মোহন পরিবারের দর্শনচিন্তা
সৌমেন দেবনাথ
অখ্যাত থেকে মানুষ পরিচিতি পেলে মানুষ তখন মানুষ থাকে না। সভ্য সভ্য লাগে চোখে, অসভ্য হয়ে উঠে মনশ্চক্ষে। অচেনা যতক্ষণ ছিলো ছিলো ততক্ষণ ভালো আর চরিত্রে সমৃদ্ধ। যেই না একটু কর্ম আর একটু ভাগ্যগুণে পরিচিতি পেলো হয়ে গেলো যত না ঘৃণ্য তারচেয়ে বেশি নোংরা। বহুত্বে মেশা আর অবাধে মেশাতে হয়ে উঠে অভ্যস্থ। শরীর জুড়ে সৌন্দর্য, তাই শহর-ঘাট জুড়ে সবার সাথে বন্ধুত্ব। গ্রাম্য নারীর কোমর দেখা গেলে বা মাথার ঘোমটা খসলে বেলাল্লাপনা উপাধি পায়, আর শহুরে দাপুটে সুপরিচিত শ্বেত চামড়ার মনোলোভার এগারো হাত শাড়ির আট হাত বাতাসে উড়ে, যার পাশে অগণিত পুরুষের খিলখিলাখিল হাসি, সে পায় সম্মান। দেশজোড়া মানুষ তার কীর্তিকলাপ দেখে মনে মনে একান্তে বিহ্বল হয়, আর গালি পাড়ে উচ্চারণে। তার দেহকলার প্রতি প্রকোষ্ঠে সুতীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে নজরতৃপ্তি নেয়, দিন শেষে নিজ ঘরে ফিরে তাকেই সমালোচনা করে। মনে মনে দেখার চেষ্টা, অনিন্দ্য জ্ঞানে দেখে, নিন্দার পুরোভাগ তাকেই আবার ফিরিয়ে দেয়।
মনোলোভা আমাদের পেয়ে বসে কারণ মনোলোভাতে আমরা বুদ হয়ে উঠেছি। সে কি করছে না করছে, কোথায় যাচ্ছে না যাচ্ছে তা দেখতে তাকে খুঁজি আর তাই সে কি ছেড়ে কি করবে আর কি করবে না এই ভাবনা ভুলে কত কিই না করছে। কত সমৃদ্ধ খবর আমরা হেলায় ফেলে দিচ্ছি কিংবা শুনছি না, দেখছিই না। মনোলোভা কখন কোন পোশাক পরছে, কোন লিপিস্টিক ব্যবহার করছে দেখতে দেখতেই ভুলে যাচ্ছি কত না প্রয়োজনীয় বিষয়। মনোলোভা হাসলে দেশ হাসে, নাবালক থেকে সাবালক, বৃদ্ধসহ। মনোলোভার শরীর খারাপ হলে শরীরলোভীদের মন মেঘলা আকাশের মত হয়ে উঠে। কী এক যন্ত্র-জামানায় বাস করছি, সৌন্দর্যের সংগা ভুলে যাচ্ছি। দেহবিলাসীদের দেহঢঙ্গে মগ্ন থেকে আত্মকর্ম ভুলে যাচ্ছে কতই না দেহলোভী। মনোলোভার আত্মকথায় কান পেতে কানের তৃপ্তি নিচ্ছে মোহনের মত কতই না পুরুষ। মনোলোভার দর্শনবর্ণনা শুনে আপ্লুত হয়ে উঠছে হাজারও পুরুষ। দেশজোড়া মানুষ জানে ও মানে মনোলোভা সবার, কিন্তু মনোলোভা লোভনীয় ভঙ্গিমায় বলে তার মন এখনো ফাঁকা। মনোলোভার ফাঁকা মনের গল্প শুনে ফাঁকা হৃদয়ের মোহনপুরুষ আপ্লুত হয়ে উঠে। একান্তে মোহন মনোলোভাকে দেখতে থাকে, আর রাঙতে থাকে, হতে থাকে উষ্ণ। মনোলোভার উষ্ণ শরীরের উথাল-পাতাল ঢেউ-তরঙ্গে নিমগ্ন থাকে মোহন। মন কাতর সারাক্ষণ মনোলোভাতে। বৌর আগমনে ইতস্ততবোধ করে নিজের এহেন কৃতকর্ম লুকানোর চেষ্টা করে। কমলা হাতে-নাতে ধরে বলে, যাকে দেখে উত্তপ্ত হবে তার কাছে যেয়ে শীতল হবে।
কমলা থেকে এমন উচ্চারণ শুনে মোহন ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, অনাকাঙ্ক্ষিত কথা বলবে না। অবিবেচকের মত কথা বলবে না। সহ্য করা যায় না এমন কথা বলবে না। সুখী হওয়ার সংলাপ তোমার মুখ থেকে বেরই হয় না। জানো কেবল তীর্যক বচন। কাউকে আমায় ভালো লাগতে পারে, তাই বলে তুমি আমার মন্দের তালিকায় নও।
প্রতিউত্তরে কমলা বললো, মনোলোভাকে দেখবে না, আমার হিংসা হয়। মজবে কেবল আমায় দেখে।
মোহন বললো, মনোলোভাকে দেখবো, মনোলোভা আমাকে প্রশান্তি দেয়।
কমলা রাগান্বিত হয়ে বললো, স্বামীর মনে অন্য কোন নারীর বাস জেনে কোন স্ত্রী স্থির থাকতে জানে না। তোমার মনে আমার ঠাঁই না হোক, অন্য কারো ঠাঁই দিও না।
স্ত্রীর কথাতে কর্ণপাত না করে মোহন চ্যানেল চেঞ্জ করে মনোলোভা অভিনিত সিনেমাতে দিলো। চোখের পলক পড়ে না মনোলোভার মুখাবয়ব দেখে। জাদু লেপ্টে যেন সর্ব অঙ্গে।
রঙিন পর্দায় মনোলোভা সৌন্দর্যের ঝর্ণাধারা ঝরিয়ে হাজির হয়েছে। যেমন নয়নলোভন সৌন্দর্য, তেমনি নয়নাভিরাম অঙ্গভঙ্গি। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ধারণ করেছে এক অঙ্গে। বুদ হয়ে দেখছে মনোলোভাপ্রেমি মোহন। সংসার সামলানো নারীটি কিছুক্ষণ পরপর তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে, কাজে যাও।
আর তাতে মোহন চরম বিরক্ত হচ্ছে। কমলা কণ্ঠস্বর বাড়িয়ে বললো, নষ্ট-ভণ্ডদের উত্থান কাহিনিই শুনবে। কারণ নষ্ট-ভণ্ডদের একজন হয়ে উঠেছো।
মোহন রক্তচক্ষু দেখিয়ে বললো, দেখো মনোলোভা কত সুন্দর, তুমি তা না। দেখো মনোলোভা কত মিষ্টি করে কথা বলে, তুমি তা পারো না। দেখো মনোলোভার হাসি কি মিষ্টি, তুমি হাসতেই জানো না।
কমলা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, যেদিন তুলনা বাদ দিতে পারবে, সেদিন চোখে অনেক কিছুই পড়বে। যতদিন এই তুলনা আকড়ে থাকবে, ততদিন চোখে ঐ সব সৌন্দর্যই ধরা পড়বে যাতে চোখের তৃপ্তি পেতে গিয়ে বাস্তবতার অনেক প্রাপ্তিতেই অরুচি থাকবে। যারা রুচি বোঝে না, তারাই অরুচিকে নিয়ে পড়ে থাকে।
কমলা সংসারের কাজে লেগে যায়। যার কাজে সংসারে সংসার চালানোর রশদ আসবে সেই পড়ে থাকে টেলিভিশন আর মোবাইল স্ক্রিনে। হাজার গুণে রূপবতীর চেয়ে বিশ্বাসী কালো মেয়েও যে শ্রেয় এই বোধটুকু যতদিন না কারো হৃদয়ে জাগে ততদিন মানুষ কাঁচকে কাঞ্চন ভেবে আঁকড়ে থাকে।
মনোলোভার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার চলতে থাকে। কমলা দরজায় এসে ভাবতে থাকে, লোকটা চোখের সামনে থাকতে থাকতে গোল্লায় যাচ্ছে। মানুষটার সাথে থাকি আমি, কিন্তু মানুষটার মন পেলাম না, মনটা পড়ে থাকে ডাস্টবিনের ময়লায়। অজ্ঞান কখনো জ্ঞানে ফিরতে চায় না।
কমলা না সহ্য করতে পেরে বললো, অন্য নারীর ঐ রকম ছলাকলা দেখতে থাকা মোটেও সুস্থ মস্তিষ্কের কাজ না।
মোহন উত্তরে বললো, যাকে যত ভালো লাগে তাকে তত দেখবো।
কমলা ক্রোধান্বিত হয়ে বললো, তুমি একটা ছন্নচ্ছাড়া পুরুষ। আমার জীবনে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছো। বিষফোঁড়া নিয়ে চলা যায় না।
মোহন রেগে বললো, তুমি চুপ থাকো। যার চেহারা সুন্দর তার দুটো বড় কথা শোনা যায়।
কমলা চুপসে যায়, যে যতই সুন্দর হোক, তাকে কেউ অসুন্দর বললে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। কমলা তবুও বললো, তুমি যে সৌন্দর্যের মায়ায় নিমগ্ন হয়ে আছো সেটা আসলে এক ধরণের মায়া, বিভ্রম, মরীচিকা। আমাকে ভালো লাগে না, তবে আমাকে বরণ করেছিলে কেন? মনোলোভায় পঞ্চমুখ, আমায় দেখে কেন হও বিমুখ?
মোহন কঠিন চিত্তে বললো, সাগরের বড় বড় মাছে লোভ যার, পুকুরের ছোট ছোট মাছে তার নজর পড়ে না।
কমলাও কম বলে না। বললো, তোমার দৌড় মাঠ পর্যন্ত। কৃষক মানুষের অত সৌন্দর্য লোভী হওয়া মানায় না। চামড়া রোদে পুড়িয়ে কালো করো, নতুবা পেটে দুই বেলা ভাত যাবে না। ছা-পোষা মানুষের অত বিলাসীতা মানায় না।
মোহন বলে, ছা-পোষা মানুষের মানসিকতাও ছা-পোষা হলে হয় না।
কমলা বিমর্ষ মনে বাইরে এসে বসে থাকলো। তার স্বামী সুন্দর দেখে আর একটা বিয়ে না করে এই দুশ্চিন্তাও মাথায় নিলো। তাই ঘরে ফিরে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিলো। মোহন ভীষণ রেগে বললো, নিজে সুন্দর না বলে তুমি সৌন্দর্যও বোঝ না। তুমি সুন্দর না, তোমার চোখ দিয়ে সৌন্দর্যও প্রবেশ করে না।
কমলা বললো, চোখের খিদে কমাও, সুখহীন থেকে সুখী হবে।
মোহন যথোচিত জবাব দিলো, বললো, ভুল পাত্রে সুখের আশা করা যায় না।
কমলার চোখে মুখে দুশ্চিন্তা ভর করলো, বললো, সুখী হতে জানতে হয়।
মোহন বললো, কথা বলাও জানতে হয়। দেখো, মনোলোভা কত ভালো ভালো কথা বলছে! তুমি তো ভালো কথাই জানো না।
এহেন এহেন কথা শুনতে শুনতে কমলা বিধ্বস্ত হয়ে গেলো। বাইরে গিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। কেউ যখন জানতে পারে কাছের মানুষটি তাকে পছন্দ করে না, তখন হৃদয়টা ক্ষত হতে থাকে।
ওদিকে মোহন টেলিভিশনের স্ক্রিনে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। মনোলোভা ভালোবাসার এপিঠ-ওপিঠ সব বলছে, বললো, দেখুন, ভালোবাসার সুনির্দিষ্ট কারণ কোন কালেই ছিলো না। ভালোবাসা হয়ে যায়, ভালো একটা মন থাকলে ভালোবাসা শ্লোগান দিতে দিতে মনের ঘরে প্রবেশ করে।
এভাবে বসে বসে মনোলোভার কাছ থেকে ভালোবাসার সংগা, রং, কারণ শিখতে থাকলো মোহন। আর যে তাকে ভালোবাসা উজাড় করে দিচ্ছে, তাকে বাইরে রেখে ঘরের আগল টেনে দিয়েছে।
পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে সব কথা শেয়ার করে কমলা। ভাবী রাগতস্বরে বললো, মূর্খরা মূর্খদের বাঁধতে জানে না। গরুরা গরুদের বাঁধতে পারে না। কেবল পাশাপাশি শুয়ে জাবর কাটে।
বিস্মিত হয়ে কমলা বললো, মানে? আমি মূর্খ বলে স্বামীর মন জয় করতে পারি না? আমি গরুর পর্যায়ে চলে গেছি? শুধু অর্থহীনভাবে তার সাথে থাকি? কত কত ত্যাগ স্বীকার করছি তার জন্য! আমার থেকে সবটুকু সুখ নেয় সে, কিন্তু একটুও সুখ দেয় না সে।
ভাবী সহমত পোষণ করে বললো, পুরুষ প্রজাতিই এমন, শুধু বাঁকতে চাইবে, নিজ প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট না। নিজের জমি রেখে পরের জমিতেই চাষ দিতে তাদের বেশি আনন্দ ও ইচ্ছা। এসব পুরুষদের চরিত্রের চৌহদ্দি বৈচিত্র্যে ঢাকা। বাঁধতে না জানলে ছুটে যায়। বাঁধতে জানলে ছুটতে চায়। স্বামী মানেই নিশ্চিন্তের জিনিস না, ঝুঁকিপ্রবণ।
এরপর ভাবী কমলাকে স্বামীর মন জয়ের দুটি বুদ্ধি শিখিয়ে দিলো। পরদিন কমলা সাজতে বসলো। নারী মানেই সাজগোজপ্রিয়। সংসারের কাজের চাপে সাজগোজ তার হয়ে উঠে না। সাজলে যে কাউকেই সুন্দর লাগে। কিন্তু মোহন দেখে বললো, কাঁথায় যতই নকশা দেয়া হোক, তা কখনো কম্বল হবে না।
শুনে কমলা নিরীহ প্রাণীর মত মোহনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। পরে বললো, তোমার জন্য না, নিজের জন্য সাজছি। হয়েছি না হয় বাঁকা, তাই বলে চিৎ হয়ে শয়নের শখ থাকবে না!
কমলা পড়ে গেলো দ্বিধায়। স্বামীকে কাজে যেতে তাগাদা দিতে ভয় করে। নিজেই কাজে লেগে যায়। বাঙালি নারী স্বামীর মন জয়ে কত কিই না করে! অথচ সেই স্বামী প্রজাতি বিরল প্রজাতির মত দূর বনান্তে থাকে। স্ত্রীর কাজ করা দেখে মোহন বললো, কাঠ পুড়ে কয়লা হলে কয়লা হয় কারখানার জ্বালানি, তুমি পুড়ে ময়লা হলে হবে ডাস্টবিনের কাঁচামাল।
কথাটি শুনে অবুঝ হরিণীর মত নিষ্পলকে তাকালো কমলা। চোখের পানি ঝরালো না তবুও। কিছু মানুষ চোখের জলের মূল্য জানে না। কাজ ফেলে সে উঠলো না, কাজ করতে থাকলো। যার মন পড়ে থাকে অন্য নারীতে, তার মন কি এসব কাজ করা দেখে টলে?
মোহন চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে মনোলোভার দেখা পেলো। আজ সে ছোটবেলার প্রেমের গল্প করছে। প্রথম যাকে ভালোবেসেছিলো তার গল্প করতে করতে বললো, জীবনে ভুল হয়ে যায়, কিন্তু জীবনের সেই ভুলকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার কোন মানেই হয় না। মনের সাথে মন না মিললে মানিয়ে নেয়ার কিছু নেই, মেনে নেয়ার কিছু নেই। মন যারে মানবে না, তার সাথে থাকার মানে নেই।
একথা কমলার কানেও গেলো। এসে বললো, এসব কথা শুনে শুনে বিগড়ে যাচ্ছো, গোল্লায় যাচ্ছো। সংসারকে দোজখ বানাচ্ছো।
স্ত্রীর দিকে না তাকিয়ে মোহন মনোলোভার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এবার সে দ্বিতীয় ভালোবাসার গল্প শুরু করেছে। শুনে মোহন একটু ভ্রূ কুঁচকালো। তার প্রিয় অভিনেত্রী জীবনে এত প্রেম করেছে জেনে বিমর্ষ হলো। মনোলোভার দ্বিতীয় প্রেম বিচ্ছিন্নের কিচ্ছা করছে, বলছে, নিঃশ্বাস দূরত্বে দাঁড়িয়েও মানুষ চেনা যায় না, নিঃশ্বাস দূরত্বে থেকেও মানুষকে বিশ্বাস করলেও ঠকতে হয়। বিশ্বাস শূন্যতায় বাঁচা যায় না, নীড় বাঁধা যায় না। বিশ্বাসহীনতায় হৃদয় ভঙ্গ ঘটে। এই সব বিশ্বাসহীনের সাথে গালগল্প করা যায়, পথ চলা যায় না, ঘর বাঁধা যায় না।
শুনে কমলা বললো, এক বিশ্বস্ত আর এক বিশ্বস্তের গল্প শুনছে! ন্যূনতম বিশ্বস্ত থাকতে জানলেও কি ঘরের ভেতর পরের প্রবেশ অবাধ হয়?
মোহন বললো, সুন্দররা যা বলে তাই সুন্দর লাগে।
কমলা মুখের উপর উত্তর দিলো, তুমি শরীরী সৌন্দর্যটাই দেখো, মনের সৌন্দর্য দেখার তোমার চোখই নেই।
মোহন কমলার কথাতে অধিক কর্ণপাত করতে নারাজ। টেলিভিশনের দিকে মনোনিবেশ করলো। দ্বিতীয় ভালোবাসার গল্প শেষে মনোলোভা তৃতীয় ভালোবাসার গল্প শুরু করেছে। শুনে মোহন ও সঞ্চালক উভয়ই বিস্মিত হলো। কিন্তু মনোলোভার এমন সুন্দর কণ্ঠ, অন্যমনস্ক হওয়া যায় না। এমন সুন্দর দেহতনু, অন্যদর্শন করা যায় না। তার কথাতে কেবল আকর্ষণীয় শক্তিই না, কৌতূহলও বিরাজ করে। তৃতীয় প্রেম ভেঙে যাওয়ার কারণ জানালো মনোলোভা, পাশে থাকার জন্য যে থাকা সেটা আসলে থাকা না। তৃপ্তির জন্য সান্নিধ্য কামনা, তৃপ্তি শেষে অতৃপ্তি প্রকাশ সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। কাছে রাখার বাহানাতে যদি কেবল কামুকতায় প্রকাশিত হয়, তবে কি আর সম্পর্কের শিকড়গুলো বাড়তে পারে? চোখে চোখ রাখা, হাতে হাত রাখার চেয়ে যদি ঠোঁটে ঠোঁট রাখা প্রাধান্য পায়, নতুন করে ভাবার তখন ইচ্ছাটা প্রবল হয়।
শেষের কথাগুলো মোহন শুনলোই না। কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থির হয়ে থাকলো সে। কমলা বললো, এখনো মনোলোভাকে শুনবে? মনোলোভার প্রতি বেশি আগ্রহ, আমার প্রতি বেশি অনীহা দুটোই দোষের। মনোলোভা স্বপ্ন, আমি বাস্তব।
মোহন সব কথার উত্তর রেখে বললো, মনোলোভা তিনটা প্রেম করেছে। এখন সাময়িক বিরতিতে আছে। একটা মানুষ তিনটা মানুষের মন ভেঙেছে?
কমলা উত্তরে বললো, কোন রঙিলা প্রতারক না? প্রতারকরা সব সময়ই ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী।
মোহন অন্যমনস্ক, মনোলোভা কথা বলেই চলেছে, কমলা কিছুটা মনস্ক। মনোলোভা বলছে, যার সাথে মনের মিল হবে না, তার সাথে জোর করে থাকার মানে নেই। বাজে স্বপ্ন ভেবে মন থেকে মুছে ফেলে দিতে জানতে হবে। নতুন স্বপ্নে বাঁচতে হবে।
একথা শোনামাত্রই কমলা টেলিভিশন বন্ধ করে দিলো, আর বললো, এসব বাক্য শুনে শুনে গোল্লায়ে যাচ্ছো। সাংসারিক জ্ঞান কি আছে মনোলোভার? আছে দেহবিলানোর জ্ঞান। দেহবিলাসীদের কথা শোনো, তাদের অনুসরণ করো, কেমন মানুষ তুমি? তোমার মানসিকতাও পঁচে গেছে।
মোহনের আঁতে ঘা মারলো কথাগুলো, বললো, যাকে তাকে যাচ্ছেতাই বলবে না, জানবে আগে বলবে পরে। কী মিষ্টি দেখতে, কাজ খারাপ করবে কেন?
মোহন আবার টেলিভিশন অন করে নিবিষ্ট হলো। সঞ্চালক বলছে, যারা মন জিতে নেয়, হৃদয় জিতে নেয়, তারা তো অজেয়ই থাকে। তারা কি পরাজিত হবে না কোন প্রিয় মানুষের কাছে? আমি বলতে চাচ্ছি, বিয়েটা কবে করছেন?
মনোলোভা বললো, দেখুন, কেউ তো আর ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে থাকে না! সবচেয়ে সুন্দর না খুঁজে জীবনকে সবচেয়ে সুন্দর করবে যে তাকেই খুঁজি। বুঝবে, জানবে, পাশে থাকবে, মানবে, সহ্যও করবে এমন মানুষ পেলেই বিয়ে করে ফেলবো।
অনুষ্ঠান শেষ না করেই মোহন কাজে চলে গেলো। দেখেও ভালো লাগলো কমলার। কাজে না মন, মনোলোভাতে মন বুদ হয়ে থাকলো। ডাটা চালু করে মনোলোভাকে খুঁজে তার ছবি, তার কার্যকলাপ, কাণ্ডকলাপ দেখে সে। কোন পোশাকে তাকে কেমন লাগে এগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে। চোখ দিয়ে দেখে, গালি-গালাজ দেয় মুখে। দেখাও বন্ধ করে না, সমালোচনাও বন্ধ করে না। এভাবেই বেশ কিছুদিন গেলো। হঠাৎ একটা খবর সামনে এলো। মনোলোভার কাল বিয়ে। হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে মোহনের। ফেসবুকজুড়ে মনোলোভার ছবি, মনোলোভার কথা। টেলিভিশন অন করতেই সেখানেও একই খবর। দেশের বড় অর্জনের খবরটিতে কারো খেয়াল নেই। মনোলোভার বিয়ে, মোহন দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। তা দেখে কমলা বললো, ভাগ্যবানদের প্রতি ভাগ্য ঢলে, দুর্ভাগ্যবানদের প্রতি ভাগ্য ঢলে না।
মোহন তীর্যক চোখে চেয়ে বললো, দুর্ভাগ্যবান না হলে কি তোমাকে বিয়ে করা লাগতো? তোমার মত গান্ধীপোকার গন্ধ শুকে দিনাতিপাত করা লাগতো?
কমলা বললো, আমার দোষ-ত্রুটিই চোখে পড়বে, যেদিন নিজের ভুল, দোষ-ত্রুটি বুঝতে পারবে সেদিন বুঝবে তুমি নিজেকে যা ভাবো তা না। ঘরে বৌ থাকতে অন্য নারীকে মনে দাও ঠাঁই, অপবিত্র মন তোমার। শ্লীল-অশ্লীলতায় নিমজ্জিত থাকো, লম্পট পুরুষ।
এ কথা শুনে মোহন কমলাকে মারতে উদ্যত হলো, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করলো। কমলা বললো, আমার সাথে পারবে, নরম মাটি খোঁড়া সহজ। ঘরের বৌকে সব পুরুষই ফুটবল ভাবে, দেখলেই দুই লাথি। ঘরের বৌকে সব পুরুষই তুলোর বস্তা ভাবে, দেখলেই দুই ঘুষি।
মোহন রাগান্বিত অবস্থাতেই বললো, নরম কথা বলবে, সহজে হজম হবে; পেঁচিয়ে কখনো কথা বলবে না, পেঁচিয়ে যাবে। তোমরা তোমাদের কথার জন্যই পঁচে যাও।
কমলা কাদতে কাদতে বললো, তৃপ্তি শেষ সম্পর্কও শেষ।
মোহন বললো, সম্পর্ক যেখানে সুদৃঢ় তৃপ্তি সেখানে অশেষ।
বলেই মোহন মনোলোভার বিয়ের খবরে ফিরলো। কোথা থেকে বিয়ের শাড়ি কিনবে, কোথা থেকে কসমেটিকস কিনবে এসব খবর শুনতে শুনতে দিন চলে গেলো।
হঠাৎ একদিন মনোলোভা স্বামীকে নিয়ে টেলিভিশনে হাজির হলো। আগের সেই ভালোলাগা নেই আর মোহনের। মনোলোভার ভালো ভালো কথাও আর তার ভালো লাগে না। লিপিস্টিকে ঠোঁট রাঙিয়ে আসা মনোলোভার ঠোঁটে আর তাকাতেও ইচ্ছা করে না। মারাত্মক হাসিতেও আর মারাত্মকভাবে জখম হয় না সে। টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে কাজে চলে গেলো। কমলা সব প্রত্যক্ষ করে আর ভাবে স্বামী তার হয়ত পথে ফিরবে। পাশের বাড়ি থেকে ভাবী এলে কমলা বললো, মনোলোভা বিয়ে না করলে স্বামী তো কাজে ফিরতোই না!
ভাবী বললো, মনোলোভাকে ভালো না বেসে যদি গ্রামের কোন মেয়েকে ভালোবাসত কী অবস্থা হত ভেবে দেখ। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের মত চোখে চোখে রাখবি, অস্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে যাবে বুঝতেও পারবি না।
নতুন দুশ্চিন্তায় পড়লো কমলা। পুরুষ মানুষের বিবেক না থাকলে পথে ফেরানো যায় না। বিবেকহীন পুরুষ পথে-ঘাটে ইজ্জত বিলিয়ে দেয়। বোধযুক্ত মানুষ ইজ্জতকে বড্ড মূল্য দেয়। মস্তিষ্কে পঁচন ধরলে মানুষ গণধিকৃতকে জনপ্রিয় ভাবে।
দুই মাস না যেতেই মনোলোভা নিজেকে একা করে নিলো। মিডিয়াতে একা হাজির হয়। দেশজুড়ে গুঞ্জণ শোনা গেলো মনোলোভা তার স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছে। কমলা বললো, বর ছেড়ে বর ধরা মেয়েদের আমার খুব পছন্দ। যে বর পর পর বা বর্বর তার নেই দরকার। জগৎ অনেক বড় ধৈর্য ধরে কাউকে বোঝার কিছু নেই। সহ্য না করে ছুঁড়ে ফেলায় উত্তম।
মোহন ভ্রূ কুঁচকে বললো, বর ভালো না হলে ছুঁড়ে ফেলার মানসিকতা পোষণ করো?
কমলা কটাক্ষ করে বললো, বর ভালো না, মানুষের কাছে ভালো বলে উপস্থাপন করার মত নারী না আমি। খারাপকে ভালো বলে সত্যায়িত করার অর্থ নেই। হীন মানবিক গুণাবলীর কাউকে সুউচ্চ করে প্রত্যায়িত করার মানে নেই।
মোহন আশ্চর্য হয়ে বললো, স্বামীর স্বামীত্ব সহ্য না করলে নারীর নারীত্ব থাকে নাকি?
মোহন আবার মনোলোভার কথাতে কান পাতলো। মনোলোভা বলছে, একসাথে থাকতে জানা অনেক বড় কাজ। এক সাথে থাকতে পারা যথেষ্ট কঠিন কাজ। কাছাকাছি থাকলে কিছু না কিছু ঘটবে। ছোটখাটো ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে দামামা বাজালে তো একসাথে চলাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা ভালো থাকাটা জরুরি। যৌথ চলার পথে যদি ভালো লাগাটা না থাকে তবে একা থাকা শ্রেয়। একা থেকেও তো ভালো থাকা যায়। একা থেকেও তো কত মানুষ যথেষ্ঠ ভালো আছে।
শুনে কমলা বললো, সঙ্গের সাথীর সঙ্গ সুন্দর না হলে ছেড়ে দিয়ে একা থাকায় ভালো। পাগলের পাগলামি মানা যায়, মন্দের মন্দামি মানা যায় না।
মোহন হতোদ্যম হয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কমলা খুব মনোযোগ দিয়ে মনোলোভার কথা শুনছে আজ। মনোলোভা বলছে, স্বামী মানেই কর্তৃত্ববাদী এ মানায় যাবে না। বৌ অধনস্ত কর্মী নয় যে, স্বামী শুধু আদেশ করবে।
কথাটি মোহনকে আঘাত করলো। টেলিভিশন বন্ধ করে দিলো আর বললো, রান্না করতে যাও।
কমলা বললো, মনোলোভার কথা তো ভালোই লাগছে। মনের কথাগুলো বলছে। নারী মানেই নিষ্পেষিত, হোক সে গরীবের ঘরে কিংবা ধনীর ঘরে। হোক সে কুৎসিত কিংবা যতই সুন্দরী। প্রতিটি ঘরে নারী ঠকছে, প্রতিটি কাজে নারী ঠকছে, প্রতি পর্যায়ে নারী হারছে, ঠকছে, পিছাচ্ছে গুণ, যোগ্যতা, দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও।
মোহন বাজে একটা অঙ্গভঙ্গি করে বললো, সব নারী এমনই মূর্খ, হোক সে যতই বর্ণে কালো বা রূপসী, ধনে ধনী বা গরীব। যেই মনোলোভাকে দূর দূর করতে, আজ সেই মনোলোভাকেই শুনছো, তাও মনোযোগে। পক্ষে বললেই পক্ষে ঝুলে পড়া আর বিপক্ষে বললেই প্রতিপক্ষ ভাবা সুবিবেচকের কাজ না।
এভাবেই মনোলোভাকে ঘিরে মোহন-কমলার মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। মাস খানেকের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়লো মনোলোভা আবার বিয়ে করেছে। খবরটা মোহনের কাছে অরুচিকর লাগলো। ন্যূনতম সে খবরে সে আর কর্ণপাত করলো না, দৃষ্টিপাতও করলো না। কমলার কানেও সে খবর প্রবেশ করলো। মোহনকে বললো, সাথী ছাড়া থাকা সত্যই কঠিন। সাথী হারা পাখিও সাথী খুঁজে নেয়। সাথী ছাড়া সাপ সাথীকে খুঁজতে গিয়ে মারাও পড়ে যায়।
মোহন রাগান্বিত কণ্ঠে বললো, স্বামী টিস্যুপেপার না, প্রয়োজনে টেনে নিলাম, ব্যবহার শেষে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। স্বামী কসমেটিকস না, ব্যবহার শেষে ধুয়ে ফেলে দিলাম। স্বামী লিপিস্টিকও না যে এলার্জি হলে বদলে নতুন আর একটা নেয়া।
মোহনের কথাগুলো ভালো লাগলো কমলার। সে নিজেকে আরো বেশি শুদ্ধ করতে মনস্থ হলো। সে ভাবলো, যে ভালো পথে হাটা শুরু করেছে তাকে পূর্বের বিপথ গমনের কথা শুনিয়ে দেয়ার দরকার নেই। দিনে দিনে মোহন আরো সংসারী হয়ে উঠলো। একজন স্ত্রীর জন্য একজন স্বামীর সুপথে ফিরে আসা অনেক বড় উপহার।
কখনোই মোহন কমলার সাথে এমন মিষ্টি আচরণ করেনি যেমনটা আজ সে করছে। গদগদকণ্ঠে কমলা বললো, আমাকে ভালো লাগছে, আমি তো মনোলোভার মত অভিনয় জানি না।
মোহন প্রতিউত্তরে বললো, মনোলোভা মিছে মিছে অভিনয় করে। পর্দায় ভালোবাসা দেখায়, বাস্তবে ভালোবাসা খুন করে। অভিনয়ের সাথে জীবন-যাপনের কোন সাদৃশ্য নেই। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী।
কমলা আবারও বললো, আমি তো মনোলোভার মত হাসতে জানি না।
মোহন বললো, মনোলোভার হাসির চেয়ে তোমার হাসি পবিত্র।
কমলা দ্বিধান্বিত হয়ে বললো, মনোলোভার মত তো আমার চেহারা সুন্দর না।
মোহন উত্তরে জানালো, মনোলোভার মত তো নিজেকে বিজ্ঞাপিত করো না। সে চেহারায় সুন্দর, তুমি মনে সুন্দর।
কমলা আবার বললো, আমি তো মনোলোভার মত নাচতে জানি না।
মোহন এবার বললো, মনোলোভা নাচতে জানে, নাচাতেও জানে। তুমি নাচতে জানো না, নাচাতেও জানো না, তুমি সংসারমনা। তুমিই আমার জীবনের কোরিওগ্রাফার। তুমি নিজেকে মনোলোভার সাথে তুলনা করো না। এক সময় তার সব কিছুই ভালো লাগত, এখন তার সব কিছুই খারাপ লাগে। শুধু উচ্চারণ করতে পারি না, পৃথিবীর সব গালিই তাকে দিতে ইচ্ছা করে।
এভাবেই তারা নতুন করে আবার কাছে আসতে শুরু করলো। এতদিন দুটো মানুষ এক ছাদের নিচে বসবাস করলেও একটি সন্তান তাদের কোলে আসেনি। ছিলো না দুটো মনে একাত্মতা, দিতো না কেউ কাউকে সম্মান। একের জন্য অন্যজন আন্তরিক ছিলো না। অথচ দুটো মনে মিল এসে বাঁধলে বাসা কত মিষ্টি একটা বাচ্চা তাদের ঘরে এসে উপস্থিত হলো। ভালোবাসা না থাকলে ভালোবাসার আগমন ঘটে না।
মনোলোভা সম্বন্ধে নতুন খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। দ্বিতীয় স্বামীকেও সে তালাক দিয়েছে। আজ মোহন কিংবা কমলা কেউ-ই মনোলোভাতে নিবিষ্ট হলো না। যার তার কাছ থেকে জ্ঞানী কথা শুনে তারা আর দ্বন্দ্বকে আমন্ত্রণ জানাতে চায় না। তারা তাদের সন্তানের আনন্দের জন্য কার্টুন চ্যানেলই দেখতে থাকলো।