মেহনাজ মুস্তারিনের কবিতা
একই শহরে বসবাস
কিছু একটা বলতে অশ্বত্থ গাছের কাছে
দাঁড়িয়েছি, নদীর এক কোনায় নির্জীব দাঁড়িয়ে আছে
প্রায় চার যুগ; জানি না কী ভাবছে,
কোনদিন জানা হয়নি; তবু দেখি তার, বুকজুড়ে অহংকার!
জুবুথুবু নিস্পলক চাহনি!
প্লাবন যায়, দহন যায়, নদীর জল শুকিয়ে যায়!
তবু দেখি, জেদি এক সাপের মতো মাটি কামড়ে
দাঁড়িয়ে থাকে সে; ফুল ফুটতে দেখি, পাতা যায় ঝরে;
নতুন পাতা গজায়,
আড়ালে ফিঙে পাখি ঘড়কুটো নিয়ে হাজির হয়!
এই শহরে অনেকদিন ধরে আছি
তোমার বসবাস এখানেই, কাছাকাছি!
অথচ, সেই গোলাপি খাম
তোমার হাতে আজও পৌঁছায় না !
কত কথা দুফোঁটা জলে আঁকা
এগলি ওগলি ঘুরতে থাকা
ডাকপিয়নের হাত ঘুরে অবশেষে
জংধরা মরচেপড়া পোস্ট বক্সে ঘুমায়।
একই শহরে আমি আছি
তুমি থাকো কাছাকাছি
এমোড়ে ওমোড়ে মুখেমুখে কবিতাগুলো ঘুরছে,
কয়েকজন তো মুখস্তই করে ফেলেছে!
শুধু তুমিই শুনলে না!
কত কাগজ ভিজেছিল জলে, লেপ্টে দিয়েছি
কত কালি, কাটাছেঁড়া করতে করতে অবশেষে ছুঁড়ে ফেলেছি
ডাস্টবিনে! লিখেছি যা তোমায়, বলতে চেয়েছি
যা কিছু বারবার,
ডাস্টবিনের তলায় তারা ঘুমায় এবার!
অনেক রাতে কবিতার শব্দগুলো যখন ডুকরে কাঁদে, ঠিক সেই সময়
রাতের শকুনগুলো থমকে যায়! নিস্তব্ধ রাত জেগে থাকে তমসায়
কবিতার ধূসর শব্দের মাঝে সে খোঁজে আশ্রয়!
একদিন ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নায় দেখি এক নাইটকুইন ফুটেছে!
দেখি, শিশির ভেজা ঘাসকে চাদর বানিয়ে শুয়ে আছে
একাকী চাঁদ।
অকস্মাৎ
আজব এক আদরের নেশা আমার বুকে জ্বলে উঠতে দেখি!
মেঘগুলো ভুলে যায় ঠিকানা, আমি তাকে বুকের মধ্যে ধরে রাখি,
সকালের আলো গোলাপি আভা ছড়িয়ে দেয় মুখজুড়ে,
ঘুমিয়ে পড়ার আগে শেষবারের মতো তাকে দূরে-বহুদূরে
চলে যেতে দেখি। তার নিঃশ্বাস থেকে যায়
আমার ঠিকানায়!
এভাবে এই শহর বহু নিঃশ্বাসের সাক্ষী হয়ে থাকে! বহু জায়গায়
তার ক্ষত, তবু এখনো একই রকম চেনা যায়! শুধু বিষন্ন বর্ষায়
ভিজে যায় স্মৃতির পাতা! নিঃশব্দ নির্জনে নিঃশ্বাস থমকে দাঁড়ায়!
এইখানে, খুব কাছাকাছি থাকো তুমি এই শহরে,
আমাদের স্মৃতিসম্পদকে নিজের সাথে জাপ্টে ধরে!
জানি, তবু জানি, মুখ ফুটে বলবে না
অভিমানের কথা! জানতে দিবে না
সেই রাতের কথা, দগ্ধ শরীর আর্তচিৎকারে কেঁপে উঠেছিল যখন
প্রেম নয়, স্বপ্ন নয়, তখন
এক তপ্ত শিশা দখল নিয়েছিল তোমার করোটির,
বধ্যভূমিতে উপুর হয়ে পড়ে গেলে মানচিত্র এসে ঢেকে দিয়েছিল তোমার সোনালি শরীর,
পেছনে শক্ত করে বাঁধা তোমার হাত তখন শেখ মুজিবের তর্জনীর মতো উঁচু হতে হতে
পিঠের ওপরে মিনার বানায়!
উদ্বাহু সেই স্তম্ভের গোড়ায়
উই পোকা বাসা বাঁধে! ফিঙে পাখির সাথে তাদের নিত্য বসবাস!
হাড্ডির ভাঁজে ভাঁজে তারা খোঁজে ভালোবাসার খাদ্য; বাঁচার আশ্বাস!
স্বাধীন দেশ! আমরাও স্বাধীন! বীরাঙ্গনা তুমি!
ভালোবাসি! ভালোবাসি! সুজলা-সুফলা জন্মভূমি,
তারা যেন দেখে আমি ভালো আছি,
এই কথাটাই বলতে চেয়েছি
বারবার! এই শহর যে তোমার আমার সকলের!
এখানেই যে বসবাস আমাদের!
**********************