মুক্তিযুদ্ধ, মৌলিক চেতনাবোধ ও প্রজন্মের দায়
আজিজ কাজল
স্বাধীন বাংলাদেশ এর স্বপ্ন নিয়ে ঘটনাবহুল যে নির্মম অধ্যায় সূচিত হয়েছিল, তার নাম মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছরের বাংলা। বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ। অসাম্প্রদায়িক বাংলা নামের একটি ভূ-খণ্ডের স্বপ্ন নিয়েই আজকের বাংলাদেশ। দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক অবৈজ্ঞানিক ফর্মুলার মাধ্যমে সাতচল্লিশের দেশভাগ। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। ১৯৫৮ এরআইয়ুব বিরোধী আন্দোলন। ১৯৬২ এর গণ আন্দোলন। ১৯৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন। ১১ দফা। ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান। ১৯৭০এর নির্বাচন। ১৯৭১ এর ৭ ই মার্চের ভাষণ। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কাল রাত। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর। ২৬ শে মার্চ—এই বিবিধ বাঁক ও কাল পরিক্রমায় আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ নামক একটি সুন্দর স্বাধীন ভূখণ্ড গঠন কল্পে যে বিষয়টি অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছিল, সেটি হচ্ছে বুদ্ধিজীবী হত্যা। পঁচাত্তর পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা। জাতীয় চার নেতা হত্যার মতো জঘন্য একটা কাল-অধ্যায় রচনা করা। যেটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে অনেক বড়ো শূন্যতা তৈরি করেছিলো। বাংলার আকাশে তখন কালো মেঘের ঘনঘটা। এরপর স্বৈরশাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলায় নতুন দুর্যোগ। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে আরোপিত জাতীয়তাবাদ। সংবিধানে আরোপিত সংশোধনী। বাঙালি এবং নৃ-গোষ্ঠির মধ্যে নতুন শত্রুতা ও সহিংস সম্পর্ক। ঠিক এরপরই এসেছে আবারো সামরিক শাসন। শিক্ষা ব্যবস্থায় নোংরা রাজনীতির অনুপ্রবেশ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নাম দিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পুন: অভিঘাত। ঠিক এই সময়ের মধ্যে মানুষের সম্পর্কগুলো নানা অবিশ্বাস, আশংকা আর হতাশার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক পুরো বৃহত্তর পরিবারকে করা হলো দ্বিধা বিভক্ত।
রাস্ট্রীয় নানা সহিংসতা আর অসংলগ্ন অবস্থা সাহিত্য ও সুকুমার বৃত্তিতে আঘাত হানলো। মোটাদাগে এর প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, কবি শামসুর রাহমান এর (বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে লেখা) বারুদমাখা কবিতা। এবং বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘বন্দি শিবির থেকে’। যেখানে ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ নামে দু’টো বিখ্যাত কবিতা রয়েছে। এভাবে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবংকবিতায়ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে।
এবার আসি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তথা বর্তমান প্রজন্মের অবস্থা, তাদের সমূহ করণীয় ও নৈতিক দায়সহ কিছু মৌলিক জিজ্ঞাস্য-আলোচনায়। এক বিংশ শতকের প্রজন্মের জীবন ও যাপন, বর্তমানে শুধু তথ্য সংশ্লিস্ট কিছু সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ করার জন্য মুখস্তকরণ অথবা কোন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে নিজেকে শো করার জন্য মুখস্ত বিদ্যার মতো কিছু কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ। অথচ বাংলা কি। বাঙালি কি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি। এছাড়াও পাক ভারত উপমহাদেশে হাজার বছরের
বাংলা। বাংলার জনপদ। চর্যাপদ। দেশ বিভাগোত্তর বাংলা। বাংলাদেশের অবস্থান। এবং উভয় বাংলার শিক্ষা, মূল্যবোধ, মানসিক অবস্থা। জীবন যাপন প্রণালি কি সিংহভাগ প্রজন্ম এর সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নয়। এ বিষয়ে তাদের করণীয় ও আধেয় কি তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
আসলে সাত চল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্ন, এবং সর্বোপরি একাত্তর। এই সময় পরিক্রমার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেছে, পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ধারনের আরেক রূপকল্প। আরেক ইতিহাস। ঠিক এর মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেছে দুই বাংলার ভূগোল, শিক্ষা, মনস্তত্ত্বসহ অন্তর্গত আলাদা চেতনা ও দেশজ পরিচয় নির্ধারণের নানাবিধ চিহ্ন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ তার বড় প্রমাণ। এবং এই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। ইতিহাস ও শিল্প সাহিত্যে নিজস্ব রুচি ও সূচি নির্ধারণে বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। এখন কথা হচ্ছে বাঙালি জাতির এই সমস্টিগত শিক্ষা ও সংস্কৃতির অবস্থা এবং ইতিহাস সম্পর্কে মৌলিক বিষয়গুলো অনুধাবন করা। এটি আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য বড়ো হুমকি ও আশংকাকে সামনে নিয়ে আসে। এখন আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে বিষয়গুলো অনুধাবন কল্পে তা কতোটুকু প্রস্তুত আছি। যদিও আমাদের পাঠ্যগত ইতিহাস ও তথ্যের মাঝে বিষয়গুলো কিছুটা হাজির আছে। কিন্তু সংগঠিতভাবে বিষয়গুলো ধারণ করার ব্যাপারে এবং আত্মস্থ করার ব্যাপারে, আমরা নানা কারণেইত দ্বিধান্বিত। এ জন্য বাজারি শিক্ষাব্যবস্থা যদিও অনেকটা দায়ী। এতে করে বর্তমান প্রজন্ম তার ক্যারিয়ার জীবনের ব্যক্তিগত সাফল্য ও মানের পেছনে ছুটছে। কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিক শিক্ষায় অনেক অনেক পিছিয়ে থাকছে।
আমাদের শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক, (অন্যান্য মাধ্যমসহ) এই সময়গুলো বড়ো একটা প্রতিযোগিতামূলক প্রস্তুতি তথা ভাল জিপিএ নির্ধারণেই সময় দেয় বেশি। বাবা-মা ভাই বোন এমনকি আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে, অনেকের মধ্যেই গঁৎ বাধা চিন্তা ও কাঙ্ক্ষিত এক রোখা মানসিক অবস্থিতি আছে। গৎবাঁধা সিলেবাসের ভেতরে নিজেকে আটকে রাখছে। এতে করে উন্নত মানসিক, মানবিক ও সংবেদনশীল সুরুচির যে সুকুমার চর্চা সেই চর্চাও সে আর করতে পারছে না। নিজেকে চেতনে অবচেতনে বৃহত্তর একটা বাজারমুখি তথা ক্যারিয়ার মুখি রবোট মানুষ হিসেবে বড় করছে। এই মানসিক অসংগতি, সংবেদন, পুরো পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থাপনায় প্রভাবিত করছে নানাবিধ নেতিবাচকতায়।
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা—সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা যতই উন্নত হয়, সেই দেশের নাগরিকদের জীবন ব্যবস্থাপনার মান দিনকে দিন উন্নত হতে থাকে। দেখা যায় সেই নাগরিকের আচরণ, চলা-ফেরা-খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা,সবকিছুই সুন্দর রুচির পরিচায়ক হয়ে ওঠে। এমনকি সেই দেশের রাস্তাঘাট। ট্রাফিক সিগন্যাল। পরিকল্পিত নগরায়নের একটি সুসংহত দৃশ্যপট তৈরি হতে থাকে। সামগ্রিক বিকাশের ভেতর দিয়েই একটি দেশকে, সেই দেশের মানুষকে আমরা বুঝতে পাই। একটি সুশৃঙ্খল সমাজে ধূর্ত, শঠ, চালাক ও অনৈতিক মানুষরা নগণ্য হয়ে যায়। সর্বত্র কোথাও তখন তাদের জায়গা হয় না। আসলে এই ভাল গুণাবলীর প্র্যাকটিসগুলো ধারাবাহিকভাবে একটি পরিবার- একটি সমাজ, সর্বোপরি, একটি রাষ্ট্রকে নানাভাবে সুরক্ষিত রাখে এবং রাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া সামাজিক যতো বিশৃঙ্খলা, নানাভাবে নানা সূচকে কমে আসে। সেই দেশের জীবনমান, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যও তখন মানগত দিক দিয়ে উন্নত হয়ে ওঠে। অসৎ বালখিল্য শিল্প সাহিত্যের জায়গায় উন্নত জীবনবোধের শিল্প-সাহিত্য স্থান পায়। নাগরিকদের মধ্যে বড় ধরনের কোন মানসিক নৈরাজ্য বা হতাশা কাজ করে না। এবং
নিজের অবস্থান ও যোগ্যতা বিচারে নিজেকেও সে তখন চিনতে পারে এবং বুঝতে পারে।
এবার আসি কোন দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়লে সেই দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি কি অবস্থায় পরিগণিত হয় সেই বিষয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যা, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জাতীয় চার নেতা হত্যা বাংলার পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় যে হাহাকার ও অসংগতি তৈরি করেছে, সেই অসংগতি ও অভিশাপ থেকে কেউ বেরুতে পারে নি। সেই শুন্যতার জায়গাটুকু ভরে গিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী দানব শক্তির এক অদৃশ্য ছায়ায়। সেই শক্তির ভেতরে সূচিত হয়েছে, জগাখিচুড়ির গণতন্ত্র, লুটেরা অর্থনীতি। শিক্ষাব্যবস্থাপনার নানা অসংলগ্নতাসহ নানা ধরণের ত্রুটি বিচ্যুতি। আমাদের প্রজন্ম বিষয়গুলো যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারে, তাহলে জাতীর এই ক্রান্তিলগ্ন-কাল এভাবেই একেক সময়ে এসে আরো বিশৃঙ্খলার পথকে বিস্তৃত করবে। আমরা এমনিতেই শংকর জাতি। বহু রক্তের স্রোত আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। সুতরাং রক্তের দোষ বা নানা অসংলগ্নতাকে কাটানোর বড়ো উপায় হচ্ছে একটি যুগোপযোগী মানবিক শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষার মধ্য দিয়ে নানা অসংলগ্নতাকে ওভারকাম করা যায়। সেই সাথে থাকতে হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাগুলোর প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং স্বদেশপ্রেম। প্রথমে দরকার এই বিবিধ বিষয়গুলো অনুধাবন করা। যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার সাথে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা খুবই জরুরি । সর্বোপরি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে একটি সুস্থ সেতুবন্ধন রচনা করার লক্ষ্যে উদারনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হওয়া।