You are currently viewing মুক্তিসেনা/ বিচিত্রা সেন

মুক্তিসেনা/ বিচিত্রা সেন

মুক্তিসেনা

বিচিত্রা সেন

শীতের রাত। গ্রামগঞ্জে শীতের রাত খুব তাড়াতাড়িই নামে। সন্ধ্যা হওয়ার ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সুনসান নীরবতা নেমে আসে। এ বছর শীতও পড়েছে বেশ জাঁকিয়ে। সন্ধ্যার পরপরই দুটো খেয়ে নিয়েছেন নিরুপমা দেবী। তারপর গায়ে লেপটা মুড়িয়েই শুয়ে পড়েছেন। ঘুমাবার এত আয়োজন,কিন্তু ঘুম কি আর আসে!

হঠাৎ দরজায় টুকটুক শব্দ হতেই ধড়ফড় উঠে বসেন তিনি। এত রাতে কে আসলো? মিলিটারি নয়তো? নাকি রাজাকার বশির? কান পেতে আবারও শব্দটা শুনতে আগ্রহী হন নিরুপমা দেবী।আবারও খুব সন্তর্পণে টুকটুক করে শব্দ করে বাইরে থেকে কেউ একজন। ভয়ে নিরুপমা দেবীর গলা শুকিয়ে আসে। তবুও গলাটা খাঁকারি দিয়ে খানিকটা ভাঙা গলায় তিনি জানতে চান, “কে?” বাইরে থেকে ফিস ফিস করে আওয়াজ আসে “আমি মিলন”।

মুহূর্তেই নিরুপমা দেবীর পিঠ বেয়ে যেন ঠাণ্ডা স্রোত নেমে আসে। মিলন! তাঁর ছেলে মিলন ফিরে এসেছে! তিনি ভুল শুনলেন না তো? মিলন বাইরে থেকে ফিসফিস করে বলে,”মা দরজা খোলো,আমি মিলন।” ঠিক যেন উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে ছুটে যান নিরুপমা দরজার দিকে।নিমিষেই কাঠের ডাঁসাটা সরিয়ে ছিটকিনিটা খুলে দিতেই তাঁর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে মিলন এবং পেছন ফিরে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সে।

ঘরের ভেতর এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছেলের আকস্মিক আগমনে নিরুপমা এতটাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলেন যে হারিকেনটা জ্বালাবার কথা তাঁর মাথাতেই আসেনি। হারিকেন না জ্বালিয়েই তিনি দরজা খুলে দিয়েছিলেন। এবার তিনি হারিকেন জ্বালাবার জন্য বালিশের নিচে দেয়াশলাইটা খুঁজে নেন। ততক্ষণে আন্দাজের ওপর ভর করে মিলন বসে পড়েছে খাটে।

হারিকেন জ্বালিয়ে নিরুপমা ছেলের মুখের কাছে ধরেন। গাল ভর্তি দাড়িতে মিলনকে এই আলো আঁধারিতে অচেনা মনে হয়। এই কয় মাসে ছেলেটা যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। কেমন গম্ভীর মুখখানা তার। মায়ের চোখের আকুলতা মিলনের দৃষ্টি এড়ায় না। মাকে জড়িয়ে ধরে সে  বলে,”অমন করে কী দেখতাছো মা?”

“তোরে দেখি বাপ” নিরুপমা উত্তর দেন। কেমন শুকিয়ে গেছে তাঁর আদরের ছেলেটা। নিশ্চয় ঠিকমতো খেতে পায় না। চোখ ভরে জল আসে নিরুপমার। মায়ের মনের কথা হয়তো বা বুঝতে পারে  মিলন। কেমন যেন ম্লান হাসে সে,বলে “অত দেখতে হইবো না তোমার। আগে আমারে কিছু খাওন দাও।” তারপর পেটের দিকে তাকিয়ে বলে,”বড্ড খিদা লাগছে। তয় আমার হাতে সময় কিন্তু বেশি নাই কইলাম।”

কথাটা শুনেই নিরুপমা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কতদিন পর তাঁর ছেলে তাঁর কাছ থেকে কিছু খেতে চাইছেন। দিনের পর দিন তিনি ছেলের পথ চেয়ে ছিলেন। ছেলে খেতে পাচ্ছে না ভেবে তিনিও বেলার পর বেলা না খেয়ে ছিলেন। সেই ছেলে আজ তাঁর কাছ থেকে ভাত চাইছে!

বিধবা মহিলা তিনি। মাছ মাংস খান না। ডাল আর সবজিই তাঁর নিত্য দিনের খাবার। একমাত্র ছেলে মিলনকে নিয়েই ছিল তাঁর ছোট সংসার। কিন্তু যুদ্ধ লাগার দুই/ তিন মাস পরে যখন মিলনও যুদ্ধে যাবার জন্য গোঁ ধরে বসলো তখন তিনি একমাত্র সন্তানকে হারানোর ভয়ে হাহাকার করে উঠেছিলেন। কিন্তু মিলন তো দমবার পাত্র নয়। ধীরে ধীরে সে মাকে বোঝাতে পারলো দেশের এই দুঃসময়ে সে তরুণ হয়েও যদি দেশকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ না করে তবে আজীবন তাকে কাপুরুষের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হবে। তখন মা হয়ে তিনি কি তা সইতে পারবেন? তাই মায়ের উচিত এ মুহূর্তে মিলনকে নিজ ইচ্ছাতেই যুদ্ধে পাঠানো।

নিরুপমা দেবী অনেক ভাবেন মিলনের কথাগুলো নিয়ে। সত্যি দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাঙালির মনোবলকে ভেঙে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যায় মেতেছে। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে এদেশের কিছু বেঈমান,যারা নিজেদের নাম দিয়েছে রাজাকার,আলবদর,আলশামস।

চারপাশের পরিস্থিতি তখন এতটাই ভয়াবহ যে নিরুপমার মনে হয়েছিল যুদ্ধে না পাঠালেও তিনি ছেলেকে বাঁচাতে পারবেন না। তার চেয়ে ছেলে দেশের জন্য লড়ুক। মরতে তো সবাইকে একদিন হবেই। এভাবে পালিয়ে পালিয়ে কুকুর বিড়ালের মতো না মরে দেশের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করে মরুক।

মায়ের অনুমতি নিয়ে মিলন সেই যে যুদ্ধে গেলো আর একবারের জন্যও সে মাকে দেখতে আসতে পারেনি,আজকেই প্রথম মাকে দেখতে এলো এই গভীর রাতে চুপিসারে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই নিরুপমা ছেলের জন্য ভাত বাড়েন। বেশি কিছু দিতে পারেন না ক্ষুধার্ত ছেলেকে তিনি। দুপুরের রান্না করা মুগ ডাল এবং ফুলকপি আর আলুর ডালনা দিয়ে হাড়িতে থাকা সব ভাত তিনি সাজিয়ে নেন ছেলের জন্য। মিলন মায়ের কাছ থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে গোগ্রাসে খায়। ছেলের খাওয়া দেখতে দেখতে চোখ ভরে জল আসে নিরুপমার। কতদিন নিশ্চয় মিলন ভালো করে ভাত খায়নি। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তাঁর ছেলে। না জানি কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে।

মিলন কিন্তু একবারও মায়ের দিকে তাকায় না। মাথা নিচু করে খুব দ্রুততার সাথে ভাত খায় সে। মনে হয় মায়ের হাতে দুটো ভাত খাওয়ার জন্যই বুঝি তার এতটা ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি আসা। খেয়ে উঠে মিলন দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসে। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে।বলে,মাগো তোমারে দেখতে খুব মন টানছিলো। তাই আইয়া পড়লাম, কিন্তু এবার আমার যাইতে হইবো মা। তুমি অনুমতি দাও।”

বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে নিরুপমার। তাঁর মিলন তাঁকে ছেড়ে আবার চলে যেতে চাইছে। কী করে থাকবেন তিনি ছেলেকে ছেড়ে? “আরেকটু থাক বাপ”  নিরুপমা আকুল হয়ে বলেন।

“না গো মা,আমি আবার আমু। বেশিক্ষণ থাকলে রাজাকাররা হয়তো টের পাইয়া যাইবো। ওরা রাইতের বেলা সব বাড়ির উপর নজর রাখে।”

ফিসফিস করে বলে মিলন।

রাজাকার শব্দটা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে নিরুপমার। প্রতিদিন ওদের তাণ্ডবের নানা কথা তাঁর কানেও আসছে। হেন অপকর্ম নেই যা ওরা করছে না। প্রথমদিকে ওরা লুটপাট, বাড়িঘরে আগুন দেওয়া এসব করলেও ইদানিং তারা মানুষ খুনের নেশায় মেতেছে।ওদের ভয়ে মিলন চলে যেতে চাইছে। চলেই যাক ছেলেটা,ওকে আর আটকে রাখা ঠিক হবে না।

বুকের ভেতর থেকে কান্না দুমড়ে মুচড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেও ঠোঁট কামড়ে তা সামাল দিতে চান নিরুপমা। হাসি মুখে বলেন,”হ বাপ যাইতে তো হইবোই।” মিলন কাঁধে রাইফেলটা নিয়ে,তার উপর গায়ে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে  দরজার দিকে পা বাড়ায়,আবার কী ভেবে পেছন ফিরে মাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। মা ছেলের কপালে চুমু দিয়ে আশীর্বাদ করেন।

তারপর বলেন,”বীরের মতো ফিরে আইবা বাপ,এক্কেবারে দেশটারে স্বাধীন কইরা।”

মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে মিলন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। খানিকটা পথ এগিয়ে কাঁচা রাস্তাটায় উঠতেই আচমকা অন্ধকার ফুঁড়ে বের হয়ে আসে ওরা তিনজন। বশির রাজাকার আর ওর দুজন সাগরেদ। মিলনকে দেখতে পেয়ে  ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো চোখ দুটো হিংস্র হয়ে ওঠে।

তারপর বলে, “আরে ভাতিজা! এত রাতে তুমি?  কখন আইলা,কোথায় ছুটলা কিছুই তো বুঝতে পারতাছি না।” বলেই কেমন একটা খ্যা খ্যা করে বিশ্রী রকমের হাসি দেয়।

বশির রাজাকারের তাণ্ডব সম্পর্কে আগেই খবর পেয়েছিল মিলন। সে জানে এ গ্রাম এখন পুরোটাই বশিরের নিয়ন্ত্রণে। তার তাণ্ডবে গ্রামের বেশির ভাগ বাড়ি তরুণ তরুণী শূন্য। সব জেনেও এই গভীর রাতে বাড়ি আসার ঝুঁকি নিয়েছিল শুধু একবার মাকে দেখবে বলে। ভেবেছিল গভীর রাতে হয়তো বশির এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের চোখ এড়াতে পারবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।বাড়ির দিকে একবার তাকায় মিলন। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব।

রাইফেলটা গায়ের চাদরের নিচে আছে,কিন্তু তাক করার সময় পাবে তো? ততক্ষণে বশিরের সাগরেদ দুজন মিলনের গায়ের চাদর ধরে টান দেয়। ওদের হাতে চাদর গেলে উন্মুক্ত হয়ে যায় মিলনের কাঁধের রাইফেল।চকচক করে ওঠে বশিরের নেকড়ের মতো চোখ। অনেকদিন ধরে সে এই শিকারের আশায় ছিল। আল্লাহ মেহেরবান,আজ তার শিকার নিজেই তার সামনে এসে পড়লো। সময় নষ্ট করা বুদ্ধিমানের কাজ না,তাই মিলনকে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ না দিয়েই বশিরের একহাত লম্বা চাকু ঢুকে যায় মিলনের তলপেট বরাবর। কঁকিয়ে ওঠে মিলন, মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে একবার।

মা বলেছিল বীরের মতো ফিরতে, তাই পড়ে যেতে গিয়েও  মিলন  রাইফেল তাক করে টালমাটাল অবস্থায়। কম্পিত হাতে ট্রিগার চিপলে পর পর দুটো গুলি বেরিয়ে আসে। কিন্তু তিন রাজাকারকে পাশ কাটিয়ে অসীমতার দিকে ছুটে যায় রাইফেলের সেই গুলি। মুখ থুবড়ে পড়ে মিলন। বুদ্ধিমান বশির রাজাকার আবারও সময় নষ্ট করে না,  সাগরেদদের হুকুম দেয়,”হালার পোরে জবাই করে দে।” বিপুল উৎসাহে সাগরেদরা কাজে নেমে পড়ে। একজন মিলনের হাত দুটো চেপে ধরে,আরেকজন জবাইয়ের কাজটা তৃপ্তি সহকারে সারে। তারপর তারা “মুক্তি” খতম করে কল্পিত বেহেশতের দিকে যেন হেঁটে যায়।

রক্তস্নাত হয়ে পড়ে থাকে বাংলার বুকে শহীদ মিলনের লাশ।