You are currently viewing মোহ || হিমাদ্রি মৈত্র

মোহ || হিমাদ্রি মৈত্র

মোহ || হিমাদ্রি মৈত্র

প্রথম বর্ষের ভর্তি শুরু হয়েছে। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ঘরের সামনে টেবিল চেয়ার পেতে তৃতীয় বর্ষের শৌভিক বসে আছে, তার উপর আজ ভার পড়েছে নতুনদের ইউনিয়নের সদস্য বানানোর। কিছুদিন হল বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে, কলেজের ইউনিয়নগুলো‌য় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কমিটি গঠন শুরু হয়েছে। সে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। সেসময়ে ভাব বিনিময় বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই হত, আকাশের শুণ্যতা ছিল না সম্পর্কের মধ্যে।। শুধু তরঙ্গে ভেসে আসা নিঃশব্দ কথামালায় সম্পর্ক তৈরী হত না; চোখের ভাষা, স্পর্শের আকুলতা, বাস্তবের রূপ,রস,রঙ্গ দিয়ে তৈরী হত সম্পর্ক, মনে মনে যোগটা হত যেমন জোরালো, বিয়োগটাও হত জোরাল।

কলেজের গেটটা দিয়ে কেউ ঢুকলে সরাসরি এখানে বসে দেখা যায়। সেখানে বাস থেকে একটি মেয়ে নেমে গেটে ঢুকল, শৌভিক দেখল। মেয়েটির পড়নে অফহোয়াইট শাড়ী, শাড়ীর আকাশ জুড়ে মেঘ রঙের কারুকার্য করা আর ঐ মেঘরঙের ব্লাউজ। চিকন শ্যামল শরীরে যেন মেঘ লেপ্টে আছে। মেয়েটি কাছাকাছি আসতে শৌভিক ডাকল।
মেয়েটি থমকাল, কাছে এল।
– আপনাকে আমাদের সদস্য হতে হবে।
– হতেই হবে
– না, তা নয়। তবে একজোট হয়ে থাকলে যেকোন অন্যায়, অবিচারে লড়াই করা যাবে।
মেয়েটি তাকাল, ইউনিয়নের সাইনবোর্ডটা দেখল, তারপর এগিয়ে এল।
– নামটা বলুন, কুপন কাটব
– বন্দনা দস্তিদার
– কোন বিভাগ
– হিউম্যানিটিস
– ওহ, আমারও। ঠিক আছে, চাঁদাটা দিন
– দিতেই হবে
শৌভিক তাকাল। বন্দনা তাকাল। চোখে চোখ পড়্ল। বন্দনার চোখের পাতা আনত হল।
শৌভিকের ভাল লাগল। সেই ভাললাগাটা রয়েই গেল। হয়তো সিনিয়র হিসাবে কিছু পরামর্শ, হয়তো কিছু নোট চালাচালি, হয়তো একটু মিষ্টি হাসি, চোখের কোণে একটু অজানা ভাষা, একটুকু ছোঁয়ায় অনেক অবুঝ কথা, হয়তো কথার ফাঁকে না বুঝতে পারা কোনো ঈঙ্গিত, এইভাবে একদিন কলেজ পাশ করে ফেলল শৌভিক। এরপর বেকার জীবন, উদ্ভ্রান্তের মত চাকরী খোঁজা, জীবনে দাঁড়ান। জীবনটা যেন উদ্দেশ্য-বিধেয়হীন, জীবনের সব ভাললাগাগুলো খরার দিনের নিদাঘ দুপুর, অস্থির মন ঘুরে বেড়ায় দিশাহীনভাবে, কি যেন একটা খালি খালি ভাব, যা বলার থাকে বলা হয়ে ওঠে না, যা করার নয় করা হয়ে যায়, যাকে যেটা বলার নয় বলা হয়ে যায়, ছন্নছাড়া এক জীবন যেন। হয়তো কোথাও ছায়া ছিল, হয়তো কোথাও মেঘ ছিল, বৃষ্টিতে ভেজা ছিল, হয়তো‌ ভয় ছিল, হারিয়ে ফেলার ভয়, হয়তো কোনো দুঃসময়ে মনে হয়েছিল সে মেঘ হয়তো অন্য আকাশে বৃষ্টি দিচ্ছে। হয়তো ছিল কোথাও একটা বন্ধন, কিন্তু দোনামনায় নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে সে বাঁধন থেকে পালিয়ে গেল। বন্ধুরা বলল এটা নাকি infatuation, বলল মোহ, এই মোহ কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিরকম বন্ধুবিহীন একলা হয়ে যেতে থাকল সে তার বেকার জীবনের যন্ত্রণা নিয়ে। তারপর চাকরীর খোঁজে এ তল্লাটে। তারপর অমোঘ সেই চিঠি, তারপর হরিপদ কেরানির ‘ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া’!

মোরামের রাস্তার মোরাম আর অবশিষ্ট নেই, কাঁকড় আর বালিপাথর বেরিয়ে আছে রাস্তাটায়। রাস্তার একপাশে কয়েকটা বাড়ি, এরমধ্যে শৌভিকের ভাড়ার ঘরটা বেরসিকের মত দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার ওপারে রেলকোয়ার্টারে যদি বা সবুজের ছোঁয়া আছে, এর না আছে ছিড়ি, না আছে ছাঁদ, না আছে সবুজ; তৈরী করা পরিবেশের মধ্যে একেকটা অবুঝ যেন। জায়গাটা পশ্চিম বাংলার লাগোয়া, এলাকাটা বাঙালি প্রধান একটা ঘেরাটোপের মধ্যে। এলাকার আদি বাঙালিদের বাংলা টানে দেহাতি ভাষার টান এসে গেছে। খাস কোলকাতার বাবুরা দুচারদিনের জন্য এদিকে এলে বাড়ী ফিরে এদের ভাষা নিয়ে ক্যারিকেচার করে। কাজের কল্যাণে যারা এখানে এসে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল, স্থানীয়রা তাদেরকে উন্নাসিক বলেই ভাবত।‌
সুদীপা যখন এই অবস্থায় খাস কোলকাত্তাইয়া এক চাকুরের প্রেমে পড়ল, আর সেটা বন্ধুমহলে জানাজানি হয়ে যেতে তার পাড়ার দাদারা যতটা না সুদীপার উপর রাগল, তার চেয়ে বেশী রাগল শৌভিকের উপর। অথচ শৌভিক এর বিন্দু বিসর্গ জানল না। সে বেচারী আড্ডা মারতে পাড়ায় বেরোয়, হয়তো কোনোদিন সুদীপাকে নজরে পড়েওছিল, এইপর্যন্ত। কিছুদিন আগে আচমকা ঘটনাটা না ঘটলে হয়তো চিনতোও না।
সুদীপা সুন্দরী একথা বলা যায় না, বিদুষী একথাও বলা যায় না। সে পড়াশোনা করেছে, গ্ৰাজুয়েশন করতে করতে প্রেমে পড়েছে। পাড়ার দাদারা বাড়ীর দাদাদের বন্ধু হওয়ায় তাদের অভিভাবকত্ব করার একটা দায় বর্তায়। তাছাড়া, রূপসী, বিদুষী এরকম যদি কেউ পাড়ায় থাকে, তাকে পাড়ার দাদারা একটু সমীহ করেই চলে। হয়তো মনে করে সে তাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু এটা সুদীপাতে বর্তায় না। সে সাদামাটা ঘরের সাদামাটা মেয়ে। সে যে নাগালের বাইরে চলে যাবে এটা ঠিক পাড়ার দাদাদের মনঃপুত হয়না। কিন্তু এমনটাও নয় যে সেটা সরাসরি বলার মত মনের জোর তাদের আছে।
সেদিন কলেজের পর টিউশনি সেরে ফিরছিল। পড়ন্ত বিকেলে রাস্তার পীচ তখনো গলে গলে আছে। হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনষ্ক ভাবে, অনমনষ্কতা সে বয়সে নতুন কিছু না, হয়তো কোনো নায়কের বাহুলগ্না রূপসীকে হিংসা করে, কোনো সুপুরুষ শিক্ষকের সার্টের খোলা বোতামের ভিতর থেকে উঁকি মারা রোমরাজির তঞ্চকতায় বা, সদ্যবিবাহিতা বান্ধবী রোমির প্রথম রাতের শিল্পকলায় অভিভূত হয়ে, বা, ‘ইয়ে জিন্দেগী উসিকা’ বলতে বলতে নরম পীচে চটি আটকাতেই পারে; এতে কোনো দেবতার ষড়যন্ত্র ছিল এমন ভাবার কারণ থাকতে পারে না। বাস্তবিক ষড়যন্ত্রটা হল এরপর! সে ঐ আধগলা পীচের উপর দিয়ে বাড়ী ফিরবে কি করে! এমনিতে তার পা মীনাকুমারী সদৃশ না, যে মাটিতে পা পড়লে গোলাপ ফুটে উঠবে! কিন্তু তাই বলে এমনও নয় যে ঐ শক্ত বাঁধানো রাস্তা তার পায়ের কোমলতা, পেলবতাকে রেহাই দেবে। উপায়ান্তর না দেখে ঐ ছেঁড়া স্ট্র্যাপের চটি কোনোরকমে গলিয়ে সে রওনা দিল। কাছেপিঠে না আছে জুতো সারাইয়ের দোকান, না আছে কিছু। সামনের ঢালটা বেয়ে ওঠাটাই কষ্টের, তারপর গলিটা মেনরোডে পড়ছে, কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। এই আশ্বাস মনে পুষে রেখে এগোল সে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মেন রাস্তায় উঠে তার কোনো সুরাহা হল না, শুধু পানের দোকানটা খোলা। সে ভাবল ওখানে যদি কিছু অন্ততঃ পাওয়া যায়, নেহাৎ একটা সেফটিপিন!
ওখানে শৌভিক দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, পাশে মোটরসাইকেল রাখা। ওরা কেউ কারো সাথে পরিচিত ছিল না; একে অন্যকে কোনোদিন দেখেছে হয়তো। সুদীপাকে তার বাসার সামনে দিয়েই আসতে হয়, ওটাই রাস্তা।‌ তাই কেউ কারো দিকে মনোযোগ দিল‌ না। একটা সেফটিপিন নিয়ে কোনোরকমে স্ট্র্যাপে লাগিয়ে সে রওনা দিল, এভাবেই তাকে পৌঁছাতে হবে।
তখনো শৌভিকের সিগারেট খাওয়া শেষ হয়নি। শেষ টানটা মেরে মোটরসাইকেল স্টার্ট করল, রওনা দিল। একই পথ, একটু দূরেই দেখতে পেল মেয়েটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, তার মানে সেফটিপিন খুব একটা কাজ দেয়নি। ইউনিয়নের একটা অলিখিত নির্দেশ ছিল, পাড়ার মেয়েদের সাথে মেলামেশা না করতে। কিন্তু মেয়েটিকে সে চেনে, আলাপ-পরিচয় না থাকলেই বা, একটু ভেবে সে তার বাহন থামাল মেয়েটির সামনে।
– উঠে পড়ুন
– না, না, চলে যাব
– তা যাবেন, কিন্তু কাল‌ আর আসতে পারবেন না। উঠে পড়ুন।
– আপনি চেনেন আমাকে
– হ্যাঁ, ঐ তরু বৌদিদের বাড়ির ওদিকে থাকেন। এবার চলুন।
সুদীপা সেটা জানে। তরু বৌদির বাড়িতে একে ঢুকতে দেখেছে। বয়সের গুণ, হ্যান্ডসাম, সম্ভবতঃ ব্যাচেলর একটি পুরুষ বাড়ির সামনে দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছে, আর কোন বা মেয়ের চোখ পড়বে না! উভয়তঃ। শৌভিকের নজরে যে সে এসেছে সেটাও বোঝা গেল।
দোনামনা করে সে পিছনে উঠে পড়ল। শরীর বাঁচিয়ে, যেন ছোঁয়া না লাগে, যেন ছোঁয়া লাগলে কি যে হবে সে জানে না, বিশেষতঃ তার বালিকাসুলভ স্তনযুগল যেন পৃষ্ঠস্পর্শে আকাঙ্ক্ষিত না হয়ে ওঠে, তা’তে পিঠে কোনো শিহরণ অনুভূত হবে কি না জানা নেই, বইয়ের ব্যাগটা মধ্যবর্তিনী হয়ে যাহোক মান বাঁচাল, কিন্তু রাস্তা বড় দুর্বিনীত, শরীরের বাকী অংশ তার বারণ না মেনে যেন পুরুষ স্পর্শে আবেশিত হতে থাকল, এদিকে চটিজোড়া সামলাতে হবে, ওড়নাও তার শাসন মানে না, এদিকে নাসারন্ধ্রে ঘাম ও সেন্ট মিশ্রিত গন্ধ বিক্ষোভ সৃষ্টি করায় সে তার মুখমন্ডল ঐ শরীর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ব্যস্ত, ওদিকে একহাতে মোটরসাইকেলের সিট ধরা, নইলে প্রপাত ধরণীতল, আরেক হাত বুকের সামনে ব্যাগ সামলাচ্ছে, কিভাবে সবকিছু সামলাবে ভাবতে ভাবতে বাড়ির সামনে উপস্থিত, এ পথ শেষ হয়েই গেল, না শেষ হবার কোনো বাড়াবাড়ি রকমের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেবার আগেই।
শৌভিক পিঠে মহিলা বসিয়ে অভ্যস্ত, সে চেনা বা অল্প চেনা, যেই হোক। তারপর সে সাধারণভাবে ঐতিহাসিক কারণে নারীবিদ্বেষী না হলেও, কমবয়সী মেয়েদের এড়িয়ে যেতেই ভালবাসে। অতএব এই মেয়েটি পিছনে বসে কি ভাবছিল, কি করছিল, তা নিয়ে তার কোনো কৌতুহল হয়নি, বা স্পর্শজাত কোনো অনুভূতিকেই সে পাত্তা দিল না। এটা তার কাছে একটি বিপদে পড়া মেয়েকে সামান্য সাহায্য করা ছাড়া আর বড় কিছু ছিল না। ফলে মনে রাখার মত কোনো আলোড়ন তার মনে ঘটেনি।
এরকম নির্মোহ হবার পিছনে যে ইতিহাস, সেটা‌ মোহেরই ইতিহাস। সে এখনো একটা মোহের মধ্যেই আছে। এখানে আসার পরপরই, তা বছর দুয়েক হল, বন্দনার লেখা বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়েছিল, সামান্য কটা অক্ষর তা’তে,
–‘আমার বিয়ে, তোমার আশা চাই’।

প্রথম দেখায় বন্দনাকে ভাল লেগেছিল, ভাল লাগাটা ছেড়ে যায়নি, কিন্তু বিয়ের চিঠি পেয়ে সে বুঝল বন্দনাকে সে ভালবাসে, মোহের আড়ালে যেটা লুকিয়ে ছিল। এটা যদি সে আগে বুঝত! কোনোদিন হয়তো মুখ ফুটে বলেও ফেলত!
এখানে আসার পর পত্রালাপ ছিল, তবে তা অনিয়মিত। বাড়িতে গেলে দেখা সাক্ষাত হত, তাও অনিয়মিত। কিন্তু ভাললাগাটা সবসময় জড়িয়েই থাকত, একটা সুবাতাসের মত। তার মনে হত সে বাতাসে বন্দনাও জড়িয়ে আছে। ফলতঃ শৌভিকের মনে হয়নি যে এ বাতাসকে রঙিন করে তুলতে হবে, রঙ যেন তার মর্মে লাগে, তার রোমান্টিক মন কেন যে বলল, তরঙ্গে তরঙ্গে আপনি বেজে উঠবে ঝঙ্কার, তাতে যে সুর লাগবে সে সুরের বাঁধনে সে এমনিই বাঁধা পড়ে যাবে, মনে হল যেন কোনো বাহ্যিক প্রকাশ এ খেলায় অবিবেচকের মত তাল কেটে দেবে, যেন সেটা হবে রসের প্রাঙ্গনে বেরসিকের সুর ভাঁজা।
সেই মোহ আর কাটল না, সেটা যে তার গভীরে প্রেম হয়ে নিভৃতে রয়ে গেছে, তার খবর পেতে দেরী হয়ে গেল। না পাবার বেদনা আরো গাঢ় হয়ে তার সমস্ত বাস্তবকে ঢেকে দিল। কোনো দূরের বাঁশীর সুর ছেয়ে রইল। যদি এমন হত যে সে অধিকার করতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত–কিন্তু তার কাছে অধিকারের কোনো বোধ ছিল না, যদি মনে করত কেউ একটা শাস্তি পাবার যোগ্য, সে যদি অশান্ত হয়ে পড়ত ঝড়ের সমুদ্রের মত, তবে হয়তো ঝড় কেটে গেলে শান্ত হয়ে উঠত সমুদ্র, তাতে আবার জীবনতরী ভেসে চলত বাস্তবের আঙিনায়। কিন্তু সে একটা নিগূঢ় মোহজালে নিজেকে জড়িয়ে রাখল। তার বাইরের পৃথিবীর কাজ রুটিন মাফিক চলতে থাকল, কিন্তু ভিতরের ঘরে তালা পড়ে গেল। সে ঘরে কোনো আলোড়ন নেই, কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই, কোনো অধিকার বোধ নেই, কোনো অন্ধকারও নেই, এক মায়াবী আলো ভরে আছে। নিজের অজান্তেই সেই মোহ কবে প্রেম হয়ে পড়েছিল। এ প্রেমে অধিকার নেই, এ প্রেমে চাওয়া-পাওয়া নেই, ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে’। ছোট ছোট চিঠিগুলো যত্ন করে রাখা, ছোটবেলার প্রিয় খেলনা, মাঝে মাঝে ছুঁয়ে নেড়ে সেই বেলায় ফিরে যাওয়া, ভিতর ঘরে ঢুকে পড়া।

সুদীপার হল সমস্যা, একগাদা প্রশ্ন, কেন, কেন, কেন। কেউ মেনে নিতে পারছে না, আর কিছু নয়, একটা ছেঁড়া চটি, একটা লোক, একটা মোটরসাইকেল, একটা সাহায্য, একটা পৌঁছে দেওয়া। একই আলোচনা ঘুরে ফিরে, কিছুতেই কেউ ভুলতে দিচ্ছে না সে একটা অচেনা লোকের সাথে এল কি করে! কিন্তু তার কাছের লোকেরা বুঝতে পারছিল না এরকম করে তারা দূরের লোকটাকে কাছে এনে দিচ্ছিল। সে বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল, তখন একান্তে মনে আসছিল ঐ শরীরটা, ঐ শরীরের গন্ধটা, ঐ আওয়াজটা; ঐ মোটরসাইকেলের শব্দটা তরু বৌদির বাড়িতে যাবার সময় তার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে তুলছিল।

সুদীপার সমস্যা বাড়াল তার বড়দাদা। সে যেখানে কাজ করে সেখানে একটি জাতীয়তাবাদী ইউনিয়নের সে ছোটখাট নেতা। ফলে পাড়ার ছেলেদের মাতব্বর। সেই ছেলেদের সুদীপাকে কিছু বলার সাহস নেই ঠিকই, কিন্তু তার দাদাকে কথাটা লাগাতে কসুর করল না। ফলে সে দাদার পরিস্কার হুকুম, ঐসব কোলকাতার লোকের সাথে কোনোরকম জল অচল, তারা কোথায় কি করে এসেছে কে জানে। স্বাভাবিক! সুদীপার এখন জল তো দূরের কথা, কোনো কিছুই চলে নি। বরং কৌতুহলটা বাড়ল। দুর্ভাগ্যক্রমে তার মোটরসাইকেল এপিসোডটা বন্ধুমহলে গল্প করেছিল, কিছুটা রোমান্টিকতা এনেই বোধহয়, কিছুটা বাড়িয়ে চড়িয়ে, যা নয় তা ঘটিয়ে। অথচ দ্বিতীয়বারের মতোও কোনো মোলাকাৎ হয়নি তখনো। কানাকানি হতে হতে সেটা জানাজানি হল।
এরপর বারকয়েক ঐ রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় পিছন থেকে মোটরসাইকেলের আওয়াজ শুনল, বুকের খাঁচাটার ভিতর সেটার প্রতিধ্বনি হতে না হতেই সেটা তাকে ছেড়ে পেরিয়ে গেল। অদ্ভুত! যার জন্য দিনরাত অকারণে কথা শুনতে হচ্ছে, বন্ধুদের থেকে ঈঙ্গিতে কথা শুনতে হচ্ছে, পিছন থেকে আওয়াজটা এলে শিরদাঁড়ায় একটা শিরশিরানি জাগছে, একটা মোহের মত ছড়িয়ে পড়ছে, পা দুটো বিনা কারণে ভারি হয়ে আসছে, বাড়ির সামনে দিয়ে আওয়াজ হলে মনে হচ্ছে ছুট্টে বেড়িয়ে যাই, সে কিনা তাকে এইভাবে উপেক্ষা করছে!
এইভাবে বেশ কিছুদিন চলল। একদিন তরুবৌদি শৌভিক কে ধরল।
– তোমার নামে কমপ্লেন আছে, তুমি একজনকে পাত্তা দিচ্ছ না
– কে তিনি
– কেন, তোমার মোটরসাইকেল বিহারিনী
– সে তো কতজন এরকম
– কিন্তু সবার তো মন খাওনা, সে আমার তরুনী প্রতিবেশিনী
– ও, সেই ছেঁড়া চটি
– তা, সে কি আবার চটি ছিঁড়বে তোমার পিঠে বসার জন্য! একবার দুবার শিভ্যালরী দেখালে কি বয়ে যাবে
– তা তোমার উনিই তো বারণ করে দিয়েছে পাড়ার কারো সাথে মেশামিশি করতে
– সে আমি বুঝে নেব। একজন একটু মন পেতেছে তোমার বন্ধ ঘরের দরজায়, আর তুমি এখনো সেই স্বপ্নচারিণীর ধ্যান করে যাচ্ছ
শৌভিক দেখল ওপাশের দেওয়াল থেকে একটা ছায়া সরে গেল। পিছনে আড়ালে কেউ ছিল।
এরপর টিউশনি সেরে ফেরার পথে কোনো কোনো দিন ভটভট করতে করতে বাহনটা থেমে যেত, কোনো আহ্বান নেই, একটু ঈঙ্গিত। একজন চড়ে বসত, একজন গাড়ি স্টার্ট দিত, গাড়ি চলতে থাকত। ইতিমধ্যে কাঁধে হাত পড়ল, সামলে বসার বাধা রইল না, ঝাঁকুনিতে চালকের গায়ে পড়ে যাওয়ায় সঙ্কোচ রইল না, বেসামাল অবস্থায় কাঁধে হাতের চাপ বাড়ল, শরীরের গন্ধ আর পায়রার নরম বুকের মত দুটো মাংসপিন্ড সচেতন হয়ে উঠে সুদীপার অস্থিতে মজ্জাতে শিহরণ তুলতে লাগল। কিন্তু ওপক্ষের সাড়া পাওয়া গেল না।
এরমধ্যে কলেজের পরীক্ষা এল, গেল। ফাইনালের রেজাল্ট বের হল, পাশ করার খবর পেয়ে সুদীপার তর সইছিল না, কোনোরকমে বাড়ির আব্দার মিটিয়ে সে খবরটা দিতে তরুবৌদির বাড়ি ছুটল।

এসব ক্ষেত্রে যেরকম হয়ে থাকে, একটা পাশ করার পর মেয়ের বিয়ের তোড়জোর শুরু হয় আর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বশতঃ মেয়ে বলে দেয় সে বিয়ে করবে না। সুদীপাও তাই করল। এতদিনে বাড়ির সকলেই জেনে গেছে তার মন কোথায় পড়ে। কিন্তু তার বড়দাদা বেঁকে বসল। সে দলবল নিয়ে ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে সরাসরি শৌভিক কে হুমকি দিয়ে বসলো। ব্যাপারটা এতদূর এগিয়েছে শৌভিকের মাথায় আসেনি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সে বলে বসল, এরকম তো কথা দেয়নি যে সে সুদীপাকে বিয়ে করবে! তার ভিতর ঘরে বসত করে আনজনা।
খবরটা যথারীতি সুদীপার কানে পৌঁছাল। একদিন সে তরুবৌদির ঘরে শৌভিক কে যা নয় তাই বলল। সে নাকি কাপুরুষ, সে মজা লোটার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি এটাও বলে দিল যার জন্য আসন পেতে বসে আছে, সে তো খবরও নেয়না। অনুযোগটা তরুবৌদিকেও শুনতে হল। রেগেমেগে সুদীপা তরুবৌদির বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। অতঃপর তরুবৌদির পালা।
– বৌদি, আমি বুঝছি না কি করবো। মেয়েটাকে ঠকাবো কি করে, শিভ্যালরী দেখাতে বলে কি ঝঞ্ঝাটে ফেললে
– যে তোমাকে ভালবাসে তার ভালবাসাটাও তুমি উপেক্ষা করতে পার না
শৌভিক বুঝতে পারছিল তার বন্ধ দরজায় কড়া নাড়া শুরু করেছে সুদীপা। এখানে কোনো মোহ ছিল না। কিন্ত সে দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছেই না। সে নিজেকে ঘরবন্দী করে দিল। কাজেও বের হল না। বেশ কয়েকদিন এইভাবে ঘরে বসে বসে তার যত্ন রাখা বাব্যাগের থেকে চিঠিগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখত আর তার সেই পিছনে পরে থাকা ভাললাগার দিনগুলোতে ফিরে যাবার চেষ্টা করত। কিন্তু এখন আর সে ফিরতে পারছিল না, পিছন থেকে টেনে ধরছিল সুদীপা। যতবার সে যেতে চাইছিল, ততবার টান পড়ছিল। এইভাবে মাসখানেক চলল। শেষপর্যন্ত সে সুদীপার ভালবাসাকে মেনে‌ নিল। সে তার সেই স্মৃতির খেলনাগুলো একটা একটা করে ভেঙে ফেলল। তারপর বাইরের ড্রেনে ফেলে দিল। কাজে বেরোনোর আগে সুদীপার সাথে দেখা করতে হবে। স্থির করে নিল নিজেকে সে নিজেকে সমর্পণ করবে, নত হবে সে ভালবাসার কাছে। নত না হলে ভালবাসা যায় না। মোটরসাইকেলটা গেটের বাইরে বের করল।

এই সকালে একদল মহিলা কোন বা কনের বাড়ি থেকে তামার ঘড়া কাঁখে জল সইতে যাচ্ছে নিয়ে তার বাসার পাশের পুকুরে, সেই জল দিয়ে কোন বা বর-কনেকে স্নান করানো হবে। সেই দলে সে দেখল ঝিমিকে, সুদীপার বন্ধু। ঠিক সেই সময়ে ঝিমিও তাকে দেখে ছুটে এল। আজ সু’র বিয়ে, এই বলে সে ছুট লাগালো ঐ দলে যোগ দিতে। বুঝল সে আবারো দেরী করে ফেলেছে।
শৌভিক অভ্যাসবশতঃ তার মটরসাইকেলের তেলের ট্যাঙ্ক খুলে দেখছিল কতটা তেল আছে। সে এবার মনোযোগী হয়ে দেখতে লাগল কতটা আছে। ওকে তো অনেক দূর চলে যেতে হবে! সবকিছু থেকে পালিয়ে। যেন বাহনটাই উপযুক্ত ওর পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হতে।
যে খেলনাগুলো নষ্ট করে ভাসিয়ে দিল ড্রেনে, সেগুলো তার পুরোন স্মৃতিকে ভাসিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে যাচ্ছে দূরে। আর অন্য দিকে সুদীপার বিয়ের স্নানের জলের তামার কলসীটা বুগ বুগ আওয়াজে তাকে ব্যঙ্গ করে ভরে উঠছে। নতুন করে পাবে বলে সে যখন পা বাড়ালো, তখনই সেটা ফেলে আসা স্মৃতির ঘরে নতুন করে কড়া নাড়িয়ে ঢুকে পড়ল।
স্নেহ, প্রেম, মমতার স্থিতিশীল তীরভূমি হারানোর ভয়ে এতদিন যা কিছু আঁকড়ে ধরে ছিল বা নতুন করে আঁকড়ে ধরার আয়োজনে ছিল তাও যখন ছেড়ে চলে গেল, তীরভূমির মায়া ছেড়ে সে উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপ দিল। ‘আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে’!

********************************