মেরি অলিভারের কবিতা
অনুবাদ ও ভূমিকা: খায়রুল আলম চৌধুরী
স্কুল তাঁকে টানেনি, টেনেছে বন, টেনেছে কবিতা। যুক্তরাষ্ট্রের কবি মেরি অলিভারের (১৯৩৫-২০১৯) নিরান্দন শৈশব কৈশোর কেটেছে ওহাইতে। স্কুলের শেষ বছরগুলোয় ক্লাসরুমের চেয়ে বরং বনে ঘুরতেই বেশি ভালো লাগতো তাঁর। ব্যাগে থাকতো ওয়াল্টহুইটম্যানের কবিতার বই। জীবন ও জগতকে নতুনভাবে আবিস্কার করেন জালালুদ্দিন রুমির কবিতায়। নিজেও লিখতে শুরুকরেন কবিতা। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। বনের নির্জনতায় নতুন রূপে জীবনকে খুঁজে পান অলিভার:
“শামুকেরা উঠে খেয়ে ফেলবার আগে,
রুদ্র, কল্যাণী বৃষ্টির তোড়ে
পাইন পাতার ডগার আঘাতে থুবড়ে যাবার আগে
ছোট হলেও, মাশরুমেরও একটা জীবন আছে।“
(কবিতা: এক; কাব্যগ্রন্থ: কেন আমি ভোরে উঠি)
‘প্রার্থনা’ অলিভারের কাছে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,‘একাগ্রতা’ যার মূল চাবিকাঠি। বনে অথবা পুকুর পাড়ে কিংবা সৈকতেচুপচাপ বসে থেকে চারপাশের জীবনকে উপলব্ধি করাও তাঁর কাছে প্রার্থনা। তাঁর কাছে প্রার্থনা মানে:
“… খোলা দরোজা
কৃতজ্ঞতা আর নীরবতার, যেখানে
অন্য একটা কণ্ঠস্বর কথা বলতে পারে।”
(কবিতা: প্রার্থনা; কাব্যগ্রন্থ: থার্স্ট)
সমুদ্র উপকূলের প্রভিন্সটাউনের প্রকৃতি অলিভারের কবিতায় তীব্রভাবে উপস্থিত। পাথর, ওক গাছ, গোলাপ, রাজহাঁস, বক, শিয়াল, পদ্ম, ফড়িং, মকিং বার্ড, কাঠঠোকরা, ফিঞ্চ, কিংবা ব্যাঙ এসব নিয়েই তাঁর কবিতা। জীবনকে দেখেন তিনি:
“যখন একা থাকি তখন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি আমি। পাশ দিয়ে শিয়ালদের নির্বিকার ধেয়ে যাবার আগ পর্যন্ত গজিয়ে ওঠা বুনোলতার মতো বালিয়াড়ির উপর স্থির বসে থাকতে পারি আমি— শুনি অশ্রুতপ্রায় গোলাপের গান।”
(কবিতা: যেভাবে আমি বনে যাই; কাব্যগ্রন্থ: সোয়ান)
বনে ঘুরে ঘুরে দেখেন তিনি:
“কীভাবে বুকে পাথর বয়ে নিয়ে যায় নদী,
ব্যাংকে একটা টাকা জমা না থাকার পরও কীভাবে মনের সুখে গান গায় বনের পাখি,
কীভাবে কিছু না গায়ে দিয়ে আলোর মালায় সেজেছে ফুলেরা।”
(কবিতা: ক্যালেন্ডারে যখন বসন্ত এলো; কাব্যগ্রন্থ: লং লাইফ)
পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী অলিভার কবিতায় তাঁর নিজের ভাষা তৈরি করতে পেরেছেন। পাঠকের সাথে সরাসরি কথা বলেনতিনি কবিতায়:
‘বল আমাকে, তুমি কি পরিকল্পনা করেছ
তোমার এই আত্মহারা ও অলোকসামান্য জীবন নিয়ে?’
(কবিতা: বসন্তদিন; কাব্যগ্রন্থ: হাউজ অব লাইট)
বলা হয়ে থাকে, বনে যাবার আগের মানুষটি আর বন থেকে ফিরে আসার পরের মানুষটি কখনো এক হয় না। আর প্রায় সারাজীবন বানপ্রস্থে কাটানো অলিভারের সব কবিতাই যে প্রার্থনার কবিতা হবে, যেখানে থাকবে প্রাণেশ্বরের নিবেদন তাতে আরআশ্চর্যের কিছু নেই। বরং আছে প্রাণজুড়ানো প্রশান্তি আর ভালোবাসাময় এক নতুন জগতের সন্ধান:
“আকাশ কী নীল, আকাশ কী নীল,
কত নীল কত অসামান্য আর কত ত্রাণময় সককিছু, এমনকি তুমিও,
তোমার চোখ, তোমার ভাবনা।“
(কবিতা: এক; কাব্যগ্রন্থ: কেন আমি ভোরে উঠি)
আর তাই দেশ কালের সীমানা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত অলিভার আমাদের সময়ের কবি, লিখেছেন আমাদের আত্মার মুক্তির কবিতা, উদ্বোধন করছেন জীবনের সৌন্দর্য, প্রার্থনা আর নিবেদন যেখানে প্রবলভাবে উপস্থিত।
মেরি অলিভার হয়তো সব সময়েরও কবি!
কেন আমি ভোরে উঠি
আমার মুখে রবিকর, প্রণতি তোমায়!
যে-তুমি সকাল আনো—
ছড়াও আলো মাঠের উপর,
টিউলিপের মুখে,
হাওয়ায় দোলা মর্নিং গ্লোরির গায়, এমনকি
শোক আর জরাগ্রস্তের জানালায়—
প্রণতি তোমায়!
যে-তুমি আনো মঙ্গলবারতা চিরদিন,
প্রিয় জ্যোতির্ময়, মহাবিশ্বের কোলে
রাখো আমাদের চির-আঁধারবিহীন,
রাখো তোমার উষ্ণ ছোঁয়ায়,
আলোর কৃপা হাতে করো আলিঙ্গন—
সুপ্রভাত, সুপ্রভাত, সুপ্রভাত।
দেখো, কীভাবে শুরু করি দিন এখন
আনন্দ আর করুণায়।
বসন্তের কবিতা
ঘর থেকে বের হয়ে,
আমি দেখতে বের হলাম
ধরো, ব্যাঙ,
তার উজ্জ্বল সবুজ ত্বক;
পিচ্ছিল ঘোমটার মতো
তার ডিমগুলি;
গোল সোনালি রিমের ভিতর
তার চোখ দুটি;
পুকুরে
ফুটেছে পদ্ম ফুল;
ফোটা ফোটা গোলাপি ফুলের
উষ্ণ পুকুর পাড়;
বাতাসহীন, লম্বা দুপুর
আর ঝরা মেঘের মতো
একটা শাদা বক
খুব সাবধানে একটা পা ফেলছে
কিছুক্ষণ থেমে
আবার আরেকটা পা,
লিখছে শান্ত জলের গায়ে
নরম পায়ের কবিতা।
গোলাপ, বসন্ত শেষে
কি ঘটে
পাতারা যখন
লাল আর সোনালি হয়ে ঝরে
যায়? কি ঘটে
গানের পাখিদের,
যখন তারা গাইতে পারে না
আর? কি ঘটে
তাদের দ্রুতগামী ডানার?
তোমার কি মনে হয়
আমাদের কারো জন্য
ব্যক্তিগত বেহেস্ত আছে?
তোমার কি মনে হয়
অন্ধকারের ওপার থেকে
কেউ আমাদের ডাকবে?
গাছগুলোর ঐ পাড়ে
শিয়ালেরা শেখায় বাচ্চাগুলোকে
উপত্যকায় বেঁচে থাকার কৌশল।
তাই তারা কখনো হারায় না, থাকে সব সময়
প্রতিদিন সকালে
শুকনো আকাশে
দিনের আলো ফুটলে।
আর সাগর তীরে
এক সারি পাহাড়ে
শেষ গোলাপেরা খুলেছে তাদের মিষ্টি সুবাসের কারখানা
আর ফিরিয়ে দিচ্ছে তা ধরণীরে।
আমার যদি আরেকটা জীবন থাকতো
পুরোটা কাটিয়ে দিতাম আমি
বন্ধনহীন এই আনন্দ মেলায়।
আমি একটা শিয়াল হতাম, কিংবা
দোলানো শাখাভরা একটা গাছ।
মাঠভরা গোলাপ বাগানের একটা
গোলাপ হতেও আপত্তি নেই আমার।
ভয় কিংবা উচ্চাশা এখনো গ্রাস করতে পারেনি ওদের।
কারণ, এসব কখনো ভাবে না তারা।
তারা কখনো জানতে চায় না, আর কতদিন
তাদের থাকতে হবে গোলাপ হয়ে এবং তারপর কি হবে।
অথবা নেই তাদের অন্য কোনো বোকা প্রশ্ন।
শিস দেয়া হাঁস
যখন তুমি প্রার্থনা কর তুমি কি তখন মাথা নত কর কিংবা
তাকাও আকাশের নীলে?
তুমি খুঁজে নাও তোমার পছন্দ, সব দিক থেকেই প্রার্থনা যায় ঈশ্বরের কাছে।
কী ভাষা ব্যবহার করছো তা নিয়ে মোটেও চিন্তা করার দরকার নেই,
ঈশ্বর যে সব ভাষাই বোঝেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এমনকি হাঁসগুলো যখন উত্তরে উড়ে যেতে যেতে শিস দিয়ে যায়, সে সব ভাষাও শুনে ও বোঝে ঈশ্বর।
রুমি বলেছেন, আত্মার কোনো প্রমাণ নেই।
কিন্তু বসন্তের ফিরে আসা আর আমাদের হৃদয়ে তার দোলা লাগাই কি এর যথেষ্ট প্রমাণ নয়?
হ্যাঁ, আমি জানি, ঈশ্বরের নীরবতা কখনো ভাঙ্গবে না, কিন্তু তা কি কোনো অন্তরায়?
হাজার কন্ঠ ডাকছে চারদিকে, শোনা যায়।
ভাবো (কথার কথা), হাঁসগুলোও জানে সবকিছু, যেমন জানি আমরাও।
আসো, উড়ে যাওয়া ঐ হাঁসগুলো আমরা দেখি এবং তাদের শিসে কান পাতি, শুনি তাদের গান।
নাও এখান থেকে দুহাত ভরে, যতটুকু পারো।
উপহার
শান্ত আজ আত্মা আমার,
নিমেষহারা
দেখে স্বর্গ, দেখে ধরা
বেলা যায়, চকিতে ধায়
চঞ্চল চপল চলো তুমি
আজ মৃদু পায়।
ধীর মৌনতা ঘিরে
অন্তর জাগে আজ।
প্রেমে তারে নাও কাছে
গভীর উচ্ছ্বাসে,
যেমন নিয়েছিলে তারে।
জানুক আজ ভগবান
আর জগতের সবাই
তোমার নিবেদন—
পেয়েছো তুমি উপহার।