প হাজির করতেন।

ভারতীয় এক নিবিড় আঁতুড়ঘরে বিবেকানন্দের এই আধুনিকাধ্যাত্মিক ব্যক্তিটির জন্ম হয়- যে পরিপূর্ণ মানুষচরিতের কথা পশ্চিমের জানা নেই; কেবল তাঁরই অধিকারে আছে মৃতবৎ পশ্চিমের আরোগ্যের দাওয়াই।

অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ সংশয়ের বরপুত্র, তিনি নিশ্চিতকরে কিছুই জানেন না- না অহং, না ভারত, না পশ্চিম, না পুব। তিনি কেবল অনুভব করেন মনের অধিক মননে, আবার মননাধিক প্রাণে আকাশভরা সূর্য-তারা অফুরান কথা বলে।

মাঝখানে চারপাশ চাহিয়া দেখিয়া আমাদের মনে হয়- যে প্রকল্প নির্মাণাধীন তাহাই পরিপূর্ণ, কেননা আমরা যতো না বাস করি বাস্তবে, তার অধিক রহি আশা আর বাসনার ওমে; বোধকরি জীবনও ভাষাসদৃশ- কোনদিনই তা পরিপূর্ণ নয়, কেবল নিত্য নিত্য নির্মাণাধীন।।

ব্যক্তির পূর্ব-পশ্চিম

তার আগে প্রথমেই বাতিল করে নিই সেই পুরাতন কূটচাল : জলের উপর পানি না-কী পানির উপর জল; তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতিসত্ত্বার ভিতরমহলে আলো ফেলে আমাদের জন্য তুলে আনেন সহজ প্রণম্য সারবস্তু যে অর্থ করে এক ও অদ্বিতীয় – সত্য ঘোরনিষ্ঠা- প্রিয়তম জীবনসুষমার জয়ধ্বনি আর কলকাকলি; হীনমন্যতার সাধ্য কী মুহূর্তলাগি কালি ফেলে জীবনমাধুরী পটে।

মিথ্যা আর পুরাতন গ্লানির ক্ষমতা-ই নেই পথ আটকে দাঁড়ায় আনন্দকল্যাণ অভিযাত্রার মুখে- তিনি রবীন্দ্রনাথ জাদুকরি হাতের স্পর্শে আমাদের ভাষায় প্রতিষ্ঠা করেন নোতুন প্রাণের উৎসার, হৃদয়ের যতকথা মেঘ ও রৌদ্রের কলহাস্যে গুঞ্জরণ করে, দুঃখ ফোটে বসন্তদিনের নিদারুণ কল্লোলে; যে-ভাষা চমকায় প্রকৃতির সহজিয়া বিস্তারে, তিনি সেই ভাষায় মন্ত্র শোনান পাশ্চাত্য অন্ধগতির কানে কানে।

জাতীয়তাবাদী গণ্ডারী ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা ব্যক্তিকে তিনি দেখতে চান সহমর্মিতা আর সংবেদের মনকড়ায় বন্দীবিলাসে মুক্ত;  রবীন্দ্রনাথ চান প্রাণহীন পশ্চিমা ক্ষিপ্রতার গোঙানির জায়গায় ফুটে উঠুক মননের গৌরব, প্রাচ্যের স্থবির সংস্কারে চনমনিয়ে উঠুক গতির টঙ্কার, মর্যাদাবান ব্যক্তির বলিষ্ঠ জাগরণ তাঁর সর্বৈব সাধনা- তাই আজো কে থাকে ঘুমের ভিতরে নিষ্প্রাণ জড়, তাঁর আমূল সুরে ও প্রাণে চিত্তের মিলনযাত্রায় অর্ধব্যক্তিরা আড়মোড়া ভাঙে, নিসর্গও কাতরায় বুঝি প্রত্যুষের দিকে-

একাএকা মর্মরধ্বনি জাগে মনে ও মেঘে, ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় তাহারই চিহ্ন পড়ে!

 

রবীন্দ্রনাথের ইমাম মেহেদি

সভ্যতার সঙ্কট লেখাটায় রবীন্দ্রনাথকে বেশ বিচলিত লাগে। মাঝেমাঝে নিজের প্রতি তাঁর ক্ষুব্ধতাও আমাদের চোখ এড়ায় না। তিনি যে ইংরেজকে আশীর্বাদ মনে করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল ইংরেজি সাহিত্যপাঠ। সাহিত্যপাঠের ভিতর দিয়ে তাঁকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছিল- পঠন পাঠনে তাঁর কাছে ইংরেজদের মনে হয়েছিল আশার বাণী, মুক্তির দূত।

আমরা দেখি তিনি এখানে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই মুসলমানদের প্রসঙ্গ টেনে কথা বলেছেন,বারবার বলছেন। সোভিয়েত দেশে মুসলমান, পারস্যের মুসলমান প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সভ্যতার সঙ্কটে বারবার মুসলমান প্রশ্নটি এমনভাবে এনেছেন- যারমধ্যে একটা তাড়াহুড়ার প্রশ্রয় আছে।

এখানেই দেখা যাচ্ছে, ইংরেজকে তিনি খ্রিস্টান বলছেন।পুরো ব্যাপারটি দেখে অনুমান করা যায়, মুসলমান প্রশ্নে তাঁর মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল।

একইরকম অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ গল্প- মুসলমানীর গল্প- যা মৃত্যুর ৬সপ্তাহ আগে লেখা হয়েছিল; ঠিক লেখা হয়নি- তিনি বলেছিলেন, যার শ্রুতিলিখন করা হয়েছিল।

ওখানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবের তুলনায় ডেসপারেট। বিয়ের পর স্বামীবাড়ি যাবার পথে মধুমোল্লা ডাকাতের হাতে পড়ে হিন্দু ব্রাহ্মন ঘরের মেয়ে কমলা সবকূল হারায়। ডাকাতির পর কমলা কাকার ঘরে ফেরত যায়, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তার ওখানে ঠাঁই হয়নি। ঠাঁই যে হবে না হবির খাঁ আগে থেকেই জানতেন।

হবির খাঁ কমলাকে বিনা দ্বিধায় নিজগৃহে নিয়ে আসেন। কমলা হবির খাঁ’র বাড়ি এসে দেখে মুসলমানের বাড়ি হলেও এখানে নামাজের ঘর পাঞ্জাখানার চেয়ে অধিক সৌম্য মর্যাদায় শিব ঠাকুরের পূজার ঘর বিন্যস্ত। 

রবীন্দ্রনাথ যেমন হিন্দু হয়েও ঠিক হিন্দু নন- হবির খাঁ-ও তেমনি মুসলমান হয়েও ঠিক মুসলমান নন; তাঁর জন্মকূলের দিক থেকেও অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। হবির খাঁ মায়ের দিক থেকে রাজপুতানির ছেলে, যদিও তিনি লালনে পালনে মুসলমানের ধর্ম গ্রহণ করেন।

এই গল্পটি থেকে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ লগ্নে এসে যে এক অকূলান অস্থিরতার মধ্যে পড়েছিলেন তার একটা চালচিত্র পাওয়া যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন- প্রতিবেশী এতোবড় একটা সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর যে পরিমান মনোযোগ দেবার দরকার ছিল- তা তিনি দিতে পারেননি।

ফলে তিনি বোধকরি, সেই ঘাটতিটুকু পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবানুগ অন্তর্গতভাবে একটি সম্প্রদায় সম্পর্কে লিখতে চাইলে যে ধরনের যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার তা রবীন্দ্রনাথের ছিল না। আসলে সমাজ রাষ্ট্রের যে ব্যাপক কর্মজীবী শ্রেণী- তাদের ভূমিকাটা দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর বোঝা হয়ে ওঠেনি।

তিনি মাটির উপরে দৃশ্যমান দালানঘরটিই দেখেছেন, কিন্তু যে অগণিত ইটের সারি মাটির নিচে প্রাসাদের ভরকেন্দ্র হিসাবে থাকে- তাদের দেখতে পাননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অলোকসামান্য বোধির কারণে সম্ভবত নিজের ঘাটতিটুকু অনুধাবন করেছিলেন, আর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা পূরণ করার। ফলে তাঁর অস্বস্তি ও বেদনার পরও যে সমাধানের পথ খুঁজে বের করেন সেটি চিরায়ত রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা কেউ নন। রাজা নাটকে যেমন, রক্তকরবীর যে সমাধানকারী তার থেকে ভিন্ন কোন নায়কের আবির্ভাব ঘটেনি। শেষপর্যন্ত একজন ক্যারিসমেটিক, সকল সঙ্কট উতরানো রাজা- এ কাইন্ড হার্টেড হিরো- যিনি তাঁর ভাষায় ওই মহামানব আসে।

রবীন্দ্রনাথের ইমাম মেহেদি বুঝি আসবেন, মৃত্যুর মুখে তিনি তারই পায়ের আওয়াজ শুনতে চেয়েছিলেন; আমরাও তার পদধ্বনি শুনতে বুঝি কান পেতে রই।

মোহন সর্বনাশ

তিরিশি কবিদের দাপটের কাছে একসময় আধুনিক কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ খানিকটা পিছিয়ে আসেন।

তিনি যে কবিতা থেকে সরে এসে গানে নোঙর করেন- তার মধ্যে একটা ঐতিহাসিক দার্শনিক ঘটনার রূপায়ণ ঘটে।

রবীন্দ্রনাথের অন্তর্লোকে একটি গভীর নিজস্ব ঐতিহ্যকাতর দীক্ষা ছিল- যাকে তিনি কখনও দূরে সরিয়ে দেননি। আধুনিক কবিতার জন্য নিজের ছায়া কেটে ইউরোপীয় মাজহাব কায়েমে তিনি ঠিক ওইভাবে জঙ্গম হয়ে উঠতে রাজি হননি।

ভাবগীতল গানের মাঝে বাঙলা লোককবির সারল্যের সঙ্গে পশ্চিমা ব্যক্তি মানস উন্মোচনের একটি দ্বিধা থরোথরো কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদম্য আত্মগোপনকারী সুরের শিখায় ছুঁইয়ে দেন।

প্রটেস্ট্যান্ট ক্রিসটিয়ানিটি যেমন নবীকে কবির সঙ্গে মিলাতে রাজি থাকে, রবীন্দ্রনাথও উঠতি ব্যক্তি মানুষের বিশদ চৈতন্যকে তাঁর গানে বেদমন্ত্রের উপরে সমাসীন করেন।

রবীন্দ্রনাথের এই সুরের ঝুঁকি আমাদের ভীষণ কাজে আসে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসের কেন্দ্রীয় বিহ্বলতা অতঃপর দু’টি আকুতি নিয়ে গড়ে ওঠে : বাতাসে দোলা বাবুই পাখির বাসা, আর রবীন্দ্রনাথের গানে মহীয়ান সর্বনাশের উদযাপন।

অমীমাংসা

সবচেয়ে উচ্চশিখর বাঙালির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তিনি প্রথম এশীয় যিনি ইউরোপীয়দের কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলে আনেন, তিনি বাংলা ভাষার সাংগঠনিক সংহতি আনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখেন, তাঁর আগে আমরা জানতাম না- আমাদের প্রাণের অন্দরমহল যে কত সহস্র শিহরণের নগর!

তিনি প্রথম বাঙালি পশ্চিমা লেখক  যিনি হিন্দু ও মুসলমানকে রাখীবন্ধনে বাঁধেন, সেই সঙ্গে বিজ্ঞান ও সাহিত্যে শানজরের উদ্যোগ নেন, তিনি মানুষকে আগুনের কাছে বিনত করেন- আগুনকে উদ্বুদ্ধ করেন নতশির হতে, রবীন্দ্রনাথ ধর্মকে দৃশ্যমানতার অয়োময় থেকে অদেখার অনুরণনের বোধির সঙ্গে মেলান, তিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে কাঁটাতারের বিভেদ দিগন্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেন।

এতোগুলো অর্জনের কারণেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সর্বোচ্চশিখর বাঙালি নন; তাঁকে নিঃসঙ্গ মৃত্তিকামুকুট রাজার অধিষ্ঠানে গ্রহণ  করি- কেননা তিনি পথভোলা এক পথিক- নিশ্চিত করে জানেন না তাঁর আসলে গন্তব্য কী- অন্বেষা-ই তাঁর বাড়ি; সবার সর্বাংশে জানার মচ্ছবে তিনি-ই একমাত্র না-জানার সংশয়ে মহীয়ান।

কেইটলিন ডেভিসের কাছে আমার রবীন্দ্রনাথ

আজ থেকে ১০বছর আগে কেইটলিন ডেভিসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কেটলিন একজন সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানী- দুনিয়ার তাবৎ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির খোঁজ রাখা তাঁর নেশা, খানিকটা পেশাও- তিনি একটি কলেজে নৃবিজ্ঞান  পড়ান। আমার সঙ্গে আদিবাসী আমেরিকানদের ইতিহাস কৃষ্টি বিষয়ে কথা কলার সূত্রে তার সাথে পরিচয় হয়।

একথা সেকথার পর কেইটলিন আমাকে ধাঁধার ধাঁচে একটি প্রশ্ন করেন- আচ্ছা ধরো, আমি তো বাঙালি নই, দুনিয়ার অন্য জায়গায় অন্য কায়দায় বড় হয়ে উঠেছি; আমি বাঙালি না হওয়ায় এমন একটা জিনিসের নাম বলো যা আমি মিস করেছি, যা আমার দুর্ভাগ্যের সামিল- সরিষা ইলিশের কথা নয়, অন্যকিছু বলো।

আমি উত্তরে বলি- আমাদের ভাষায় একজন কবি আছেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তুমি ওঁর গান শোনোনি, বা শুনলেও বুঝতে পারো না- এটিকে আমি তোমার দুর্ভাগ্যই বলবো, তামাম দুনিয়ায় এমন অমৃত খনি ও বাণী আর কোথাও নাই।

১০বছর পর কেইটলিন ডেভিসের সঙ্গে দেখা হলে  সে আবার আগের কথাটি পাড়ে। বলে, আমি এখনও তোমার বলা নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাথায় নিয়ে ঘুরি। কিন্তু এবার তাকে বলি- আজ যদি তুমি আমাকে একই প্রশ্ন করো, আমি কিছুটা অন্যভাবে এর জবাব দিবো। কেটলিন বলে- তাই নাকি, ধরো আজও আমি একই প্রশ্ন করেছি, তুমি কী বলবে?

তুমি বাঙালি নও, বাঙলা অঞ্চলে তোমার জন্ম হয়নি বলে লালন সাঁই নামে আমাদের এক ফকির কবি আছেন- তাঁর গান শুনতে পাওনি- এবেলায় এটিকে তোমার দুর্ভাগ্য বলবো। লালন আমাদের জনপদের সমন্বিত পিছুটান ও এজমালি আর্তির হৃদপসারি রূপকার, দার্শনিক সুরের মোহরদানা।

কিন্তু মজার কথা কী জানো- যে অভিজ্ঞান, রুচি আর বীক্ষার উপর দাঁড়িয়ে আজ রবীন্দ্রনাথের বদলে লালন সাঁইয়ের কথা বলি- সেই পাটাতনের উপর দাঁড়াতে যে মনীষী আমাকে তৈরি করেছেন- তিনি প্রধানত, মুখ্যত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।

গৃহী ও বাণপ্রস্থ

এমন একটি সমীকরণ থাকুক- তা কোনভাবেই চাই না, কিন্তু এই সমীকরণটি সত্য হতে পারে বলেও মনে হয়: আমরা যতদূর ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আলোকায়ন কবুল করি, রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের ততোদূর ভালো লাগে; যখনই পশ্চিমা দর্শন, উন্নতি, অর্থনীতি আর মানুষে মানুষে সম্পর্কটি নেড়েচেড়ে দেখি- তাকে বিনা জেরায় গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ বোধ করি না- রবীন্দ্রনাথের গানও তখন আমাদেরকে আর তেমন তুমুলভাবে টানে না; একান্ত গভীর ব্যক্তির একক আকুতির উন্মিলনে রবীন্দ্রনাথের যে আয়োজন- তা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যেরই জয় ও বাসনা; এই ব্যক্তির প্রাণভোমরায় একা বেড়ে ওঠার বীজমন্ত্রটি যুক্ত আছে।

দেখতে পাই- আমাদের এতোদিনকার আরাধ্য পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য মুখ থুবড়ে পড়েছে, তার আয়ু ও প্রকল্প করপোরেট পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে হাঁসফাঁস করে- ব্যক্তিরও নাভিশ্বাস ওঠে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এখন আর অর্গল খুলে যাওয়া বোঝায় না- বোঝায় দেয়াল, ব্যক্তির হীনমন্যতা ও স্বার্থপরতার জগদ্দল, কুয়া, কুণ্ডলির ভিতর আবদ্ধতার নাম, তা আর আগুনের ওম নয়, দাহ; নীরবতা নয়- বরফ।

কিন্তু এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দূরদর্শিতা অনুসরণযোগ্য: তিনি সংশয়হীনভাবে বুঝতে পেরেছিলেন- ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যের বেপরোয়া উত্থানের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের পাগলা ঘোড়ার একটি প্রত্যক্ষ যোগ আছে। রবীন্দ্রনাথ লাগাতার জাতীয়তাবাদের অন্তর্গত নৃশংসতার ব্যাপারে সতর্ক উদ্বেগ জারি রেখে গ্যাছেন, বারবার পশ্চিমাদের রোষানলে পড়েছেন। এভাবেই তিনি গৃহী ও বাণপ্রস্থ, অতীত আর ভবিষ্যতের মিলনবিন্দু।

ব্যক্তির উন্মেষ, জাগরণ ও কাতরতার জন্য রবীন্দ্রনাথের যে পণ এতোদিন পরে এসে আজ আর তা গন্তব্য নয়, কিন্তু জাতীয়তাবাদী উত্থানের অধঃপতন এবং নীচতা সম্পর্কে তাঁর উৎকন্ঠা আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক ও দূরপ্রসারী।।

*****************************

বদরুজ্জামান আলমগীরঃ

কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক

====================